Friday, July 5, 2019

ঔরস : মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস


                                                                            

জওয়ান : স্যার, দুজন সিভিলিয়ান হিট হয়ে খাদে পড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে ; কানে ইয়ারপ্লাগ লাগিয়ে গান শুনছিল মনে হয়, ট্র্যানসেন্ড বা মোবাইল থেকে, তাই আমাদের আর শত্রুদের ফায়ারিঙের আওয়াজ শুনতে পায়নি ।
অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাণ্ডান্ট : মোবাইল ? এখানে মোবাইলের কোনো টাওয়ার একশ কিলোমিটারের মধ্যে নেই । যাকগে, যেতে দাও, অমন আনুষঙ্গিক দুর্ঘটনার জন্য আমরা দায়ি নই । বাস্টার্ডগুলো এই অঞ্চলে এসেছিলই বা কেন ! ডিসগাস্টিং ।
জওয়ান : ওদের বডি কি রিকভার করা হবে ? উওমেন না মেন বুঝতে পারছি না ।
অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাণ্ডান্ট : তোমার কি মাথা খারাপ ? থাকুক যেখানে পড়ে আছে । আমাদের অপারেশান ক্লোজ হলে স্হানীয় প্রসাশন বা বনবিভাগ গতি করবে ।
জওয়ান : গ্রাম তো কাছে পিঠে নেই স্যার; দুজনেই জীবিত বলে সন্দেহ হচ্ছে ।
অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাংণ্ডান্ট : বাজে ব্যাপারে মাথা ঘামিও না । ওটা সিভিল প্রশাসনের মাথাব্যথা ।

দুই
আগুনের ঢেউ-তোলা আর ফিনকি-ওড়ানো কয়েকটা জ্বলন্ত খোড়ো চালাঘরের সোনালি আলোয় , চারিদিকে ছিৎরে ছড়ানো লাশের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল ক্রুদ্ধ অপু, পোশাকি নাম অশ্বমেধ ঘোষ, যার বাবা সুশান্ত ঘোষকে অনেককাল আগে কিডন্যাপ করে, দশ লাখ টাকা ফিরৌতি বা র‌্যানসাম না পেয়ে, নিজের চোদ্দ বছরের কচি শ্যামলিমা নিরক্ষর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন তারিণী মণ্ডল, মহানন্দে, ধুমধাম করে, যেভাবে অপরাধ-জগতের ছাতিঠোক অখণ্ডপ্রতাপ বাহুবলি বীরেরা ভাগলপুর আর মাধেপুরা জেলার গঙ্গার চরের দিয়ারায় করে থাকে, করে আসছে বহুকাল যাবত, আর তারিণী মণ্ডল তো অপরাধিদের জগতে ছিল মহাজ্যোতিষ্ক, যার কদমছাঁট হাফটেকো মাথা ঘিরে ভনভন করত দুপুর গঙ্গার ঢেউ-গনগনে চনমনে রোদ, তেল-চুকচুকে সোঁটার পেতলমাথায় ধরা থাকত অমাবস্যার নদী-ছলছলে অন্ধকার । সে সোঁটার অভিজ্ঞতা তারিণী মণ্ডলের চেয়ে পুরোনো, ব্যাপক আর গভীর, কেননা ওটা উনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রে, লাঠিয়াল বাবার কাছ থেকে, যে তার বাবার, সে তার বাবার । তারিণী মণ্ডলের দুঃখ যে ওনার ছেলে নেই, জামাই যদিও ঘরজামাই, তিনি ওসব সোঁটাসুটির প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্রে বিশ্বাস করেন না, আধুনিক পিস্তলও শুধু লুঙ্গির গেঁজেতে গুঁজে রাখেন, কখনও একটু-আধটু চালিয়ে দেখার চেষ্টা করেন না । নাতি অপু বরং ওর বাবার চেয়ে আধুনিক, আজকালকার তেজিয়ান ছোকরা ।
অপু জানতে পেয়েছিল, বেশ একটু দেরিতেই, আত্মীয়-স্বজন জ্ঞাতিগুষ্টি দলচররা চেষ্টা করেছিল নানা-নানির অপঘাতে মৃত্যুর দুঃসংবাদটা ওর কানে যাতে দেরিতে পৌঁছোয়, যে, দাদু তারিণী মণ্ডল আর দিদিমা মন্হরা দেবী খুন হয়ে গেছে সকালবেলায়, একেবারে ছলনি । রোজকার মতন তেলমাখা লাঠি আর দুজন কালচে-কেঁদো খইনিঠোকা বন্দুকধারী দেহরক্ষীর গাঁট্টাগোট্টা পাহারায়, পটলের লোডিং তদারকি করতে বেরিয়েছিল, ট্রাকে পটলের পঞ্চাশটা বস্তা চালান হবার কথা ছিল ভোরবেলায় ।
যে ট্রাক আসার কথা ছিল সেই নম্বরের ট্রাকই এসেছিল, বনেটে বজরংবলির গেরুয়া টুনিপতাকা উড়িয়ে, কিন্তু তা থেকে মুখে লাল গামছা বাঁধা চারজন লাফিয়ে নেমে তারিণী মণ্ডলকে লক্ষ করে একনল্লা দুনল্লা একে-সানতালিস চালিয়ে চকাচৌঁধ ধুঁয়াধার অন্ধাধুন ব্রাশফায়ারে ছলনি করে, ট্রাক ফেলে রেখে, ট্রাকের পেছনে যে ছাইরঙা ইনোভা আসছিল, তাতে চেপে দক্ষিণের ভোররাতের গু-শোভিত আর মাটির সোঁদা দেয়ালে ঘুঁটেতে পাঁচ আঙুলের ছাপ-মারা গোবর-সুসজ্জিত কাঁচা রাস্তা ধরে আধাশীতেল অলস কুয়াশার সঙ্গে ধুলো মিশিয়ে উধাও।
মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল দাদু , বাঁ-চোখের কোটর থেকে নকল সিনথেটিক মণি বেরিয়ে ছিটকে নর্দমায়, আর ডাকসাইটে দিদিমা ওপরমুখো চিৎ ; দেহরক্ষীরা পিছু ধাওয়া করে কাঁধ থেকে একে সানতালিস নামাতে-নামাতেই বেতাহাশা গুলি খেয়ে হাত-পা ছড়িয়ে তারা দুজনেও মোরাম-পথের ওপর ঠ্যাং ছড়িয়ে লালজবজবে-চিৎ, আকাশের দিকে হাঁমুখ, চোখ-খোলা । দিদিমা, মানে নানি, নানিকে নিয়ে বেরোত না নানা সচরাচর । নানির হাঁটুর ব্যাথা সারাবার জন্যে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, যাতে পায়চারি করে জাম হয়ে থাকা হাঁটুর চাকতি আলগা হয় ।

তিন
চারজনের রক্ত গড়িয়ে মিশেছে মাছিদের আহ্লাদী জমায়েতে, মাছিরা তাদের এঁদো-পলটন ভাইবেরাদর সবাইকে ডেকে এনেছে, র‌্যালিতে-মিছিলে, যারা ভোরের দিয়ারায় ডোমপাড়ার শুয়োরদের আড্ডায় টাটকা-তাজা গু খেতে বেরিয়েছিল, তারাও তাজা রক্তের সু-বদবুর সংবাদ পেয়ে, হাঁফ-ফুরোনো বাংলা বৈদ্যুতিন মাধ্যমের দামড়া-চোয়াল ভাতচিকন সাংবাদিকের অনুকরণে, কুয়াশাভেজা ঘষাকাচ-ডানা নাচাতে-নাচাতে পৌঁছে গেছে ।
--হ্যাঁ দীপঙ্করদা-মাছি, ঘটনাস্হলে কী দেখতে পাচ্ছেন ?
--সুমিতা-মাছিনী, এখানে চারজনকে কে বা কারা খুন করে বডি ফেলে তিনচার দিকে দৌড়ে চলে গেছে বলে জানাচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী মাছিরা ; ইশে, নিমন্ত্রণ করা হয়েছে বিভিন্ন পাড়ার বিশেষজ্ঞ মাছি-মাছিনীদের । একজন মহিলা কেন খুন হলেন তা ভেবে দেখতে হবে, অ্যাবং খুন হলেও কেন তিনি লজ্জা নিবারণ করতে পারলেন না, তার জন্য সরকারকে জবাবদিহি করতে হতে পারে ।
--দীপঙ্করদা-মাছি, আপনি কী স্বয়ং স্বাদ নিয়েছেন, রক্তের অ্যাবং গুয়ের ? না নিয়ে থাকলে ঘটনাস্হলে যাঁরা একত্রিত হয়েছেন, তাঁদের দিকে একটু ক্যামেরা প্যান করতে বলুন, আমরা মাছি-দর্শকদের দেখাতে চাই, যাতে মানুষের কাঁচা গু খেয়ে-খেয়ে বিরক্ত দর্শকরাও রক্তের স্বাদ নিতে পারেন ; চার-চার জনের রক্তের স্বাদ কীরকম তা আমাদের গুয়েমাছি চ্যানেলেই প্রথম দেখানো হচ্ছে । অ্যাবং নারীরক্তের স্বাদ সম্পর্কে একটু পরেই স্টুডিওর রাসায়নিক মাছি ও ফরেনসিক মাছিনী তাঁদের মূল্যবান মতামত গু-ঞ্জরিত করবেন ।
--সুমিতা-মাছিনী, স্টুডিওতে যে গুসেবক অ্যাবং রক্তসেবক মাছিরা বিতর্কে অংশ নিতে এসেছেন, তাঁদের জন্য আরেকবার আমরা ক্যামেরা প্যান করে তারিণী মণ্ডল নামে মানব প্রজাতির জনৈক প্রতিকল্পের ছিৎরে-যাওয়া মগজ দেখাতে চাই ; ইশে, ঘিলুসেবন করার জন্য স্হানীয় নির্বাচনক্ষেত্রের নীলমাছি পৌঁছে গেছেন, তাঁর ভোজন সমাপ্ত হলে স্টুডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করব । ইশে, তারিণী মণ্ডলের স্ত্রীর শব দেখাতে পারছি না, কেননা স্তনদ্বয়ে গুলি খেয়ে পড়ার পর তাঁর শাড়ি ওপরে উঠে গিয়ে অকুস্হলের পাকাচুল বেরিয়ে পড়েছে । ইশে, রাজ্য প্রশাসন দেশের প্রগতি দাবি করে অথচ আজ পর্জন্ত অকুস্হলের পাকাচুলের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি ।
--দীপঙ্করদা-মাছি, দ্রুত সংবাদের জন্য ধন্যবাদ । এতক্ষণ আপনারা ভাগলপুরের দিয়ারা-সম্রাট তারিণী মণ্ডল হত্যার দৃশ্য দেখছিলেন । সময়াভাবে আমরা পৃষ্ঠভূমি সঙ্গীত তৈরি করতে পারিনি । পরবর্তী কোনো হত্যাকাণ্ডে যাতে ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোর দেয়া যায় তার ব্যবস্হা করা হয়েছে । সঙ্গে থাকুন ; রক্তের অ্যাবং গুয়ের স্বাদ উপভোগ করুন ।
--সুমিতা-মাছিনী : দর্শকগণ, কেউ একজন আমাদের সংবাদ পরিবেশনকে ঠাট্টা করে তার ঔরস উপন্যাসে যা নয় তাই লিখেছে । ল্যাখককে বিশ্বাস করবেন না, কেননা আপনারা ওনাকে দেখতে পাচ্ছেন না, আমাকে স্বচক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা দেখছেন । মনে রাখবেন, যা দেখছেন তা-ই সত্য ।

চার
সাড়ে ছ’ফিটের ছিয়াত্তুরে তাগড়া-কালো তারিণী মণ্ডলের টেকো খুলির হাড় গুলিতে ছিৎরে গিয়েছিল, মুখের আদরা চৌচির, টেরিকটের ফিকে-গেরুয়া পাঞ্জাবি রক্তে জবজবে, বুক পকেট থেকে উঁকি মারছে হাজার টাকার গোটাকয় করকরে নোট । ধুতি থেকে বেরিয়ে-থাকা পায়ের গোছের পাকাচুল ঘিরে লতানো ফুলে-ওঠা শিরা । ভারিভরকম মন্হরা দেবী হাঁটবার সময় শাড়ি দুহাতে সামান্য তুলে পা ফেলছিল বলে আচমকা গুলির চোট খেয়ে সম্পূর্ণই তুলে ফেলেছে । মাছিরা তার পাকাচুলশোভিত হাট করে খোলা হাটে বসে কী যে পান করছে তা মাছিগুলোই জানে ।
অপু ক্লাস বাংক করে বাড়ি এসেছিল দিনকতকের জন্যে । দিল্লির জওয়াহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে, মানে জে এন ইউতে একই সঙ্গে, দিল্লির হবু দেশসেবকদের খাদিয়াল ঢঙে, সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর আর বামপন্হী ছাত্র ইউনিয়ান করছিল । বামপন্হী ছাত্র ইউনিয়ান করার সুবিধা এই যে পরে ইচ্ছেমতন এবং হাওয়া বুঝে ভিনপন্হী বিজয়ী দলে সেঁদিয়ে যাওয়া যায়, ভিনপন্হী হলে বামপন্হীতে ঢোকা একটু কঠিন কেননা ভিনপন্হীদের ছ্যাঁদা বড়ো, বামপন্হীদের ছ্যাঁদা ছোটো । এই করেই দিল্লি-গুড়গাঁওয়ার ছাত্ররা জীবনে এগিয়ে যেতে পারে, জানে ও, দেখেছে আগের ব্যাচের ফেলটু ছাত্ররাও দিল্লির রাজনীতিতে কেমন করেকম্মে টরটরিয়ে টঙে চড়ে গেছে, কোনো চাকরি-বাকরি না করেই ফাঁপিয়ে তুলছে দুদিকের পকেট, ডেনিম-প্যাণ্টের হোক বা খাদিয়াল পাঞ্জাবির, নিজের বা জ্ঞাতিগুষ্টির । ইউনিয়ানের নির্বাচনে টাকা দরকার বলে দাদুর কাছে এসেছিল অপু, ফোমচামড়ার ব্যাগ নিয়ে, কাঁচা টাকা নিয়ে যাবে, যা তারিণী মণ্ডলের তিজোরিতে সব সময়েই থাকে, কেননা দিয়ারার জীবন বেশ ঝুটঝামেলার, দরিন্দগির, লেনদেনের, কখন কী হয় কত টাকা ঝপ করে কার দরকার তার নিশ্চিতি নেই ।
হাত-পা বাঁধা, গুটকাদেঁতো মুখে লিউকোপ্লাস্ট, বছর তিরিশের ঢাউসভুঁড়ি হুলোচোখ ট্রাক ড্রাইভারটা মার খেয়ে আধজখম হয়ে খড় কাটার যন্ত্রে সবুজ নাইলন দড়ি বাঁধা অবস্হায়, অজ্ঞান হয়ে নেতিয়ে ছিল, প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাশিদের পাড়ায় তোতারাম পাসওয়ানের মহাত্মা গান্ধি রাষ্ট্রিয় কর্মইয়োজনার টাকা মেরে তৈরি খামারে। ট্রাকচালক বৈসাখি যাদবের কাছ থেকেই তারিণীর সাঙ্গপাঙ্গরা আঁচ করতে পেরেছিল খুনের পেছনে কাদের হাত থাকতে পারে । আররে, বৈসাখি হ্যায় কংসায়তি যাদব, অসলি কৃষ্ণায়ত যাদব নহিঁ হ্যায়,মুহ খোলেগা ক্যায়সে নহিঁ ; ডরপোক কংসায়তি ফাট্টু কঁহিকা ।
তারিণী মণ্ডলরা, তার নিজের দাবি অনুযায়ী, যখন সে সুশান্ত ঘোষকে অপহরণ করে বন্ধক রেখেছিল, তখন পোড়াটে-কালো বুকে ঘুষি ঠুকে বলেছিল, তার পূর্বপুরুষরা লালেলাল খাঁটি-রক্তের বাঙালি ছিল, তিন-চারশ বছর আগে, আংরেজদের জমানায় । যে পূর্বপুরুষ প্রথম খুন করে মহাঅপরাধীর খেতাব পেয়েছিল, সে শত্রুর জিগর বা হৃদয়ের রক্তে ভেজা পৈতে পরার চল আরম্ভ করলে, হলেই বা নিচু জাত, উত্তরপুরুষরাও প্রথাটা বজায় রেখেছিল, যদিও শত্রুর হৃদয়ের রক্তের বদলে অমাবস্যায় জবাই করা পাঁঠার দিল-কা-খুনে ভেজা পৈতে পরার চল করে গেছে কোনো পূর্বপুরুষ । তারিণী মন্ডলের পৈতেও অমাবস্যার দিন পাঁঠা কেটে জিগরের রক্তে ভিজিয়ে পরানো হয়েছিল । নাতি অপুকেও অমন পৈতে পরাবার চেষ্টা করেছিল তারিণী মন্ডল, জামাইয়ের প্রতিবাদের জন্য সফল হয়নি । জামাই বলেছে, মনে রাখবেন, ও সুশান্ত ঘোষের ছেলে, ঘোষরা যতই খুনোখুনি করুক না কেন, কায়স্হই থাকবে।
বেবি নামের চোদ্দ বছরের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর মেয়েকে বিয়ে করে, ভাগলপুরের দিয়ারায় থেকে গিয়েছিলেন ছাপোষা বাঙালি বাড়ির কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক চাকুরে যুবক সুশান্ত ঘোষ, প্রথমে রোগাটে বাংগালি জামাই, তারপর দোহারা সুশান্তবাবু নামে, তারপর পেটমোটা গদাইলস্কর জামাইবাবা নামে অপরাধীদের রাজপুত্র হয়ে উঠেছেন গোপালপুরের ফলকিয়া, পরবত্তা, ডিমহা, কেলওয়ারি, তিনহেংগা আর কহলগাঁও-এর অনাদিপুর, আভাপুর আর অঠগম্মা দিয়ারায় ।
সুশান্ত ঘোষ প্রথম দিকে ফিতেবাঁধা কুকুরবাচ্চার মতন গোমড়া মুখে বোবা সেজে থাকলেও, গ্রাম্য অশিক্ষিত বাংলা জানে না এমন, গংগোতা জাতের চোদ্দ বছরের কচি নিরক্ষর শ্যামলিমা তুলতুলে মাংসের মেয়ের সঙ্গে বাসা বেঁধে ফেলেছিলেন, ঠান্ডা মেঠো দেয়ালের সোঁদা-ছমছমে প্রায়ান্ধকারে, খালি গায়ে, মাদ্রাজি হাফ-লুঙ্গিতে, শাশুড়ির দেয়া কালো কাপড়ের চৌকো তাবিজ গলায় , ছত্রিশ ডিগ্রির বালি-ওড়ানো থমথমে গ্রীষ্মে, এগারো ডিগ্রির কম্বলচাপা হিহি ঠাণ্ডায়, বর্ষার মেঘপাগল ঝোড়ো ঝড়ের টালিভাঙা দাপটে । যখন কিডন্যাপ হয়েছিলেন, তখন দিয়ারার এই এলাকায় বিজলি ছিল না, যাতায়াতের রাস্তা ছিল না, পানীয় জল ছিল না । তারপর ওনার রাজত্ব ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে, স্কুল-কলেজের লিখাপড়হিকে কাজে লাগিয়ে বিজলি সড়ক পানি এনেছেন।
দিয়ারার লোকেরা মনে করে উনি, সুশান্ত ঘোষ, আড়ালে কলকাঠি নাড়েন । সামনে সবসময় ভঁয়সাবদন কউয়াডোল তারিণী মণ্ডল । যদিও কখনও-কখনও, হয়ত নদীর ওপর বিদ্যুতের কিলবিলে কেউটে রুপোলি খোলোস ছেড়ে ঝাঁপিয়ে-পড়া সন্ধ্যায়, মগজের ব্যাস্টিলে নিজেকে পায়ে চেন-বাঁধা কয়েদির ঢঙে, ভেবে ফ্যালেন, তিনি আসলে একজন মহা-অপরাধীর জামাই, গংগোতা-ডন নামক এক ভয় উদ্রেককারী দুষিত চরিত্রের মানুষ, যে ওই মহাডনত্বে আটকা পড়ে ছটফট করতে পারে, নিজের কারাগার থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারে না । চারিদিকে এত সাঙ্গপাঙ্গের জি-হুজুরি, কচি নিরক্ষর স্নেহদেহ স্ত্রীর নিঃশর্ত আগুনযোনি-ভালোবাসা, শশুরশাশুড়ির অফুরন্ত আদরযত্ন সত্ত্বেও, তিনি নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের বিষে ক্ষয়ে চলেছেন । আসলে তিনি, সুশান্ত ঘোষ, মনে করেন যে এই ক্ষয়-রোগের আনন্দে সুফিসন্তের মতন অজানা ঐশ্বর্যে আলোকিত হয়ে চলেছেন প্রতিদিন।
যে-সময়ে সুশান্ত ঘোষকে অপহরণ করা হয়েছিল, ভাগলপুরের ষোলোটা ব্লকের ছয়টায় দিয়ারা ছিল , যাদের গঙ্গা দয়া করে ছাড় দেয়ায়, চিকচিকে পলিমাটির চাদরে ঢাকা প্রায়-পাকা চেহারা নিয়েছে সেগুলো । গঙ্গার সুমতি বা দুর্মতি যা-ই হোক, আরও তেরোটা ব্লকে জেগে উঠেছে চর, যাকে লোকে বলে দিয়ারা । এই চরগুলো অনেক সময়ে বেগড়বাঁই করতে-করতে মেটেল জলের তলায় বর্ষায় ডুবকি মেরে লুকিয়ে পড়ে, আবার ফিরে আসে ঝিলিকদার হাসি ফুটিয়ে সারমাটি মাখা মাথা উঁচু করে । নারায়ণপুর, বিহপুর, খারিক, ফুলাউথ, নৌগাছিয়া, ইসমাইলপুর আর গোপালপুরে লোকবসতি জমে উঠেছে জামাইবাবার রাজত্বে ।
হেমন্তে, ঝিরিঝিরি হাওয়ার আদুরে সুড়সুড়িতে, বালির ছোটোছোটো নাভি ঘিরে আলতো ঘুর্ণিরা দিয়ারাময় খেলে বেড়ায় । সেই হাওয়াই আবার গ্রীষ্মকালে বালির ঘোমটা মাথায় দল বেঁধে দেহাতি বউদের ঢঙে দৌড়োয় চরের ওপর দিয়ে । বসন্তকালের বালি ডেকে আনে পোয়াতি পাখিদের, তাদের খোকা-খুকুকে বাছাই পোকা, ফড়িং, প্রজাপতি খাওয়াবে বলে ।
জামাইবাবা চোখে কালো রেব্যান চশমা, লাল বা নীল টিশার্ট আর ডেনিম-জিন্স পরে টাটা সুমোতে বা বোলেরোয় তবিয়ত খুশ করার জন্য ভাগলপুর শহর ঘোরেন, তমঞ্চাধারী দেহরক্ষীদের পাহারায় । বাবা-জ্যাঠার বাড়ি যেতে কি ইচ্ছে করে না ওনার ? করে । ছেলে হবার আগে আর পরে সবসুদ্দু পাটনার গর্দানিবাগের বাড়িতে গেছেন সাকুল্যে চারবার, বোলেরোয়, বন্দুকধারী দেহরক্ষী নিয়ে । কিন্তু দিয়ারার হারামখোর মৌজমস্তি আর শোধ-প্রতিশোধের আঘাত-প্রত্যাঘাত আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ তো নেই সেই ছাপোষা বাঙালি জীবনে, বেবি নামের মেঠোগন্ধা সুঠামবুক নধরউরু গাঁইয়া নিরক্ষর চোরাটান বউ নেই, যার আয়ত গোবেচারি চাউনি সেই চোদ্দ বছর বয়সেই আটক থেকে গেছে। বাবা মারা যাবার খবর পেয়ে গিয়েছিলেন বটে, তবে ওনাকে কাঁধ দিতে দেয়া হয়নি, ক্রিমিনাল পরিবারে ছোটো জাতে বিয়ে করে ওনার কাঁধ নিচে নেমে গেছে বলে । ওনার ছেলেকেও কাঁধ দিতে দেয়া হয়নি, তার কাঁধ জারজ বলে আরও তলায় । শোকার্ত বিষণ্ণতার মর্মপীড়া ফর্দাফাঁই করে, ওনার মা ঘোষণা করেছিলেন যে সুশান্তর কুকর্ম সহ্য করতে না পেরেই বাবা মারা গেলেন।
বাবা মারা যাবার আগে যখন সুশান্ত ঘোষ পাটনার বাড়িতে গিয়েছিলেন, বাড়ির ছোটোবড়ো প্রতিটি সদস্যের জন্য হালআমলের স্মার্টফোন কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন, সিম কার্ড তোমরা যে-যার নিজেদের নামে কিনে নিও, আর যদি চাও তাহলে মাঝে-মাঝে ফোন কোরো । মেজজ্যাঠার নাতনি ইতু ছাড়া, প্রথমে ইতস্তত করলেও সকলেই নিয়ে নিয়েছিলেন, জেঠি-কাকি, ভাই-বউদি, ভাইপো-ভাইজি, এমনকি মা-বাবাও । বাবা মুখ গোমড়া করে বলেছিলেন, ঠিক আছে, টেবিলের ওপর রেখে দে । মা বলেছিলেন, এ তোর খুনোখুনির টাকায় কেনা নয়তো, দেখিস বাবা, তোর পাপের ভাগি করিসনি যেন আমাদের।
জবাবে সুশান্ত বলেছিলেন, আমি সেখানে কোনো কাজই করি না মা , ঠ্যাং ছড়িয়ে আরাম করি, সারাদিন খবরের কাগজ পড়ি, বাংলাও, টিভি দেখি, ইনটারনেট ঘাঁটি, খাইদাই আর ঘুমোই, যেমন ঘরজামাইরা করে । একটু থেমে, যোগ করেছিলেন, পিঁজরেপোলের ষাঁড়ের মতন ।
খোশগল্পপ্রিয় বড়জ্যাঠাইমা, প্রায়-ফোকলা হাসিমুখে, তখনই মোবাইলের কাগজ-বাক্স খুলে ফোনটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলেছিলেন, আমি তোর সঙ্গে প্রায়ই কথা কইব, তুই আমাকে তোর নম্বরটা দিয়ে যা। কথা কইবার টাকা ফুরিয়ে গেলে তোর ওখান থেকে ভরিয়ে দিস । কেউ তো অ্যাদ্দিন কিনে দেয়নি, তুই দিলি ।
অমিত কোথায়, দেখছি না ? জানতে চেয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ । অমিত ওনার প্রথম যৌবনের বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলে, যাকে শৈশবে ওনাদের গর্দানিবাগের বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন অতনু চক্রবর্তী ও তাঁর সঙ্গিনী মানসী বর্মণ ; তাঁরা জানিয়েছিলেন যে, নওয়াদায়, যেখানে তাঁদের বাস, সেখানে অমিতকে পড়াশোনা করানো সম্ভব নয়, তাঁদের রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে খাপ খাবেনা একটি শিশুর আধুনিক লালন-পালন, বুঝিয়েছিলেন অতনু-মানসী জুটি ।
--অমিত উচ্চমাধ্যমিক দেবার পর বাড়ি থেকে চলে গেছে, কাউকে কিছু বলে যায়নি । কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল, হাসপাতাল, থানা-পুলিশ করা হয়েছিল, ওর কোনো পাত্তা নেই , বলেছিলেন ইতুর রাঙাকাকা, সুশান্তর ছোটো ভাই, যিনি অমিতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ; ওনার ছেলেপুলে হয়নি বলে বাড়ির সবাই অমিতকে পরিবারের সদস্য করে নিয়েছিল । সুশান্ত যখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিলেন, অকালমৃত ভাই অপাংশুর মেয়ে ইতুর সঙ্গে দেখা করার জন্য, সিঁড়ির বাঁকে অপেক্ষারত রাঙাবউ সুশান্তকে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, অমিত আর ইতুর মাঝে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তিন তলার ছাদে অন্ধকারে গাঁজাপাতা খেয়ে দুজন জড়াজড়ি করছিল, তখন সেজোকর্তা ধরে ফেলেছিলেন । জানাজানি হতে অমিতকে এমন অকথা-কুকথা বলা হয়েছিল যে যেদিন ওর উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল বেরোলো সেদিন রাতেই কাউকে না বলে কোথাও চলে গেছে । তোমার কিডন্যাপ হয়ে চলে যাবার পর এটা এই বাড়ির আরেক মর্মান্তিক অঘটন । বিজ্ঞাপন-ফিজ্ঞাপন, হাসপাতাল-পুলিশের গল্প সব বানানো, বিশ্বাস কোরোনি ।
মানসী বর্মণ-অতনু চক্রবর্তীর ইচ্ছানুযায়ী, অমিতের পদবি স্কুলে বর্মণ হিসাবে নথি করানো হয়েছিল বলে বাবার সম্পর্কে অবজ্ঞামেশানো চাপা ক্রোধ পুষতো অমিত ।
সুশান্তর মেজজেঠার নাতনি, অপাংশুর মেয়ে ইতান, অর্থাৎ ইতুর সঙ্গে ওর তিন তলার ছাদের ঘরে দেখা করতে গেলে বলেছিল, কী করব মোবাইল ফোন নিয়ে, আমার কে আছে জগত-সংসারে যার সঙ্গে কথা বলব, সামনা-সামনিই কথা হয় না কারোর সঙ্গে, তো ফোনে কার সঙ্গে কথা কইব, আর দরকার পড়লে বাড়িতে তো ল্যাণ্ডলাইন আছেই ; তুমি কখনও আমাকে ফোন করেছ, যে মোবাইল ফোন দিতে এসেছ বড়ো ।
অমিত নিরুদ্দেশ হবার পর, ইতু মনে করে, ওর বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে ; ভ্রু কুঁচকে থাকার দরুন কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে, কোমর হয়ে গেছে ভেতো , বয়সের তুলনায় উঁচু বুক। অপাংশুর একমাত্র সন্তান । অপাংশু আর ওর বউ যখন ডাক্তার দেখিয়ে হাতেটানা রিকশা করে কংকরবাগ থেকে ফিরছিল, তখন একটা ট্রাক ওদের রিকশাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে, দুজনকেই চাপা দিয়ে, চলে যায় । ইনশিওরেন্সের টাকা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । সেই থেকে, মনে করে ইতু, একান্নবর্তী পরিবারে ওর জায়গা ক্রমশ নেমে-নেমে ডিলুক্স চাকরানির স্তরে চলে গেছে । বাবা-মা মারা যেতে, এম বি বি এস এক বছর পড়ে ছেড়ে দিতে হয়েছে, কে-ই বা খরচ যোগাবে? বেশ কিছুকাল দুঃখিত ক্রোধে আচ্ছন্ন থাকার পর নিজের প্রগলভা সদালাপী দুঃসাহসী নির্ভীক আন্তরিকতায় ফিরেছে । এম বি বি এস এর বিকল্প হিসাবে, বাবার রেখে যাওয়া সঞ্চয়ে, পড়েছে অলটারনেটিভ মেডিসিন । মানুষের জন্য কিছু করতে হবে, সমাজের জন্য কিছু করতে হবে, দেশের জন্য কিছু করতে হবে, অন্তত অলটারনেটিভ মেডিসিনের মাধ্যমেই করা যাক, ভেবেছিল ইতু ।
সুশান্ত বেফাঁস বলে ফেলেছিলেন, বিয়ে করলি না কেন ?
গোখরো সাপের ছোবলের আগে সতর্কবার্তার মতন ইতু বলে উঠল, বিয়ে ? চাইলেই বিয়ে করা যায় নাকি? বাড়ির কেউ কি কখনও চেষ্টা করেছে আমার বিয়ের ? তোমার ভাইরা তোমার ভাইপো-ভাইঝিদের বিয়ে দিয়েছে, তারা যে যার বিয়ে করে সংসার পেতে ফেলেছে, আর প্রায় সকলেই মা-বাপের দায়-দায়িত্ব এড়াবার জন্য এবাড়ি ছেড়ে, নানা অজুহাত দেখিয়ে, পালিয়েছে । তোমার জেঠা-কাকারা নিজের-নিজের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, ব্যাস, সবায়ের সব দায়িত্ব শেষ । সহানুভূতির জন্য টিকে আছে শুধু তিনজন বুড়ি, বটঠাকুমা, মেজঠাকুমা আর তোমার মা, মানে আমাদের অন্নমা, যাঁদের আর তেমন গুরুত্ব দেয় না এই একান্নবর্তী নৌটাংকি পরিবার । এরা এমন যে এদের সুবিধা হবে ভেবে রেলপার বস্তি থেকে একজন বাংলাদেশি বউকে এনেছিলুম রান্নাঘরের পুরো কাজ করার জন্য, থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে, তা তোমার কায়েত পরিবার বামুনগিরি ফলিয়ে বলল যে বাড়ির কাজে মুসলমান চলবে না ।
--কেন, অলটারনেটিভ মেডিসিন পড়লি, তার একটা দাম তো আছে, কত লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করছিস ।
--হুঃ, অলটারনেটিভ মেডিসিন । এম বি বি এস কোর্স পুরো করার মতন টাকা খরচ করতে চায়নি তোমার খুড়তুতো-জাঠতুতো ভাইরা, জ্যাঠা-বাবা-কাকারা, তোমার নিজের ভাই রাঙাকাকার কথা তো যত কম বলা যায় ততই ভালো , তাই ওই সস্তার ডাক্তারি পড়তে হল, তাও ডিপ্লোমা, একটা অখদ্দে প্রাইভেট কলেজে । তুমি তো এ-বাড়ির ত্যাজ্যপুত্র, নয়তো তোমার দিকে হাত বাড়াতে পারতুম । কিন্তু তুমি কখনও জানতে চাওনি যে মা-বাপ মরার পর ইতুটা কেমন আছে, কী করছে । আমার বাবা তো আর জেঠাদের মতন মাইনে পেত না, যেটুকু সঞ্চয় রেখে গেছে, তা থেকেই চেম্বার খুলেছি, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, বিহারি ডাক্তারদের মতন বড়ো-বড়ো করে ডাক্তার ইতু ঘোষ লিখে। মাসে একটা কি দুটো রোগি আসত, তাও তাদের পয়সাকড়ি খরচ করার যোগ্যতা নেই বলে আসত ; যারা আসত তারাও অবাক হতো যে আমি কেন রাংতায় মোড়া ট্যাবলেট দিচ্ছি না । খগোলের গরিব বস্তিতে গিয়ে ফোলডিং টেবিল পেতে রোগিদের সেবা করার চেষ্টা করেছি ; তারাও ভাবে ওষুধের বড়ি নেই, ইনজেকশান নেই, এ আবার কেমন ডাক্তার, জড়িবুটি দ্যায়, গা-হাত-পা টেপে, জলে মাথা ডোবাতে বলে । শুধু ভাড়াই গুণে যাচ্ছি । এবার বন্ধ করে দেবো । ভেবেছিলুম যে গরিবদুঃখিদের জন্য অন্তত এইটুকু তো করি, জীবনের একটা উদ্দেশ্য তো হোক । কিছুই হল না । আই অ্যাম জাস্ট এ ফেলিয়র ।
--কেন, অলটারনেটিভ মেডিসিনের প্রচার তো ভারতের ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টও করে ।
--সেই ডাক্তারদের চেম্বারে গিয়েছ কখনও, তাদের তো চেম্বার নয়, বিরাট দপতর থাকে, বাগানবাড়ি থাকে, কয়েকজন লোক খাটে, ওষুধের বিরাট ভাঁড়ার । ব্যবস্হাও ভালো । অলটারনেটিভ মেডিসিন জিনিসটা কী তা জানো ?
--না । কী ?
--হাইড্রোথেরাপি, অ্যাকুপাংচার, অ্যারোমাথেরাপি, আয়ুর্বেদ যাকে আমরা বলি হার্বালিজম, হিপনোথেরাপি, রেইকি, ম্যাগনেট থেরাপি, চিরোপ্র্যাকটিক এটসেটরা । একবার কেরলে গিয়ে দেখে এসো , তোমার যা ঝিল্লিদার চর্বি জমছে, ট্রিটমেন্ট করিয়ে এসো । অনেকে হোমিওপ্যাথিও করে , যদি কোর্সটা আলাদা করে পড়া থাকে । আমার সঙ্গে যারা অলটারনেটিভ মেডিসিন পাশ করেছিল তারা প্রায় সবাই ক্লিনিকে বসে অ্যালোপ্যাথিক মেডিসিনকে গুঁড়িয়ে পুরিয়া তৈরি করে রোগিদের রোগ সারাচ্ছে । আমি এখনও, আনফরচুনেটলি, বিবেক নামের ইডিয়সিটা ঝেড়ে ফেলতে পারিনি বলে গরিব মানুষদের ঠকাতে পারছি না। ট্রাই করে যাচ্ছি ।
--বিয়ে করলি না কেন । অলটারনেটিভ মেডিসিন বাদ দে । এমনি হাউসওয়াইফ ম্যারেজ তো করতে পারতিস ।
--কে বিয়ে করত আমায় । তোমার মতন গায়ের রং পাইনি । তোমার মায়ের মতন নাক, দিদিদির মতন চোখ, কিছুই তো পাইনি । শুধু একরাশ চুল পেয়েছি আমার মায়ের মতন । চুল দেখে কে-ই বা বিয়ে করে আজকাল ? লাখ দশেক টাকা ছড়ালে হয়তো দুচারটে কাক-চিলকে ফাঁসানো যেত । তা কে করবে ? তোমাকে যখন কিডন্যাপ করেছিল তখন তোমার শশুরবাড়ির লোকেরা দশ লাখ টাকা চেয়েছিল । দিতে পারেনি তোমার বাবা-জেঠারা । সবাই মিলে হয়ত যোগাড় করতে পারত টাকাটা, কিন্তু এ-বাড়ি হল মানসিক দারিদ্র্যে সমৃদ্ধ।
--তুই কি কাউকে বিয়ে করতে চাইছিলি ?
--বিয়ে করতে চাইলেই তো আর তাকে বিয়ে করা যায় না । পাত্র যদি বাপের পদবির বদলে তার মায়ের পদবি নিয়ে জন্মায়, যদি সেই পাত্রের মা তার বাবার নয়, অন্য কারোর বউ হয়, যদি সেই পাত্রকে তার মা-বাপ অনাগ্রহী এক দম্পতির কোলে ফেলে দিয়ে কেটে পড়ে, তাহলে সেই পাত্রকে কোন চোখে দেখা হয় জানো ? কুলের কলঙ্ক । আমি সেরকম এক পাত্রকে পছন্দ করেছিলুম, কিন্তু বাড়ির গুরুজনদের মতে, যদিও তারা পষ্টাপষ্টি সেকথা বলেনি, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছে যে অমন পাত্র এই বাড়ির সম্মানের উপযুক্ত নয় । তোমাকেই এরা আজ পর্যন্ত স্বীকার করতে পারল না তো যার বাবা-মায়ের সম্পর্ক সন্দেহজনক তাকে স্বীকার করবে কী ভাবে ? তোমারই তো নিকট বন্ধু ছিল অতনু চক্রবর্তী আর তোমার এককালের সহকর্মী ছিল মানসী বর্মণ । মানসী বর্মণ নাকি অতনু চক্রবর্তীর চেয়ে দশ বছর বড়ো, আর তাঁরা লিভ টুগেদার করতেন, মানসী বর্মণ আর অতনু চক্রবর্তী নাকি মানসীর স্বামীর সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন । তাতে তাদের ছেলে কী দোষ করল ? আর যদি তোমরা এতই রক্ষণশীল ছিলে তো শিশুটাকে এবাড়িতে রেখে মানুষ করবারই বা কী দরকার ছিল ? ওনারা কোথায় থাকেন তাও এবাড়ির কেউ জানে না, জানবার চেষ্টা করেনি । তোমার তো বন্ধু ছিল ওরা, এই অতনু-মানসী জুটিকে কেমন দেখতে বলোতো ? কেমনতর রাক্ষস-রাক্ষসী যে নিজেদের বাচ্চাকে অন্যের কোলে চাপিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে?
--কেন, রাঙা আর রাঙাবউ তো অমিতকে নিজের ছেলের মতনই মানুষ করেছে বলে জানি ।
--কিছুই জানো না । তোমার মায়ের পেটের ভাই, সে তোমার বিপরীত । অমিতকে দত্তক তো আর নেয়নি; এমনিই কোলে নিয়েছিল । আর তারপরেও বাচ্চা হবার জন্য আইভিএফ করাতে কলকাতা দৌড়োতো । কতবার যে সে আইভিএফ ফেল করল আর প্রতিবার লাখ খানেক করে গচ্চা গেল, তার কোনো হিসেব আছে ? ওই টাকায় ওরা অমিতকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারত । ওই যে বলে না, দাঁত নেই, চলেছে বিষকামড় দিতে, রাঙাকাকার অবস্হা তেমনই । আইভিএফ করালে সে বাচ্চাটা রাঙাকাকার হতো না, অন্য কারোর হতো, তাতেও আপত্তি নেই, অবশ্য দেখতে-শুনতে ভালো হতো, ফর্সা ঢ্যাঙা ডোনারের বীজ নিলে ।
--আর গাঁজাটাজা খাস না তো ? কন্ঠস্বর নামিয়ে জানতে চেয়েছিলেন সুশান্ত, প্রশ্রয়দানকারী জেঠামশায়ের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টায় ।
দীর্ঘ চুলের ঝাপট বুক থেকে পিঠে উড়িয়ে, উঁচু গলায় ইতুর জবাব, ওঃ, তোমাকে জানানো হয়ে গেছে, তোমারও দেখছি এজেন্ট রয়েছে এ-বাড়িতে । তারপর যোগ করেছিল, কলেজে পড়ার সময়ে মারিহুয়ানা ফোঁকেনি, এমন ছাত্রছাত্রী তোমাদের জুরাসিক যুগে ছিল, তোমার ছেলেও হয়ত খায় বা খেয়েছে, জিগ্যেস করে দেখো । কলেজ তো বহুদিন ছেড়েচি, মৌজমস্তি করার টাকাকড়ি কোথায়, যে ওসবে ইনডালজ করব ? বিরক্তি ধরে গেছে জীবনে, কিচ্ছু ভাল্লাগে না । আমার আইডেনটিটি কী ? গ্যাসভরা ফানুস !
--কবে চলে গেছে অমিত ? সুশান্ত সরাসরি প্রশ্ন তুললেন, যে ভাবে উকিলরা সাক্ষীদের প্রশ্ন করে ।
--চার বছরের বেশি । কে জানে বেঁচে আছে কি না । অপমানে হয়ত আত্মহত্যা করে থাকবে । প্রায় ফুঁপিয়ে ফেলেছিল ইতু, সামলে নিল ।
সুশান্ত বললেন, মোবাইলটা নে, মন খারাপ হলে আমার সঙ্গে কথা বলিস । তোকে দেখতে যথেষ্ট ভালো ; কলেজে তোর ছেলে-বন্ধুরাই এককালে লাইন মারত বলে শুনেছি । তুই-ই কাউকে প্রশ্রয় দিসনি, এখন বুঝতে পারলুম যে তার কারণ অমিত বর্মণ ।
সুশান্তকে স্তম্ভিত করে ইতু বলল, তুমি আমাকে কিডন্যাপ করিয়ে দাও না, তোমার ওখানকার কারোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিও, সুখে ঘর করব, কথা দিচ্ছি, সিরিয়াসলি বলছি, তুমি আমাকে কিডন্যাপ করিয়ে নাও, কবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে বল, সেই মতো অপেক্ষা করব । জীবনটা তো জীবনের মতন হয়ে উঠুক । একটা উদ্দেশ্য তো হোক বেঁচে থাকার । তুমি জানো , তথাকথিত এই একান্নবর্তী পরিবারে আমি সবচেয়ে বেশি বোল্ড, যা ভালো বুঝি তা-ই করি, সব্বাই কাওয়ার্ড, ইনক্লুডিং অমিত । মেজমাসির মেয়ে ফুলকিও বোল্ডনেস দেখালো । জানো তো ফুলকি বাচ্চা হবার পর ওর বরকে ডিভোর্স দিয়ে আবার সেই বরের কাছেই ফিরে গেছে, বাচ্চাও হয়েছে । আসলে পারপাস, জীবনের একটা পারপাস চাই, অভিমুখ চাই ।
--আমার দিয়ারার গাঁয়ের যে কোনো যুবক তোকে বিয়ে করতে চাইবে, সম্রাজ্ঞী বানিয়ে রাখবে, কিন্তু বিয়ে করতে পারে এমন কেউ তোর বয়সী তো নেই । ওখানে ছেলেদের ছোটোবেলাতেই বিয়ে হয়ে যায় ।
--তাতে কি । কম বয়সী বরও তো হয় অনেকের, কিংবা আমি কারোর দ্বিতীয় বউ হয়ে থাকব, সুখে-শান্তিতে তো থাকব, কারোর সংসারের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে, বেঁচে থাকার পারপাস তো হবে । আমার মাথার ভেতরে একজন ল্যাংটো ইতুকে তো শান্তি দিতে পারব । আমার কি সাধ-আহ্লাদ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই ? প্রেমিককে চুমু খাওয়াও এরা সহ্য করতে পারে না, কেননা তাদের মতে সে প্রেমিক সম্ভবত বেজন্মা ।
--কী বলছিস জানিস ? আমার ছেলেকেও একই সঙ্গে গালাগাল দিচ্ছিস ।
--হ্যাঁ, এরা তো তা-ই মনে করে । তোমার ছেলের তো এ-বাড়িতে প্রবেশ নিষিদ্ধ । জানি না তুমি কেন আত্মসম্মান খোয়াবার জন্য যেচে এসেছ ।
--সকলের জন্য মাঝে-মাঝে মনকেমন করে রে ।
--এ-বাড়িতে আমি তো একজন শ্রদ্ধেয় চাকরানি, গ্লোরিফায়েড মেইড । সুশান্তকে উত্তরহীন বসে থাকতে দেখে ইতু বলল, দেখলে তো, সমাধান কারোর কাছে নেই, সবাই কেবল উপদেশ ঝাড়ে । তোমার বউকেই এরা আসতে দিতে চায় না এমন কনজারভেটিভের এঁটো-খাওয়া বংশ । কোন জগতে তুমি বাস করো গো ? এখনও মনকেমন টাইপ আবেগে ভোগো !
মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে ইতু বলেছিল, সিমকার্ড কেনার টাকা দিয়ে যাও, আর মাঝে-মাঝে তোমার ওখান থেকেই রিচার্জ করিয়ে দিও । জানি এতে অনেক খেলা-টেলা থাকে, তাই করেই টাইমপাস করব, আমাদের বাড়ির কাজের বউয়েরও মোবাইল আছে যখন , আমি তো বললুম তোমাকে, আমি হলুম গ্লোরিফায়েড খাওয়াপরার মেয়ে, চব্বিশ ঘণ্টার।
সুশান্তর প্রায়-ফোকলা বড়জ্যাঠাইমা অবশ্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন, নিয়ে আয় না তোর বউকে, কি হয়েছে, আমরা তো সবাই তোর বউয়ের ভাষায় কথা বলতে পারি । মোবাইলে বড়জেঠিই সুশান্তর সঙ্গে প্রথম কথা বলা আরম্ভ করেছিলেন, তখন উনি জামশেদপুরে ছেলের কাছে, হাসপাতাল থেকে ফোন করতেন । বড়জ্যাঠাইমার বড়ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে বদলি নিয়ে বউ-ছেলে-মেয়েসহ চলে গেছে জামশেদপুর । বড়জ্যাঠাইমা গিয়েছিলেন কিন্তু ছেলের বাড়িতে ওঠেননি, ওনাকে ছেলের বউ ফ্ল্যাটের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি । যে তিন মাস জামশেদপুরে ছিলেন সে তিন মাস ছেলে ওনাকে এক হাসপাতালের শীতাতপ আরামে ভর্তি করে দিয়েছিল ; প্রতিদিন সকাল বিকাল গিয়ে দেখা করত ; দুয়েকবার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল মার সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে তোলার জন্য । হাসপাতালের স্বাস্হ্যকর খাবার খেয়ে সুশান্তর জেঠির চেহারার খোলতাই হয়ে গিয়েছিল । ছেলের বউ চেয়েছিল যে তার বুড়ি বিধবা মা, একা, চোখে ভালো দেখতে পান না, থাকুন পাটনায় ছেলের বাড়িতে ; তাতে সুশান্তর বাবা-কাকা-জেঠারা রাজি হননি । এসব ঝুটঝামেলা এড়াতে বড়জ্যাঠাইমার ছেলে বদলি নিয়ে পালিয়েছে জামশেদপুর । ছোটোছেলে আমেরিকায় পড়তে গিয়ে আর ফেরেনি ; ওখানের চিনা মেয়েকে বিয়ে করে থেকে গেছে, দুই মেয়ের চিনাভাষায় নাম রেখেছে ।
সুশান্তর বাবা কখনও ফোন করেননি ওঁকে । ইতু ফোন করে জানিয়েছিল যে সুশান্তর মায়ের মোবাইলটার প্যাকিঙই খোলা হয়নি । যেখানে সুশান্ত রেখে গিয়েছিল ড্রইংরুমের সেই সাইড টেবিলেই ধুলোর ওপর পড়ে আছে । কাজের বউ সৌদামিনীও ঝাড়পোঁছ করার সময়ে তাতে হাত দেয় না ।
তারপর সুশান্ত ঘোষের বাবা মারা গেলেন । হয়ত উনিও ফোনটা ব্যবহার করেননি ।

পাঁচ
পুড়তে-থাকা কুঁড়েঘরগুলোর মাঝে দাঁড়িয়ে, এ কে সানতালিস রাইফেলটা হাতে নিয়ে, সিলভারব্যাক গোরিলার ঢঙে বুক চাপড়ে, রগ বয়ে যৌবন-প্রাপ্তির মস্তির রস ঝরানো যুবক হাতির মতন, অপুর, অশ্বমেধ ঘোষ-এর, কন্ঠস্বর থেকে যে চিৎকার বেরিয়ে এলো তাকে বৃংহনের সঙ্গেই তুলনা করা যায় । তার কারণ অপু ক্রোধেও গালাগাল দিতে পারে না, দিতে না-পারার অতিরিক্ত আক্ষেপে ক্রোধ মাথায় উঠে যায় ; সে-উক্তিগুলো ওর সাঙ্গপাঙ্গরাই করছিল ।

ছয়
বাবা-মার জন্য স্মৃতির জারকে আচ্ছন্ন সুশান্তর মনকেমন করে মাঝেসাঝে, তখন গ্যাঁজানো তরমুজের চোলাই-করা সোমরস নিয়ে বসেন, সঙ্গে শুয়োরের মাংসের বড়া , আদা-রসুন-পেঁয়াজবাটা আর বেসন মাখা, হামান দিস্তায় থেঁতো করা মাংসের বড়া, সাদা তেলে যা রাঁধতে ওনার বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউয়ের ভারিভরকম মায়ের জুড়ি নেই । ওনার ছেলে অপু , যদিও বাংলা বলতে পারে, কিন্তু মাকে শুনিয়ে হিন্দিতেই বলে, হাঁ পিজিয়ে পিজিয়ে অওর গম গলত কিজিয়ে ; আরে অগর আপকা দিল নহিঁ লগতা থা তো ভাগ কেঁও নহিঁ গয়ে থে ? য়ঁহাসে নিকলকে ভাগলপুর স্টেশন, অওর ওঁয়াহাসে সিধে পটনা, স্টেশন ভি ঘর কে নজদিক । পর আপ নহিঁ ভাগে । লগতা হ্যায় আপকো অপনে বিবি সে জ্যাদা প্যার অপনে সসুর সে হ্যায় । বিবি কহিঁ ভি মিল জাতি, মগর তারিণী মণ্ডলকে তরহ মকখনভরা পহাড় নহিঁ মিলতা, য়হি হ্যায় না আপকা গম ?
তারিণী মণ্ডলের হাঁটু-ডিংডং স্ত্রী, ফোকলা গুটকাদেঁতো হাসি হেসে নিজের মহিষ-কালো বরকে খুসুরফুসুর কন্ঠে বলেন, দোগলা হ্যায় না আপকা পোতা, ইসিলিয়ে বহুত দিমাগ রখতা হ্যায় । সাধারণ জারজ নয়, বাঙালি-বিহারি, উঁচুজাত-নিচুজাত, পড়াশোনাঅলা- মুখ্খু, শহুরে-গাঁইয়া, গরিব-মালদার, কানুনি-গয়েরকানুনি, কলমচি-খেতিহর, কত রকমের মিশেল ।
--আরে মাথা তো খাটিয়েছিলুম আমি ছোঁড়াটাকে বন্ধক বানিয়ে, ঘরজামাইও পেলুম, আবার নসলও ভালো হয়ে গেল । এখন কয়েক পুরুষ চকচকে ফর্সা বাচ্চা পাবি ; অপুর মেয়েদের বিয়ে দিতে বেশি অসুবিধা হবে না। জামাইবাবার মেয়ে না হওয়াই ভালো, কী বল ? বলল তারিণী মণ্ডল, ডান চোখে হাসি মেলে । যখন সুশান্ত ঘোষকে কিডন্যাপ করেছিল, তখন অবশ্য দুটো চোখই ছিল,বাঁ চোখটা নষ্ট হয়নি রামধারী ধানুকের হামলায় ।
--সে কথা ঠিক । আমি তি ভেবেছিলুম ছোঁড়াটা পালিয়ে যাবে ।
--আমার মেয়ের সঙ্গে রাত কাটিয়ে পালিয়ে গেলেই হল ? ধরে এনে কেটে টুকরো করে দিয়ারার বালিতে পুঁতে দিতুম ।
--ছোঁড়াটা ভালোবেসে ফেলেছে ওর গালফোলা বউকে । শোবার সময় রোজ রাতে খুশবুর টিন থেকে গ্যাস মারে তোমার মেয়ের গায়ে, দ্যাখো না কেমন গন্ধ ভুরভুর করে বেবির গা থেকে, মনে হয় চবুতরা জুড়ে ফুলের গাছ ? ভৌঁরাভৌঁরি জোড়ি ।
--তাজ্জব ব্যাপার, না ? বকের সঙ্গে কোকিলের বিয়ে !
--তাজ্জবের কি আছে । এরকম কচি কুচুরমুচুর মেয়ের সঙ্গে কি ওর বিয়ে হতো ওদের নিজেদের সমাজে ? কোনো দরকচা হেলাফেলা টিড্ডিছাপ বউ পেতো ।
--কি যা তা বকছিস নিজের মেয়ের সম্পর্কে ।
--সত্যি কথাটাই বলছি । নিজের বিয়ের কথা মনে করে দ্যাখো । তুমিও কচি কুচুরমুচুরই পেয়েছিলে । ওই কুচুরমুচুর জিনিসটাই হল মেয়েদের দুসরা দিল, যা মরদদের থাকে না । দ্বিতীয় হৃদয়ে রক্ত থাকে না, থাকে রসালো মাদকের ফাঁদ, যে ফাঁদে একবার পড়লে রোজ-রোজ পড়ার নেশায় মরদরা ভোগে, যতদিন সে মরদ থাকে ততদিন তো ভোগেই ।
--তা ঠিক, ছিলিস ছাপ্পানছুরি-ছইলছবিলি । এটা কোনো টিভি সিরিয়ালের সংলাপ বললি নাকি ? ছোঁড়াটা নাকি প্রথম রাতেই রক্তারক্তি করে ফেলেছিল ?
--হ্যাঁ । বেচারা । গলার শেকল খুলে-দেয়া শহুরে রামছাগল । কত দিনের বদবুদার তবিয়ত ।
--ওদের বিয়ে দিতে এত দেরি করে কেন জানি না । কম বয়সের টাটকাতাজা রস সব বেকার বয়ে চলে যায় ।
--দেরি করে বলেই তো পেলে ছোঁড়াটাকে ।
তা নয় ; কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক সুশান্ত ঘোষ হয়ে গেছেন দিয়ারাচরিত্রের উন্মূল মানুষ । যখন নোট গোণার চাকরি করতেন, তখন বিহারি জোতদার পরিবারের যুবকদের মতন, রাজপুত ভূমিহার কুরমি যারা, কিংবা ব্রাহ্মণ কায়স্হ বিহারি আমলার শহুরে ছেলেদের ধাঁচে, অফিসে প্রতি ঋতুতে হালফ্যাশান আনতেন। ব্র্যাণ্ডেড জ্যাকেট জিন্স টিশার্ট উইন্ডচিটার । দপতরের গৃহবধু কর্মীদের চোখে সুশান্ত ঘোষ ছিলেন অবিনশ্বর জাদুখোকোন, লিচুকুসুম, মাগ-ভাতারের অচলায়তনের ফাটল দিয়ে দেখা মুক্ত দুনিয়ার লালটুশ । গেঁজিয়ে যেতে পারতেন, চোখে চোখ রেখে, ননস্টপ, যেন বাজে বকার মধ্যেই পালটে যাচ্ছেন পৌরাণিক কিন্নরে, সবায়ের অজান্তে । গায়কের ইশারায় যেভাবে ধ্বনিপরম্পরা টের পায় তবলাবাদকের আঙুলের ছান্দসিক অস্হিরতা, তেমনই, নৈশভোজে বেরোনো শীতঘুম-ভাঙা টিকটিকি যুবকের মতন, মহিলা সহকর্মীদের অবান্তর কথাবার্তা, ভোজপুরি বা হিন্দি বা বাংলায় বা ইংরেজিতে, বলার জন্যই বলা, শ্বাসছোঁয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে গিলতেন সুশান্ত ঘোষ ।
এখন আর ওনার, সুশান্ত ঘোষের সম্পর্কে, আগাম বলা যায় না কিছু । চাকরি করতেন পচা টাকার নোট জ্বালিয়ে নষ্ট করার । এখন কাঁচা টাকার করকরে আরামে ঠ্যাং তুলে খালি গায়ে, ভুঁড়ির তলায় চেককাটা লুঙ্গি পরে, লুঙ্গির গেঁজেতে সেমিঅটোমেটিক পিস্তল, যা জীবনে কখনও চালাননি, শাশুড়ির পরানো কালো কাপড়ের ছোট্ট তাবিজ গলায় , নিজেকে অন্যমানুষে পালটে ফেলার আনন্দে তরমুজ-সোমরসের হেঁচকি তোলেন। যা একখানা চেহারা করেছেন, ওনার স্তাবকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময়ে ওনাকে বলে গেণ্ডা-মরদ অর্থাৎ আলফা গণ্ডার ।
প্রতি রাতে শোবার আগে বিবসনা বউয়ের আগাপাশতলা বডি ডেওডোরেন্ট স্প্রে করেন সুশান্ত ঘোষ বা গেণ্ডা-মরদ, মানে আলফা গণ্ডার । এমন নয় যে বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউয়ের গায়ে দুর্গন্ধ ; প্রথম রাতেই সুশান্ত ঘোষ একটা স্যান্ডালউড সাবান কিনে বলে দিয়েছিলেন যে রোজ এই সাবান মেখে স্নান করতে হবে, সপ্তাহে একদিন শাম্পু করতে হবে । বউই আসক্ত হয়ে গেছে ডেওডোরেণ্টের, শ্যাম্পুর, লিপগ্লসের, লিপস্টিকের, ফেয়ার অ্যাণ্ড লাভলির, কমপ্যাক্ট পাউডারের, ওলে টোটাল এফেক্টের, নখপালিশের, পিচ-মিল্ক ময়েশ্চারাইজার আর নানা আঙ্গিকের শিশি-বোতল-কৌটোর-ডিবের সুগন্ধের নেশায় ।
শহুরে দশলাখিয়া বরকে বশ করার জন্য, টিভিসুন্দরীরা যা মাখে, তা মেখে কৃষ্ণাঙ্গী-অপ্সরা হবার প্রয়াস করে বেবি, সুশান্ত ঘোষের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর শ্যামলিমা চির-তুলতুলে বউ, আর সুশান্তর শাশুড়ি বশ করার মন্ত্রপূত তাবিজ পরিয়ে জামাইকে বেঁধে রেখেছেন বেবির আপাত-বেবিত্বে ।
কোনো রাতে মাতাল অবস্হায় সুশান্ত ঘুমিয়ে পড়লে, মাঝরাতে বউ ওনাকে ঠেলে জাগিয়ে দিয়ে বলে, উঠিয়ে না, নিন্দ নহিঁ আ রহল , জরা গ্যাস মার দিজিয়ে না । হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে রাখা একাধিক ডেওডোরেন্টের স্প্রে থেকে যেটা হাতে পান বউয়ের পোশাকহীন গায়ে সুগন্ধী বর্ষা ছিটিয়ে এক খেপ দ্রূত-প্রেম সেরে ফেলে দুজনে দুপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন । অনেক সময়ে বেবি নামের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বউ আগেই হুশিয়ারি দিয়ে রাখে, জল্দিবাজি মত কিজিয়ে, ধিরজ সে কিজিয়ে, বুডঢি নহিঁ না হো গয়ে হ্যাঁয় হম ।
ডেস্কটপের মনিটারে , বেবি নামের মেঠোগন্ধা শ্যামলিমা বউকে, পর্নো ফিল্ম দেখিয়ে আরো বিপদ ডেকে এনেছেন নিজের । বেবি বলে, ফিলিম মেঁ জইসন কর রহা হ্যায় ওইসন কিজিয়ে না, উঠাইয়ে, লেটাইয়ে, গিরাইয়ে, গিরিয়ে, পটক দিজিয়ে, সাঁস ফুলাইয়ে, মুহ সে প্যার কিজিয়ে, হমকো ভি মৌকা দিজিয়ে । কেতনা দের তক ভোগ করতা হ্যায়, অওর আপ হ্যাঁয় কি কবুতরকে তরহ ঝপট লিয়ে বস সো গয়ে । শুন রহেঁ হ্যাঁয় নাআআআআআ । তারপর বলে, দেখেছেন তো ওরা কেউ পৈতে পরে না ; আপনি যদি পৈতে পরতেন তাহলে সুতোর লচ্ছা সামলাতেই আমাদের সময় চলে যেত , ভালো করেছেন পৈতে পরা বন্ধ করে ।
ঘুমনেশার ঘোরে সুশান্ত বলেন, আরে ওরা সব সাহেব-মেম কিংবা হাবশি, কুমিরের মাংস, বনমানুষের মাংস, ঘোড়ার মাংস, হাতির মাংস খায়, গাধার মাংস খায় ।
--হাঁ, সে-কথা ঠিক, হাতিদের মতন ; হাতিরা কেমন নিজেদের গোমোরের জিনিসকে লটকিয়ে হাঁটে, মাটিতে ছুঁয়ে যায়। আপনি অপুকে বিলেতে পড়াশুনা করতে পাঠাতে চাইছেন ; সেখানে গিয়ে ও যদি মেম বিয়ে করে তাহলে তো সঙ্গত দিতে-দিতে হালকান হয়ে যাবে ! বিয়ে দিয়ে পাঠাতে পারতেন ; ওর বউ থাকত দিয়ারায় আমাদের সঙ্গে ।
--ওখানে বিয়ে করার দরকার হয় না ; না করেই একসঙ্গে থাকা যায় । সঙ্গত মনের মতন না হলে আরেকজনের কাছে চলে যাওয়া যায়, বুঝলি ?
--তাহলে তো ভালোই, মন ভরে গেলে বাড়ি ফিরে আসবে ; তখন ওর বিয়ে দেবেন ।
অপুর মা, সুশান্তর মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বউ, পর-পর কয়েকদিন মাঝ রাতে ঘুম ভাঙাবার পর বলে ফ্যালে, চাহিয়ে তো এক বংগালন বিবি শাদি করকে লাইয়ে না পটনা য়া কলকত্তা সে, সাহব-মেম খেলিয়েগা দোনো মিলকর, জইসন নঙ্গা-ফিলিম মেঁ দিখাতা হ্যায়, কেতনা মছলি পকড়া যাতা হ্যায় অপনে হি নদী মেঁ, বড়কা-বড়কা রোহু । ঘরকা বনা মিঠাই খাতে হম লোগ সব । আপ চখতে বংগালন বিবি কি মিঠি চুচি । হমরে বিছওনে মেঁ হি, লগাকে মচ্ছরদানি, পিলাসটিকবালা গুলাবি মচ্ছরদানি । নহিঁ তো কলকত্তা যাইয়ে না, বংগালন রণ্ডিলোগন কা বাজার নহিঁ হ্যায় ওয়াহাঁ কাআআআআআআ ? কমর হিলাকে আইয়ে, অইসন দুখি-দুখি মত রহিয়ে, অওর দারু মে মত ডুবে রহিয়ে রাত ভর ; দারু পিকে আপ একদম সঠিয়া যাতে হ্যাঁয় । দিন মেঁ পিজিয়ে দারু, কৌনো মনা কিয়া হ্যায় কাআআআআ ? রতিয়া কে বখত বদনওয়া ফিরি রখিয়ে জি ।
বারবার শুনে বিরক্ত সুশান্ত একদিন বলেছিলেন, ঠিক আছে, নিয়ে আসবো একজন লেখাপড়া-শেখা বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে । নাছোড়বান্দা বেবি, যাকে বলা যায় তৎক্ষণাত, প্রত্যুত্তর দিয়েছিল, নিয়ে এসে দেখুন না, আপনার আর আপনার বাঙালি বউয়ের মাথা, সেই দিনই হাসুয়া দিয়ে ধড় থেকে নামিয়ে দেবো ; জানেন তো আমি তারিণী মণ্ডলের মেয়ে ।
--হ্যাঁ, জানি, তুই প্রথমে তারিণী মন্ডলের মেয়ে, তারপর আমার বউ । ধড়টা তো তোকে দিয়েই দিয়েছি, আর আলাদা করে নিয়ে কী করবি ? আর মুণ্ডুও অনেকসময়ে তোর উরুর ঝক্কি সামলায় ।
--খারাপ লাগল শুনে ? তাহলে মাফ করে দিন । আমি বেবি ঘোষ, আপনিও জানেন, আমিও জানি, ভোটার লিস্টে দেখে নেবেন, আমি তো লিখাপড়হি জানি না, কিন্তু বেবি ঘোষই লেখা আছে আমার ফোটুর পাশে, ভোট দিতে গিয়ে জানতে পেরেছি । আমি বেবি মণ্ডল নই । আমার ছেলেও মণ্ডল নয় । আর বলব না, মাফ করেছেন কি না ? আঁয় ?
--করে দিলুম । এখন যা । দরকার হলে ডেকে নেবো ।
--দাঁড়ান চান করে আসি, তারপর । ভিজে-ভিজে শরীরে আপনি যখন ফোঁটায় ফোঁটায় গুটিপোকা ফ্যালেন তবিয়ত এতো মগন হয়, গুটিপোকাগুলো সব ভেতরে গিয়ে নানা রঙের প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায় ।
--এই জন্যই তো থেকে গেলুম ; যখন বলি তখনই তুই তৈরি, ঘুম থেকে উঠে হোক, দুপুর হোক, সন্ধ্যা হোক, মাঝ রাত হোক ।
--রান্না চাপিয়ে গ্যাস নিভিয়েও তো কতবার এসেছি আপনার গুটিপোকাদের ফোঁটা নিয়ে প্রজাপতি ওড়াবো বলে। ভাগ্যিস আপনাকে পেয়েছি, কোনো গংগোতা বর হলে তো যৌবন নষ্ট হয়ে যেত বছর-বছর বাচ্চা পয়দা করে ।
দিয়ারা, দ্বীপের মতন চর, জেগে ওঠে, জলপ্রবাহকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে বছরের পর বছর, জামাইবাবার মতন, বেগুসরায় মুঙ্গের থেকে গঙ্গা নদীর কিনার বরাবর, ভাগলপুর কাটিহার অব্দি ; এক জায়গায় ডুবে আরেক জায়গায় কুমিরের মতন জেগে ওঠে, খেলা করে অজস্র মানুষের সুখ-শান্তি নিয়ে, তাদের দুর্ধর্ষ ক্রুর মমতাহীন আতঙ্কিত উদ্বিগ্ন করে রাখে আজীবন, ভালা বরছি গাঁড়াসা ভোজালি পাইপগান কাট্টা তামাঞ্চা একনল্লা দুনল্লা একে-সানতালিস একে-ছপ্পন দিয়ে ।
আচমকা যদি কখনও ওনার, সুশান্ত ঘোষের, মগজে ঘুমিয়ে থাকা লোকটা ধড়মড় করে উঠে বসে জানতে চায় যে, ওহে খোকা, তুমি কি ছিলে আর কি হয়ে গেলে, তখন ছিপি খুলে গুড়ে চোলাইকরা তরমুজের সোমরসের বোতল নিয়ে বসেন, আর নিজেকে বলেন, ইতু জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে চলেছে, আমার উদ্দেশ্য আমাকে খুঁজতে হয়নি। উদ্দেশ্যই আমাকে খুঁজে নিয়েছে । আমারও কী আত্মপরিচয় আছে ? কী ? আমি তারিণী মণ্ডলের জামাই, বেবির স্বামী, গংগোতা ক্ল্যানের ডনের অভিনেতা ! আমি কে ? আমি, যার নাম সুশান্ত ঘোষ ? আই অ্যাম নাথিং ।
ল্যাপটপে বা স্মার্টফোনে লোডকরা ওনার প্রিয় গান শোনেন, বারবার, বারবার, দিল ঢুণ্ডতা হ্যায় ফির ওয়হি ফুরসতকে রাতদিন, ব্যায়ঠে রহে তসব্বুর-এ-জানা কিয়ে হুয়ে, দিল ঢুণ্ডতা হ্যায় ফির ওয়হি ফুরসতকে রাতদিন...। শুনতে পান, বেবি বলছে, এরকম দুখি-দুখি গান শুনছেন কেন, অন্য গানটা শুনুন না, দো দিওয়ানে শহর মেঁ, রাত মেঁ য়া দোপহর মেঁ...। ঠিক আছে, শোন, জিন্দগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি হায়, কভি ইয়ে রুলায়ে, কভি ইয়ে হাসায়ে...।
বেবি : কী-ই বা করবেন, আমাদের দুজনের অদৃষ্ট, আর সেই শুশুকটার ইশারা, আপনি রামচন্দ্রজীর মতন দরজায় এসে যেদিন দাঁড়ালেন, তার আগের দিন গঙ্গায় শুশুক দেখে সবাই বলেছিল যে আমার জন্য গঙ্গা মাইয়া একজন রাজপুত্রকে পাঠাচ্ছেন । হ্যায় নাআআআআআ ।
দুপুরের প্যাচপেচে গরমে একা বসে-বসে স্বস্তি না পেলে ল্যাপটপে বা ডেস্কটপে ট্রিপল এক্স । তাতেও স্বস্তি না পেলে বেবি বলে হাঁক পাড়েন, আর বেবি ঘরে ঢুকলে, বলেন, দরোজা বন্ধ করে দে, এই নে, দেখে একটু শরীর টাটকা-তাজা করে নে, তারপর তুই শুশুক ধরিস, আমি চুচুক ধরব, তাড়াহুড়ো করব না । বেবি উত্তর দ্যায়, তাড়াহুড়ো করলে আপনার গুটিপোকাগুলো থেকে তরমুজের গন্ধ বেরোতে থাকে, ভাল্লাগে না, গ্যাসের টিন বরবাদ ।
জমিন, জল, জবরদস্তি-- এই তিনটের মালিকানা, একদা লালটুশ এখন ভুঁড়োকার্তিক সুশান্ত ঘোষকে করে তুলেছে বহু ফেরারির আশ্রয়দাতা । নর্থ বিহার লিবারেশান আর্মির নেতা শংকরদয়াল সিং, ফাইজান পার্টির অওধেশ মণ্ডল আর হোয়াইট অ্যান্ট পার্টির বিকরা পাসওয়ানদের পোঁদে বেয়নেট ঠেকিয়ে পুলিশ যখন তাড়িয়ে বেড়াবার খেলা খেলছিল, তখন সুশান্ত ওদের লুকিয়ে রেখেছিলেন দুষ্প্রবেশ্য নামহীন এক দিয়ারায়, গঙ্গামাটির প্রলেপ-দেয়া, ডিজেল ইনভার্টারে চালানো রুমকুলারে ঠাণ্ডাখড় আরামঘরে । ভাড়া সেভেনস্টার হোটেলের । রুম সার্ভিস চাইলে ওনার শশুর ডান্সবারের নাচিয়েদের আনান নৌকোয় চাপিয়ে, সার্ভিস হয়ে গেলে ডান্সগার্লদের ফেরত পাঠান ভোর রাতের নৌকোয় চাপিয়ে ।
সুশান্ত ঘোষের পারিবারিক কিংবদন্ধি অনুযায়ী, ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ছিল ঠগি ; গুড়ে চোলাই করা তরমুজের মদ টেনে সুশান্ত ঘোষ ভেবে ফ্যালেন যে হয়ত তাই তিনিও শশুরের দেয়া সুপারঠগির সিংহাসন দখল করলেন ।
পুলিশ যায় না অপরিচিত কোনো দিয়ারায় ; গুজব যে ভাগলপুর শহর থেকে চান করার মার্বেল-বাথটব এনে দিয়ারার বালিতে বসিয়ে রেখে গেছেন তারিণী মণ্ডলের বাবা । তাইতে নাইট্রিক অ্যাসিড ভরে একজন পুলিশের মুখবির বা ইনফরমারকে চুবিয়ে গলিয়ে ফ্যালা হয়েছিল ।

সাত
শেষবার যখন ইতু ওর ক্লিনিক থেকে নিজের সঙ্গে, একদা পালিয়ে-যাওয়া অমিতকে বাড়ি নিয়ে এলো, বিরোধের হল্কা প্রায় নিভে গিয়েছিল, কেননা ইতিমধ্যে একান্নবর্তী পরিবারের অধিকাংশ সদস্য একে আরেকের সঙ্গে কথাহীন বার্তা-বিনিময় করে নিয়েছিলেন, যে, ইতুটাকে ঘাড় থেকে যদি নামানো যায় তাহলে স্হান-কাল-পাত্রের যেমন সুবিধা পাওয়া যাবে, তেমনই, আর্থিক দায়টাও বাড়ির বাইরে চালান করে দেয়া যাবে। এর আগে যখন অমিত এসেছে, সেদিন বিকেলেই চলে গেছে বা থেকে গেছে একদিন, বহিরাগতের মতন, অতিথির মতন নয়, বাড়ির সদস্যের মতন তো নয়ই ।
শেষবার যখন অমিত এসেছিল, কোথায় শোবে তা নিয়ে আলোচনা চলছিল, ইতু প্রস্তাব দিল, তিনতলার ছাদে ওর ঘরেই রাতটা কাটাক অমিত, সঙ্গে টয়লেট-বাথরুম আছে, কোনো অসুবিধা হবে না ; দোতলার বারান্দায় যে খাট পাতা আছে তাতে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়বে ইতু, একটা রাতেরই তো ব্যাপার । আগে ঘরটা ছিল সুশান্তর বাবার, তিনি মারা যেতে জাঠতুতো ভাই সমরেন্দ্রর দখলে গিয়েছিল ; ওর বউ যমজ বাচ্চাদের ইতুদের বাড়ির জিম্মায় চাপিয়ে ঝাড়া হাত-পা ডিভোর্স দিয়ে নাচতে-গাইতে চলে গেছে, যার দরুণ নিজের বলার মতন একটা ঘর পেয়েছে ইতু ।
অমিত যখন এই বাড়ির সদস্য ছিল, তখন ও একতলায় ওর রাঙাবাবা-রাঙামা, মানে ইতুর রাঙাকাকা-রাঙাকাকিমার ঘরে ওনাদের সঙ্গে থাকত । উধাও হবার পর প্রথমবার ফিরে, অমিত ওর রাঙাবাবা-রাঙামায়ের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখায়নি ; ওনারাও কুন্ঠিত, হয়তো অমিত চলে যাওয়ায় ওনারা যেচে-নেয়া দায়ভার থেকে ছাড়ান পেয়েছেন ।
শুকগে তিনতলার ঘরে, মরুকগে যাক, মেয়েটা মা-বাপকে খেয়েছে, এবার ছেলেটাকে খাক, বয়স্কদের মুখ দেখে, তাদের ঘিলুর ভেতরের মেঘে সেরকমই রুপোলি পাড় দেখতে পেয়েছিল ইতু ।
সকলকে শুনিয়ে ইতু বলল, তুই চল, বিছানা পেতে দিচ্ছি, জিনিসপত্র নেই দেখছি, শুধু এই কাঁধব্যাগ ?
--হ্যাঁ, এতেই আমার পেন আর খাতা আছে, সংবাদ যা পাই টুকে নিই, পরে অফিসে গিয়ে তথ্যগুলো খাতা থেকে লিখে নিই আর যা দেখেছি বা শুনেছি তা স্মৃতি থেকে লিখে নিই । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
--একটা ল্যাপটপ রাখলেই পারতিস, রিপোর্টাররা তো আজকাল ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন এই সব নিয়ে কাজ করেন । ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।
--আমি এখনও টেকস্যাভি হতে পারিনি । হাতে কলম নিয়ে লিখতে ভালো লাগে আমার । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
--তুই স্নানটান করে রেডি হয়ে নে, খাবার সময় হলে ডেকে নেব । ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।
--আমার না খেলেও চলবে, রিপোর্টারের চাকরিতে সময়ে খাওয়া হয়ে ওঠে না, জানিসই তো, অভ্যাস হয়ে গেছে । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
--ও লজ্জা পাচ্ছিস । এমব্যারাসড ফিল করার কী আছে, আমি তোর ডিনার ঘরেই পৌঁছে দিচ্ছি । ডিনার মানে রুটি আর আলু-পটলের তরকারি হয়েছে আজকে । ছয়টা রুটি চলবে তো ? ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।
--না না, দুটো রুটি হলেই হবে । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
রাঙাকাকা আর সুশান্তজেঠুর মা, যাকে ওনার ছেলেরা, ভাসুরপো-দেওরপোরা, তাদের বাচ্চারা, অন্নমা বলে ডাকে, অমিতকে বললেন, তুমি আসো বেশ ভালো লাগে বাবা , তুমি সুশান্তর সবচেয়ে কাছের বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলে, এ-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েই বা কেন গিয়েছিলে , সব বাড়িতেই অমন মেলামেশা হয়, তাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় নাকি , কী আর বলব, আমার কোনো গুরুত্ব আর নেই, সুশান্তর বাবা মারা যাবার পর কিছুই আর ভালো লাগে না । কিন্তু প্রতিবার অমন আপত্তি করো, আর যাই-যাই করো বলে মন খারাপ হয়ে যায়। এমনিতেই আমার মন বিষিয়ে থাকে, জানোই তো ।
ইতু জানে, সুশান্তজেঠুর অভাব, জেঠুর বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলের মাধ্যমে কিছুটা মেটাবার চেষ্টা করেন অন্নমা । অতনুজেঠুকে ইতু দেখেছে ছোটোবেলায়, সুশান্তজেঠুর মোটরসাইকেলে বসে এ-বাড়িতে আসতে, কিন্তু ভুলে গেছে ওনার মুখ । সুশান্তজেঠু কিডন্যাপ হয়ে চলে গেলেন, তারপর অতনুজেঠু চাকরি-বাকরি ছেড়ে চলে গেলেন কোথাও । তখন সবাই বলত উনি সাধু হয়ে গেছেন, কুম্ভ মেলায় ওনাকে জটাজুট দেখা গেছে । শেষে উনি যখন অমিতকে এবাড়িতে রাখতে এলেন, ইতু তখন স্কুলে, জানা গিয়েছিল যে উনি নওয়াদা জেলার কোনো গ্রামে মানসী বর্মণের সঙ্গে সংসার পেতেছেন, সেই বাড়িতে আবার মানসী বর্মণের স্বামীও থাকেন । আরও পরে, যে অফিসে উনি কাজ করতেন, সেখানের কর্মীদের সূত্রে, কানাঘুষা শোনা গিয়েছিল যে ওনারা নকসল্লি-মালে আন্দোলন করতেন, পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন ; ওনাদের বিপ্লবী জীবনে শিশু অমিত খাপ খাবে না ভেবেই হয়ত রেখে গিয়েছিলেন ইতুদের বাড়িতে । বাবা-মাকে খুঁজে পাবার আগে পর্যন্ত অমিত ছিল বাবাহীন-মাহীন ।
তিন তলার ঘরে পৌঁছে ইতু বলল, তোর মেসেঞ্জার আমাকে যে চিরকুট দিয়েছিল তাতে তো লেখা ছিল তুই কালকে সকালে আসবি ? মেসেঞ্জারদের দেখে বাড়ির লোকেদেরও খটকা লাগে ; বলেন ওরা কে রে, তোর পেশেন্ট, অথচ তুই তো বলতিস যে তোর রোগি জোটে না । বানচোদ, তোর জন্য কতো আর মিথ্যার সিনেমা করব ? আমি বিপদে পড়লে ক্ষতি নেই, বাড়িসুদ্দু লোকেরা যেন বিপদে না পড়ে ।
--আমার বিহারশরিফে একটা কাজ ছিল । প্রতিবারের মতন আমি পাটনায় চলে এলুম । কতদিন তোর সঙ্গে দেখা হয়নি, মুখোমুখি কথা হয়নি । তোকে টাচ অ্যান্ড ফিল করতে ইচ্ছে করে ।
ডিনারের বদলে একটু পরে ফোটো অ্যালবাম নিয়ে এলো ইতু । খাটের ওপর বসে, অ্যালবাম খুলে দ্যাখালো, এই দেখ, আমাদের দোল খেলার দিন তুই, তোর ক্লাসের বন্ধুরা সবাই এসেছিল, এই যে তোর ছবি, কতকাল হয়ে গেল, অবহেলায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ।
গোটা দশেক ফোটো ছিল ওদের, সেগুলো প্লাসটিকের খাপ থেকে বের করে অমিত যখন বলল, আমি কি এগুলো রেখে নেব, তখন ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ইতু বলল, রেখে আবার কী করবি ? ডেসট্রয় করে ফেলতে চাইছিস তো ?
--হ্যাঁ, এ-বাড়িতে আমার কোনো চিহ্ণ রাখতে চাই না ।
--পরে কথা হবে, ফোটোগুলো ছিঁড়তে-ছিঁড়তে বলল ইতু । তারপর হাতের মুঠোয় দলাটা ধরে যোগ করল, জ্বালিয়ে ফেলতে হবে তো ? ডিনার আনছি, ঘুমিয়ে পড়িসনি যেন । ফোটোগুলো থাকলেও বিশেষ কিছু ক্ষতি হতো না । এই বাড়িতে এসে কে-ই বা তোর ফোটো খুঁজবে । যাদের খোঁজবার তারা যদি সন্দেহ করে থাকে তাহলে তোর স্কুল-কলেজের রেকর্ড থেকেই যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়ে ডোসিয়ার বানিয়ে ফেলে থাকবে ।
--ফোটোগুলো কেনই বা রেখেছিলিস, আননেসেসারিলি ।
--ফোটোগুলো ছমাস যাবত প্রায়ই দেখতুম আর আশা করতুম যে তোর চিরকুট আসবে বা তুই নিজে আসবি। তার বদলে এসেছে তোর মেসেঞ্জার, একজন চিঠি দিয়ে যায়, তো আরেকজন নিয়ে যায় । ভাগ্যিস ক্লিনিকটা বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিতে হল ।
রাতভোজন এনে, সামনে বসে অমিতকে খাইয়ে, বাথরুম থেকে অমিত হাত ধুয়ে এলে, ইতু বলল, সকলের খাওয়া হয়ে গেছে, তোর আর কিছু চাই ?
--না, এত করছিস আমার জন্য, না চাইতেই । কাল সকাল-সকাল বেরিয়ে যাবো ।
--বার-বার অমন যাই-যাই কোরিসনি তো, ইউ ইডিয়ট । কতদিন পর তো এলি । বলেছিলিস সঙ্গে নিয়ে যাবি অথচ প্রতিবার এড়িয়ে যাস, ইউ লায়ার । আমার তো কেমন সন্দেহ হওয়া আরম্ভ হয়েছে । তোর হয়তো কিছুই চাই না, আমার চাই, আমি এবার তোর সঙ্গে যেতে চাই, পালাতে চাই এখান থেকে ।
--কিন্তু..
--থাম দিকিনি । ফোটো জ্বালিয়ে এলুম , আর এখন আবার গল্প ফাঁদবার তালে আছিস । তোর কাঁধব্যাগও দেখে নিয়েছি, শুধু একটা লুঙ্গি আর গামছা । জানতুম না যে সিক্রেট কাল্টের মানুষরাও মিথ্যাবাদী হয় । আমি এবার তোর সঙ্গে যাচ্ছিই । ফাইনাল ।
অমিত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর আত্মগ্লানির মতন করে বলল, সিক্রেট কাল্ট বলে অপমান করিস না প্লিজ, চে গ্বেভারার নাম শুনেছিস ?
--শুনেছি । বিপ্লবীদের রোমান্টিক মৃত্যু নিয়ে বেশ একটা মুখরোচক রহস্য তৈরি করে ফেলিস তোরা । গুয়েমুতে মরে পড়ে-থাকা স্তালিনকে নিয়ে, কই, তোদের মুখে কিছু শুনতে পাই না । পল পটের বিষয়েও শুনি না। কিম জং উন, কিম জং ইন, কিম জং হিং এটসেটরা, তাদের কথাও তো শুনি না । যাকগে যাক, কী হবে আমার ওসব জেনে ? তোর কাজের অংশীদার করার প্রয়োজন মনে করিসনি আমাকে । আমি যেন তোর ডাকবাক্স । একজন চিঠি দিয়ে যায়, আর আরেকজন এসে নিয়ে যায় । এতই যখন বিশ্বাস করেছিস আমাকে, তো সঙ্গে নিসনি কেন ? এ-বাড়ি ছেড়ে যখন উধাও হয়ে গেলি তখনই তো সঙ্গে নিতে পারতিস ? তোর নিজের বাবা-মাকে খুঁজে পেলি, তবু নিয়ে গেলি না ।
--চেয়ার রয়েছে তো, বোস না আয়েস করে, গল্প করা যাক ।
ইতু বিছানার ওপর নিজেকে, তেমনই মনে হল অমিতের, পাথর-চাঁইয়ের মতন ফেলে, বলে উঠল, তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে, চেয়ারে বসলে হবে না । অমিত অনুমান করতে পারেনি ইতু কী করতে চলেছে। ইউ কাওয়ার্ড আহাম্মক, অমিতকে সজোরে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল প্রগলভা ইতু ; আঁকড়ে ধরে, ইতু নিজের ঠোঁট অমিতের ঠোঁটে চেপে ধরে রেখেই বলল, তুই হয় আমাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবি, নয়তো আমি আজকে রাতেই আত্মহত্যা করে তোর আরেকবার উধাও হয়ে যাওয়া ভণ্ডুল করে দেব ।
--তুই কী করতে চাইছিস বল তো ? দু’জনে এভাবে ধরা পড়ে গিয়েছিলুম বলে, আমাকে তোদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল । এবার দেখে ফেললে ওনারা নির্ঘাত গলাধাক্কা দেবার আগে বেদম পিটুনি দেবেন । বলল উদ্বিগ্নবাক অমিত ।
--ছাঁচি পেঁয়াজি মারিসনি । ভয়কে কাবু করতে শেখ, স্টুপিড । মার খেলে পালটা মার দিতে শেখ । নিজে তো মা-বাবার আদর-ভালোবাসা খাচ্ছিস । আমার কি ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে না ? জড়িয়ে ধর আমায়, হোল্ড মি ইন ইওর আর্মস, শক্ত করে ধর । প্রেম কর আমার সঙ্গে । জানি আমি প্রায় চটা-ওঠা, তামাটে, নাক-নকশা ভালো নয় । হলেই বা তুই কোনো সিক্রেট কাল্টের জানগুরু, আমিও তো মানুষ, না কি, অ্যাঁ । সাধারণ মানুষের জন্য, দেশের জন্য, কিছু করার কাজে কি আমার কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ? ইতুর নিঃশ্বাসে তাপ । অমিতকে জাপটে বিছানায় শুয়ে ইতু বলল, তোর মনে আছে নিশ্চই তোর মা তোকে ভালোবাসা সম্পর্কে কী বলেছিলেন ? তবে ?
--অমিত বলল, মায়ের কথায় তো সঠিক উত্তর পাইনি । যতই যাই হোক, কেন মা-বাবা আমাকে, নিজের বাচ্চাকে, ফেলে চলে গিয়েছিলেন, আর কখনও পেছন ফিরে তাকাননি, তার সঠিক উত্তর আজও পাইনি ।
--অত-শত জানি না, আই অ্যাম নট গ্রেট লাইক দেম ; নিজের আর্জের কথা জানি । অবদমনের মানসিক অশান্তির কথা জানি ।
--এই বারই এত চাপ দিচ্ছিস কেন, ছমাস আগে তো এরকম বিহেভ করিসনি । আমার জন্যেই তুই সবায়ের দ্বারা অপমানিত হয়েছিলি। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর কার ছবি সামনে রেখে মিষ্টিবিষ্টি করতিস?
--আহাআআ, আহাআআ, মেয়েদের কোড ওয়র্ডটাও জানিস দেখছি । বেগুন ব্যবহার করতুম, বুঝলি । নারকেল তেলে ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ইনফেকশান হয় না । আর কিছু ? বিব্রত করার চেষ্টা করিসনি । তুই কার ছবি মনে করে মিষ্টিবিষ্টি করতিস ? কোনো ফিল্মস্টারের বোধহয় ?
--না, একটা বিশেষ অঙ্গ কল্পনা করে নিতুম, যা নেটে দেখেছি । একটু দেখতে দে না ।
--দ্যাখ, দেখে নে, ইউ বিট্রেয়ার, চোখের জলের আলোয় দেখে নে, ইউ মেনিমুখো কাওয়ার্ড ।
--মুখ দেবো ? আমার তো সিংহের কালো কেশর গজিয়েছে, দ্যাখ হাত দিয়ে ।
--তোর চোখের জলে ভিজিয়ে ওখানে মুখ দিবি, হাঁটু গেড়ে বসে । গেট অন ইওর নিজ । কাঁদ, ফোঁপা, তোর ফোঁপানি শুনতে চাই আমি, কাঁদ, কাঁদ, কাঁদ, ইউ আনগ্রেটফুল ডেজার্টার । অমিতের চুল দু’মুঠোয় ধরে বলল ইতু ।
ঘর্মাক্ত প্রেমের শেষে, প্রস্তুতির জন্য এনে-রাখা ওষুধের বড়ি গলায় ফেলে, বেডসাইড টেবলের গেলাস থেকে জল খেলো ইতু । বলল, ভিতুরা হল লাশের মতন, স্রোতের সঙ্গে ভাসে ; স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতরাতে শেখ, তোর অস্তিত্বে প্রাণ আছে কিনা তা প্রমাণ করতে হলে তোকে স্রোতের বিরুদ্ধে ননস্টপ হাত-পা চালিয়ে যেতে হবে।
--প্রথমবার প্রেম করতে গেলে যে ছড়ে যায়, জানতুম না, আমার ধারণা ছিল মেয়েদেরই ছেঁড়াছিঁড়ি হয়, বলল অমিত ; তারপর যোগ করল, এসেছিলুম এক রাত কাটিয়ে চলে যাবো, এই ভেবে ; তুই কি করলি জানিস? তুই আমাকে আইডেনটিটি দিলি, প্রেমিকের আইডেনটিটি, এ-ছাড়া আমার বলার মতো আত্মপরিচয় নেই । বাবা-মা বিসর্জন দিয়ে চলে গেল, তোদের বাড়ির লোকেরা যৌথ সম্পত্তিতে ভাগ বসাবো ভেবে দত্তক নিল না, পরিবারের অংশ বলে মনে করল না, প্রতি বছর আগের ছাত্রদের বই চেয়ে-চেয়ে পড়ে কোনো রকমে পাশ করতুম, স্কুলও ফালতু তকমা দিয়ে লাস্ট বেঞ্চে বসাতো । বাবা-মাকে যতটা বুঝেছি, ওনাদের কাছে আমি আরও হাজারখানেক কর্মীর একজন, গুরুত্বহীন । ওনারা যেসব তত্ত্বকথা আওড়ান, তা যে আমার জীবনে প্রযোজ্য, সেকথা ভুলে যান । বলতে-বলতে ছলছল-চোখ হয়ে গিয়েছিল অমিতের।
--তখন কাঁদতে বলেছিলুম, জাস্ট এ মোমেন্টারি রিভেঞ্জ, দ্যাট ওয়াজ এনাফ, আর ধ্যাড়াসনি, প্লিজ । কেন করলুম জানিস, বলল ইতু, তুই এবার আমাকে নিয়ে যেতে বাধ্য হবি । তুই তো কাল্ট মেম্বার, কমিটেড, ডেডিকেটেড, আদর্শবাদী, অ্যান্ড হোয়াটএভার, ফেলে পালাতে তোর দায়বদ্ধ বিবেক বাধা দেবে । আই থিংক সো । আমাকে ধোকা দিয়ে পালাতেও পারবি না, আমি দোতলাতেই জেগে থাকব সারারাত, পাহারা দেব । বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই, তারপর দেখা যাবে ছাড়াছাড়ি এটসেটরা, আই ডোন্ট কেয়ার, আমি একাই এনাফ । আর, গুছিয়ে বলি, তোর প্রাপ্য তোকে দিয়ে দিলুম, পরে দেয়া হয়ে উঠবে কিনা, দেবার সময়-সুযোগ হবে কিনা, তা তো জানি না ।
--অমন অদ্ভূত সব খুঁতখুতে শব্দ কোথায় পেলি ? না, তোকে ফেলে এবার পালাব না, পালাবার হলে আর আসতুমই না, তোদের বাড়ির গোমড়ামুখগুলো দেখতে ; পাহারা দেবার দরকার নেই, তুই জানিস তোর টান ছিন্ন করতে পারিনি । তুই এবার আমার সঙ্গে যাবি । তোর কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হয়ে গেছে । অকল্পনীয় কষ্টের জীবনে তোকে মানিয়ে নিতে হবে, শারীরিক কষ্টের । হয়ত পানীয় জল নেই, বিজলি বাতি নেই, শোবার ঘরবাড়ি নেই, প্রতিদিন খাবার জোটার সম্ভাবনা কম । পদে-পদে মৃত্যু ওৎ পেতে থাকতে পারে । সময়ে-অসময়ে ডাক্তারি করতে হতে পারে ।
--বাড়ির কুচুটে নোংরা স্বার্থপর জঙ্গলে বসবাসের পর আমি আফ্রিকার সিংহ আর হায়েনাদের জঙ্গলে গিয়েও থাকতে পারব ।
--জঙ্গলে নয়, ওরা সাভানার ঘাসভূমিতে থাকে ।
--হোয়াটএভার, ডোন্ট ট্রাই টু টিচ মি । তোর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করতুম ।
--কেউ কোথাও আমাকে চিনে ফেললে, তুই বলবি তুই আমার সঙ্গী নোস, কোনো একটা জায়গায় যাবার নাম করে বলে দিস বাবা বা কাকার বাড়ি যাচ্ছিস ।
--সে দেখা যাবে, কপি-পেস্ট সংলাপবাজি করিসনি । যখন অমন বিপদ আসবে তখন তার মোকাবিলা করব । তাছাড়া এটা পাটনা শহর। গয়া, নওয়াদা, সাসারাম, জেহানাবাদ, পালামউ নয় । এই শহরের জাতপ্রথার রাজনীতিকদের খেলা যতটা বুঝি, এখানে তোদের কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয় না ; অবশ্য খুনোখুনি হলে আলাদা কথা ।
--না, ওই লাইনে ভাবিসনি ।
--কোথায় যাব আমরা ? প্রশ্নটা এই জন্য করছি যে আমার যাবার সঙ্গে ইলোপ শব্দটা জুড়ে আছে ।
--তুই যেখানে যাবি সেখানে যারা থাকে তারা মুরিয়া মারিয়া মাড় গোঁড় । দশ-পনেরো বছর আগে পর্যন্ত ওদের যুবতীরা পোশাক দিয়ে বুক ঢাকত না, খালি গায়ে গয়না পরে থাকত । কোনো-কোনো গ্রামে পৌঢ়ারা এখনও খালি গায়ে থাকে, যখন খুব গরম পড়ে । অবশ্য ওদের খুচরো জনবসতিগুলোকে গ্রাম বলা যায় না, এক জায়গায় চাষবাস করে আবার জনবসতি অন্য জায়গায় তুলে নিয়ে যেত, সেখানে গিয়ে এক ঋতু চাষবাস করে আবার অন্য কোথাও বসতি তুলে নিয়ে যেত । ব্রিটিশ গবেষকরা লিখে গেছেন ওদের মাড় শব্দটা নাকি এসেছে বনের আগুন, মানে, পলাশ ফুলের নাম থেকে । আমার তা মনে হয় না, কেননা গাছটাকে তো ওরা পুজো করে না । তার তুলনায় মহুয়াগাছকে শ্রদ্ধা করে ।
--জঙ্গলমহলে ? ঝাড়খণ্ডের খবরও তো পড়ি কাগজে ।
--ওয়েস্ট বেঙ্গলে আর ঝাড়খণ্ডে কী গোঁড় বা মাড়িয়া উপজাতির মানুষ থাকে ? আমি যাদের কথা বলছি তারা পশ্চিমবাংলার মানুষ নয় । সিলেবাসের বাইরে একটু-আধটু সাধারণ জ্ঞানের বই-টই পড়তে পারতিস । তুই যাবি দণ্ডকারণ্যের দুর্ভেদ্য, প্রায় দুর্ভেদ্য, জঙ্গলে । অবুঝমাড় ।
--হ্যাঁ, অবুঝই ছিলাম এতকাল । অবুঝ জীবনে পড়ে-পড়ে মার খেয়েছি । তুই যাবি মানে ? তুই যাচ্ছিস না ? কিন্তু তুই ওরকম ব্লাডি মোরোনদের মতন বসে-বসে পা দোলাসনি ।
--এই তো বললি যে সাধারণ দুস্হ গরিব মানুষের সেবা করতে চাস । আমার থাকা-না-থাকার সঙ্গে তোর জীবনের উদ্দেশ্যকে কেন জড়াচ্ছিস ? আমার মা-বাবা তো আমাকে এখনও পুরোপুরি জড়ায়নি তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে, আলাদা দায়িত্ব দিয়েছেন ! আমি চিরকাল পরিত্যক্ত সন্তান থেকে যাবো, ফর দেয়ার কজ ।
--আমিও ইনডিপেন্ডেন্টলি কাজ করতে চাই, তোর লেজুড় হবো বলিনি । আমি কারোর লেজুড় হতে চাই না । কিন্তু তুই না থাকলে কী করে জানবো যে কোথায় যেতে হবে, কাদের সেবা করতে হবে ? হোয়াট অ্যাবাউট টাকাকড়ি ?
--গন্তব্য তো তোর, ঠিকই পৌঁছে যাবি । জানি তুই যথেষ্ট বোল্ড, আউটস্পোকন, সেল্ফ-মেড, এমনকি দুঃসাহসী । নিজেকে প্রয়োগ করে দ্যাখ-ই না । ভারতের এলোমেলো-হেলাফেলা মানুষদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হোক । টাকাকড়ির জন্য সুশান্তজেঠুর দরবারে ঢুঁ মারব ।
--ওকে, তবে তা-ই হোক । এবার থেকে আমিই আমার গন্তব্য । কারেক্ট, আমার উদ্দেশ্য আমি নিজে । জানি, গন্তব্যের লক্ষ্যে চলতে থাকা জরুরি, চলাটাই সফলতা, লক্ষ্যবস্তুটা নয় । আজ থেকে আমার কাছে যুক্তি আর যুক্তিহীনতার পার্থক্য রইল না । আর তো ভার্জিন থাকার বিড়ম্বনা রইল না যে আগের মতন ওয়ান-ডে প্রেমিকদের দুর্ভাবনায় সিঁটিয়ে থাকবো ।
ঘুমোতে যাবার আগে ইতু ড্রয়ার থেকে কাপড় কাটার কাঁচি এনে বলল, আমার আকর্ষণের কেন্দ্র বা ভ্যানিটি, যা-ই বল, তা হল আমার চুল, তুই তো জানিস, এই নে , ঘাড়ের কাছ থেকে ঘ্যাঁচাৎ করে কেটে দে দিকিনি ।
--ভ্যানিটি ? আকর্ষণের কেন্দ্র ? তা তোর সুরাহিদার গর্দন, ভারি পাছা আর নিটোল বুক ।
--শাট আপ, চাপলুসি করিসনি । হ্যাঁ, আমার বুক সম্পর্কে আমার গর্ব আছে । কিন্তু ওগুলো তো আর কেটে বাদ দিতে পারি না । চুল কেটে দিতে বলছি, কাট, এই নে ।
--এরকম দীর্ঘ চুল, পুরো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আ্ছে, তাকে বাদ দিয়ে দিতে চাইছিস ?
--হ্যাঁ, জাস্ট ডু ইট, কেটে ফ্যাল, এত বড়ো চুল বয়ে বেড়ানো যায় না । আমিও আর আয়নার মুখ দেখতে চাই না । যাদের মাঝে বড়ো হয়েছি, তাদেরই যদি বাদ দিতে পারি, তাহলে চুলটুকু কেন বাদ দিতে পারব না ?
চুল কাটতে গিয়ে অমিতের নজরে পড়ল মাথার শিয়রে স্যাঁতসেতে দেয়ালে সেলোটেপ দিয়ে একটা ইংরেজি পোস্টার লাগানো, ফ্যাকাশে, পুরোনো, ছেঁড়া । রঙিন হরফে লাইনের তলায় লাইন উদ্ধৃতি । চুল কাটার শেষে লাইনগুলো জোরে পড়ে ফেলছিল, ইতু বলল, মনে-মনে পড়, ওটা ডাকবাংলো রোডের ফুটপাথ থেকে কিনে এনেছিলুম । বেশ ভালো, না ? অমিত অনুবাদ করে পড়ল :
“কখনও নিজেকে গুরুত্বহীন মনে করবেন না
কখনও উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপন করবেন না
কখনও সদর্থক দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন না
কখনও শরীরে আরামের শিকড় গজাতে দেবেন না
কখনও নিজেকে অক্ষম মনে করবেন না
কখনও অসন্তোষে আপ্লুত হয়ে নিজের সঙ্গে মনে-মনে কথা কইবেন না
কখনও আত্মাভিমান বর্জন করবেন না
আনন্দের মুহূর্ত ছোট্ট হলেইবা তাকে সযত্নে উপভোগ করুন”
চুলের কাটা গোছাটা ইতুর হাতে দিয়ে অমিত ইতুর মুখের দিকে অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ে তাকাতে, ইতু বলল, হ্যাঁ, জানি, আমার মুখময় ওই কথাগুলো লেখা আছে, বহুকাল, পাঁচ বছরের বেশি, লেখা আছে, মগজে গেঁথে গেছে ইন ফ্যাক্ট । এতক্ষণে বোধহয় তুই আমার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলি । ভাগ্যিস চুলটা কাটতে বলেছিলুম, নয়তো ওদিকে তোর চোখ যেত না ।
রাত দুটোয় তিনতলার ঘর থেকে নেমে দোতলার বারান্দায় ইতুর বিছানায় অমিত মশারি তুলে ঢুকতে গেলে, ইতু বলল, তুই যে আসবি জানতুম, তোর ভয়কে যে কাবু করতে পারলি, দ্যাখ, আমার কাছে নেমে আসাই তার প্রমাণ, আরো বড়ো প্রমাণ যে তুই জামাকাপড় খুলেই নেমে এসেছিস । তোর কাওয়ার্ডাইস থেকে তোকে বের করে আনার জন্য আমাকে কী করতে হল, ভেবে দেখেছিস ? তুই আসবি জানতুম বলে আমিও শাড়ি-টাড়ি খুলে শুয়েছিলুম । দাঁড়া, এই খাটে আওয়াজ হয়, নিচের তলায় শোনা যায় । তিনতলার ছাদে চল, খোলা আকাশের তলায় শাড়ি পেতে সুহাগ-রাত করব । দ্বিতীয়বার আকুতিময় শ্বাসের ঘনঘটা আর স্পন্দনের লেনদেন শেষ হলে ইতু ওর দোতলার বিছানায় ফিরে যেতে যেতে বলল, স্কাউন্ড্রেল, কি তোড়ু লাভমেকিং করলি, বুকে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিস, হারামি কোথাকার ; তূরীয়-মুহূর্তে সিংহরা সিংহীর মাথায় দাঁত বসায়, বুকে নয় ।
ভোরবেলা বাড়ির লোকেরা জাগবার আগেই সদরের ছিটকিনি আলতো খুলে বেরিয়ে পড়েছিল দুজনে । কাঁধের ঝোলায় স্টেথোস্কোপ, মশার কামড়ের প্রতিষেধক মলম, কয়েকটা জরুরি ওষুধ, এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন, গামছা , পেনসিল টর্চ, এক সেট ডেনিম ট্রাউজার আর কটন-টপ পুরে নিয়েছিল ইতু ; পায়ে জগিং করার কেডস । রাতের নোংরা হয়ে যাওয়া শাড়ি-শায়া আর চুলের গোছা দোতলার বিছানার ওপর ফেলে রেখে গেল, যাতে বাড়ির সদস্যরা আঁচ করতে পারেন যে ওরা দুজনে ষড় করে বাড়ি থেকে পালিয়েছে ।
জানার পর আর ওনারা ইতুর খোঁজ করবেন না, জানে ইতু ।
ইতুর পালানোর চাটনি-রসালো সংবাদ বাড়ির সদস্যরা শুনলেন কাজের বউয়ের মুখে । সকালে দরোজা খোলা পেয়ে সে অনুমান করেছিল যে বড়কর্তা প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে থাকবেন । তিনতলার ছাদে ইতুর ঘর থেকেই ঝ্যাঁটানো আর পোঁছা আরম্ভ করে । দেখলো ইতুদি বিছানা তোলেনি, দোতলাতেও আসার সময়ে দেখে এসেছে খাটের ওপর বিছানা গোটানো নেই, তার বদলে পড়ে আছে ইতুদির শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ । আর অনেকখানি চুল, দেখলেই বোঝা যায় ইতুদিদির চুল, বাড়িতে আর কারোর চুলই অমন কোঁকড়া আর লম্বা নয় । শাড়ি তুলে তাতে অতিপরিচিত আঠা দেখে, নাকের কাছে এনে মোহক গন্ধে আতঙ্কিত হয়ে উঠল বিহারি কাজের ব্‌উ রুকমিনি ।
কাজের বউয়ের হাঁক, ইতুদিদি বিছৌনা তোলোনি কেন আজকে, ঘরে বসে খেয়েছ, বাসনও ফেলে রেখেছ, কলতলায় নিয়ে গিয়ে রাখেনি, ইতুদিদি, ইতুদিদি..
বাড়ির মেজবুড়োর কন্ঠস্বর শোনা গেল, ইতু ওপরেই আছে দ্যাখ, দোতলায় এখনও মশারি ফেলে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ডেকে তোল । ইতুর ঘরে একজন অতিথি আছে, টয়লেটে গিয়ে থাকবে, অমিত, আমাদের বাড়িতে থাকত আগে, তুই বোধহয় দেখিসনি, সৌদামিনী কাজ করত তখন ।
রুকমিনি টয়লেটে-বাথরুমে ঢুঁ মেরে দেখল ফাঁকা, কেউই নেই । চেঁচিয়ে বলল, কেউ নেই, অতিথিও নেই, দোতলার বিছানায় ইতুদিদিও নেই । শাড়ি-শায়া-বেলাউজ পড়ে আছে, সঙ্গে ওনার কাটা চুল ।
রুকমিনির হাঁকডাকে, যে হাঁকডাকে শাড়ি-শায়ায় আঠামাখা গন্ধের প্রচ্ছন্ন আহ্লাদ ছিল, শুনে, বাড়ির অধিকাংশ সদস্য, বৃদ্ধরা ছাড়া, দৌড়ে প্রথমে দোতলার বিছানায় দোমড়ানো শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ-চুলের গোছা আর তারপর তিনতলায় পৌঁছোলে, রুকমিনি পান-খাওয়া দাঁতে হাসি মাখিয়ে যখন বলল যে বাড়ির সদর দরজা খোলা ছিল, তখন সকলে ঠাহর করতে পারল যে ইতু অতিথির সঙ্গে উধাও হয়েছে ।
--বিয়ে দিলে না তোমরা সময় মতন, পালাবে না তো কি করবে ? বললেন সেজকর্তার গোলগাল ভারিভরকম স্ত্রী, সাতসকালে ওজনদার শরীর নিয়ে বাতের ব্যথা সত্ত্বেও তিনতলায় হাঁটু ভেঙে উঠতে হয়েছে বলে যিনি ক্লান্ত, হাঁপাচ্ছিলেন ।
--অমিতের সঙ্গে ওদের সম্বন্ধটা করে ফেললেই হতো, তোমরাই অযথা ছেলেটার মা-বাবার সম্পর্কের প্রসঙ্গ তুলে মেয়েটার জীবন গোলমাল করে দিলে । সুযোগ পেয়ে বলে নিলেন রাঙাকাকি । ওরা ভাইবোন নাকি ? তোমরা ভাইবোন-ভাইবোন আওড়াতে লাগলে । এখন হল তো সেই-ই ।
--যাক ভালোই হল একদিক থেকে, দায়িত্বটা বড় খচখচ করত এদান্তি । বললেন মেজকর্তা ।
মেজকর্তার দুই যমজ নাতি, পাঁচে পড়েছে সবে, যাদের মা, মানে মেজকর্তার বড় ছেলের স্ত্রী, ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে, নাতিরা একযোগে চেঁচিয়ে উঠল, ঘরটা আমরা নেবো, আমাদের নিজেদের ঘর নেই, পড়াশোনার ডিসটার্বেন্স হয়, একতলার বারান্দায় বড্ড চেঁচামেচি করে সবাই ।
--পড়াশুনোর নামে নিজেদের ঘর মানে তো দেয়ালে সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে জেনিফার লোপেজ. লেডি গাগা আর কাটরিনা কাইফের ব্লোআপ, সৌরভের হাফ-টেকো পোস্টারটা বদলে ফেলিস, এখন ওর মাথায় আবার চুল গজিয়েছে । বললে দুই খোকাটে নাতির বাবা, পরোক্ষে তাদের দাবির সমর্থনে । দুই নাতির দিকে তাকিয়ে মুখে পানপরাগি-হাসি খেলালো রুকমিনি ।
ইতুর পলায়নে তৃপ্ত অভিভাবকরা সিঁড়ির ধাপে চোখ রেখে, এক-পা দু-পা করে নেমে চলে গেলেন যে যার ঘরে । নাতি দুজন তিনতলার ছাদের ঘরে ঢুকে ইতুর আর ইতুর আগে ওদের বাবার চাকরানি-প্রেমী যৌনতার স্মৃতিকে নিশ্চিহ্ণ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ।
--চুলটা আমি নিচ্ছি , খোঁপার ভেতরে ঢুকিয়ে বানখোঁপা বাঁধলে বেশ ভালো দেখাবে । নেবো তো ? জিগ্যেস করল রুকমিনি, নেমে যেতে থাকা সিঁড়ির উদ্দেশ্যে ।
--নিয়ে নে, বিছানার ওপর যা শাড়ি-টাড়ি আছে সেগুলোও যাবার সময় নিয়ে যাস ।
--আর যেগুলো ইতুদিদির আলমারিতে আছে ?
--নিয়ে যাস সময় করে, কিন্তু গিটারটা নিসনি যেন, ওটা নবনীতার, ফাইনাল ঝগড়া করবে বলে রেখে গেছে । জবাব দিল নামতে-থাকা সিঁড়ি ।
রুকমিনিকে রাখা হয়েছে তার আগের কাজের বউ সৌদামিনির সঙ্গে দুই নাতির বাবা সমরেন্দ্রর আঠালো সম্পর্ক ধরা পড়ে যাবার পর । সৌদামিনির সঙ্গে দুপুরে বিছানায়, ওদেরই বিছানায়, দুই নাতি তখন শিশু, সমরেন্দ্র রঙ্গিলা-রতির ম্যাটিনি শো করছিল । শিশুদের দেখাশোনার জন্যই রাখা হয়েছিল সৌদামিনীকে, যার বর আরেকটা বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে গেছে হরিয়ানার খেত-খলিহানে কাজ করতে । সমরেন্দ্রর বউ নবনীতা অনুমান করেছিল যে কিছু একটা গোলমাল চলছে, কেননা যখনই সৌদামিনীকে বকুনি দেয় নবনীতা, তখনই সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে সমরেন্দ্র ঝগড়া করত নবনীতার সঙ্গে । একবার তো নবনীতার গালে চড় কষিয়ে দিয়েছিল সমরেন্দ্র, শিশু দুটোর কান্না সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে শুনে অফিসের পোশাকেই সোজা তিন তলার ছাদের ঘরে পৌঁছে দ্যাখে বাচ্চা দুটো গুয়েমুতে মাখামাখি । যে ডায়াপার নবনীতা পরিয়ে গিয়েছিল, দুটো বাচ্চাই সেগুলো পরে আছে, আলগা ডায়াপারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে গুয়ের স্রোত ।
নবনীতা সৌদামিনিকে বকুনি দিতে, বুকে কাপড় চেপে ও সমরেন্দ্রর দিকে চোখ কুঁচকে তাকালে, সমরেন্দ্র সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে বলেছিল, কত কাজ করবে ও, সারা বাড়ির ফাই ফরমাস, তারপর দু-দুটো বাচ্চা সামলানো ।
--ও, কাজের বউ তার মালিকের মুখ নিজের বুকে গুঁজে খাটছিল, তাই না ? দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল নবনীতা।
--ও তুমি বুঝবে না, যাদের হৃদয় বড়ো হয় তাদের বুকের মাপও বড়ো হয় । সমরেন্দ্রর উত্তর ।
--হৃদয় বড়ো না ছোটো তা বিয়ের আগে তো আন্দাজ করে থাকবে ?
--তখন তো দেখে মনে হয়েছিল হৃদয় যথেষ্ট বড়ো । তা যে নকল কী করে জানব ?
--নকল হৃদয়ের সুধারস পান করার সময় তো উচ্ছ্বসিত হতে ।
হাঁ করে তাকিয়ে থাকা সৌদামিনীকে বুঝিয়েছিল সমরেন্দ্র, হৃদয় মতলব দিল, যিস অওরতকা দিল জিতনা বড়া, উস অওরতকা ছাতি ভি উতনাহি বড়া হোতা হ্যায় ।
সমরেন্দ্র যখন ডিউটি আওয়ার্স পালটে রাতের শিফট নিল, সন্দেহে জারিত নবনীতা সেদিনই নির্ণয় নিয়েছিল যে ব্যাপারটাকে এবার ট্যাকল করতেই হবে । একদিন অফিস যাবার নাম করে অফিসে না গিয়ে বন্ধুদের বাড়িতে সময় কাটিয়ে দুপুর বারোটা নাগাদ পা টিপে-টিপে ওপরে উঠে দরোজা আলতো ফাঁক করে দ্যাখে সৌদামিনি আর সমরেন্দ্র দুজনে উলঙ্গ হয়ে ঘুমোচ্ছে বিছানায় । তিনতলার ছাদে কেউ আসে না ভেবে ওরা দুজনে বেপরোয়া হয়ে গিয়ে থাকবে, তাই দরোজা বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করেনি ।
বড়জেঠি আর রাঙাকাকিকে চুপচাপ ডেকে এনে, দরোজা ঠেলে, সৌদামিনী পর্বের শেষ দৃশ্যের অভিনয় নবনীতা দেখিয়ে দিয়েছিল ওনাদের । তাৎক্ষণিক ঝগড়া, বড়ো-হৃদয়ের প্রাপ্তি সম্পর্কিত বুকের আদল, ইত্যাদি প্রগাঢ় মন্তব্য । তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে নবনীতা সোজা বাপের বাড়ি, কয়েকদিন পর ডিভোর্সের নোটিস, ব্যাস। সমরেন্দ্র চালান হল দুই শিশুর সঙ্গে একতলায়, কেননা শিশুদের দেখাশোনা যাঁরা করবেন তাঁদের একতলা-তিনতলা করার ক্ষমতা ছিল না ।
ইতু পেয়ে গেল ঘরটা । রুকমিনি পেয়ে গেল চাকরি ।
সমরেন্দ্র আর বিয়ে করেনি । এখনও নাইট ডিউটি করে । দুপুরে বেরিয়ে যায় খেয়েদেয়ে, যেখানে যায় সেখান থেকেই নাইট ডিউটি করতে চলে যায় । বাড়ির সবাই জানে কোথায় যায় । রুকমিনি পেছন-পেছন গিয়ে দেখে এসেছে, সৌদামিনীর বস্তির ঘরে ঢুকছে সমরেন্দ্র । সৌদামিনীর তিন মাসের বাচ্চাটা যে সমরেন্দ্রর তাতে কোনো সন্দেহ নেই, অত চেকনাই-মার্কা বাচ্চা কী করেই বা হবে ! সৌদামিনী সাঁওলা ওর পালিয়ে-যাওয়া বর কালো । বাচ্চা চেকনাই-মার্কা বলে সৌদামিনীর কত গর্ব, রুকমিনিকে বলেছিল, এরকম খোকা-বাচ্চা তোর কোনো কালেই হবে না ; পারিস তো করে দ্যাখা । অটোতে বসিয়ে সৌদামিনীকে কুর্জি হোলো ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সমরেন্দ্র, বাচ্চা হবার সময়ে, ফর্মে বাপের জায়গায় নিজের নামই লিখেছে, রুকমিনিকে জানিয়েছে সৌদামিনী, নিজের স্কুটারের পেছনে বসিয়ে পোলিও ড্রপস খাওয়াতে, ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায় ওর বাংগালি আদমি, সাচ্চা দিলওয়ালা ।
সমরবাবু বাচ্চাটার খাওয়াপরার খরচ দ্যায় আর বলেছে বড়ো হলে ওকে ভালো আংরেজি স্কুলে পড়াবে ।
--কী করে শুরু হল তোদের প্যার-মোহোব্বত ? জানতে চেয়েছিল রুকমিনি ।
--বাচ্চা দুটো একদিন ভিষণ কাঁদছিল, একেবারেই চুপ করছিল না, কী করব ভেবে পাচ্ছিলুম না, তো সমরবাবু বলল, তোর দুই বুকে বাচ্চা দুটোর মুখ গুঁজে দে না, তোর বুক তো নবনীতা মেমসাবের চেয়ে বড়-বড় । আমি বললুম আমার বুকে তো দুধ নেই, ওরা কি হাওয়া খেয়ে চুপ করবে ? জবাবে সমরবাবু বললে, বাচ্চারা যেভাবে চুষিকাঠি চুষে ঘুমিয়ে পড়ে, তুই ওদের মুখে তোর বুক গুঁজে দ্যাখ চুপ করে যাবে, ঘুমিয়েও পড়বে । সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল বাচ্চা দুটো । সমরবাবু আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল । আমি বললুম, আমি রোজ-রোজ একাজ করতে পারব না । সমরবাবু জিগ্যেস করল, কেন, তোর অসুবিধা কিসের । আমি বললুম, বাচ্চারা আমার বুক চুষলে গা থিরথিরিয়ে যায়, মনে হয় কাউকে জড়িয়ে ধরি । তা সমরবাবু তক্ষুনি আমায় জড়িয়ে ধরলে পেছন থেকে আর বললে, যখনই তোর শরীর থিরথিরোবে, আমাকে বলবি, আমি শান্ত করে দেব । তারপর তো সমরবাবু দিনের বেলার অফিসের ডিউটিকে রাতের ডিউটি করে নিলে, আমরা দুজনে মিলে বাচ্চা দুটোকে ঘুম পাড়িয়ে, নবনীতা দিদির বিছানায় শুয়ে পড়তুম । কত রকম ভাবে প্যার-মোহোব্বত করতে পারে সমরবাবু ; কাঁইচিমার মোহোব্বত করতে শিখিয়েছে । চুল ওঠাবার কিরিম, বগলের পাউডার, বুকের কিরিম, গায়ে গন্ধমাখার গ্যাসের টিন, শ্যাম্পু, লিসটিপ, প্যার-মোহোব্বত করতে গেলে এসব জিনিস কত দরকার তা সমরবাবুর চেয়ে ভালো কেউ জানে না । নবনীতা দিদি জানবার পর আমাকে যখন বকুনি দিচ্ছিল, সমরবাবু নবনীতাকে গালে কষে দিয়েছে এক থাপ্পড়, এইসান, ধাঁয় । ওনাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, আমি সমরবাবুকে পেয়ে গেলুম, এখন আমি ডবল মাইনে পাই, কাজও করতে হয় না ।
ডিভোর্স দেয়া সমরেন্দ্রর বউ নবনীতা এখন নিজের মারুতি গাড়ি চেপে অফিস যায়, নিজে চালায় । বলেছে, যাদের বাড়ির পদবি নিয়ে বাচ্চা দুটো জন্মেছে, তারাই মানুষ করুক । সৌদামিনীকে স্কুটারে পেছনে বসিয়ে, রাজপথে নবনীতার গাড়ি দেখতে পেলে, তার পাশাপাশি চালায় সমরেন্দ্র । নবনীতার দিকে বাচ্চাটাকে তুলে দেখিয়েছে সৌদামিনী, বত্রিশপাটি হাসি ফুটিয়ে । সেই ঘটনার পর, আইনত নিষিদ্ধ হলেও, গাড়ির কাচে কালচে সানফিল্ম লাগিয়েছে নবনীতা ।



আট
ইতুকে দেখে অবাক হননি সুশান্ত ঘোষ, কেননা ইতু বাসে বসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে গর্দানিবাগের বাড়িতে অমিত বর্মণ এসেছে আর ও আজকেই অমিতের সঙ্গে পালাচ্ছে, সুশান্তজেঠুর বাড়িতে যাবে, বাসস্ট্যাণ্ডে সুশান্তজেঠু যেন ওদের নিতে আসেন । তার আগে সুশান্তর বড়জেঠি, মানে ইতুর বটঠাকুমা, ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, দ্যাখ ইতু আর তোর ছেলেবেলাকার বন্ধু অতনুর ছেলে অমিত তোর বাড়ি পৌঁছোল বলে, এখানে হইচই ফেলে চলে গেছে, যা করেছে একশবার ভালো করেছে, ওদের মুখেই শুনিস ।
বাসস্ট্যাণ্ডে বোলেরো নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সুশান্ত ঘোষ। দিয়ারায় পৌঁছে, পটলের পাহাড়, তরমুজ-শসা-ফুটির ডাঁই দেখে ইতু বলল, এ তো বেশ ভালো জায়গা গো, ভিলেজ-ভিলেজ টাইপ, যেমন টিভিতে দেখি । দিনকতক থেকে গেলে হয়না এখানে ?
--না না, প্রায় আঁৎকে বলে উঠল অমিত, যত তাড়াতাড়ি কেটে পড়া যায় ততই সবায়ের মঙ্গল ।
--ঠিক আছে, যাসখন, কালকে সকালে তোদের জন্যে নৌকো করে দেব । আজকে রেস্ট নিয়ে নে । আমরা কি খাই কোথায় শুই এসব দেখে যা । আমাদের জীবন কম রঙিন নয় । আমার বউ, শশুর, শাশুড়ির সঙ্গে আগে পরিচয় করিয়ে দিই তোদের ।
--হ্যাঁ, আমি তো আজ পর্যন্ত তোমার শশুরমশায়কে দেখিনি, শুনেছি যে উনি গর্দানিবাগের বাড়িতে এসে তোমাকে ফেরত দেবার জন্য দশ লাখ টাকা চেয়েছিলেন ।
--উনি যখন জেঠা-বাবা-কাকার কাছে র‌্যানসাম চাইতে গিয়েছিলেন, তার আগেই বেবির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। উনি জানতেন যে বাবা-জেঠারা ফোতো-বড়োলোক, আর দশ লাখ টাকা দেবার মতো ক্ষমতা বাবা আর জেঠাদের নেই ।
অমিত বলল, তোমার লাইফটা আনবিলিভেবল । অ্যাডভেঞ্চারস ।
--এখানে এসে টের পাচ্ছি গো, কী ধরনের বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছ নিজের জীবনে । ইতু বলেছিল ।
সুশান্ত, এই যে আমার বউ বেবি, বলতে, একজন ঢ্যাঙা কালচে কৃশতনু যুবতী, দেখলেই বোঝা যায় সাজগোজ করে পারফিউম মেখে এলো, অমিত আর ইতুর পায়ে দুহাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল । সুশান্তর বউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করল ইতু, কেঁপে-কেঁপে কাঁদতে লাগল । ইতু বলল, হিন্দিতে, তুমি আমাদের পায়ে হাত দিচ্ছ কেন ? বয়সে তুমি আমাদের বড়ো, তুমি তো আমার জেঠিমা হও ।
বেবি : এই প্রথম শশুরবাড়ির লোক আমাদের বাড়ি এলো । শশুর শাশুড়িকে তো দেখিনি ; তাদের প্রণাম তোমাদের পায়ে রাখলুম ।
সুশান্তর শশুর তারিণী মণ্ডল আর শাশুড়ি মন্হরা দেবী ইতুদের আসার খবর পেয়ে হাজির হলে, ছফিটের ঋজু পালোয়ানি কালো তারিণী মণ্ডলকে দেখে ইতু বলে ফেলল, তোমার শশুর তো একেবারে কোমোডো ড্র্যাগন গো, সেরকমই জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছেন । বলে ফেলে, বলল, সরি , ওনাকে দেখে বেফাঁস বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।
--বেফাঁস বেরোয়নি, উত্তর দিল সুশান্ত, তারপর যোগ করল, ইতু তোর অবচেতনে ওনার সম্পর্কে যে ভীতি জমে আছে তা থেকেই বেরিয়ে এলো কোমোডো ড্র্যাগনটা । ঘাবড়াসনি, উনি কোনো ড্র্যাগনের কথাই জানেন না, নিজেকে ছাড়া ।
তারিণী মণ্ডলের শাশুড়ি বলল, এতদিন পরে আত্মীয়দের সঙ্গে জামাইবাবার খাঁটি বাংলায় কথা বলার সুযোগ হল । বলে নাও, বলে নাও, তারপর আমাদের পালা । অমিত-ইতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার নাতিও বাংলা, আংরেজি, হিন্দি, ভোজপুরি, মৈথিলি বলতে পারে ।
তারিণী মণ্ডল গমগমে কন্ঠস্বরে গর্ব ঝরিয়ে বলল, আমার নাতি বাংলা বলতে, লিখতে আর পড়তে পারে। ইংলিশে কথা বলতে পারে, একদম আংরেজ পলটন জইসন ।
বেবির প্রশ্নাতুর ভ্রু দেখে অমিতের মনে হল, এনারা বোধহয় প্রণাম বা নমস্কার আশা করছেন ওদের তরফ থেকে ; বেবি এসেই ঝপ করে দুজনের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে । ইতু নির্ঘাত প্রণাম করতে চাইছে না, হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করতেও ওর বাধো-বাধো ঠেকবে, একে বিহারি তায় আবার শিডুলড কাস্ট, হয়ত জীবনে কোনো বিহারির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেনি । হাতজোড় করে নমস্কার করাটাও বিসদৃশ । অমিত আচমকা সবাইকে অবাক করে দিয়ে মুঠো পাকিয়ে নির্বাক রেড স্যালুট দিল সুশান্তর শশুর-শাশুড়িকে । দেখাদেখি ইতুও তাই করল ।
তারিণী মণ্ডল বলল, চাবস চাবস, এই তো চাই, নেতাজির মতন স্যালুট দেবে, বলে, সুভাষচন্দ্র বসুর নাম উচ্চারিত হলেই যা করে থাকে, উরুতে চাপড় মেরে বিব্রত করল নিজের জামাই আর তার অতিথিদের । মন্হরা দেবী বেবিকে হুকুম দিল, এই বেবি, আজকে ওদের জন্য একটা কচি শুয়োর কাটতে বল, গরম-গরম শুয়োরের মাংস আর পুদিনার চাটনি দিয়ে ভুট্টার রুটি খেয়ে যাক ।
শুয়োরের মাংস খেতে হবে শুনে অমিতের কব্জি আঁকড়ে ফেলেছিল ইতু । অমিত ফিসফিস করে বলল, যেখানে যাচ্ছ সেখানে হয়ত মহুয়ার রুটি আর ভাল্লুকের মাংস খেতে হতে পারে । পরে, নৌকোয় করে যাবার সময়ে, ছইয়ের ভেতরে বসে, নদীর ছলাৎছলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অমিত গল্প করেছিল মুরিয়া, মাড়িয়া, গোঁড় উপজাতিদের জীবন নিয়ে । অবুঝমাড়ের পাহাড়ি মানুষদের বিভিন্ন গোষ্ঠীদেবতা আছে । নাগবংশ, যারা কেউটে সাপের পুজো করে বলে কোনো সাপ খায় না, মরা সাপ দেখতে পেলে সেদিন শোক পালন করে গোষ্ঠীর সবাই । তেমনই আছে কাছিমবংশ, বকরাবংশ, বাঘবংশ, আর বোধমিকবংশ, মানে মাছের বংশ ।
--হ্যাঁ, তাহলে আজকে থেকে অভ্যাস করে নিই । বমি পায় পাক, বমি করতে-করতে তো পোয়াতিরাও অভ্যস্ত হয়ে যায় ; প্রসবের অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগে বারবার বাচ্চার জন্ম দেয় । ইতু বলল ফিসফিসিয়ে । শুয়োরের মাংস তবু খেলো না ইতু, বলল, এখন পারছি না, ক্রমশ অভ্যাস করব । সুশান্তর ঘরে খেতে বসে বেবির দেয়া সিম আর ফুলকপির আচার দিয়ে মকাইয়ের রুটি খেলো । বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডের বডি পারফিউম দেখে ইতু বলল, তুমিও তো তোমার এই জীবনে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারোনি দেখছি ।
বেবি : ওই সব গ্যাসগুলো নাআআআ ? ফিকফিকে দাঁতে বলল বেবি, ডেওডেরেন্টের দিকে তাকিয়ে ইতুকে কথা বলতে দেখে, ওই গ্যাস আমার গায়ে না মারলে আমার ঘুম আসে না ।
ইতু : কার ঘুম আসে না ? তোমার না আমার জেঠুর ?
বেবি : আমাদের দুজনেরই । তুমি নিয়ে যাও না কয়েকটা গ্যাস, বেশ ভালো লাগবে । দুজনে ঘুমোতে পারবে ।
--আর ওই কসমেটিকসগুলো ? বউকে তো হাল ফ্যাশানের সাজগোজের জিনিস কিনে দাও দেখছি, বলল ইতু ।
--আমি কিনে দিই না, বেবি টিভিতে দ্যাখে আর কিনতে লোক পাঠায় । বলল সুশান্ত, শুয়োর মাংসের বড়ার ঢেঁকুর তুলে ।
--সুশান্তজেঠু তোমার কাছে যদি থাকে তো তুমি ইতুকে মশা থেকে বাঁচার ক্রিম দিতে পারো, গিয়েই হয়তো অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না । অমিতের প্রস্তাব ।
--আমি নিয়ে নিয়েছি সঙ্গে, কোথায় থাকবো শোবো কিছুই তো জানি না, প্রথম-প্রথম লাগবে । ওষুধ-বিষুধও নিয়েছি ।
--অ্যালোপ্যাথিক ? প্রশ্ন করল অমিত ।
--হ্যাঁ, হারবাল মেডিসিন তোদের চারপাশ থেকে যোগাড় করে নেব ।
--তোর দলের ডাক্তারের অভাব পুরণ করে দিল ইতু। বলল সুশান্ত ।
--তোমার ছেলের নাম কি গো, গর্দানিবাগে তোমরা যখন এসেছিলে, আমি ছিলুম না ? জানতে চাইল অমিত ।
--অপু, সুশান্ত বলার আগেই জবাব দিল ইতু ।
--ওর নাম আপ্রাধি ঘোষ, বলল বেবি, অপু আর নাম এই শব্দ দুটো থেকে প্রশ্নটা অনুমান করে ।
সুশান্ত বলল, সামান্য হেসে, বেবি টের পাবে না এমন করে, ওর দাদুর মতে মহাকবি বাল্মিকী ছিলেন ওনার মতনই অপরাধী, তিনি যদি পূজিত হন, তাহলে কারোর নাম অপরাধী হলে সে পূজিত হবে না কেন । এরা সবাই জানে যে আমার ছেলের নাম আপ্রাধি : আমি স্কুলে ওকে অশ্বমেধ নামে ভর্তি করেছি, স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট, বি এ পাশের ডিগ্রিতে আমার দেয়া নামটাই আছে । ছেলেকে বলা আছে যে এ-কথা এনাদের কাছে ফাঁস করার প্রয়োজন নেই, ওনারা যে নামে ডাকতে চান ডাকুন, পরিচয় করাতে চান, করুন ।
--তুমি কিন্তু একেবারে বদলে গেছ, তাই না, উচ্চমাধ্যমিক দেবার পর বাড়ি ছেড়ে ? অমিতকে বলল সুশান্ত । ইতুর কাছে শুনলুম এন জি ওতে ঢুকে দেশোদ্ধারের কাজ নিয়েছ।
--দেশোদ্ধার ? এই দেশের ব্যবস্হাকে আমূল উপড়ে না ফেললে, কারোর উদ্ধার হবে না । বাবার আওড়ানো বুলিকে, প্রয়োগ করল অমিত, তারপর বলল, তুমিও তো অন্যমানুষ হয়ে গেছ , দেখে মনে হচ্ছে, নিজের মতন করে শোষণের বিরুদ্ধে লড়ছ ।
--না আমি সেই লোকটাই আছি, কেবল অভ্যাসগুলো পালটেছে । টাকাকড়ি করার লোভ ছিল, তা করেছি, আয়েস করার লোভ ছিল তা করছি । মানুষের ওপর আধিপত্যের নেশাই আলাদা, ও তুমি বুঝবে না, কারোর বিরুদ্ধেই লড়ছি না ; আর শোষণের বিরুদ্ধে ? কই ? বরং শোষকের সিংহাসনে বসে পড়েছি হে । শোষিতরা শোষকের আনন্দের মজা বুঝতে পারে না । ধার্মিক গুরুদের দেখেছ তো ? অনেকটা সেরকম । নিজেকে নিঃশব্দে বললেন, আমি আমার বিরুদ্ধে লড়ছি ।
--ঈশ্বরে বিশ্বাস এটসেটরা হিন্দুগিরি করছ নাকি, চারিপাশে তাকিয়ে টের পাচ্ছি । রসুন, পেঁয়াজ, আদাবাটা, বেসন মাখানো, হামান দিস্তেতে থেঁতো করা শুয়োরের মাংসের বড়ে খেতে-খেতে বলল অমিত ।
--ইসওয়র নাআআআআ ? ছট পুজা করতে হ্যাঁয় ইনকে খাতির, বলে, সুশান্তর দিকে ইঙ্গিত করল বেবি ; আপ ভি কিজিয়েগা ইতু দিদি, আপকে আদমি কা লমবিইইইই জিন্দগি কে লিয়ে ।
--ঈশ্বর ? ইউ মিন গড ? ইয়েস, গড ইজ ওমনিকমপিটেন্ট ওমনিপ্রেজেন্ট । আই অ্যাম গোইং টু গেট হিম ইরেজড ওয়ান ডে, ওনার অবসান পৃথিবীতে অবধারিত । বক্তব্য রাখতে গিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন সুশান্ত ।
--বদলাওনি দেখছি, বলল ইতু, আগে গর্দানিবাগের বাড়িতে যেমন বলতে, তেমন ধরনের কথাই বলছ, ভগবানের ওপর বেশ চটে আছ, তাই না ? এখন আর কি, এখন তো তুমিই-ই ভক্তের ভগবান, দেখতেই পাচ্ছি এসে অব্দি ।
--হ্যাঁ, শুধু ঈশ্বর বদলে-বদলে যেতে থাকে । তারপর জিগ্যেস করলেন, আমার আর অতনুর বন্ধুবান্ধব, যেমন অরিন্দম মুখার্জি , মৌলিনাথ, মাহমুদ জোহের, এরিক পেজ, মলয় রায়চৌধুরী, ওদের খবর জানিস নাকি ইতু ? দেখা-সাক্ষাৎ হয় ? সবাই বুড়ো হয়ে গিয়ে থাকবে বোধহয় ; আমিই কেবল যুবক থেকে গেলুম, বেবি আর বেবির বাবা-মায়ের খাঁচার খাবার-পানীয় সেঁটে ।
--তোমাদের অফিসের শ্যামলী কর্মকারকে মনে আছে ? যার পিঠে শিরদাঁড়ার দুপাশে জড়ুল, যেন প্রজাপতির ডানা, দেখাবার জন্য পিঠখোলা ব্লাউজ পরেন ? ওনার মেয়ে তো আমার বন্ধু । সব খবরই পাই । অরিন্দম ওনার সাঁওতাল গার্লফ্রেণ্ডের সঙ্গে কার অ্যাকসিডেন্টে পুড়ে মরে গেছেন, কলকাতায় । মৌলিনাথ কিডনি ফেল করে মরে গেছেন, কলকাতায় । মাহমুদ জোহের দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন, করে, সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পা ভেঙে হুইলচেয়ারে জীবন কাটাচ্ছিলেন ; একদিন এক যুবক এসে মাহমুদ জোহেরের চোখের সামনেই ছোরা মেরে-মেরে ওনার দ্বিত্বীয় বউটাকে মেরে ফেললে, পাটনায় ; যুবক ছিল দ্বিতীয় বউয়ের প্রেমিক ।
--সে কি !
--হ্যাঁ গো । এরিক পেজ পাগল হয়ে গেছেন, বাড়িতে ওনাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে, মোকামায় ; শুনেছি যে যখন বেশি চেঁচামেচি-গোলমাল করেন তখন ওনার হাতে একটা ব্রিটিশ আমলের রুপোর টাকা গুঁজে দিলে চুপ করে যান, আর টাকাটাকে শুধিয়ে-শুধিয়ে, হ্যালো মাউন্টব্যাটেন সাহেব, আপনি চলে গেলেন কেন, এখন আমাদের কী হবে, ইনডিয়াকে ফ্রিডাম দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু বেইমানি করে চলে গেলেন, কেউ-কেউ ফ্রি হল, সবাই কেন হল না, ডেডউইনা মাইয়া, ডেডউইনা মাইয়া, ডেডউইনা মাইয়া, এই ধরনের কথা বলে নিজের মনে বকবক করেন ।
--পাগল হয়ে গেল ? অতনুদের গ্যাঙের তো ও লিডার ছিল রে ! অমিতের দিকে ফিরে বললেন, সরি অমিত, তোমার বাবার অন্যধরণের বন্ধুবান্ধবও ছিল, নারী-নারকটিক গ্যাঙ বলত সবাই ।
--মলয় রায়চৌধুরী, নোট পোড়াবার চাকরি ছেড়ে, পাটনার বাড়ি ছেড়ে, গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরি নিয়ে কলকাতা চলে গেছেন; পাটনায় এসে হোটেলে উঠেছিলেন, এসেছিলেন আমাদের বাড়ি, বউকে নিয়ে । পাটনার বাড়িটা আর বসবাসের মতন নেই জানিয়েছিলেন, ওনার পাটনার বাড়ির লাইব্রেরি থেকে হাজার খানেক বই রঞ্জিত ভট্টাচার্য নামে ওনাদের এক আত্মীয় চুরি করে নিয়ে চলে গেছে । কলকাতায় আবার নাকি অনেক বই জড়ো করেছিলেন, মুম্বাই যাবার সময় সেসব বই যাকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই লোকটাকে রাজনৈতিক মাস্তানরা এমন পিটুনি দিয়েছিল যে মরো-মরো লোকটা প্রায় ছয় মাস ভেলোরে ট্রিটমেন্টের পর সুস্হ হয়েছে, কিন্তু হিন্দু বাঙালিদের ওপর চটে গিয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেছে, চার্চ-টার্চ যায়।
-- ওঃ, তুই তো অনেক খবর রাখিস রে । সমরেন্দ্রর কী খবর ?
--সমরজেঠুর গোলমালের কথা তুমি কী করে জানলে ? জিগ্যেস করল ইতু ।
--বড়জেঠিমাকে মোবাইল কিনে দিয়ে এই সুযোগটা পেয়েছি, উনি বহুক্ষণ আমার সঙ্গে গ্যাঁজাতে ভালোবাসেন । ওনার কাছ থেকে বাড়ির সব খবর পেয়ে যাই । বাংলায় কথা বলার সুযোগ পাই । আমি ওনার বেশ কিছু গল্প মোবাইলে রেকর্ড করে ল্যাপটপে ধরে রেখেছি । শুনি মাঝে-মাঝে ।
--সমরজেঠুর লেটেস্ট সমস্যার কথা বলেছে জেঠি ?
--কী সমস্যা ?
--সৌদামিনীর বাচ্চাটাতো বেশ ফুটফুটে ক্যালেণ্ডার-খোকা হয়েছে । নবনীতাজেঠির দুই যমজ ছেলের চেয়ে ভালো দেখতে । তো সেই বাচ্চাটাকে মহাবীর নেমিচাঁদ নামে একজন বিলডার-কনট্রাক্টার লিফ্ট করিয়ে নিয়েছিল । বিলডারটার দুটো মেয়ে আছে, নয় বছর আর চোদ্দো বছরের ; তবু ব্যাটা ছেলে-ছেলে করে অবসেসড ছিল । সৌদামিনী একদিন অটো করে বাচ্চাটাকে খগোলে ওর বাপের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল মা-বাবাকে দেখাবার জন্য, তখন মোটর সাইকেলে দুজন লোক বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিয়ে দে চম্পট । সৌদামিনী, জানো বোধহয়, কেমন চালাকচতুর মেয়ে, মোটর সাইকেলের নম্বরটা মনে রেখেছিল । সমরজেঠুকে সঙ্গে নিয়ে কোতোয়ালিতে কমপ্লেন করার বারো ঘন্টার মধ্যে বাচ্চাটাকে ফেরত পায় ওরা । সবসুদ্দু সাতজন লোক ধরা পড়েছে । নেমিচাঁদ নাকি ওর বউকে সঙ্গে নিয়ে দানাপুরের এক মন্দিরে পুজো দিয়ে বেরোবার সময় সিঁড়িতে বাচ্চাটাকে পেয়ে ওর বউকে বুঝিয়ে ছিল যে বাচ্চাটা ঈশ্বরের দান । যে গুণ্ডাগুলোকে দিয়ে লিফ্ট করার কাজে লাগিয়েছিল, তারা, পরিকল্পনা অনুযায়ী বাচ্চাটাকে মন্দিরের সিঁড়িতে রেখে দূরে দাঁড়িয়ে বাকি পেমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখনই পুলিশ ওদের পাকড়াও করেছে । নেমিচাঁদ সৌদামিনিকে প্রোপোজাল দিয়েছে যে মামলাটা তুলে নিলে দুলাখ টাকা দেবে । সৌদামিনী সমরজেঠুকে সঙ্গে নিয়ে নেমিচাঁদের বাড়ি গিয়েছিল, এক লাখ টাকা নিয়ে নিয়েছে বিল্ডারটার কাছ থেকে, কিন্তু মামলা এখনও ফেরত নেয়নি সৌদামিনী, সমরজেঠু চাপ দিচ্ছে অ্যামাউন্ট বাড়াবার জন্য । পাটনার হিন্দি কাগজে তো সৌদামিনী আর সমরজেঠুর কোলে ওর বাচ্চা নিয়ে ফোটো বেরিয়েছিল, দেখোনি ?
অমিত অবাক তাকিয়েছিল ইতুর দিকে । গল্প শেষ হলে বলল, যেখানে যাচ্ছ সেখানে কোনো গল্প পাবে না, কেবল শোষণ, অস্বাস্হ্য, মৃত্যু আর গুলিবারুদের রক্ত হিম করা গল্প পাবে । দারিদ্র্য, ক্ষুধা, শোষণ আর বঞ্চনার প্রতিদিনকার সত্যকার ঘটনা স্বচক্ষে দেখবে ; তোমার এই গোপ্পুড়ে মস্তিষ্ক এখানে দিয়ারার গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে যাও । বাবার বক্তৃতার কয়েকটা কথা, যে কথাগুলোকে, শুনে-শুনে, অমিত মনে করে কিতাবি-বাকোয়াস, ব্যবহার করার সুযোগ ছাড়ল না ।
উচ্ছ্বাসকে সামলে ইতু বলল, সরি, সুশান্তজেঠুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেই ছোটোবেলায় ফিরে গিয়েছিলুম, যখন ডাইনিং টেবিলে বসে বড়োরা সবাই মিলে শহরের নানা কেচ্ছা আলোচনা করত, আর আমরা ছোটোরা শুনতুম, তুইও তো হাঁ করে শুনতিস, ভুলে গেলি কেন ।
--দু-দুটো মেয়ে রয়েছে লোকটার, আবার ছেলের কী দরকার ? মেরে ফেলা মেয়ের কথা মনে পড়ল সুশান্তর, ওকে তো সেই মেয়ের মুখও দেখতে দেয়া হয়নি ।
--সৌদামিনীর বডি দেখলে মাথা বিগড়োবেই । বটঠাকুমা বলেছিল যে একে রেখো না, এর ভাবগতিক ভালো নয়, কাজের বউয়ের অমন খাঁজ-দেখানো লোকাট ব্লাউজ কেন ? কিন্তু সকলে মিলে সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে বলেছিল যে তিন তলা বাড়ি ঝ্যাঁটানো, পোঁছা আর এতগুলো লোকের বাসন মাজার জন্য উপযুক্ত স্বাস্হ্য থাকা জরুরি ।
সুশান্ত : আমার কাছে অমরেন্দ্রর গল্পটাও রেকর্ড করা আছে । বড়জেঠি বলেছিল একদিন, শুনবি ?
ইতু : শোনাও, বড় জেঠি ভেতরের খবর আরো বেশি জানেন । অমরকাকু চলে গেছে ব্যাঙ্গালোর । কী করবে বল ? বউ পালিয়ে গেলে পুরুষদের যে কী অবস্হা, যেন জাঁতিকলে পড়া জ্যান্ত ইঁদুর । অমিতের দিকে ফিরে ইতু বলল, তুই তো জানিস, অমরেন্দ্রকাকু আমাদের নতুনদাদুর ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট ছিল, খড়গপুরে পড়েছে, নতুনদাদু ওকে পড়াবার জন্য মেমারির তিন কাঠা জমি বিক্রি করে টাকা তুলেছিলেন ।
অমিতের উদাসীন মুখের পানে তাকিয়ে ইতু টের পেল যে প্রসঙ্গটা তোলা উচিত হয়নি । অমিতের মা মানসী বর্মণ, পালিয়ে না গেলেও, স্বামীর উপস্হিতিতেই আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে অমিতের জন্ম দিয়েছেন । হয়ত অমিতের বাবা-মা সেই কারণেই অমিতকে মানুষ করার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন রাঙাকাকু-কাকিমার ওপর ; ওনারা অমিতকে আইনত দত্তক নিয়ে নিলে অমিত নিশ্চই গর্দানিবাগের বাড়ি থেকে অমনভাবে উধাও হয়ে যেত না ।
সুশান্ত : শোন । স্পিকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দিই ।
ইতু : তোমার তরমুজ মদ দাও তো একটু, খেয়ে দেখি, হুইস্কি, রাম, ব্র্যাণ্ডি, জিন, ভোদকা খেয়েছি, চিড়াইয়াটাঁড়ের দেশিদারুও খেয়েছি, এই ধরণের রঙিন কান্ট্রি লিকার খাইনি । বার্থ ডে সেলিব্রেট করতে বার-রেস্তরাঁয় গেলে, বাবা বিয়ার এলাউ করত, বড় জোর, দু’পেগ প্রিমিয়াম হুইস্কি ।
সুশান্ত । এই নে, চুমুক দিতে-দিতে শোন ।
...এদিকে কী হয়েছে জানিস তো...অ্যাঁ...অমরের বউটা একজনের সঙ্গে পালিয়েছে...অমর রে...অমরেন্দ্র...প্রেম করে বিয়ে করেছিল...আই আই টিতে পড়ার সময়ে...বামুন বাড়ির মেয়ে...তুই তো দেখিসনি….বাবা...কী দেমাগ...মাটিতে পা পড়ে না...পালিয়েছে এক ব্যাটা তামিলিয়ানের সঙ্গে...কোথায় জানিস...আমেরিকা...অমর কেন জানতে পারেনি...তুই-ই বল...পাসপোর্ট ওর বউয়ের আগে থাকতেই ছিল...কবে ভিসা হল...কবে টিকিট হল...কাকপক্ষীও টের পায়নি...আচ্ছা তুই আমাকে বল...অমর কেন জানতে পারেনি না যে ওর বউ কার সঙ্গে মিশছে...কোথায় যাচ্ছে...রাত করে কেন ফিরছে...অমরের মতন পুরুষদের উচিত শাস্তি...ওরা বউকে মনে করে যেন ফলের গাছ...যখন ইচ্ছে এই ডাল থেকে আম খাচ্ছি..ওই ডাল থেকে লিচু খাচ্ছি...সেই ডাল থেকে আপেল খাচ্ছি...তা খাচ্ছিস তো খা না...কে বারণ করেছে...কিন্তু বউ তো আর গাছ নয়...যে এক জায়গায় শেকড় বসিয়ে সারা জীবন তোমার পোঁতা মাটিতে থেকে যাবে...আর তুমি আজ হিল্লিতে কাল দিল্লিতে যত্তো নচ্ছার বন্ধুদের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করে বেড়াবে...বউয়েরও তা সাদ আহ্লাদ আছে...শরীর আছে...রসের চাহিদা আছে...তাকেও তো সময় দিতে হবে...বউকে অবহেলার ন্যায্য পুরস্কার পেয়েছে ব্যাটা...তুই তোর বউকে সময় দিস তো...তোর বউ অবশ্য পালাবে না...বউ তো গাছের মতন নয় যে নট নড়ন-চড়ন এক জায়গায় থেকে যাবে...এখন বোঝো...গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ঘুমোও...আর গাছের গুণকেত্তন করো খঞ্জনি বাজিয়ে...পরে আবার গল্প করব, অ্যাঁ...পার্কে বসে তোকে ফোন করছি রে...বাড়িতে কে আড়ি পেতে শুনবে...তার চেয়ে পার্কে আসি সকালে...ডায়াবেটিস কমাতে হলে নাকি দুবেলা হাঁটতে হবে...এই এক বেলাই হাঁটি...বিকেলে টিভিতে একটা প্রোগ্রাম হয়...মেজকত্তা কচুর লতি এনেছিল ভুল করে...লতির ঘণ্ট তোর প্রিয় ছিল বলে কাজের বউকে বললুম ফেলে দিয়ে আসতে… ও কী আর ফেলে দেবে...নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে নিজেদের মতন করে রাঁধবে….রাঁধলে তোর মা কান্না সামলাতে পারবে না….বিকেলে টিভির জন্য সময় পাইনা...ভালো থাকিস...তোর বউ ছেলেকে আশীর্বাদ দিস...সকালে পুজো-আচ্চা আছে...জানিস তো...
ইশারায় বেবিকে ডেকে ইতুদের গিফ্ট দিতে বলল সুশান্ত, ইতু বলল, আরে তুমি বিয়ে করলে, নতুনবউকে গিফ্ট তো আমরাই দেবো, তোমার বউ কেন দেবে ? তুমি বরং আমাদের কিছু মোটা টাকা দিও । তোমার বউকে দেবার মতন আমার সঙ্গে অবশ্য কিছুই নেই । তোমার বউয়ের গালে বরং একটা চুমু দিই ।
বেবি হাজার টাকার দুটো প্যাকেট এনেছিল । সুশান্ত বলল, ওরা যেখানে গিয়ে সংসার পাতবে সেখানে বোধহয় লোকে একশ টাকার নোটও দেখতে পায় না । শুনে, বেবি প্রকৃতই হতবাক, বলল, বাংগালের লোকেরা কি বিহারিদের চেয়েও কাংগাল ?
সুশান্ত বলল, একশ আর দশ-পাঁচ টাকার প্যাকেট নিয়ে আয়, হাজার টাকা প্যাকেট খুলে নিয়ে আয় । এনে ইতুর ঝোলাতে রেখে দে ।
--জি । আচ্ছা ।
ইতু : এরকম করকরে টাটকা হাজার টাকার নোটের প্যাকেট ? এ তো আমিও দেখিনি গো !
সুশান্ত : পলিটিশিয়ান আর ঠিকেদারদের দেয়া ডোনেশান । শশুরমশাই মাসোহারা পান ।
ইতু : এরকম রাজত্ব পেয়েছ, সঙ্গে দীঘলচাউনি রাজকন্যা পেয়েছ । ও, তাই তো ভাবি, কীসের টানে আটকে রইলে । তোমার বউতো একেবারে হরিণী, অমন বড়-বড় চোখ, এই বয়সে ফিগারও মেইনটেইন করেছে, গায়ের রঙের কী করার আছে ! ওনার ব্যবহার অনেক মিষ্টি । ট্রফি বলে একটা কথা আছে, জানো তো, তোমার বউ হল সেই ট্রফি ।
বেবি : হরণ ? না ওনাকে বাবা হরণ করে আনেননি, উনি নিজেই এখানে বাবার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন । তখন ওনাকে দেখতে অনেক ভালো ছিল, এখন মদ আর শুয়োরের মাংস খেয়ে-খেয়ে ভমচৌলা কুম্ভকরণ হয়ে গেছেন । ওনাকে দেখেই আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল । আমি কেন দিয়ারার অন্য কাউকে বিয়ে করতুম, বলুন, যখন এত ভালো পাত্র আমাদের দরোজায় শ্রীরামচন্দ্রের মতন এসেছে !
সুশান্ত : আমাকে হরণ করার কথা বলছে না । বলছে যে তুই হরিণের মতন সুন্দরী ।
বেবি হাঁটু মুড়ে ইতুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলল, এতদিনে শশুরবাড়ির আশীর্বাদ পেলুম । ইতু ওর মাথা ধরে কপালে একটা চুমো দিল, বলল, তুমি তো বাক্যবাগীশ হরিণী গো, আমি ভাবতুম আমিই বুঝি গায়েপড়া বেহায়া ; সুশান্তজেঠু, আমার হয়ে তোমার বউকে একটা মুখরোচক চুমু দিও । নিজের দুই হাত থেকে চারগাছা চুড়ি আর কান থেকে টপ খুলে বেবিকে দিয়ে ইতু বলল, যেখানে যাচ্ছি সেখানে এগুলোর প্রয়োজন হবে না, তুমি রেখে নাও । বেবি সুশান্তর দিকে চাইতে, সুশান্ত বলল, লে লে, কুছ তো তুঝে তেরে সসুরাল সে মিলা ।
--এই ছিঃ, গুরুজন না, ইতুর চুমু প্রসঙ্গে বলল অমিত ।
--কোনো-কোনো গুরুজন ঝাঁসু হন, ইয়ার্কিকে প্রশ্রয় দিতে ভালোবাসেন । সুশান্তজেঠু তাদের এক ও অদ্বিতীয় । করে নিচ্ছি ইয়ার্কি । আর তো বোধহয় দেখা হবে না । তাছাড়া এই মদটা বেশ কড়া । তোমার ছেলে অপুকে দেখছি না, তোমার শশুরবাড়ির ট্র্যাডিশান ফলো করে ওর বিয়ে দাওনি এখনও ?
বেবি বলল, আপ্পু নাআআআআ ? ওকে বিলেতে পাঠাতে চান উনি, আরও পড়াশুনা করার জন্য ; বিলেতে গেলে কি আর ফিরবে ? থেকে যাবে সেখানেই, টিভিতে দেখি, কত সুন্দর ওদেশের মেমরা, বুড়িরাও জোয়ান ।
অপুর সঙ্গে ওদের দেখা হল না । অপু তো দিল্লিতে ।
সুশান্ত ওদের নৌকোয় চাপিয়ে দিলে, গর্দানিবাগের বাড়িতে দেয়া মোবাইলটা গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছিল ইতু । সুশান্ত ওকে একটা চোরাই মোবাইল আর চারটে বেনামি সিমকার্ড দিয়েছেন ।
অমিতরা চলে যাবার পর সুশান্তকে মনমরা দেখে মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বেবি জানতে চাইল, পুরোনো দিনের জন্য আপনার মন খারাপ লাগছে ?
অমিত আর ইতু চলে যাবার পর সুশান্ত ঘোষের মনে হচ্ছিল যে উনি প্রকৃতপক্ষে একা, নিঃসঙ্গে । ওনার বউ রয়েছে, চারিপাশে হুকুমবরদার রয়েছে, শশুর-শাশুড়ি রয়েছে, তবু উনি একা বোধ করেন নিজেকে । কেন এমন হয় ? কিছুরই তো অভাব নেই । ঠাণ্ডা একটা চাঞ্চল্য, বিক্ষোভ, অজানা অসন্তোষ লুকিয়ে রয়েছে , সেন্স অব বিলংগিং নেই ওনার, সদা সন্ত্রস্ত থাকেন, ভয়ে নয়, সন্ত্রস্ত থাকার অবস্হানকে ভালোবেসে ফেলেছেন বলে । মনে করেন যে ওনার বাইরের সঙ্গে ভেতরের মিল নেই । হোক না অস্বাস্হ্যকর, তবু একা থাকতে ওনার ভালোলাগে । উনি তো সেই চাকরি করার সময় থেকে মিশে আসছেন সবায়ের সঙ্গে, ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে, কিন্তু দিয়ারায় স্হায়ী হবার পর থেকে আসেপাশের সবাই ওনাকে হতাশ করে চলেছে । উনি যেমন জগতসংসারের পরোয়া করেন না, তেমনই পৃথিবী ওনার পরোয়া করে না, জানেন উনি । এই যে অমিত বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতে চাইছে, রাষ্ট্রকাঠামো বদলে ফেলে ইউটোপিয়া আনার স্বপ্ন দেখছে, তাতে জগতসংসারের বয়েই গেছে । কাটার সময় শুয়োরগুলো যেমন আতঙ্কিত চিৎকার দেয়, তেমনই নিঃশব্দ চিৎকার ওঠে ওনার অস্তিত্ব জুড়ে । তিনি যেন তাঁর নিজের মগজের ফাঁকা পোড়োবাড়ির একমাত্র ভাড়াটে । কিসের সঙ্গে যে সংঘর্ষ করে চলেছেন তা উনি নিজেই জানেন না । কে জানে কোন আড়ালে ওৎ পেতে আছে বিষণ্ণ আতঙ্ক, ঘষা কাচের ভঙ্গুর আদলে ভেসে বেড়াচ্ছে শরীরময়, পেটের ভেতরের কুনকি-হাঁস, যাকে তরমুজের মদ প্রতিদিন গিলিয়েও বশে আনা যাচ্ছে না । বেবির সমর্পিত ভালোবাসার অতিউন্নত খোঁয়াড় সত্ত্বেও নিজেকে কেন অসম্পূর্ণ মনে হয়, পার্থিব সব কিছু পাবার পরও, চাহিদা মেটার পরও, নিজেকে অতৃপ্ত মনে হয়, আর এগুলো তো স্হায়ী হয়ে গেছে। এ থেকে যে মুক্তি নেই, তা আরও বিষময় যন্ত্রণাদায়ক এক সমস্যা ।

নয়
দিয়ারার আসেপাশের জলে মাছ ধরতে হলে, নৌকো বাইতে হলে, সুশান্তকে, মানে জামাইবাবার নামে তাঁর শশুরকে, রংদারি ট্যাক্স দিতে হয় । এই মহার্ঘ বালিয়াড়িতে সরকার বলতে বোঝায় তারিণী মণ্ডলের জামাই, যাকে গ্রামের লোক আর প্রশাসনের লোকেরা যে-যার আতঙ্কের মাধ্যমে চেনে-জানে । অঞ্চলের অন্য গুণ্ডারা, যেমন দীনা যাদব, দমদমি যাদব, রাসবিহারি মণ্ডল, দারা মিয়াঁ, সৎইয়া মণ্ডল প্রতিমাসে জামাইখোরাকি দিয়ে যায় ওনার শশুর বা শাশুড়িকে । ওনার দলের সবায়ের কাছে কাট্টা,তমঞ্চা, একনল্লা, দুনল্লা আছে, কয়েকজনের কাছে একে-সানতালিস আর একে-ছপ্পন ।
যে দিয়ারাগুলোর পলি প্রায় পাকা জমির চেহারা নিয়েছে, সেখানে সরকারি স্কুল আছে বটে কিন্তু বর্ষায় তারা ডুববে না ভাসবে তা কেউ আগাম বলতে পারে না বলে সারা বছর ক্লাস হয় না । ছেলে অপুকে তাই ভাগলপুর শহরে রেখে সেইন্ট জোসেফ কনভেন্টে ভর্তি করে দিয়েছিলেন জামাইবাবা । তারিণী মণ্ডলও চেয়েছিলেন নাতি আজকালকার খ্যাতনামা অপরাধীদের মতন স্যুটটাই পরে দেশে-বিদেশে নাম করুক । স্কুলে যে চারটে গ্রুপ ছিল লাল, হলুদ, সবুজ আর নীল, তাতে লাল গ্রুপে ছিল অপু, বাদশাহি লাল । ওর, অপুর, নামটা তারিণী মণ্ডলের দেয়া, আদর করে, আপ্রাধি ঘোষ, তারিণীর মতে জগতসংসারে অপরাধীর চেয়ে বড়ো আর কেউ হতে পারে না, তা মহারাজ বাল্মিকীর জীবন থেকে জানা যায় । এককালের ডাকাত সর্দার, পরে রামায়ণের লেখক, তাঁর নাম যদি উইয়ের ঢিবি হতে পারে তাহলে তারিণী মণ্ডলের একমাত্র নাতির নাম কেন রামায়ণ রচয়িতার অনুকরণে হবে না । তাই আপ্রাধি ; সুশান্ত নিজের মতো করে তাকে বাঙালিয়ানা দিয়ে অপু করলেও, কেউই ওকে অপু বলে ডাকে না, এমনকি সুশান্তর বিড়িসেবিকা মেঠোগন্ধা নিরক্ষর ডাগরচোখ শ্যামলিমা বউও নয় । বেবি ডাকে আপ্পু বলে ।
ওর ডাকনাম হয়ে গেছে আপ্পু । আড়ালে, আপ্পু দোগলা । স্কুলেতে সহপাঠীরা ‘আবে আপ্পু’ ডাকটাকে ‘এবি আপ্পু’তে, মানে ‘এ বাস্টার্ড আপ্পুতে’, পালটে তাতাতে চেষ্টা করলে, অপুর সরাসরি উত্তর, হ্যাঁ, তো কি হয়েছে ?
অশ্বমেধ হোষ নামে ডাকে না কেউ, টিচাররাও বলেন আপ্পু ।
বুক চিতিয়ে অপু জানায়, আমি বাঙালি, বুঝলি বাঙালি ।
--বাংগালি ? সে তো আরও কমজোর, দল বেঁধে চেঁচায় । দুজন এক সঙ্গে না হলে লড়তে ভয় পায় । আর কায়স্হ মানে তো মুনশিগিরি, যমরাজের কেরানি চিত্রগুপ্ত জাতে কায়স্হ । দেখিস না কায়স্হগুলো চিত্রগুপ্ত পুজো করে ।
--বাড়ি গিয়ে পুরাণ-শাস্ত্র পড়গে যা । চিত্রগুপ্ত হল বিহারি কেরানি, আর যমরাজ হল বাঙালি ।
--আচ্ছা ?
--হ্যাঁ । নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের নাম শুনিসনি তোরা । ইংরেজদের এমন বাঁশ দিয়েছিল যে সে বাঁশ কাংরেসিরা ধামাচাপা দিয়ে পুঁতে রেখেছে । একদিন ওই বাঁশের চারা বেরোবে চারপাশ থেকে, তখন দেখিস কী হয়।
সুভাষচন্দ্র বসুর নামটা তারিণী মণ্ডল মুখস্হ করে রেখেছেন । নাতিকে যখনই উৎসাহিত করার দরকার হয়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের গল্প আরম্ভ করেন, সবই গাঁজাখুরি, কেননা উনি কেবল নামটুকুই জানেন আর ফোটো দেখেছেন । বলেন, আরে ওনার ফোটুর দিকে দ্যাখ, লম্বা-চওড়া গাবরু জওয়ান, প্যান্ট-শার্ট পরে স্যালুট নিচ্ছে । আর আজকালকার নেতাদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, ভয়ে সবায়ের ল্যাজ পোঁদে এমন ঢুকে থাকে যে দশটা বন্দুকধারি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ; আমি তো শুধু দুটো পহলওয়ানকে রেখেছি, আমার ওপর রামধারি ধানুক একবার হামলা চালিয়েছিল বলে, রামধারীর জন্যই আমার বাঁচোখটা নষ্ট হয়ে গেল ।
--জানি দাদু, রামধারিকে তুমি লোক পাঠিয়ে কলকাতায় মারিয়েছিলে ; দুই রাজ্যের ঝগড়ায় সে ব্যাটার লাশ পনেরোদিন কলকাতার মর্গে পড়ে পচে পোকা ধরে গিয়েছিল ।
--আরে, এই দিয়ারার জমিজমা সবই গংগোতা আর মাল্লাহদের ছিল ।
--জানি, বাবা সেকথা বলেছিল তোমায় । এচ এচ রিজালে নামে একজন সায়েব ১৮৯১ সালে লোকগণনা করে লিখে গেছে সেসব । কিন্তু উঁচু জাতের আফসাররা টাকা খেয়ে ভূমিহার, রাজপুত, যাদব, কোয়েরি, কুর্মিদের হাতে দিয়ারার জমি তুলে দিত । গংগোতারা ফেরত নেবার চেষ্টা করতে গেলে তাদের চোখে ছুঁচ ফুটিয়ে অ্যাসিড ঢেলে দেয়া হয়েছিল, ক্রিমিনাল দেগে দেয়া হয়েছিল ।
--ক্রিমিনাল খারাপ হতে যাবে কেন ? রামায়ণ লিখেছিলেন মহারাজ বাল্মিকী, উনি কি ক্রিমিনাল ছিলেন? উনি ছিলেন মহাআপ্রাধি । তুই বড়ো হয়ে মহাআপ্রাধি হয়ে দেখা দিকিনি ।
গঙ্গার তো মতিগতির ঠিকঠিকানা নেই ; এই বর্ষায় এক দিয়ারা ডোবায় তো আরেক বর্ষায় আরেক । যে খেতি করে তার জমি ডুবলে যে নতুন জমি ভেসে উঠল সেটা তার পাওনা, কিন্তু ইংরেজরা যাবার পর উঁচু জাতের লোকেরা নতুন ভেসে-ওঠা দিয়ারা নিজেদের নামে লিখিয়ে নিত । কী আর করা যাবে, বল । তাই আমরা হাথিয়ার তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি । বন্দুক যার, জল-জমিন তার । কৈলাশ মণ্ডল নামে একজন গংগোতা নকসল্লি কামকাজ করে চেষ্টা করেছিল সব ঘোটালা বন্ধ করতে, সেই ১৯৬৭ সালে ; কিন্তু সেও তো কোথায় গায়েব হয়ে গেল ।
--গায়েব হয়নি, আমাদের ইউনিভারসিটির একজন টিচার বলেছে যে তাকে গায়েব করে দেয়া হয়েছিল । তখন নকসল্লি ধরে-ধরে গায়েব করার সরকারি কারিয়াকরম চলছিল ।
--আরে সব বেকার । লুকিয়ে-লুকিয়ে যদি কিছু করতেই হয় তো সুভাষচন্দ্র বোসের মতন করো । আংরেজরা অব্দি পালিয়ে গেল ভয়ে । কথা কটা বলে উরুতে কুস্তিগিরের চাপড় দাদুর ।
--দাদু, আমাদের মতন ছিল না সুভাষচন্দ্র বোস । ওর জন্যে জান দেবার অনেক সঙ্গীসাথী ছিল । আমরা তো নিজেরাই লড়ে মরি ।
বাবা সুশান্ত ঘোষ মনে করেন ওনার কোনো প্রত্যক্ষ অবদান নেই অপুর চরিত্র গঠনে । পরোক্ষ অবদান আছে । অপু নিজেও তাই মনে করে । বাবা বাংলা বলতে আর ভাগলপুর শহর থেকে বই এনে বাংলা পড়তে শিখিয়েছেন, সাধারণ জ্ঞানের বই কিনে দিতেন ছোটোবেলা থেকে । বাংলা শেখানোর সময়েই চটে যেতেন বাবা, কান মুলে দিতেন, চড় মারতেন । বাংলা শেখার দরুণ আলটপকা কথা বলে বিব্রত হতে হয়েছে অনেক সময়ে । জে এন ইউয়ের বন্ধুরা তো আর জানে না যে ওর মা দিয়ারার গংগোতা বিহারিন । পদবি দেখে অনুমান করে নেয় যে এ. ঘোষ মানে শহুরে বাঙালি ।
সনাতন সরকার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল অপুর। গায়ের রং বেশ ময়লা, কোঁকড়া উস্কো-খুস্কো চুল, রোগা, সাড়ে পাঁচ ফিটের, কালো ফ্রেমের চশমা-চোখ সনাতন দিল্লিতেও ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বজায় রেখেছে, পায়ে কোলহাপুরি, বাংলা কথায় ওড়িয়া টান । বিড়ি ফোঁকে । প্রথম পরিচয়ের পর প্রায়ই সনাতনের সঙ্গে আড্ডা মারে অপু ।
--হাই সনাতন, আপনিও কি সোকলড প্রবাসী ? প্রথমবার পরিচয় করার জন্য শুরু করেছিল অপু ।
--পশ্চিমবাংলার বর্ণহিন্দু হাফগাণ্ডুরা আমাদের অমনভাবে গালাগাল দেয়, ইসকি মাকা সালে…... ; তুইও কেন সেকথা পাড়ছিস । তুই তো ভাগলপুরি খোটুয়া বলে জানি । কথায় বিড়ির ধোঁয়া মিশিয়ে বলল সনাতন সরকার ।
--না, পুজোপাণ্ডালে, দিল্লি হাটে বা কোনো ফাংশানে দিল্লির বাঙালিদের সঙ্গে আলাপ হলে, যখন ওনারা জানতে পারেন যে আমি ভাগলপুরের তখন অমন প্রশ্ন তোলেন । আপনি তো উড়িষ্যা থেকে ?
--না, টু বি স্পেসিফিক, আমি দণ্ডকারণ্য থেকে । শুনেছিস কি দণ্ডকারণ্য ?
--বাবার কাছে গল্প শুনেছিলুম, রামায়ণ না মহাভারতের গল্প ঠিক জানি না, নর্মদা আর গোদাবরী নদীর তীরে দণ্ডক রাজার রাজ্য ছিল । কোনো ঋষির অভিশাপে জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল ।
--আবে সালে হাফউইট, আমি সেই আদ্যিকালের গাঁজাখুরি এরিয়ান গল্পের কথা বলছি না ।
--দেন হোয়াট ?
--দণ্ডকারন্য জায়গাটা হল ভারতের কয়েকটা রাজ্যের আদিবাসী অধ্যুষিত নয়টা জেলা , মাটির তলায় প্রচুর মিনারালস আছে ; গড়চিরোলি, ভাণ্ডারা, বালাঘাট, রাজনন্দগাঁও, কাউকের, বস্তার, নারায়ণপুর, দাঁতেওয়াড়া আর মালকানগিরি । আমি মালকানগিরি প্রডাক্ট, সুভাষপল্লিতে থাকতাম, এখনও আছে সুভাষপল্লী, জঙ্গল পরিষ্কার করে আমরাই বসত গড়েছিলাম, আর এখন চুতিয়াগুলো আমাদেরই ঘরছাড়া করে দিতে চাইছে, ইসকি মাকা... । কিন্তু এখন চলে গেছি ছত্তিসগড়ের নারাণপুরে ।
--মালকানগিরি ? অমন অড, গড ফরসেকন জায়গায় ?
--দেশভাগের পর কী হয়েছিল জানিস না, চামগাদড় কঁহিকা ?
--হ্যাঁ, জানি-জানি, বাস্তুহারাদের দণ্ডকারণ্যে সেটল করানো হয়েছিল ।
--কোন ভোঁসড়িকে-জনা তোকে বুঝিয়েছে, ইসকি মাকা... ? কিছুই জানিস না তুই । আমাদের, নমঃশূদ্র বাঙালিদের, আনসেটল করা হয়েছিল, ডেসট্রয় করা হয়েছিল, ইসকি মাকা…. । বাঙালির প্রত্নতাত্ত্বিক রুইনস যদি দেখতে চাস তো ঘুরে আয় একবার, ইসকি মাকা...। স্বাধীনতার লাৎ খেয়ে আমরা সেই সব মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছি যাদের অতীত লোপাট, বর্তমান গায়েব আর ভবিষ্যৎ নেই । আইডেনটিটিলেস । আমাদের ইতিহাস প্রতিদিন রিপিট হয়, কেননা আমরা ইতিহাসহীন, বিমূর্ত । বিমূর্ত বুঝিস ? অ্যাবসট্র্যাক্ট !
…চুপ করে যায় অপু । টের পায় যে সারেনি এমন আঘাতের রক্তপূঁজের খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছে ।
--আমরা ১৯৪৭-এ, ১৯৬৪-৬৫-তে, ১৯৭১-এ, ১৯৭৫-এ মার খেয়েছি, যখনই ওপার বাঙালির কসাইদের প্রবৃত্তি সালভাদর দালির পেইনটিঙের মতন হয় , তখনই ওরা আমাদের পোঁদে জ্বলন্ত জিরাফ ঢোকায়। অপর জানিস তো, দি আদার, পড়ছিস বোধহয়, তোদের কোর্সে আছে তো, দি আদার, ইসকি মাকা... । সম্প্রতি নাস্তিক আর আস্তিকদের খুনিখুনি হল ঢাকায়-চট্টগ্রামে, তাতেও ঘরছাড়া করা হল আমাদের, আমাদের ইয়ানেকি নিম্নবর্ণের লোকেদের । ওদেশের রাজনীতির বনেদ হয়ে গেছে খেদাও, খেদাও, খেদাও, মেইনলি রিমেইনিং নিম্নবর্ণদের খেদাও।
...চুপ করেই থাকে অপু ।
--মরিচঝাঁপি শুনেছিস, মরিচঝাঁপি ?
--হ্যাঁ, জানি ঘটনাটা, বাবা বলেছিলেন, দণ্ডকারণ্য থেকে কয়েক হাজার পরিবার গিয়েছিল সুন্দরবনের ওই দ্বীপে বসতি গড়তে ।
--ওই দ্বীপেই, ১৯৭৯ এর ৩১ জানুয়ারি আমার বাবা-মাকে খুন করেছিল ইসকি... । মরিচঝাঁপি দ্বীপটাকে চারিদিক থেকে তিরিশটা পুলিশ-লঞ্চ ঘিরে রেখেছিল যাতে খাবার আর পানীয় জল না পোঁছোয় ; তারপর যুদ্ধক্ষেত্রের ঢঙে ব্রাশফায়ার করেছিল, ইসকি... । দণ্ডকারণ্যের অনেকের বাড়িতে ৩১ জানুয়ারির দিনটা তাদের কোনো-না-কোনো আত্মীয়ের মৃত্যু দিন হিসাবে পালিত হয় । আমাদের বাড়িতে পালিত হয় আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুদিন হিসাবে । যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল তাদের কেউ-কেউ কলকাতার বারাসাতের কাছে মরিচঝাঁপি কলোনি গড়ে থেকে গেল, কেউ-কেউ থেকে গেল ক্যানিঙের হিঙ্গলগঞ্জে কলোনি গড়ে, কেউ রেললাইনের ধারে, কেউ খালপাড়ে । আমাকে মরিচঝাঁপি থেকে দণ্ডকারণ্যে নিয়ে এসেছিলেন আমার পিসেমশায়, নিজের পিসেমশায় নন, তবু আপন । নয় বছর বয়সে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম, ইসকি... । তোরা হয়তো ভাবিস তোদের চেয়ে আমার বয়স এত বেশি, ইউনিয়ানবাজি করার জন্য গাণ্ডুগর্দি চালিয়ে ইউনিভার্সিটিতে টাইম পাস করছি, হয়তো মনে করিস পি এইচ ডি করতে এত বছর লাগছে কেন, ইসকি... ।
...আবার চুপ করে যায় অপু ।
--আমাকে আবার দণ্ডকারণ্যে এনে লালন-পালন বলতে যা বোঝায় তা করেছেন, স্কুল-কলেজে পড়িয়েছেন, এখনও পড়ার খরচ যোগাচ্ছেন, আমার পিসতুতো বোন যাকে ১৯৭১ সালে রেপ করেছিল পাকিস্তানি রাজাকারগুলো, ইসকি...। সেও আমার নিজের পিসতুতো বোন নয়, কিন্তু আপন । ও দণ্ডকারণ্য থেকে মরিচঝাঁপি যায়নি । ওর বর, আমার অভিভাবক জামাইবাবু গণেশচন্দ্র সরকার যেতে চাননি ; উনি তখনই বলেছিলেন ওই টেঁটিয়া গিরগিটিমার্কা বর্ণহিন্দু বাঙালিগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না, ইসকি...। আন্দামানে যাবার জেটিতে গিয়ে ওদের ছাতুবাবুরা কালাপানি-দ্বীপান্তরের আতঙ্ক ছড়িয়ে ভাষণবাজি করে হাজার-হাজার মানুষের আন্দামানে যাওয়া ভণ্ডুল করে দিয়েছিল । নেহেরু আমাদের ঠুঁসে দিল আদিবাসীদের জংলি এলাকাগুলোয়, আর বর্ণহিন্দু বাঙালিরা পেলো চিত্তরঞ্জন পার্ক, তুই তো এসব সাপসিঁড়ির পলিটিক্স জানিস না। বাড়ি থেকে কাঁচা টাকা আনিস, আর নাইটক্লাব-ডিসকোবাজি করে বেড়াস ।
...অপু চুপ করে রইল । বুঝতে পারছিল যে সনাতন সরকার সম্ভবত মন খুলে ঝাল ঝাড়ার অবসর তৈরি করে ফেলতে পেরেছে ওর প্রশ্নগুলোর চোট খেয়ে । অপু আরও ভয়ঙ্কর হিন্দি গালাগাল জানে, ব্যবহার করে না কখনও, ছোটোবেলা থেকে বাবার চড়-খাওয়া নির্দেশ ।
--ওই নেতাগুলোর বেশ কয়েকজন বেঙ্গলের ডিভিজান করে পাকিস্তান সৃষ্টি সমর্থন করেছিল । যেই পাকিস্তান হল অমনি বর্ণহিন্দু লোকগুলো আগেভাগে পালিয়ে এলো ; এসে, এ আজাদি ঝুটা হ্যায় জিগির তুলে ট্রাম-বাস পোড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর আমরা ? আমরা তো নমঃশূদ্র, নিম্নবর্ণ, আনটাচেবল, ইসকি...। বর্ণহিন্দু পরিবারগুলো পশ্চিমবাংলায় বাড়িঘর তৈরি করে থেকে গেল, পার্টিগুলোকে দখল করে নিল । নিম্নবর্ণের জন্যে দণ্ডকারণ্য, হিমালয়ের তরাই, আন্দামান, ইসকি...। বর্ণহিন্দু ভাড়ুয়াগুলোই আমাদের আন্দামানে যেতে দেয়নি । এখন আন্দামানে গিয়ে দ্যাখ, সাউথ ইনডিয়ান আর পাঞ্জাবিরা গুছিয়ে নিয়েছে । বাংলা তো পড়তে পারিস । তোর ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে মনোরঞ্জন ব্যাপারির লেখা চণ্ডালের চোখে চণ্ডাল বইটা আছে, পড়িস । জঁ জেনে সম্পর্কে জাঁ পল সার্ত্রে বিস্তারিত আলোচনা করে সেইন্ট জেনে নামে একটা বই-ই লিখে ফেলেছেন । কোনো বাঙালি কি মনোরঞ্জন ব্যাপারিকে নিয়ে বই লিখেছে ? শালা বর্ণহিন্দু চুতিয়া ইনটেলেকচুয়ালদের দল, ইসকি...।
ক্যান্টিনের অন্য টেবল থেকে একজন সহপাঠির মন্তব্য শোনা গেল, আবে সানি, হিন্দি মেঁ গালি কিঁউ ? তু বংলা গালি নহিঁ জানতা হ্যায় ক্যা ? সুনা, সুনা, দো-চার, ইয়াদ করকে রখুঁ ।
সনাতন জবাব দিল, যাদের দিচ্ছি তাদের জন্য এই গালাগালগুলোই উপযুক্ত মনে হল । বাংলা গালাগাল কয়েকটা জানি, কিন্তু সেগুলোয় তেমন তেজ নেই । মালকানগিরিতে বাংলা বলার চল শেষ হয়ে গেছে, ইসকি...। উড়িষ্যা সরকার বাংলা শেখানো তুলে দিয়ে ওড়িয়া শেখাচ্ছে । মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর আর গড়চিরোলি জঙ্গলের উদ্বাস্তু গ্রামে বাঙালিরা আছে, তাদের বাচ্চাদের স্কুলে মারাঠি শিখতে বাধ্য করা হয়েছে, সাতচল্লিশটা স্কুলে, বুঝলি, আমরাই এসট্যাবলিশ করেছিলাম ওগুলো। চন্দ্রপুর আর গড়চিরোলিতে বাংলা বলার মতন বাঙালি আর পাবি না, দশ-পনেরো বছর পর, ইসকি...। কোথাও কোথাও ইলেকট্রিসিট পৌঁছেচে বটে, কিন্তু চাষের জল, সেচের ব্যবস্হা নেই, সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র নেই । গালাগাল দেবো না তো কী দেবো, ভ্যালেন্টাইনের খামে পুরে আমাশার মিক্সড ফ্রুট জ্যাম ?
অপু বলল, আরে আপনি ওদের ছাড়ুন, শালারা সারাদিন লন্দিফন্দি করে আর চকরলস কাটে ; ছোলে-ভাটুরে খাতে, অওর লিডারকে দুম চাটতে ।
--এখন দণ্ডকারণ্যে পোলাভরম ড্যাম তৈরি হবে নয় হাজার কোটি টাকা খরচ করে, চুতিয়া শালা ইসকি...। উপজাতি আর উদ্বাস্তু অধ্যুষিত দুশো ছিয়াত্তরটা গ্রামের দু লাখ মানুষ ভেসে যাবে, উৎখাত করা হবে তাদের, দাঁতেওয়াডায় সাবরি নদীর ধারে চাষের সব জমি ভেসে যাবে, ইসকি...। কারোর দুশ্চিন্তা নেই, তার কারণ যারা ভেসে যাবে তারা হয় শিডুল্ড ট্রাইব বা বাঙালি শিডুল্ড কাস্ট । এই যে সেনসাস হল, তাতে আমরা যে শিডুলড কাস্ট তা চাপা দিয়ে দেখানো হল আমরা বাঙালি, ইসকি...। কেন ? যাতে আমরা শিডুলড কাস্টের সুবিধাগুলো না পাই । ভোঁসড়িকে, পোলাভরমের জল যাবে ভিশাখাপটনমের কারখানাগুলোয়, স্টিল প্ল্যান্টে, হাইড্রোপাওয়ারে,শহরে । ক্যান ইউ ইম্যাজিন ? লক্ষ-লক্ষ মানুষ পানীয় জল পাবে না, ইসকি...। আর কলকাতায় গিয়ে দ্যাখ ; বর্ণহিন্দু লৌণ্ডাগুলো আমরা বাঙালি আমরা বাঙালি করে ধুতি খুলে লুঙ্গি ড্যান্স নেচে চলেছে। দেশভাগের দরুণ আমরা শুধু তাদের সাংস্কৃতিক গর্বের বাল ওপড়াবার জন্য নিশ্চিহ্ণ হয়ে চলেছি, ইসকি...। দণ্ডকারণ্যের দলিতরাও তাদের দলে আমাদের নিতে চায় না । আমরা ইতিহাসের গার্বেজ ডাম্প, ইসকি...।
সনাতন সরকার নিজের রোষকে সামাল দিয়েছে আঁচ করে অপু বলল, বাংলাদেশ কিন্তু দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নিচ্ছে, এতকাল পরে হলেও নিচ্ছে । সেখানের জনসাধারণের মধ্যে থেকেই সরকারকে নাড়া দেয়া হচ্ছে, মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করা হচ্ছে ।
--কী রকম শুনি ?
--শাহবাগে এককাট্টা হয়ে মেয়েরা পর্যন্ত প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে, বোরখা পরে নয়, ওপনলি । আমাদের এখানে চুরাশির শিখ নিধন, নেলি গণহত্যা, গোধরার পর আহমেদাবাদের দাঙ্গা, কয়েকমাস আগে মুজফফরনগরে আর শ্যামলিতে যে দাঙ্গা হল, কই এখানে তো শাহবাগের মতন রাস্তার মোড়ে নামতে দেখা গেল না ছেলে-মেয়েদের ।
--ওদের দেশে বিয়াল্লিশ বছর লেগেছে কাদের মোল্লাকে কাঠগড়ায় তুলতে, যে লোকটা শুধু মীরপুরেই সাড়ে তিনশ মানুষকে খুন করিয়েছিল । আসল শয়তান বাচ্চু রাজাকরটা আগেই পাকিস্তানে পালিয়েছিল, ইসকি...। তুই আমার তর্কটাকে অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছিস । আমাদের এখানে যতই দাঙ্গা হোক না কেন, আমরা কাউকে পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে তাড়া করে নিয়ে যাই না । আমাদের কোনো রাজাকরের ইকুইভ্যালেন্ট নেই । রাজাকর কাদের বলে জানিস ?
--ধার্মিক স্বেচ্ছাসেবকদের । যতদূর জানি হায়দ্রাবাদের নিজামের টাকায় তৈরি মিলিশিয়া ।
--আবে ঘড়িয়ালকে চামড়া, তর্ক চলছে পূর্ব পাকিস্তান আর নিম্নবর্ণের বাঙালি নিয়ে , তুই তার মধ্যে নিয়ে এলি হায়দ্রাবাদ। রাজাকার হল খুনি মিলিশিয়া, যাদের অর্ডিনান্সের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছিল টিক্কা খান, ইসকি... । পূর্ব পাকিস্তানে, আই মিন বাংলাদেশে, তুই ঘরে-ঘরে রাজাকার পাবি। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, হিমালয়ের তরাই, আন্দামান এমনকি দণ্ডকারণ্যেও বাঙালিদের মধ্যে তুই অমন জাতকসাই পাবি না । আমাদের এখানে সরকার কোনো দিনই ধর্মান্ধ মিলিশিয়া তৈরি করবে না, আমরা দেবো না তৈরি করতে, গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে , ব্লাডি সিভিল ওয়র । হুমায়ুন আজাদের নাম শুনেছিস ?
--হ্যাঁ, আমার বাবা হুমায়ুন আহমেদের অনেক বড়ো ফ্যান । যে গংগোতা বাংলাদেশ-ইনডিয়া সীমার ব্যবসা দেখভাল করে আর থার্মোকোল আইসবক্সে বাবার জন্যে ইলিশ আনে, শুঁটকি-মাছ আনে, সে বাবাকে বইপত্র এনে দ্যায় । ইলিশ-টিলিশ বাবা নিজেই রাঁধেন ।
সনাতন সরকার, স্তম্ভিত, অপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আবে, তেলচাট্টা ঘাসলেট, আমি একজন ভাবুকের কথা বলছি, পাল্প ফিকশান রাইটারের কথা বলছি না। হুমায়ুন আজাদকে পাক সার জমিন সাদ বাদ নামে একটা বই লেখার জন্য রাজাকাররা খচাখচ-খচাখচ ছুরি-ছোরা-চপার মারার কিছুদিন পর উনি মারা যান। যাকগে, তোর মতন অ্যায়রা-গ্যায়রা নাৎথু-খায়রাকে এসব বলে কোনো লাভ নেই ; কী জানতে চাইছিলিস যেন ?
--এমন লেকচার দিলেন যে যা বলতে চাইছিলুম, তা-ই ভুলে গেলুম । গালাগালের তোড়ে ভেসে গেলুম ।

দশ
মংরুরাম নুনেতি ( কানাগাঁও-এর প্রাক্তন সরপঞ্চ ): আরে, আরে, খাদেতে দুজন লোক পড়ে আছে । সাপের কামড়ে নাকি অন্য কোনো জন্তু জানোয়ার মেরে ফেলে রেখে গেছে, পরে এসে খাবে ?
গাসসুরাম ( গ্রামবাসী ) : গ্রামের তাতিম গোঁড় বলছিল যে এই জঙ্গলে সেদিন সন্ধ্যাবেলা গুলিগোলা চলেছিল । গুলি লেগে মরেছে বোধহয় ।
মংরুরাম : রক্ত লেগে নেই কেন তাহলে ? গুলি লাগলে রক্ত থাকত জামাকাপড়ে ।
গাসসুরাম : চলুন চলুন, শেষে আধামিলিট্রি জওয়ানরা দেখতে পেলে আমাদেই জেলে পুরবে । মাওওয়াদিরা দেখতে পেলে ধরেবেঁধে নিয়ে গিয়ে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে শেয়ালের মাংস ঢুকিয়ে দেবে ।
মংরুরাম : যে-ই ধরুক, নিখালিস উড়িয়ে দেবে ।
গাসসুরাম : বাপ রে । তাকাবেন না ও দিকে ।
মংরুরাম : তাড়াতাড়ি চল, তুই তো ভাঙা পা নিয়ে হাঁটতেই পারিস না ।

এগারো
দণ্ডকারণ্যে যাবো আপনার বাড়ি, যদি নিয়ে যান কখনও । আর হ্যাঁ, আমি কয়েকদিনের জন্য বাড়ি যাবো, আপনি আমার অ্যাবসেন্সটা ম্যানেজ করে দেবেন । আপনি তো পি এইচ ডি করছেন , অসুবিধা হবার কথা নয় । অপু বলল সনাতন সরকারকে ।
--চলিস আমার সঙ্গে, একা তুই রাস্তা গোলমাল করে ফেলবি । নারায়ণপুর জেলাসদর হলেও, এখনও ডেভেলাপ করেনি ।
--আমার বাবার পদবি ঘোষ হলেও, আমার মা বিহারি গংগোতা পরিবারের মেয়ে, ভাগলপুর শহরে নয়, আমাদের বাড়ি গঙ্গার চরে, দিয়ারায় । দিয়ারা শুনেছেন তো ? মলম লাগাবার মতো করে কথাগুলো বলল অপু, ক্যান্টিনে বসে মসালা দোসা খেতে-খেতে, সনাতনকে ।
--গংগোতা ? কাস্ট ? তোর পাঞ্জাবি গার্লফ্রেণ্ড সে-কথা জানে, যে মেয়েটা সব সময় তোর সঙ্গে চিপকে থাকে ?
--হ্যাঁ, বিহারের লোয়েস্ট নিম্নবর্ণ । হ্যাঃ, নিকিতা মাখিজা পাঞ্জাবি নয় , ও সিন্ধি । ওকে আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জানিয়েছি, বিশ্বাস করে না, ভাবে কাটিয়ে দেবার জন্য গুল মারছি । বলেছি প্রায়ভেট ডিটেকটিভ দিয়ে ইনভেসটিগেট করাতে, সে-প্রস্তাবকেও মনে করে ওকে ছেড়ে দেবার আরেক চাল । দিল্লির নাইটলাইফ এনজয় করা-মেয়ে, প্রায়ই ডিসকোয় গিয়ে টাল্লি হয়ে যায়, আর বাড়ি পৌঁছে দিতে হয় আমাকে । ওর বাবা-মা কেন যে অমন ছুট দিয়ে রেখেছেন, জানি না । ওকে আমাদের দিয়ারায় নিয়ে গেলে ওর হার্টফেল করবে।
--নিম্নবর্ণের আবার হাই-লো আছে নাকি রে, বওড়া ? এনিওয়ে, তোর বাবার প্রেম তো স্যালুট করার মতন অসমসাহসী ঘটনা রে । তোর বাপ পারলেন, তোর গার্লফ্রেণ্ডও পারবে, সিন্ধিরা বেশ সহজে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে, ওরাও উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিল, কিন্তু সরকার ওদের ধরে-ধরে আদিবাসীদের মাঝখানে পোঁতেনি, যেমন আমাদের পুঁতেছে । তবে টাকাকড়িকে ওরা মানুষের চেয়ে বেশি ভালোবাসে ; চেক করে দেখেনিস তোর কাঁচা টাকা ওড়ানো দেখে তোকে ফাঁসিয়েছে কি না । সেক্স-টেক্স করলে কনডোম পরে করিস, মনে রাখিস এটা ইনডিয়ার রাজধানি, এখানে মানুষের মুখের লালায় যত সায়েনাইড, তার চেয়ে বেশি সায়েনাইড তাদের চুতে আর লাঁড়ে।
--প্রেম নয়, আমার মায়ের বাবা আমার বাবাকে কিডন্যাপ করে আমার মায়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন । মায়ের বয়স তখন চোদ্দ বছর আর বাবার একুশ । মা লেখাপড়া শেখেননি, স্কুলের কোনো বিল্ডিংও দেখেননি আজ পর্যন্ত ; বাবা কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক । সেই থেকে বাবা শশুরবাড়িতে আমার নানা, মানে দাদুর সঙ্গে থাকেন, দিয়ারায় চাষবাসের উন্নতির কাজ দেখেন । বাবা আমার মাকে নিজের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাননি, একাই গিয়েছিলেন বিয়ের পরে। গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে মাকে ওই বাড়িতে অ্যাকসেপ্ট করা হবে না । তারপরে আমাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন, আমাকেও অ্যাকসেপ্ট করা হয়নি ।
--স্ট্রেঞ্জ । আমি ভাবছিলাম আমার জীবনের ঘটনাটাই ইউনিক । তুই তো নিজেই একটা ইউনিক সোশিওলজিকাল প্রডাক্ট । তো তুই বাংলা শিখলি কী করে ?
--বাবার কাছে । আমি বলতে, পড়তে, লিখতে পারি ।
--বাবা বাঙালি হলে না শেখার কারণ নেই, যদিও আমরা মাতৃভাষার, মানে মায়ের ভাষার কথা বলি, আদপে কিন্তু বাবার ভাষাটাই শিখি সবাই । তুই তো গ্রেট ।
--আপনার জামাইবাবুর বাড়ির ঠিকানাটা দেবেন আমায় । নিকিতাকে প্রথমেই দিয়ারায় আমাদের বাড়ি নিয়ে গেলে ওর মাথা খারাপ হয়ে যাবে । আমার তো বাঙালি আত্মীয়স্বজন নেই, আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবো ওকে । যদি আপনার ফ্যামিলিকে দেখে অ্যাডজাস্ট করতে পারে, তাহলে নিয়ে যাব দিয়ারার গংগোতা পাড়ায় ।
--লিখে নে না । আমি বরং জামাইবাবুকে একটা চিঠি লিখে তোকে দিয়ে রাখছি, যখনই তোর গার্লফ্রেণ্ডকে নিয়ে যাবি চিঠিটা সঙ্গে নিয়ে যাস । তোর নাম জানিয়ে ফোন করে দেব । আমরা মালকানগিরি থেকে চলে গেছি ছত্তিশগড়ে, আমার ভাগ্নের হিউমিলিয়েশান এড়াবার জন্য। দিদি-জামাইবাবু নারায়ণপুরে বাড়ি করেছেন, এখন তো নারায়ণপুর জেলা শহর, আগে যাতায়াতে বেশ অসুবিধা হতো । সরি ফর দ্য অ্যাবিউজেস । সামলাতে পারি না, বুঝলি । এত ছোটো ছিলাম যে মা-বাবার মুখও মনে নেই । ওনাদের মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। পুলিশের লোকেরা লোপাট করার জন্য শব তুলে-তুলে জলে ফেলে দিয়েছিল ।
--ভাগ্নের হিউমিলিয়েশান ? অসুবিধা না থাকলে বলতে পারেন ।
--১৯৭১-এ ঢাকায় আমার দিদিকে চারজন রাজাকার রেপ করেছিল, জামাইবাবু অ্যাবর্ট করাতে দেননি। ইন ফ্যাক্ট, জামাইবাবু দিদিকে মালকানগিরিতে বিয়ে করেছিলেন, দিদি যখন প্রেগন্যান্ট, বিষ খেয়ে সুইসাইড করতে গিয়েছিলেন দিদি। তখন মালাকানগিরিতে ডাক্তার-ফাক্তার ছিল না, জঙ্গল এলাকা, নব্বুই বছরের একজন বুড়ি ওকে জড়িবুটি খাইয়ে বিষ বের করে দিলে, জামাইবাবু দিদিকে ইমোশানাল সাপোর্ট দ্যান, বাচ্চা হবার কয়েকমাস আগে বিয়ে করেন ।
--আমি তাই ভাবতুম যে আপনি দলিতদের এক্সট্রিম লেফটিস্ট ইউনিয়ানে কেন ঢুকেছেন । আপনার পারসোনাল ব্যাকগ্রাউণ্ড তো জানা ছিল না ।
--এক্সট্রিম লেফটিস্ট ? স্ট্রেঞ্জ ওয়র্ড । দিল্লির সংসদবাজ লেফটিস্টদের দেখছিস তো ? অনেকে জে এন ইউতে এসে কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছে মাঝে-সাঝে, হোয়াট ফর ?
--দণ্ডকারণ্য তো এখন শুনি আলট্রা লেফটিস্টদের ঘাঁটি ।
--এই লেফটিস্ট ওয়র্ডটা কাইন্ডলি বারবার উচ্চারণ করিসনি । পোঁদ জ্বালা করে । আই হেট দেম ।
--অলটারনেটিভ ওয়র্ড কী ?
--প্রতিশব্দ নেই । মাওওয়াদকে প্রতিশব্দ বলা যায় না । মাওওয়াদ ইজ এ সেল্ফকনফিউজড ডগমা ।
--কেন ? আমি যদিও মাওওয়াদ সম্পর্কে বিশেষ জানি না, কাগজে পড়ি, ব্যাস ওইটুকু । সিলেবাসে্ও নেই।
--ওদের লক্ষ্য হল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক জবরদস্ত গণআন্দোলন, ইংরেজি মাইটিকে বাংলায় জবরদস্ত বলা ছাড়া অন্য ওয়র্ড আছে কিনা জানি না ।
--আমার বাংলা নলেজ আপনার চেয়ে খারাপ, হাফ বেকড । ইন ফ্যাক্ট সাম্রাজ্যবাদ ব্যাপারটাই যে কী তা ঠিকমতন বুঝি না । সবকটা রাজনীতিককেই তো মনে হয় সাম্রাজ্যবাদী, যে যার নিজের এমপায়ার খাড়া করে চলেছে ।
--কী করে তুই স্নাতক হলি রে ? টুকলি ? না তোর হয়ে অন্য কেউ পরীক্ষায় বসেছিল ? মওকাপরস্ত তেঁদুয়া কহিঁকা । হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাকে বিধ্বস্ত করতে চায় মাওওয়াদিরা, গড়ে তুলতে চায় পাওয়ারফুল আর্বান মুভমেন্ট, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির সাহায্যে, কেননা কেতাবি মার্কসবাদ মেনে সশস্ত্র কৃষকদের সংঘর্ষ এদেশের কৃষিকাঠামোয় দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয় । ভারতীয় বহুত্বওয়াদি বাস্তবতার ক্ষেত্রে ওগুলো কোনোটাই লাগু হয় না ; তাছাড়া পৃথিবীতে কী ঘটছে সেদিকেও তো তাকাতে হবে । পৃথিবী তো রামচন্দ্রের বনবাসের দণ্ডকারণ্যে আটকে নেই, রামচন্দ্রের নির্বাসনের পথটাই নাকি রেড করিডর ।
--রিয়্যালি ? এই ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা জিনিসটাও বুঝলুম না ।
--যা যতটা বুঝেছিস, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক । জে এন ইউতে কয়েকজন নেপালি ছাত্র আছে, ওই তুই যাদের বলছিস একস্ট্রিম বা আলট্রা লেফটিস্ট । তাদের একজন, চিনিস বোধহয়, জনক বহুছা, ওর মতে রেড করিডর হল যে পথে গৌতম বুদ্ধ নেপাল থেকে বেরিয়ে তাঁর বাণী বিলিয়েছিলেন ভারতবর্ষের গ্রাম-গঞ্জ-বনপথে।
--বলুন না, থামলেন কেন ? ইনটারেসটিং ।
--দণ্ডকারণ্যে ওরা বৌদ্ধবিহার বানায় না, যা বানায় তার নাম দলম । দলমরা বানায় জনতম সরকার। দলম, জনতম এটসেটরা শব্দ থেকে বুঝতে পারছিস যে ডিসকোর্সটা তেলুগু ডমিনেটেড । ডিসকোর্স বুঝিস তো, না তাতেও গাড্ডুস ? এর আগে মানুষের ইতিহাসে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতরা সন্ত্রাসের সাহায্য নেয়নি । ওদের মতে শোষিতদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় এখন সন্ত্রাস ।
অপু নিজেকে নিঃশব্দে বলতে শুনল, সনাতন বোধহয় মায়াবতীর দলের ভাবুক, আর এগোনো উচিত হবে না । বলল, আপনার পিসতুতো দিদির কথা বলছিলেন, যিনি আপনার অভিভাবক, তাঁর গল্প বলুন না , আপনার ভাগ্নের হিউমিলিয়েশানের, যদি অসুবিধা না থাকে।
--বললাম বোধহয় একটু আগে, দিদি বাচ্চাটাকে অ্যাবর্ট করায়নি, জামাইবাবু করাতে দেননি । ভাগ্নেটা জানতে পেরে দু-দুবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল । ভাগ্নের বয়স অবভিয়াসলি আমার চেয়ে বেশি, সেভেন্টিটুতে জন্মেছিল, আর আমি জন্মেছি ওর পাঁচ বছর পর, ভাগ্নেদা বলে ডাকি । ওকে ওর বাবার নাম জিগ্যেস করলে ও আনকনট্রোলেবলি উন্মত্ত হয়ে যায়, বলে, আমার বাবা একজন নয় চারজন, বাবাদের নাম জানি না । দিদি-জামাইবাবুর চোখাচোখি বড় একটা হতে চায় না কার্তিক, বাড়ির বাইরে সময় কাটায় । আমার ভাগ্নের নাম কার্তিক সরকার । ওকে একটা মোটরসাইকেল কিনে দেয়া হয়েছিল, নারায়ণপুর থেকে রায়পুর, কিংবা অন্যা নন-মোটোরেবল জায়গায় যাত্রীদের নিয়ে যায় ; সব জায়গায় তো বাস যায় না, মোটোরেবল রোডও বিশেষ নেই নারায়ণপুর জেলার ফরেস্ট এরিয়ায় । আগে তো রেসট্রিকশান ছিল ফরেস্ট এরিয়ায় যাবার, মুরিয়া, মাড়িয়া আর গোঁড় উপজাতির লোকেরা থাকে ওখানে, ষাট বছরে কোনো ডেভেলপমেন্ট হয়নি, সার্ভে হয়নি, সেনসাস হয়নি ।
--সরকারি অফিসাররা যেতে চায় না, না ? সব রাজ্যে একই ব্যাপার ।
--যেটুকু কাজ তা রামকৃষ্ণ মিশন করে, এমন কি রেশনের দোকান আর স্কুলও মিশনই চালায় । বিজলি নেই, পানীয় জল নেই, মাসে এক-আধ লিটার কেরোসিন, ব্যাস ।
--ফরেস্ট এরিয়ায় গেছেন ?
--না তেমন করে যাইনি, রেসট্রিকশান ছিল এতদিন । নদীর জল নিয়ে, জঙ্গলের গাছ নিয়ে নানা কেলেঙ্কারি হয়েছে । তারপর গোপনীয় সৈনিক, স্পেশাল পুলিশ অফিসার, অগজিলিয়ারি ফোর্স আর সালওয়া জুড়ুমের নামে উপজাতিদের নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করানো হল । ভারতের সংবিধান ওই অঞ্চলে অস্তিত্বহীন । সালওয়া জুড়ুম আর আধামিলিট্রির সাহায্যে জঙ্গলে শান্তি ফেরানোর চেষ্টা হল জাস্ট নাইটমেয়ার । কতকাল যে চলবে লড়াইটা, কেউই জানে না । ইনডিয়ার আকরিক খনিজের মানচিত্র আর ট্রাইবাল ডেনসিটির মানচিত্র একই, বুঝলি ? যারা আকরিক খনিজ চায় তারা আদিবাসিদের উৎখাত করতে উঠেপড়ে লেগেছে ; তাদের চাই-ই চাই । প্রতিরোধ করার জন্য যা-যা করা দরকার তা আদিবাসীরা করে চলেছে , এসপার নয়তো ওসপার । ইয়াতো করনা হ্যায়, নহিঁতো মরনা হ্যায় ।
অপু চুপ করে রইল, যে বিষয়ে কিছুই জানে না সে ব্যাপারে বেফাঁস কিছু যাতে না বলে ফ্যালে । প্রসঙ্গের খোঁচা ভোঁতা করার জন্য বলল, কী-কী গাছ হয় জঙ্গলে ?
--সব তো আর জানি না, তবে প্রচুর পলাশ, মহুয়া, আমড়া গাছ দেখেছি । আর আছে চিকরাসি, জিলন, শিমুল, উলি, বডুলা, কড়ুয়া পাঙার, পিছলা, জারুল, জংলি বাদাম, ছাতিম এইসব ।
শুনে, বুঝতে পারল অপু, ওর বাংলা জ্ঞান দিয়ে গাছের নাম চিনতে পারছে না । দিয়ারায় বসবাস করে গাছের নাম জানতে চাওয়া বোকামি হয়ে গেছে । কেবল মাথা দুলিয়ে সায় দিল, বোঝার ভান করে ।
--মালিক মকবুজা শুনেছিস ?
--না, কার লেখা ?
--তুই তো পুরো চুতিয়াছাপ মূর্খ থেকে গেছিস রে, পিওর অ্যাণ্ড সিম্পল গাণ্ডু । মালিক মকবুজা হল একটা স্ক্যাণ্ডালের নাম ।
--না শুনিনি । বিহারে রোজ এতো স্ক্যাণ্ডাল হয় যে অন্য রাজ্যের স্ক্যাণ্ডাল পড়ার দরকার হয় না ।
--ট্রাইবালদের ওনারশিপের নাম মালিক মকবুজা । দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে প্রচুর সেগুনকাঠের গাছ ছিল আর সেসবের মালিক ছিল স্হানীয় আদিবাসীরা । টিমবার মাফিয়ারা প্রশাসন আর রাজনীতিকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আদিবাসীদের ঠকিয়ে সেগুনের গাছগুলো কেটে পাচার করে দিত, ইসকি... । সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে লোকায়ুক্ত একটা কমিটি গড়ে রিপোর্ট চেয়েছিল । রিপোর্টে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল যে নিচেতলা থেকে ওপরতলা পর্যন্ত প্রশাসন সেগুনগাছ কাটায় আর ট্রাইবালদের ঠকানোয় ইনভলভড । সেসময়ের বস্তারের কমিশনার নারায়ণ সিং আর সালওয়া জুড়ুমের জন্মদাতা মহেন্দর করমার বিরুদ্ধে ছিল প্রধান অভিযোগ । কিন্তু অ্যাজ ইউজুয়াল সে রিপোর্ট ধামা চাপা পড়ে গেল, কারোর কিছু হল না, মাঝখান থেকে আদিবাসীগুলো জমিও হারালো আর জমির ওপরের সেগুনকাঠের গাছগুলোও, ইসকি...। রিপোর্টে দেখানো হয়েছিল যে আদিবাসীদের শহরে নিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখিয়ে বা ধমক দিয়ে বা চকচকে বোতলের মদ খাইয়ে চুক্তিতে টিপছাপ করিয়ে নেয়া হয়েছিল । যখন হইচই হয়েছিল তখন সেগুনগাছের গুঁড়িগুলোর চালান বন্ধ ছিল, তারপর সংবাদ মাধ্যম ভুলে গেল, পাবলিকও ভুলে গেল । সংবাদ মাধ্যম যে কাদের, তুই তো জানিস, ইসকি...।
--কিছুদিন আগে মারা গেছে, সেই লোকটাই মহেন্দর করমা, না ?
--হ্যাঁ, মাওওয়াদিদের অনেকদিনের পেয়ারা সনম ছিল । সালওয়া জুড়ুমের ভয়ে প্রচুর আদিবাসী ছত্তিশগড় থেকে পালিয়েছে অন্ধ্র আর মহারাষ্ট্রে ; ওদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হতো, ফসল কেটে নেয়া হতো । সরকারি অফিসাররা বলে যে মাওওয়াদিদের ভয়ে ওরা ছত্তিশগড় থেকে পালিয়েছে । দাঁতেওয়াড়ায় হাই টেনশান লাইন উড়িয়ে দশদিন অন্ধকার করে দিয়েছিল মাওওয়াদিরা । সত্যি-মিথ্যে একাকার হয়ে গেছে আমাদের দণ্ডকারণ্যে । নিম্নবর্ণের বাঙালি উদ্বাস্তুদের অভিশাপ থেকে রাঘব বোয়ালের বংশই মুক্তি পেলো না, এরা তো সব চিতি-কাঁকড়া, ইসকি...।
--এ তো দেখছি কিছুটা আমাদের দিয়ারার মতন ব্যাপার । উঁচু জাত আর উঁচু চাকরির মতলবখোরি !
--আদিবাসীদের জমিজমার কোনো রেকর্ডও সরকারি দপতরে পাওয়া যায় না, ইসকি...। একবার ছানবিন করে জানা গিয়েছিল যে দুজন মুখিয়ার পাঁচশ একর করে জমির মালিকানার পাট্টা আছে, আর কারোর নামে কোনো প্রমাণ নেই। জমি নেই তো কিষাণ ক্রেডিট কার্ড হবে না । অনেকে ভোটার কার্ড কাকে বলে জানে না, বি পি এল কাকে বলে জানে না ।
--ওফ, বড় বেশি কমপ্লিকেটেড আপনার এনভিরন । যাকগে, রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যেতে কোন কোন শহর পড়ে বলুন ? আপনার দিদিকে দেখতে ইচ্ছে করছে । সেলাম জানাতে ইচ্ছে করছে ।
--কথাটা সেলাম নয়, প্রণাম ।
--হ্যাঁ, হ্যাঁ, কারেক্ট, সরি ।
--ভিলাই, দুর্গ, দাল্লি রাজহরা, ভানুপ্রতাপপুর, তারপর নারায়ণপুর । তবে রায়পুর থেকে মোটোরেবল রোডও আছে । কোন রাস্তায় যাবি তার ওপর নির্ভর করে দূরত্ব, ২২৫ থেকে ২৭৫ কিলোমিটার খানেক হবে । শর্টকাট রাস্তা হল রাওঘাট হয়ে । এখন অবশ্য বয়লাডিলার খনির জন্যে এলাকাটায় চহলপহল দেখা দিয়েছে । আগে মাওওয়াদিরা কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছিল, এখনও ওড়ায় মাঝে-মধ্যে, রাস্তার মাঝখানে লাশ পড়ে থাকে, পুলিশ ভয়ে সরায় না, সরাতে গেলেই বোমা ফাটার সম্ভাবনা ; মরেওছে অনেক সিপাহি জওয়ান । আসাম থেকে, হরিয়ানা থেকে, তামিলনাডু থেকে, চাকরি করতে এসে বেচারাদের কি বিপত্তি ।
অপুর জ্ঞান সীমিত, টের পেল অপু, দিয়ারাও তো প্রায় আদিনিবাসীদের অঞ্চল ।

বারো
পৃথিবীর উঠাপটক-জোড়তোড় সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর রাখেন অপুর বাবা, অখবার পড়েন, আংরেজি টিভি দ্যাখেন, স্কুলে আর কালেজে যা শেখানো হতো সেসব বাবা জানেন, পড়া বুঝিয়ে দিতেন । মারোয়াড়ি কলেজে পড়ার সময়ে অনেক সাহায্য করেছেন বাবা । সকলে শহরে কোচিং পড়তে অঢেল টাকা খরচ করে, ওকে, অপুকে, করতে হয়নি । দাদু কিছুই জানেন না, খেতের রোপনি, কাটাই, মাল বিক্রি, লেন-দেন, পহলওয়ান সাপলাই আর রংদারি ট্যাক্স ছাড়া। অপুকে কোনো কথা বোঝাতে হলে মায়ের মাধ্যমে বোঝান বাবা। মা যদি তা না বোঝেন তখনই বাবা নিজে বিষয়টা নিয়ে অপুর সঙ্গে কথা বলেন ।
--আরে উ অব বচ্চা-বুতরু হ্যায় কাআআআআআ ? করনে দিজিয়ে জো মন মেঁ আবে । কৌনো মৌগি কে সাথ নহিঁ না ফঁসা হ্যায়, না আপকে তরহ দিন-দহারে দারু কা নিসা করতা হ্যায় । কহিয়েএএএএএ ।
--সসুরজি উসকো এতনা রুপয়া দে-দেকে খরাব কর রহে হ্যাঁয় ।
--আরে রুপয়া হ্যায় কিস লিয়ে ? আপ কোই সোনে কা মুরত হ্যাঁয় কি আপকা বেটা হীরা-জওহারাত কা মুরত হোগা ? মগর ডরপোক নহিঁ হ্যায় আপকে তরহ । পহলওয়ান লেকে নহিঁ ঘুমতা হ্যায় মেরা বেটা । কা কহ রহেঁ হ্যাঁয় হম, সুন রহেঁ হ্যাঁয় নাআআআআআ ? আপনার আর আমার বাবার চাপে পড়ে আমার ছেলের ঘাড়ে দুটো মাথা গজিয়েছে, বিষ্ণু ভগওয়ানের আর ভস্মলোচনের , ও নিজেই বুঝতে পারে না যে কোন মাথাটার নির্দেশ কখন শুনবে। মাথা দুটোর লড়াই একদিন ওকে ডোবাবে । দুটো মাথার একটাও আমার কথা শোনে না । যখনই ফোন করি ফোন কেটে দিয়ে বলে ব্যস্ত আছি, এখন বিরক্ত কোরো না । ছেলেটা দিল্লি গিয়ে একদম সরফিরা হয়ে গেছে ।
--মেরে তরহ গোরাচিট্টা হ্যায় উ । বাল ভি মেরে তরহ ঘুংরালি । অন্য কাউকে বিয়ে করতিস তো কয়লার খাদান থেকে বেরোনো কুলির চেহারা নিয়ে জন্মাতো ।
--কয়লা খাদানের মজা লুটবেন বলেই তো থেকে গেলেন । এমন কচি কয়লাখনি তো আর পেতেন না, যাতে ঢুকতে দু’ঘণ্টা ধরে গলদঘর্ম হয়েছিলেন । লেকিন লম্বাই-চওড়াই ওকর নানাকে তরহ হ্যায় নাআআআআআ?
--মজা ? কেঁচোর মাটিখাওয়া আবার মজা নাকি !
--তবে না তো কী ? প্রথম রাত আমি দাঁতে দাঁত দিয়ে, মুঠো শক্ত করে, চুপচাপ সহ্য করেছিলুম, আপনি কতক্ষণ চেষ্টা করে সফল হয়েছিলেন, ভুলে যাচ্ছেন কেন । আমি জানতুম যে আপনি সফল মানেই দিয়ারায় ঘরজামাই হয়ে থাকা আপনার পাক্কা । মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছিলুম যে, গঙ্গায় শুশুক ভেসে উঠেছে মানে আপনাকে আমার চাই-ই চাই, চিরে রক্তারক্তি হলেও, একফোঁটা চোখের জল ফেলব না। আপনার সফলতা আমার সফলতার সঙ্গে মিশে গেল, ছোটোবেলা থেকে স্নান করে-করে গঙ্গার যতগুলো ঢেউ আমার গায়ে জমা হয়েছিল, সেগুলো সেদিন ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল ।
--হ্যাঁ, তোর ঢেউ তবু ফুরোয়নি । গঙ্গায় স্নান করিস আর নতুন-নতুন ঢেউ গায়ে করে তুলে আনিস ।
--আপনি তো দেওয়ি-দেওতায় বিসওয়াস করেন না, গঙ্গায় স্নান করে দেখুন না একদিন, সব পাপ ধুয়ে যাবে।
--কোনো পাপই করিনি আমি যে পাপ ধোবার জন্য তোর গঙ্গায় স্নান করতে হবে । পাপ অন্যেরা করে, আমি তার পূণ্য ভোগ করি ।
জামাইবাবা সুশান্ত ঘোষের মেয়েও হয়েছিল, অপুর জন্মের এগার বছর পর । ওনাকে বোঝানো হয়েছিল, দিয়ারায় মেয়ে-বাচ্চা অশুভ বলে তাকে একদিনের বেশি বাঁচতে দেয়নি তারিণী মণ্ডলের বউ, মানে জামাইবাবার শাশুড়ি । দিয়ারার খেত এত উর্বরা কেন , যুক্তি দিয়েছেন শাশুড়িমাইয়া ; তার কারণ দিয়ারায়-দিয়ারায় পোঁতা আছে সীতামাইয়ার কন্যা-সন্তানরা, তারা মাটির তলায় নাল ফেলে-ফেলে জমিকে উর্বরা করে দ্যায় । জানতে পেরে, যদিও সুশান্ত ঘোষের গেঁয়ো বউয়ের ততটা মনখারাপ হয়নি, জামাইবাবার হয়েছিল । তারপর উনি নিজেকে স্তোক দিয়েছিলেন, যে, শহুরে মগজ নিয়ে দিয়ারার নৈতিকতা যাচাই করা অনুচিত ; যেমন ভুঁইসমাজ তেমন তার আচার-বিচার, তেমন তার সত্য, তার নৈতিক নিয়মাবলী ; কে বাঁচবে কে মরবে তার নির্ণয় নেবার অধিকার তো যে নিচ্ছে তার ।
ওনার শশুর, তারিণী মণ্ডল, কাউকে উড়িয়ে দেবার হুকুম দিলে, যাকে ওড়ানো হচ্ছে তাতে তার কোনো নির্ণয় নেবার নৈতিক অধিকার থাকে না, কেননা সে এমন কাজই করেছে যে তাকে চলে যেতে হবে । তিনি কিডন্যাপ হলেন, তাতে তো তাঁর নিজের কিছু করার ছিল না । নির্ণয় নিয়েছিলেন হবু-শশুর ।
মেয়ের মুখটুকু দেখা হল না বলে আপশোষ থেকে গেছে অপুর বাবার । যখনই মনে পড়ে, শরীর খারাপ হয়ে যায় । তরমুজের গুলাবি মদ নিয়ে বসেন ।
আসল কারণটা অবশ্য সুশান্ত ঘোষের মেঠোগন্ধা বউই ফাঁস করে দিয়েছিল, সারা গায়ে ডেওডেরেন্ট উড়িয়ে, যখন একদিন রাতে মরা মেয়ের শোকে তরমুজের চোলাই করা মদ খেয়ে একা-একা কাঁদছিলেন । বউ বলেছিল, কেঁদে আর কী হবে ? ছেলে জারজ হলেও তার বিয়ের সমস্যা হয় না । কিন্তু জারজ মেয়েকে কে বিয়ে করত ? আপনি তো এমন মানুষ যে মনের মতন পাত্র কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে দিতে পারতেন না ; আজকালকার ছেলে, কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে দিলেও সে পালিয়ে যেত কিনা বলা যায় না । তারপর আবার কাজিয়া-খুনোখুনি, বিশ-পচিশ লাশ ইধর তো বিশ-পচিশ লাশ উধর ।
ভাগলপুরের দিয়ারা অঞ্চলে সুশান্ত ঘোষ নিজে একাই এসেছিলেন, বাড়ির কাউকে না জানিয়ে, তারিণী মণ্ডলের খুংখার ক্রিমিনাল দলের সাহায্য নিয়ে মুঙ্গেরের পিপারিয়ায় বেদখল হয়ে-যাওয়া জমিজমার পুনর্দখল নেবার মতলব নিয়ে । সুশান্ত ঘোষ অফিসের বিহারি সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন যে ভাগলপুরের নাথনগর, আর বিহপুর থানার কসমাবাদ, দুধলা, বৈকুন্ঠপুর, তেতিস, অমরি, নকরটিয়া, অজমেরিপুর, ভগবতীপুর, দিলদারপুর, রত্তিপুর, ওদেদিয়া, কাহেওয়ারা, গিরিপুর, চোওহদ্দি, রাঘোপুর, গঙ্গাপুর, রসতপুর আর শাহপুরের গ্রামগুলোতে রাজত্ব করে একদল খুনি, তারিণী মণ্ডল, মলহারিয়া মণ্ডল, লালে মণ্ডল, ডুব্বা মণ্ডল আর সন্তান মণ্ডলের পহলওয়ানরা -- আধুনিক সমাজের বাইরে মারকাট অঞ্চল ।
ইংরেজদের সময় থেকে কোনো তারতম্য হয়নি এই দিয়ারার মানুষদের জীবনধারায়, সংঘর্ষে, দারিদ্র্যে, শোষণে । যার যত পেশিশক্তি তার তত জমিন আর জলপ্রবাহ, গঙ্গার ধারের জমিন, গঙ্গার মাঝে জেগে ওঠা জমিন, আর গঙ্গার জলপ্রবাহ । ১৯৫৯ থেকে ভাগলপুরে গঙ্গানদীর তীরে একশো আটত্রিশটা গ্রামে ভূমিসংস্কারের চেষ্টা বারবার ভেঙে গেছে । কাগজে-কলমে যে-ই মালিক হোক না কেন, খুংখার খুনি গিরোহদের সমর্থনে দখলে রাখতে হয় ছুঁচের ডগার সমান জমি আর তর্জনী-বুড়ো আঙুলে ছেটানোর সমান জল । সুশান্ত ঘোষ ব্রিফকেস ভরে লাখ দেড়েক টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের সাহায্যে নিজেদের পিপারিয়ার জমিদারির জমিজমা ফেরত পাবার ষড় কষতে ।
জমিজমার দখল নিতে গিয়ে নিজেই জবরদখল হয়ে গিয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ । সেই কাঁচা যৌবনে, তখনই, তাঁর চেহারার খোলতাই ছিল অবাঙালি, প্রায় মারোয়াড়ি । পাঁচ ফুটের ফর্সা গালফোলা ঘাড়ে-গর্দান কোঁকড়াচুল চনমনে । অথচ বাঙালি বলে, মুঙ্গেরের পিপারিয়া গ্রামে, যেখানে ওঁদের জমিজমা, সেখানে যাওয়া, ফসল তোলা, এতোয়ারি হাটের খাজনা আদায় সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । ওনার বাবার ঠাকুর্দা, মানে ঠাকুর্দার বাবা, হাইকোর্টে, তখন কলকাতায় মামলা লড়তে হতো, ভূমিহার রাজনাথ সিংকে ফৌজদারি মামলায় জিতিয়ে দেয়ায়, মুঙ্গেরের রোমহর্ষক দিয়ারায়, দুশো একর জমি আর সাত একর আনাজ বাগান, আর এতোয়ারি হাট ওনার ঠাকুর্দার নামে করে দিয়েছিল ।
সুশান্ত ঘোষ আগে যাননি কখনও পিপারিয়া । ছোটোবেলায় চাল মুসুর অড়র ভুট্টা সর্ষে পটল কচু আম রাঙা-আলু গাওয়া-ঘি আর হাটের টাকা আসত । তারপর ওখানে কৈলু যাদব, কজ্জল ধানুকদের দলের অপহরণকারী অপরাধীরা এমন জ্বালাতন আরম্ভ করলে যে সুশান্তদের বাড়ির কেউই ওমুখো হবার সাহস যোগাতে পারেননি । কাদের হাতে যে সেই বিশাল সবুজ খেতখামার তা কেবল কানাঘুষোয় শুনতে পাওয়া যেত। বাংগালি-তাংগালি বলে সুশান্ত ঘোষের জ্যাঠা-কাকা-বাবা সেখানে পাত্তা পেতেন না ।
সত্তরে পৌঁছে বাঁচোখ কানা তারিণী মণ্ডল পাকাপাকিভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন জামাইবাবার হাতে ।
তারিণী মণ্ডলের সিংহাসনে বসার দিনকতক পর, একদিন রাতে মুঙ্গেরের পিপারিয়ায় তাঁর দলের বাছাই পালোয়ানদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ, বাপ-ঠাকুর্দার জমিজমা দখলের জন্য নয়, সেই জমিজমা যারা দখল করে ওনাদের বেদখল করে দিয়েছে, তাদের সাফায়া করে প্রতিশোধ নেবার জন্য । সাফায়া করার পর তাদেরই তিনটে লাশ আর বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র বোমাবারুদ ফেলে এসেছিল মাধেপুরার আরেকটা দলের অঞ্চলে, যাতে তাদের পারস্পরিক খুনোখুনিটা চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের চেহারা নিতে পারে । নিয়েও ছিল । সেই থেকে মুঙ্গেরের আর মাধেপুরার অপরাধীরা লড়ে মরে জামাইবাবাকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছিল । মারকাট এড়াবার জন্যে শলা করতে বসে ওরা জানতে পারে যে ওদের মধ্যে লড়াইটা বাধিয়েছিল তারিণী মণ্ডলের জামাই ।
ভোঁসড়িকে ক্যা বাংগালি দিমাগ, হমনিলোগকে চালিস আদমি মর গেলই আপস মেঁ লড়ঝগড়কে । প্রকৃত ব্যাপার জেনে ফেলার পর, পিপারিয়া গিরোহ লোক পাঠিয়েছিল তারিণী মণ্ডল আর তার বাংগালি জামাইকে খুন করার জন্য । সাতসকালে ট্রাক চালিয়ে এসে, সামনেই তারিণী মণ্ডল আর মন্হরা দেবীকে পেয়ে যাওয়ায় শশুর আর তার বউকে সাফায়া করার লোভ সামলাতে পারেনি তারা।
বালিয়াড়িতে দুই চিতার ওপর সাজানো দাদু-দিদিমার শব দেখে পর্যন্ত অপু নিজেকে বুঝিয়েছিল যে বদলা নিতে হলে আজকেই নিতে হবে । শোক-ফোকে ডুবে থাকলে চলবে না । দাদু তো শিখিয়ে গেছেন যে পৃথিবীতে ভয় নামে কোনো ব্যাপার নেই । মনের ভেতরে পোষা অজানা আতঙ্ক ছাড়া বাইরের কোনো কিছুকে ভয় করতে নেই । বুলেটই হল চিরসত্য ।
একবার নিজের মাথার ওপর খেত থেকে সদ্য তোলা পটল রেখে, তখন ওর বারো বছর বয়স, দাদুকে বলেছিল, চালান গুলি, দেখি কে ভয় পায়, আপনি না আমি । উত্তরে তারিণী মণ্ডল বলেছিল, আমার বাঁচোখ নেই, ডান চোখ এখন খারাপ হয়ে গেছে, জোয়ান বয়স হলে চালাতুম গুলি, দেখিয়ে দিতুম তোকে, চশমা পরে তো আর এক-নল্লা চালানো যায় না । অপু বলেছিল, ডরপোক কহিঁকা ।
--আমি আর ডরপোক ? আমার নাম শুনলে সরকারি অফিসাররাও হেগে ফ্যালে, জানিস তো, আমি হলুম মূর্তিমান ত্রাস । আচ্ছা, আমি রাখছি পটলটা মাথার ওপর, তুই চালা ।
--আমার তো আর এখন অত টিপ হয়নি । পাঁচদশ বছর যাক তখন দেখবেন, দেয়ালের পিঁপড়েকেও একশ মিটার দূর থেকে গুলি চালিয়ে মেরে দেখাবো । পিস্তল-বন্দুক চালাতে শেখাচ্ছেন তো আপনিই ; দেবো গুরুদকছিণা, চিন্তা করবেন না।
--তোর বাপকে আর মাকে বলিসনি যেন যে তুই পিস্তল-বন্দুক চালাতে শিখছিস । শসার শাঁষ দিয়ে হাত পুঁছে নে, নয়তো তোর মা হাত শুঁকলে বারুদের গন্ধ পেয়ে যাবে ।
--জানি ।

তেরো
রাত নামতেই চারটে মেছো নৌকো আর একটা গাদাবোটে নম্বরপ্লেট-খোলা মোটরসাইকেল চাপিয়ে, বাবা সুশান্ত ঘোষকে না জানিয়ে, গংগোতা গ্যাঙের দলবল নিয়ে চুপচাপ মাধেপুরায় পৌঁছে গিয়েছিল অপু । সঙ্গে দশটা জেরিক্যানে পেট্রল । পটলের পাহাড়, তরমুজের ঢিবি, ভুট্টাগাছের কাটা আঁটির ডাঁই আর শুয়োর-ছাগলের খোঁয়াড়ে পেট্রল ঢেলে বোমা মেরে আগুন যখন দাউ-দাউ, অপু একে-সানতালিস চালিয়েছে ঝোপড়িগুলোকে লক্ষ্য করে ।
মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে ঠেলে দিয়েছে উল্টো দিকে, আর নিজেরা চুপচাপ ফিরেছে নৌকোয় চেপে ।
--আপ্পু, চল অব, ছোড় দে, সব মর গয়া হোগা । সঙ্গীদের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে, থেমেছিল অপু । অন্ধকারে কোনো কিছু নড়তে দেখলেই গুলি চালিয়েছিল, বেরহম । সবুজ পটলের পাহাড় পেট্রলের আগুনে ঠিশ-ঠাশ লাফিয়েছে দিকবিদিক, পাকা পটলগুলো হলদে ছ্যাদলামাখা কালো দাঁত থেকে আগুনের ফিনকি বের করে অট্টহাসিতে গলা ফাটিয়েছে। কালচে তরমুজরা শ্মশানে চিতায় শোয়া খুলির মতন ফেটে লাল রঙের ঘিলু উড়িয়েছে অন্ধকারের মহোল্লাসে । ভুট্টার খোসার ভেতরে গচ্ছিত পাকা দানাগুলো হাতবোমায় ভরা ছররার ঢঙে ফরফরিয়েছে ।
পরের দিনই স্হানীয় সংবাদপত্রের শিরোনামে তারিণী মণ্ডল ও তার স্ত্রীর হত্যা আর মাধেপুরায় নারীশিশু মিলিয়ে তেত্রিশজনের জ্বলেপুড়ে বা গুলি খেয়ে মরার খবর । তার পরের দিন সর্বভারতীয় মুদ্রিত আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে, আতংকওয়াদি নেতা আপ্রাধি ঘোষের নেতৃত্বে অতর্কিত হামলায় শতাধিক নিহত । পুলিশের ডিজিকে ওপরতলা থেকে গোপন হুকুম দেয়া হয়েছে যে আতংকওয়াদিদের নেতাকে যদি ধরা যায়, তাহলে, যদি সে ধরা দিতে না চায়, তাহলে, দেখামাত্র তাকে, আপ জানতে হ্যাঁয় কেয়া করনা হ্যায় । একটা মুদ্রিত মাধ্যমে নামকরা সাংবাদিক উত্তরসম্পাদকীয়তে লিখেছে, বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে যে লোকটা প্রতিবেশী দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিল, আর ওর প্রকৃত নাম আপ্রাধী ঘোষ নয় ।
অপু নিজেকে তারিণী মণ্ডলের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে, শুনে, খেপে গেলেন সুশান্ত ঘোষ । ভ্যাপসা অন্ধকারে বসে, মেঠোগন্ধা স্ত্রী বেবিকে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে, যেভাবে উনি কখনও আজ পর্যন্ত কথা বলেননি, বললেন, আমি নিজে কোনোদিন বন্দুক-পিস্তল চালাইনি, আমার লুঙ্গিতে এই অটোমেটিক পিসতলটা শুধু গোঁজাই থাকে, চালিয়ে মাঝে-সাঝে টেস্ট করার হলে রামশরণ করে, আমি ট্রিগারও ছুঁয়ে দেখিনি । আমি অপুকে কোনো অস্ত্র-শস্ত্রে হাত দিতে দিইনি, তোর মাথায় ছোটোবেলায় হাত রেখে ও শপথ করেছিল যে জীবনে কোনোদিন ও বোমাবারুদ গুলিগোলা বন্দুক রাইফেলে হাত দেবে না । এটা কী করে হল ? কে শেখাল ওকে ? নিশ্চই ওর দাদু কোনো ফাঁকা দিয়ারায় নিয়ে গিয়ে নিশানার অভ্যাস করিয়েছে ; তুই আমায় জানতে দিসনি, তুইও চেয়েছিস যে তোর ছেলে আমার মতো নয়, তোর বাবার মতন খুনি কিডন্যাপার অপরাধী হোক । এখন কী করবি ? তোর ছেলেকে খুন করার জন্য নিশ্চই বেরিয়ে পড়েছে শত্রুরা ।
সতত কলহাস্যময় বেবি এখন নিঃশব্দে, দুঃখ-মেশানো ক্রোধে, চোখের জল ফেলছিল ; সম্ভবত বাবা-মার অপঘাতে মৃত্যুর কারণে। চোখ মুছে, দাঁতে দাঁত রেখে, বিরক্তির স্বাচ্ছন্দ্যে, বলল, আমিও জানতাম না যে ও বন্দুক চালানো শিখেছে ; দিয়ারায় বাচ্চারা ছোটোবেলা থেকেই কাট্টা তামাঞ্চা একনল্লা দুনল্লা চালাতে শেখে । ও-ও হয়তো সেভাবেই শিখেছে ।
নৃশংস ঘটনার অতর্কিত বিহ্বলতায় বিচলিত ও বিমূঢ় সুশান্ত বসেছিলেন দাওয়ায় বাঁশের বেঞ্চে, ফলসা আর খিরনিগাছের তলায় । অপুকে কি ভাবে বাঁচানো যায় চিন্তা করছিলেন ।
বেবির পরবর্তী কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সুশান্ত ঘোষ ।
ঠোঁটের কোনে উত্তজনার দুঃসাহসী ফেনায় হতচেতন বেবি, ভয়ার্ত শ্রদ্ধায়, বলল, আপনি তো খুশিই হলেন আমার বাবা ওভাবে খুন হওয়ায়, রাস্তার মাঝখানে জানোয়ারের মতন, মুখ দেখে আর চেনার উপায় ছিল না যে ওই লোকটাই তারিণী মণ্ডল । আপনি মনে-মনে ষড়যন্ত্র করে আপনার জমিদারি বেদখলের বদলা নিতে লোক পাঠিয়েছিলেন । অন্য সবাইকে বোকা বানাতে পারেন, আমাকে নয়, আমি আপনার সঙ্গে প্রতিদিন-প্রতিরাত থাকি, জানি আপনকে, কখন কোন গান শুনছেন তা থেকে আপনার মনের অবস্হা বুঝে যাই, কেন বেশি মদ খাচ্ছেন তার আসল কারণ টের পেয়ে যাই । কী দরকার ছিল ? বেশ ভালোই তো ছিলেন, দিয়ারার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে । আসলে আপনি জানতেন যে পিপারিয়াকে আক্রমণ করলে ওরা তারিণী মণ্ডলকে নির্ঘাত খুন করবে । আর আমার বাবা আপনাকে কিডন্যাপ করে আমার সঙ্গে যে জোর করে, চারিদিকে পাহারাদার বসিয়ে, বিয়ে দিয়েছিলেন, তার প্রতিশোধ নেয়া হবে । নয়কি ? নিশ্চই আপনি মনে-মনে ষড়যন্ত্র করেছেন বিয়ের পর থেকেই, কী করে আপনার কিডন্যাপিঙের আর মুখ্যু কালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ের বদলা নেবেন।
বেবির কথাগুলো ওনাকে, সুশান্ত ঘোষকে, অবাক করল । তিনি যাকে মেঠোগন্ধা বোকা মেয়ে ভাবছিলেন, সে তো তা নয় । সে ওনার গোপন ইচ্ছের কথা জানে ! কখনও কি ঘুমের ঘোরে বা অত্যধিক মদ খেয়ে বলে ফেলেছেন মনের কথা ? কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক যুবককে রাজধানীর ব্যাপক জীবন থেকে উপড়ে তুলে এনে ফালতু একটা জায়গায় পুঁতে বনসাই করে দেবার কাজের বিরুদ্ধে পুষে রাখা রোষের আগ্নেয়গিরির মুখকে খুলে ড্র্যাগনের আগুন-নিঃশ্বাস ছড়িয়ে সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেবার পরিকল্পনা ?
বেবির মর্মপীড়া প্রতিবন্ধকহীন, বলতে থাকল, খুন-করার ঋণ খুনের মাধ্যমেই প্রতিশোধ হয়, জানি, ছোটোবেলা থেকে ; বদলা যে নেয় তার মাথার দাম বদলা নেবার সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায় । আপনি তো আলাদা মানুষ ছিলেন, সাক্ষাৎ দেওতা, কী করলেন আপনি ? বিষ খেতে-খেতে ভাবলেন যে আপনি বিষ খেলে যার কাছ থেকে বিষ কিনেছিলেন সেই দোকানদার মারা যাবে, আপনার কিছুই হবে না ।
সুশান্ত , উদাসীন ক্ষোভে, বাকরুদ্ধ, শুনছিলেন, বেবির উদ্গীরণ, কে জানে কোথায় চাপা দেয়া ছিল, যাকে উনি মেঠোগন্ধা বোকা কথাকিপটে মেয়ে ভেবেছিলেন, তার অন্তরঙ্গ মিশুকে সংযমের আড়ালে ছিল আরেক বেবি।
বেবি বলল, আপনি আপনার ছেলেকে বসিয়ে বাংলা বলতে পড়তে লিখতে শেখালেন, আমাকে তো শেখালেন না, আমি তো হিন্দিতেও আনপঢ়, আপনি চাইলে আমাকে চোদ্দ বছর বয়স থেকে আপনার বাঙালি বউ করে তুলতে পারতেন । আমাকে আপনি আপনার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাননি । মিষ্টি কথা বলে-বলে আমায় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন, তা কি আমি বুঝতুম না ? আজ আপনার কাছে অনুতপ্ত হওয়া ছাড়া কিছু করার নেই।
সুশান্ত বেবির কথাগুলোর উত্তর দিলেন না, কেবল বললেন, কোথায় অপু, ওর এখানে থাকা চলবে না, এখানে ও হয়তো আজকেই খুন হয়ে যাবে । ওকে একটা মিডিয়া আতংকওয়াদি, আরেকটা মিডিয়া মাওওয়াদি বানিয়ে দিয়েছে ।
অপু এলে সুশান্ত ঘোষ বললেন, গেট রেডি টু গেট লস্ট । গো ফ্রম দিস প্লেস । যেখানে কেউ তোকে খুঁজে পাবে না এমন জায়গায় চলে যা ।
অপু কিছু বলতে চাইছিল । ওর নিরক্ষর মা, ইংরেজির একটিও শব্দ না জানা সত্ত্বেও, সুশান্তর মনোভাব আঁচ করে, অবিচলিত কন্ঠে বলল, তোর বাবা যা বলছেন, তা-ই কর । তোর এখানে থাকা চলবে না । তোর দাদুর মতন তুইও রাস্তায় গাড়ি চাপা শুয়োরের মতন মরে পড়ে থাক তা দেখার আগে আমি গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে নেবো।
ডেস্কটপের মনিটারে গুগল ম্যাপ খুলে, বাবা সুশান্ত ঘোষ অপুকে বোঝালেন , তুই পালা, এই দ্যাখ, ইতুদিদি আর অমিত বর্মণ নামের লোকটা যে জঙ্গলে গেছে তার ম্যাপ, জায়গাটার নাম অবুঝমাড়, কেউ যায় না আদিবাসীদের ওই অঞ্চলে, গুগল সার্চ করে দেখেছি, ইমপ্রেগনেবল ফরেস্ট । প্রথমে দণ্ডকারণ্যের নারায়ণপুরে যাবি, সেখান থেকে হদিশ নিয়ে অবুঝমাড় ।
সুশান্ত ঘোষ অনুমান করেছিলেন যে পুলিশ এসে ওনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে কথা আদায়ের চেষ্টা করবে । ছেলেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্হা করে দিয়ে বেবিকে সঙ্গে নিয়ে নিজেও পালালেন দিয়ারার চরে, যেখানে পলিমাটির প্রলেপ-দেয়া চ্যাঁচারির বেড়ায় ঘেরা ঢেউতোলা অ্যাসবেসটসের চালাঘরে দাগি অপরাধীরা, পুলিশ-প্রশাসনকে এড়াবার জন্য, এসে লুকোয় । তারা এসে লুকোলে শহর থেকে নাচানিয়াওয়ালি আনিয়ে তাদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্হা করত তারিণী মণ্ডল ।
সুশান্ত ঘোষ ভেবে দেখলেন যে, যতদিনে পুলিশ ওনাকে ধরবে ততদিনে অপু পৌঁছে যেতে পারবে নাগালের বাইরে । অবুঝমাড়ে পালিয়ে গেছে শুনলে পুলিশের আর কিছু করার থাকবে না ।
দিয়ারায় বানানো গঙ্গামাটি-লেপা বাঁশের কাঠামোর ওপর বেছানো অ্যাসবেসটসে পাতা খড়ের ছাদের তলায় ফেরারি অপরাধীদের কুকর্মশালায় আশ্রয় নিলেন সুশান্ত ঘোষ । ডিজেল জেনারেটারে চালানো কুলারের ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে ছিলেন চেয়ারে । ওনার চালাঘর ঘিরে, আর নৌকোয় বসে, কুড়ি-পঁচিশজন বন্দুকধারী পাহারাদার, তারা পুলিশের আর শত্রু গ্যাঙদের আক্রমণ প্রতিহত করবে যতক্ষণ পারবে । বেবি আর ওনার মাঝে কথা বলার বিষয় হতে পারত ওনাদের ছেলে অপুর সুরক্ষিত থাকা, নির্ধারিত জায়গায় পোঁছানো । কিন্তু বিবাহ নামের কর্মকাণ্ডের দ্বারা দুজনের যোগাযোগের যে মাধ্যমটি ছিল, যা কিডন্যাপিঙের সূত্রে জোর করে তৈরি সম্পর্কে গড়ে উঠেছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে তারিণী মণ্ডলের মৃত্যুতে। বেবির নিঃশর্ত ভালোবাসা তাঁর সমস্যার সমাধান করতে পারেনি । দেখনপ্রেম হোক বা মাংসঘর্ষণ ভালোবাসা, সেসবের প্রলেপ লাগিয়ে কোনো ঘা শুকোয় না । শশুরের মৃত্যুতে তিনি যেমন গোপন আহ্লাদে মাতোয়ারা, তেমনই ছেলে অপুর অবধারিত গ্রেপ্তার, বিচার ও কারাদণ্ডের, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের, দুশ্চিন্তার চাপা আতঙ্কে বিপর্যস্ত । পারস্পরিক সম্পর্কের সমস্যার সমাধান এই ভাবেই করতে হল, বোঝাচ্ছেন নিজেকে, এ ছাড়া উপায় ছিল না । কিন্তু সে সমস্যার সমাধান হতে দিল না তাঁরই ছেলে। ছোঁ-মারা কিডন্যাপিঙের সময় যেমন আলাদা ছিলেন, এতকাল একসঙ্গে ঘর করে সেই আলাদাই রয়ে গেছেন, মাংসাশী জানোয়ারের হাইবারনেশানে, রেকলুজ, কাস্টঅ্যাওয়ে ।

চোদ্দ
মুঙ্গেরের দিয়ারার ঝোপড়িগুলোয় সাতসকালে তাজা রক্তের গন্ধে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বেলেমাছি চ্যানেল, ঘোড়ামাছি চ্যানেল, হোবারমাছি চ্যানেল, সিসিডামাছি চ্যানেল পলিমাটির দরদালানে পৌঁছে গিয়েছিল । ওঃ এত লোক গুলি খেয়ে, আগুনে পুড়ে মরেছে, আর কি থাকা যায়, প্রতিটি মাছি চ্যানেল ভনভনিয়ে ওবি ভ্যান চালিয়ে তড়িঘড়ি দুর্ঘটনার জায়গায় ।
ঘোড়ামাছি : আপনারা দেখতে পাচ্ছেন এই মুহূর্তে, জনগণমাছিদের ডুমোচোখের সামনে তিরিশ-চল্লিশটি হত্যা হয়েছে অ্যাবং সেই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ড। কিন্তু রাতের অন্ধকারে কারা এই লজ্জাজনক বীরত্ব দেখিয়েছে, তা কেউ বলতে রাজি নন, কেননা স্হানটি অসামাজিক চরিত্রের মাছিদের নিয়ন্ত্রণে । এই যে, ফলেরমাছি, আপনি তো প্রত্যক্ষদর্শী, আপনি কী দেখলেন ?
ফলেরমাছি : আমি কিছুই দেখিনি, তখন তরমুজের খোসার ভেতরে রাতের ঘুম দিচ্ছিলাম ; আমি গুলির শব্দে বিরক্ত হয়ে পচা তরমুজের ভেতর থেকে উড়তে বাধ্য হয়েছি, তাই আমার গায়ে লাল রং লেগে আছে । আমি এর ঘোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি । আমরা ফলের মাছিরা নির্ণয় নিয়েছে যে আমরা এইপ্রকার আওয়াজ অ্যাবং আগুন, যা শান্তি নষ্ট করে, তার বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবো । তবে গুজবমিশ্রিত অনুমান যে একজন যুবক বদলা নেবার হাতিহাঁক পেড়েছিলেন।
বেলেমাছি : নীল মাছির দল পৌঁছে গেছেন অকুস্হলে । আপনারা দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই, মানব প্রজাতির একাধিক মহিলার বক্ষস্হল নির্মল আকাশের তলায় উন্মুক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে অ্যাবং তাঁদের যাবতীয় অভিমান নিঃশব্দ বিলাপ হয়ে দৃশ্যমান । দীপঙ্করদামাছি, ক্যামেরাটা একটু প্যান করে দেখান ঘরের মাছিরা ঘরের কাজকর্ম ফেলে কোন আঙ্গিকে এই সামগ্রিক রসপানে অংশ নিতে র‌্যালির পর র‌্যালিতে আসছেন ।
নীলমাছি : বন্ধুগণ, আপনারা জানেন যে গত কয়েক দশক যাবত ডানার রঙ পালটে পালটে কায়েমিস্বার্থান্বেষী দলবদলু অ্যাবং রংবদলু গুয়েমাছিরা ভুল সংবাদ পরিবেশন করে চলেছেন । রক্তপাত ঘটলেও তাঁরা বলছেন যে রেতঃপাত হয়েছিল...আচ্ছা আমরা এখান থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছি, কেননা মানবপ্রজাতির বহু নমুনা পৌঁছে গেছেন এবং তাঁরা মাছিসমাজ সম্পর্কে অভদ্র কথাবার্তা বলছেন । ব্যাক টু স্টুডিও ।
হোবারমাছি : সঙ্গে থাকুন ।
মোদোমাছি : সঙ্গে তো থাকতে চাই গো, কিন্তু কী করে তোমাদের কাঁচের বাক্সটার ভেতরে ঢুকবো তার উপায় তো বাতলাও না ।
সরকারিমাছি : মানব সম্প্রদায়ের এক প্রতিকল্প তার ঔরস উপন্যাসে, আপনাদের সম্পর্কে যাচ্ছেতাই কথাবার্তা লিখেছে । আপনারা তাকে গিয়ে বিরক্ত করুন, সে-ই আপনাদের সবার সামনে ল্যাংটো করে ছেড়েচে।


পনেরো

দিল্লির ওপন টিকিট কাটাই ছিল অপুর । ফোমচামড়ার ব্যাগে তারিণী মণ্ডলের তিজোরি থেকে করকরে নোটের বাণ্ডিল আর কয়েকটা জামাপ্যান্ট নিয়ে, পাটনা গিয়ে সোজা দিল্লি, দিল্লি বিমানবন্দর থেকে রায়পুরে একরাত হোটেলে । পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে আতংকওয়াদি বা মাওওয়াদি আপ্রাধি ঘোষকে । সিকিউরিটি চেকে অশ্বমেধ ঘোষের অসুবিধা হল না । ভাগলপুর স্টেশানের টেলিফোন বুথ থেকে নিকিতাকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে ওর ম্যালেরিয়া হয়েছে, ফিরতে মাসখানেক লেগে যাবে । নিকিতা জানতে চাইছিল কী করে ভাগলপুরে অপুর বাড়ি যাবে । অপু বোঝালো, অনেকের ম্যালেরিয়া হয়েছে, শেষে নিকিতা আসলে ওর-ও হতে পারে । নিকিতা বলল, হরওয়খৎ ধোখা দেনে কে চক্কর মেঁ রহতে হো, মুঝে গিনতি মত পঢ়াও, ম্যায় জরুর পহুঁচ জাউঙ্গি, তুমহারে মাতা-পিতা সে মিলনা হ্যায় ।
অপু মোবাইলের সিম কার্ড বের করে ট্রেনলাইনে ফেলে দিল ।
রায়পুরে, বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে, বাসস্ট্যাণ্ডের সামনে, ফালতু হোটেল, ওর কাছে পরিচয়পত্র চাইল না, চাইলে ইউনিভার্সিটির পরিচয়পত্র দেখাবে বলে তৈরি ছিল , রেজিস্টারে লেখালিখিও করতে বলল না । রেজিস্টার চাইতে বেঁটে-মোটা-টেকো হোটেল মালিক বললে, আরে এখন ছাড়ুন ওসব ; এখন নদীর নিলাম হবে বলে লোক আসছে আর যাচ্ছে, আসছে আর যাচ্ছে । আপনার ভাগ্য ভালো যে ঘরটা আজ সকালেই খালি হয়েছে।
--নদীর নিলাম ? অনেক মাছ হয় নাকি ? না নৌকো যাতায়াত করে ?
--জলের জন্য নিলাম ।
--জলের জন্য ?
--শোনেননি আপনি ? রায়গড়ে কুরকেত নদী, দাঁতেওয়াডাতে সাবরি নদী, রায়পুর জেলায় খারুন নদী, কোরবাতে হাদেও নদী, ঝাঙ্গির-চম্পায় মাঁড নদী নিলাম হয়ে গেছে । সাবরি বা কোলাভ নদীর ধারে চিন্তালনাডের জঙ্গলে মাওওয়াদীরা ছিয়াত্তর জওয়ানকে মটিয়ামেট করে দিয়েছিল, কাগজে পড়েননি ? সাবরি নদীই তো উড়িষা আর ছত্তিসগড়কে আলাদা করেছে । উড়িষ্যার কোরাপুট থেকে চালু হয়েছে ।
--নদী যে নিলাম হয়, এই প্রথম শুনলুম । কোথায় গিয়ে মিশেছে নদীটা ?
--সাবরি নদী নারায়ণপুর-দাঁতেওয়াডায় প্রথমে পশ্চিম থেকে পুবে, তারপর উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে ভদ্রাচলমের কাছে গোদাবরীতে গিয়ে মিশেছে ।
--নৌকো চলে ?
--হ্যাঁ, কিন্তু বন্যার সময়ে নদীর চেহারা পালটে যায় । কখনও-কখনও আঠাশ ফিট পর্যন্ত জল ওঠে । আসেপাশে সব ডুবে যায় । যাতায়াত, এখন যেটুকু দেখছেন, তাও বন্ধ হয়ে যায় ।
...অপু আরেকটু হলে অবুঝমাড় শব্দটা উচ্চরণ করে ফেলত । গিলে ফেলল মগজ থেকে জিভে এসে নামা কথাটা।
--নদীর পাড়ে জংলিরাই থাকে । দণ্ডকারণ্যে কে যে আসলি জংলি আর কে যে মাওওয়াদী জংলি তা আপনি বুঝতে পারবেন না । পুরো দণ্ডকারণ্য জঙ্গলে হয় মাওওয়াদী নয়তো সিপাহিদের জামাত । আর ছিটপুট রিফিউজি, সোয়াধিনতার টাইমে ওরা বাংগালি ছিল।
--নদী কিনে করবে কি লোকে ?
--ফ্যাকটিরি বসছে । আপনি কিনতে পারবেন না, অনেক টাকা খাওয়াতে হয় এসব ব্যাপারে । করোড় করোড় । করোড়-করোড় ক্যাশ । নিলাম একটাকায়, পিছুয়াড়িতে করোড়-করোড়, পেটি ভর-ভরকে, খুল্লমখুল্লা।
--সব জল কি ফ্যাকট্রিই নিয়ে নেবে ? এতগুলো নদীর ?
--ওই তো কুরকেতি নদীর ধারে গারিয়া জাতের জংলিরা তরমুজ, শশা তারপর রবির মরশুমে রবি চাষ করত, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত, কিন্তু রাবো গ্রামের কাছে ড্যাম তৈরি হল, ব্যাস, জাঁপলি, কিকরিচোলি, দেহজান গ্রামের খেতি বন্ধ হয়ে গেল । এক হাজার মেগাওয়াটের পাওয়ার প্ল্যান্ট বসেছে তামনারে, সব জল খেয়ে নিচ্ছে ফ্যাকটিরি । জংলিদের খাবার জল নিয়ে চলছে হল্লাগুল্লা ।
--জংলি ?
--গারিয়া, গোঁড়, মাড়িয়া, মুরিয়া লোকেরা থাকে, গায়ে এক চিলতে জামা-কাপড় নেই, শর্মনাক, শর্মনাক, পুরুষগুলো দিনেরবেলাতেও সালফি মদ খেয়ে টপ্পাগুল বেহুঁশ ।
--আচ্ছা নারায়ণপুর যাবার সহজ উপায় বলুন তো ।
--বাসে করে চলে যান । তবে বাসগুলো সবকটা সিটে প্যাসেঞ্জার না পেলে যেতে চায় না । নৌকরওয়ালা বাসেও যেতে পারেন, ওটা রেগুলার, সরকারি নৌকরি করে যারা, নারায়ণপুর জেলা হেডকোয়ার্টার হবার পর পোস্টিং হয়েছে, বউ-বাচ্চা রায়পুরে, তাদের বাসে যেতে পারেন ।
--মোটর সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায় না ?
--ভাড়া তো পাওয়া যায় না, তবে আপনার মতন একজন বাংগালি আদমি আছে, নারায়ণপুরে বাড়ি, সে নিয়ে যেতে পারে। ও অনেক ফোটোগ্রাফার আর সাংবাদিককে নিয়ে গেছে, ওই দিকের অলিগলি চেনে ।
--লোকটাকে খবর দিন না ; আজকেই বেরিয়ে পড়ব তাহলে ।
--আগে ও মালকানগিরির যে গ্রামে থাকত তার নাম একানওয়ে ।
--একানওয়ে ? নাইনটিওয়ান ? এরকম নাম কেন ?
--বাংগালি রিফিউজিরা এসেছিল, সানতালিস, একাওয়ান, পঁয়ষট আর একহত্তর সালে, পরেও এসেছে ছিটপুট । জঙ্গল কেটে বানানো তাদের ঝোপড়পট্টিগুলোর তো নাম ছিল না । এক দুই তিন চার করে হবে বোধহয়, একানওয়ে বানওয়া এমনি করে একশো দুশো, কে জানে, সে অনেকদিন আগের কথা। যুগ কেটে গেছে কিন্তু বাংগালি লোকগুলো রিফিউজির মতনই গরিব থেকে গেছে । মাওওয়াদীরাও ওদের কাছ থেকে…
--রংদারি ট্যাক্স নেয় ?
--রংদারি ট্যাক্স । ভালো বলেছেন ।
--নাম কি ছেলেটার ?
--কাতিক, কার্তিক ছিল বোধহয়, লেখাপড়া শেখেনি তো, কার্তিককে কাতিক করে ফেলেছে । দেয়োই-দেওতাদেরও সম্মান করে না আনপড় বাংগালিগুলো ।
--ওর বাবার নাম কি গণেশচন্দ্র সরকার ?
--জি হাঁ । আংরেজি পড়ান । লেকিন কাতিক অপনে বাপ কো আব্বা পুকারতা হ্যায়, অওর মা কো অম্মি। অজব বাংগালি ।
--একটু ফোন করে দেখুন না । গণেশচন্দ্র সরকারের বাড়িতেই যাবো ।
--এসে যাবে, এসে যাবে, কজনই বা প্যাসেঞ্জার হয়, মোটর সাইকেল সওয়ারি করতে অনেক প্যাসেঞ্জারের সাহস হয় না ।
--আচ্ছা । তাহলে অপেক্ষা করি ।
--আপনি কী করেন ?
--আমি ফিউজিটিভ ?
--ফিউজিটিভ মতলব ?
--ভগোড়া ।
--হেঁঃ হেঁঃ, আচ্ছা-খাসা মজাক কর লেতে হ্যাঁয় আপ ।
ঘণ্টাখানেক পরে মোটর সাইকেলে গেরুয়া মাটির ধুলো উড়িয়ে কাটাঢ়েঁড়া জিন্সের প্যান্ট আর হাতকাটা লাল গেঞ্জিতে, পাঁচ ফিটের, বছর চল্লিশের একজন দোহারা লোক হোটেলের সামনে পৌঁছে হর্ন দিতে, হোটেল মালিক বলল, নিন, এসে গেছে কাতিক । লোকটাকে দেখে, বাবা একটা শব্দ শেখাতে কয়েকটা চড় মেরেছিলেন, সেই শব্দটা অপুর মগজে ভেসে উঠল, অকুতোভয় ।
কয়েকটা ধাপ নেমে অপু বলল, হিন্দিতে, আমি নারায়ণপুরের ইংলিশ টিচার গণেশচন্দ্র সরকারের বাড়ি যেতে চাই । উকোখুস্কো চুল লোকটা জিগ্যেস করল, গণেশচন্দ্র সরকার ? তার সঙ্গে কী কাজ ? আজ পর্যন্ত কাউকে দেখিনি তাঁর খোঁজে আসতে । অপু জবাবে বলল, সনাতন সরকার একটা চিঠি দিয়েছেন তাঁকে দেবার জন্য । ছেলেটার চোখ কটা, লক্ষ করল অপু ।
--সনাতনভাই ? তাঁর সঙ্গে কী করে পরিচয় হল, জানতে চাইল কার্তিক ।
অপু বলল, ওনার সঙ্গে পড়ি ।
--আপনি এখন কী করেন ? ভ্রু কোঁচকায় কার্তিক, নিশ্চিন্ত যে ওর মোটর সাইকেলের একজন সওয়ারি পাওয়া গেল । মোটর সাইকলের ধুলো পুঁছতে-পুঁছতে বলল, হাজার টাকা নিই ।
--ঠিক আছে, নো প্রবলেম, বলে অপু যোগ করল, কিছুই করি না । আমি ফিউজিটিভ ।
--ফিউজিটিভ ইয়ানে কি ?
--ভগোড়া । আমি আইনের চোখে ধুলো দিয়ে পালাচ্ছি । ওনার সাহায্য নিয়ে অবুঝমাড় জঙ্গলে গিয়ে লুকোবো । জঙ্গলটা নাকি দুর্ভেদ্য, পুলিশও যায় না সেখানে ।
কোমরে হাত দিয়ে গেরুয়া ধুলোর পাশাপাশি অট্টহাসি ওড়ালো কার্তিক । বলল, আরে ইয়ার, মাওওয়াদি, বনবিভাগ, রেভেন্যু ডিপাট আর আধামিলিট্রি মিলে জবরদস্ত কাহানি ছড়িয়েছে, হাউয়া খাড়া করে দিয়েছে । ভারতীয় জওয়ানরা কার্ল গুস্তাভ রাইফেল, আনডারব্যারেল গ্রেনেড হাতে ভেতরে ঢুকে বুড়বক বেনে গেছে । গিয়ে দ্যাখে হাড্ডিসার ঝোপড়পট্টি, গাছের পাতা আর সরু বাঁশে তৈরি ভুখমরিতে বেচয়েন অনজান আদমিদের গ্রাম, আর তংগ দড়িদঙ্কা আদিবাসী । অবুঝমাড়ে এখন যার ইচ্ছে সে ঢুকে যেতে পারে । শুধু মাওওয়াদিদের আর আধামিলিট্রির তিকড়মবাজিতে পড়ে চকনাচুর হয়ে যাবার মওকা থাকে, এই যা, বাদবাকি সব মনোহর কাহানিয়াঁ । চলুন, বসুন, ফিউজিটিভ মহাশয়জি ।
প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা জামা-ট্রাউজারে, ফোমচামড়ার ব্যাগে, চুলে, ভুরুতে ধুলোর চাদরে ঢাকা পড়ার পর অপু পৌঁছোল রায়গড় থেকে নারায়ণপুর ।
কার্তিকের বাবাকে সনাতন সরকারের চিঠিটা দিয়ে, গংগোতা প্রথা অনুযায়ী গণেশচন্দ্র সরকার আর তাঁর স্ত্রীর হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করে অপু ওনাদের জানালো যে চিঠিতে ওর যে বান্ধবীর উল্লেখ রয়েছে, তাকে সঙ্গে আনতে পারেনি ।
গণেশচন্দ্র সরকার সনাতনের চিঠি পড়ে অপুকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, দ্যাখো, কতদূর থেকে তুমি এলে, সনাতনের বন্ধু বলে, জায়গাটা দেখার ইচ্ছা হয়েছে তোমার ; কেউ আমাদের কোনো খোঁজখবর নেয় না, কে-ই বা নেবে, কেউ তো নেই। সনাতন নিশ্চয়ই ওর গালাগালের স্টক তোমার মাথায় উপুড় করে দিয়েছে? ভীষণ রগচটা । যত বেশি পড়াশোনা করছে তত ওর হিন্দি গালাগালের স্টক বাড়ছে । তুমি খাও-দাও, যতদিন ইচ্ছা থাকো, আমাদের ভালো লাগবে, তার আগে স্নান করে নাও, লাল চালের ভাত খাও, মাছ-টাছ পাবে না ।
অপু ওনাকে বলল, আপনি বসুন, প্রথমে শুনুন, আমার জীবনে কী ঘটেছে, আমি কেন এসেছি, কেন আমার বান্ধবীকে সঙ্গে আনিনি, আর এখন আমি কেন অবুঝমাড় জঙ্গলে যেতে চাইছি । শুনে, গণেশচন্দ্র সরকার, কোলে হাত রেখে, কিছুক্ষণ বসে রইলেন, পাশে দাঁড়িয়ে ওনার স্ত্রী । অপুর মনে হল, রোগা, ময়লা, টাকমাথা গণেশচন্দ্র সরকারের বয়স ওনার স্ত্রীর চেয়ে বেশ কম । ওনার স্ত্রী বললেন, তোমাকে কে বুঝিয়েছে যে অবুঝমাড় দুর্ভেদ্য? আমার ছেলে ওই জঙ্গলে তিন বছর ছিল ; মাওওয়াদিরা ওর গোঁড়-মাড়িয়া বউকে গুলি করে মারার পর ও পালিয়ে এসেছে । বাড়িতে প্রায় থাকেই না কার্তিক । রাতে ফেরে, খায়, ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ভোর না হতেই বেরিয়ে পড়ে ; যদি রায়পুরে থেকে যায় তাহলে সে-রাতে ফেরেই না ।
অপু স্তম্ভিত ।
কার্তিক সরকার অপুকে পৌঁছে দিয়ে নতুন যাত্রীর খোঁজে মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ।
কার্তিকের বাবা-মা ওর জীবনের ঘটনা, থেমে-থেমে, কন্ঠস্বরে শ্লেষ্মা মিশিয়ে, অপুকে বলতে আরম্ভ করলেন। কার্তিক এক মাড়িয়া-গোঁড় মেয়ের প্রেমে পড়েছিল ; মেয়েটি মাঝে-মাঝে কোকোমেত্তায় ডিম, মুর্গি, শুয়োর বাচ্চা, বিয়ার বাহুতি পোকা, মহুয়ার ফুল, সালফি মদ বিক্রি করতে আসত । কার্তিক ওর ডিম কিনত, মুর্গি কিনত, সালফি খেতো আর যত দাম তার চেয়ে বেশি টাকা দিত । একদিন মেয়েটা কার্তিককে জানালো মাওওয়াদিরা ফতোয়া জারি করেছে যে জঙ্গলের বাইরে আর যাওয়া চলবে না । যারা যাবে তাদের পুলিশের চর বলে সন্দেহ করা হবে ; ফিরে আসলে জন আদালতে তাদের বিচার হবে । মেয়েটার নাম ছিল কুমিয়া খোসা।
---ছিল মানে ?
--কইছি, কইছি, কার্তিক কুমিয়াকে মোটর সাইকেলে বসিয়ে, আমাদের কাছে এনে জানালো যে ও চলে যাচ্ছে মেয়েটার সঙ্গে ঘর করতে, কুমিয়ার হিকোনার গ্রামে । আমরা কার্তিককে কোনো কাজে বাধা দিই না, ওর জন্মের কথা আরেকদিন শুনো । মনে হয়েছিল, যাচ্ছে যাক, কোথাও তো সংসার পাতবে, নারায়ণপুরে একা-একা অস্হির হয়ে, মাথা খারাপ করে, দুঃখে-দুঃখে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে, ঘুরে বেড়াবার চেয়ে ঢের ভালো ।
হিকোনারে যাবার পর ওদের বিয়ে দেয়া হয়েছিল গোঁড়-মাড়িয়া রীতি অনুযায়ী , দুজনকে রঙিন কাপড়ে আগাপাশতলা মুড়ে ওদের ওপর দুধ ঢেলে বিয়ে হল ; আমরা দুধ, গায়ে জড়াবার শাড়ি, গোটা পাঁঠার মাংস কিনে নিয়ে গিয়াছিলাম । গোঁড়-মাড়িয়া সমাজে বিয়ে না করলেও চলে, অনেক ছেলে-মেয়ে বিয়ে করে না, তাদের কয়েকটা বাচ্চা হয়ে যাবার পরও বিয়ে করতে পারে না, দুধের টাকা, নতুন কাপড়ের টাকা, মাংস খাওয়াবার টাকা, সালফি খাওয়াবার টাকা, কোথা থেকে পাবে, বলো । পঁচিশ তিরিশটা চালাঘর নিয়ে এক-একটা গ্রাম, যদিও সেগুলো পাশাপাশি নয়, ছড়ানো-ছেটানো । তুমি ভেবো না যে অবুঝমাড় অ্যামাজনের মতন ঘন জঙ্গল, মোটেই নয়, সুন্দরবনের মতনও নয়, খোলামেলা ধরণের জঙ্গল, দূর থেকে গাছের ফাঁকে দেখতে পাবে, কে আসছে, ভাল্লুক, শেয়াল, বনবিড়াল আসছে কি না।
আমরা ওর সংসার শুরু করার কয়েক মাসের খরচ দিয়ে ফিরে এসেছিলাম । ওরা তেল-মশলা দিয়ে আমাদের মতো রান্না করে না, বেশির ভাগ মাংস পুড়িয়ে খায় । একদিক থেকে ভাল, খরচের বোঝা কম । ভালই ছিল দুজনে, ওদের চালাঘরে, মুর্গি, খরগোশ আর শুয়োর পুষেছিল । কুমিয়া তীর-ধনুক দিয়ে খরগোশ, বেঁজি, কাঠবেরালি, সাপ, পাখি শিকার করে আনলে দুজনে মিলে খেতো । পেণ্ডা খেতি, মানে শিফটিং কালটিভেশান বা জুম চাষের সময়ে পাহাড়ের ঝোপঝাড় পোড়ানোয়, ফসল পোঁতা আর কাটায়, অংশ নিত । শিকারের ফাঁদ পাতায়, জংলি পাখি শিকারে, মহুয়ার ফুল কুড়োনোয়, অংশ নিত ।
সকলের দেখাদেখি কার্তিকও পাঁচ টাকা দিয়ে মাওওয়াদি জনতম সরকারের নাগরিক হয়ে গেল । জন আদালতের সদস্য করা হল ওকে । কার্তিক ভেবেছিল সদস্য হয়ে গেলে জঙ্গলের কোনো অংশের পাট্টা পাবার সুবিধা হবে । পাট্টার জন্য জনতম সরকারের অধ্যক্ষকে বলতে গিয়ে বিপদে পড়ল । পাট্টা দেয় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট । জনতম সরকারের নেতারা ভাবল যে কার্তিক যেহেতু গোঁড়-মাড়িয়া নয়, তাই গোঁড়-মাড়িয়া মেয়ের সঙ্গে বসবাস করে, বাচ্চা পয়দা করে, বন বিভাগ-রাজস্ব বিভাগে যোগাযোগের নামে ফিরে যাবার তাল করছে, ফিরে গিয়ে হয়ত পুলিশের সঙ্গে যোগসাজস করে জনতম সরকারকে বিপদে ফেলে দেবে ।
তার আগে সেরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে, কোনো-কোনো গ্রামবাসী জনতম সরকারের হুকুম পছন্দ হয়নি বলে পালিয়েছে জঙ্গলের বাইরে, নারায়ণপুরে, বা আরও দূরে অন্ধ্র কিংবা মহারাষ্ট্রতে । পুলিশ তাদের সাহায্য নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার চেষ্টা করেছে, ঢুকেছে, খুনোখুনি হয়েছে, গুলিগোলা চলেছে । এই তো সেদিন সতেরো বছরের একটা মেয়ে ধরা পড়ল, সে আইইডি বানাতো ; সে জানিয়েছে যে তার চেয়ে কম বয়সী মেয়েরা আইইডি বানায় ।
গোঁড়-মাড়িয়ারা নির্লোভ, সরল প্রকৃতির, বুঝলে, খায়, নেশা করে, জংলি জানোয়ার বা পাখি শিকার করে, পেণ্ডা খেতি করে সবাই মিলে, ফসল তোলে, এই ভাবেই জীবন চলে যায় । সহযোগীতার ক্ষেত্রে ইজরায়েলের কোঅপারেটিভের চেয়ে ভালো । ওরা পড়ে গেছে মাওওয়াদি আর সরকারের জাঁতাকলে । আদিবাসীরা প্রথমে ভেবেছিল যে মাওওয়াদিরা ওদের সরকারি অত্যাচার-অবিচার থেকে বাঁচাবে। তার বদলে সেই একই শাসনপ্রথা নতুন ভুত হয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে ।
ওখানে সরকারি স্কুল আছে, আঙনওয়াডিও আছে, সোলার পাওয়ার আছে, পাহাড়ে ওঠার আগে পর্যন্ত হ্যাণ্ড পাম্প আছে । স্কুলে মিড-ডে মিল রান্না করার কাজ পেয়েছিল ওর বউ । রান্না করার দরকার হতো না । শুনে তুমি অবাক হবে যে স্কুলের প্রার্থনা হয় গায়ত্রী মন্ত্র গেয়ে, কারণ স্কুলটা সরকারি, আমি দেখে এসেছি । স্কুল থেকে বরাদ্দ র‌্যাশন মাওওয়াদিরা নিয়ে চলে যেত, তাদের বন্দুকধারি ক্যাডারদের জন্য, তাতে কারোরই আপত্তি ছিল না । ওরা জানতে পারেনি যে ওদের ওপর জনতম সরকারের জন মিলিশিয়া নজর রেখেছে ; কার্তিক তো রিফিউজির ছেলে । মালকানগিরিতেও লক্ষ করতুম যে মাওওয়াদিরা বাঙালি রিফিউজিদের পছন্দ করে না । জন মিলিশিয়ারা বন্দুকধারী গণমুক্তি গেরিলা বাহিনীর ক্যাডারদের থেকে আলাদা । জন আদালতে কাউকে মেরে ফেলার হুকুম হলে জন মিলিশিয়ার লোক তা পালন করে । জন মিলিশিয়ার ছোকরাদের কাছে ট্রানজিসটার আর ল্যাপটপ দেখেছি । ল্যাপটপে ওরা সিনেমাও দ্যাখে, হলিউডের হিন্দিতে ডাব করা সব ফিল্ম, হিরোগিরির ফিল্ম, যদিও বেশির ভাগ গোঁড়-মাড়িয়া হিন্দি ভালো জানে না । কুমিয়া, কার্তিকের বউও, তেমন হিন্দি জানত না । কার্তিক অবশ্য ছোটোবেলা থেকে ওদের সঙ্গে মিশেছে বলে গোঁড়-মাড়িয়ায় কথা বলতে পারে, আমরা দুজনেও তত ভালো পারি না ।
বাচ্চা হবার পর কুমিয়াকে নিয়ে তিন-চার মাসে একবার আসত আমাদের কাছে । গোঁড়-মাড়িয়া মেয়েদের গয়নার খুব শখ । কুমিয়ারও গয়না পরার শখ ছিল । সোনার চেয়ে রুপোর জল-দেয়া ব্রোঞ্জের গয়না ওদের বেশি পছন্দ । আমরা ভাবলাম ব্রোঞ্জের কেন দেবো, ছেলের বউকে দিচ্ছি যখন তখন রুপোর গয়নাই দিই। ওদের ওপর যে জন মিলিশিয়ার জাসুসরা নজর রাখত তা ওরা টের পায়নি । গয়না পরে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল কুমিয়াকে । কার্তিক ভাবল যে বার-বার কষ্ট করে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে প্রায় আট-দশ কিলোমিটার হেঁটে আসা আর আবার আট-দশ কিলোমিটার হেঁটে ফেরত যাওয়ার চেয়ে মোটর সাইকেলটাই গ্রামে নিয়ে গিয়ে রাখবে, ছাগল-চরানো রাস্তাতেও কার্তিক মোটর সাইকেল চালাতে পারে । ওর বউ আগে চলে গেল বাচ্চা নিয়ে যাতে জনতম সরকারের কোপে না পড়ে । কার্তিকের যেতে দু’দিন দেরি হয়ে গিয়েছিল, মোটর সাইকেলের সারভিসিং করাতে গিয়ে ।
গ্রামে পৌঁছে কার্তিক জানতে পারল যে জন আদালতের বিচারে কুমিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে । গুলি করে মারা হয়েছিল কুমিয়াকে । কার্তিক যাবার আগেই ওরা কুমিয়াকে কবরও দিয়ে দিয়েছিল । বাচ্চা ছেলেটা কার কাছে আছে জানতে চাইলে কেউ কার্তিকের সঙ্গে কথা বলেনি । ওকে বলা হয়েছিল তক্ষুনি নারায়ণপুরে ফিরে যেতে নয়তো ওরও কুমিয়ার দশা হবে । কুমিয়ার কবরের কাছে গাছের ডালে নিজের শার্ট খুলে বেঁধে খালি গায়ে চলে এসেছিল ।
সেই যে ও জঙ্গল থেকে মোটর সাইকেলে চেপে পালিয়ে এসেছে, আর ও-মুখো হয়নি । আমাদের মনে হয় পালিয়ে এসে বেঁচে গেছে । এই কিছুদিন আগে অপারেশান হাক্কা করেছিল সরকার, টোকে নামের পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল। হেলিকপ্টারের ডানার বাতাসে অনেকের চালাঘরের ছাদ উড়ে গেছে । আসলে অবুঝমাড় নিয়ে সবাই এতকাল এমন গল্প ফেঁদেছিল যে প্রচার হয়ে গিয়েছিল জায়গাটা দুর্ভেদ্য । সরকার তো ড্রোন উড়িয়ে ফোটো তুলেছিল আর ভেবেছিল যে কালো-কালো দেখতে জায়গাগুলো বুঝি ট্রেঞ্চ আর মাওওয়াদিদের ক্যাম্প । কোবরা-ফোবরা, সিআরপিএফ, পুলিশের লোকজন অপারেশান হাক্কা চালিয়ে ভেতরে ঢুকে বুঝতে পেরেছে যে সবই ফক্কিকারি, মাওওয়াদি, টিম্বার মাফিয়া আর সরকারি কর্মচারীদের স্বার্থান্বেষী প্রচার ।
--কিন্তু আমি তো এরকমই শুনে এখানে এসেছি । এটাই সেফেস্ট জায়গা মনে হয়েছিল ।
গণেশচন্দ্র সরকার বললেন, আশির দশকের শুরুতে বিদেশি টিভি চ্যানেল অবুঝমাড়ে ঢুকে ওদের ঘোটুল নিয়ে একটা তথ্যচিত্র তৈরি করে প্রচার করেছিল । এখন গোঁড়-মাড়িয়া মেয়েরা সকলেই পোশাক পরে, শাড়ি-ব্লাউজ-শায়া, ভেতরের জামা । এখনও ঘোটুল আছে, সেখানে পোশাক পরে ঢোকে ছেলে-মেয়েরা ; সেক্সের ব্যাপারে ওদের সমাজ ইউরোপ আমেরিকার চেয়েও প্রগ্রেসিভ আর পারমিসিভ । যখন তথ্যচিত্র তোলা হয়েছিল তখন ওদের ঘোটুলে ওরা পোশাক পরে যেত না । ভারত সরকার ভাবল যে এটা ভারতবিরোধী প্রচারের ষড়যন্ত্র, ভারতের ইমেজ বিদেশে নষ্ট হচ্ছে । ব্যাস, হাঁটু-কাঁপা প্রতিক্রিয়ায় অবুঝমাড়কে প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করে দেয়া হল । এতকাল নো একট্রি জোনই ছিল, এই কিছুদিন হল নিষেধ তুলে নেয়া হয়েছে । নিষেধের ফায়দা লুটত মাওওয়াদি, টিমবার মাফিয়া, বন বিভাগ, তেন্দু পাতার ব্যাপারি, রেভেনিউ ডিপার্টমেন্ট । নিষেধের দরুণ একদিকে তো নানা গল্প ছড়িয়েছে, অন্যদিকে দেশের অন্য আদিবাসীরা যে সুযোগ-সুবিধা পায় তা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত থেকেছে অবুঝমাড়ের আদিবাসীরা ।
আমার প্রতিবারই এলেকশান ডিউটি পড়ে । গত বিধানসভা নির্বাচনে কোকোমেত্তায় ভোট দেবার জন্য কুরসুনার, জিলাপুর, সোনাপুর, কুদলা, কাছাপাল, ঝারাবাহি, মাঙ্গুর, বোলাবেড়া, মাস্তুর, সাহাকাগোড়া থেকে গোঁড়-মাড়িয়া আর মুরিয়ারা হেঁটে ভোট দিতে এসেছিল, বাচ্চা কোলে মেয়েরা, বুড়ো-বুড়িরাও । ভোটের জন্য ঢেড়া পেটানো হয়েছিল গ্রামে-গ্রামে, যাকে ওরা বলে মুনাড়ি । অনেকে আগের দিন রাতের বেলাই পৌঁছে গিয়েছিল বলে তাঁবু খাটিয়ে শোবার ব্যবস্হা করতে হয়েছিল ।
এবারের সংসদ নির্বাচনেও গোঁড় মাড়িয়া মুরিয়ারা দলে-দলে ভোট দিতে এসেছিল । তা ভোট শেষে ফেরার সময়ে পোলিং পার্টির আটজন আর আধামিলিট্রির পাঁচজনকে কেতুলনার গ্রামের কাছে ল্যাণ্ডমাইন পেতে উড়িয়ে দিল আশি-নব্বই জনের মাওওয়াদি জামাত । ঈশ্বরের কৃপায় আমার এলেকশান ডিউটি এখানেই পড়েছিল । তুমি বলো, ওভাবে কি বিপ্লব হবে ? গোঁড়-মাড়িয়াদের জীবনের উন্নতি হবে ? আমি তো কিছুই বুঝি না বাবা ।
--বিপ্লব ? বিপ্লবের আমি তেমন কিছু বুঝি না । যুক্তাক্ষর শব্দগুলো সব বেকার ।
হ্যাঁ, একটা কাজ ওরা করছে, তা হল সেগুনগাছ, শিশুগাছ, শালগাছগুলো টিম্বার মাফিয়াদের করাত থেকে বেঁচেছে ; তখন যদি ওরা থাকত তাহলে মালিক মকবুজার মতন জঘন্য ঘটনা ঘটত না । আরেকটা হল, সব আদিবাসী এলাকার মতন অবুঝমাড়েও তো মাটির তলায় খনিজে ভরা । যতদিন ওরা পাহারা দিতে পারবে ততদিন কর্নাটকের আকরিক লোহার মতন লুকিয়ে-লুকিয়ে জাহাজ ভরে-ভরে মাও-এর দেশ চিনে চোরাচালান করা হবে না । দেখা যাক কারা শেষ পর্যন্ত জেতে ।
কার্তিকের সঙ্গে কথা বললেই টের পাবে যে জঙ্গলের ভেতরে কে যে আদিবাসী, কে মাওওয়াদি জন মিলিশিয়া, কে জন আদালতের সদস্য, কে মাওওয়াদি তাত্ত্বিক, কে কেন্দুপাতার ফড়ে, আর কে বনদপতর বা রাজস্ব বিভাগের কর্মী তা তুমি পার্থক্য করতে পারবে না । শুধু পিএলজিএ, মানে গণমুক্তি গেরিলা বাহিনীর ক্যাডারদের, চিনতে পারবে, ওরা জওয়ানদের মতন জলপাইরঙের পোশাক পরে । আমার-তোমার মতন সাধারণ মানুষের সামনে ওরা বেরোয় না বড়ো একটা । আদিবাসীরা দুপক্ষের শাসনের-হুমকির আতঙ্কে জীবন কাটাচ্ছে ।
তুমি ফিউজিটিভ হয়ে এখানেই থাকো । বিহারে সবই কালক্রমে ধামাচাপা পড়ে যায়, তিন হাজার কোটি টাকার চারাঘোটালাই চাপা পড়ে গেল । এবারের এলেকশানে রাবড়ি দেবী এফিডেভিট দিয়ে জানিয়েছেন যে ওনার সম্পত্তি হল পঁয়ষট্টি কোটি টাকা, ওনার মেয়ে মিশার চার কোটি টাকা । তবেই বোঝো । সম্প্রতি প্রাক্তন কয়লা সচিব পি সি পারিখের স্মৃতিকথা সময় পেলে পোড়ো । উনি লিখেছেন যে কয়লা মন্ত্রী শিবু সোরেন আর ওনার উপমন্ত্রী দাসারি নারায়ণ রাও কোল ইনডিয়া লিমিটেডের পদে পোস্টিঙের জন্য শশী কুমার-এর কাছ থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা একলপ্তে আর প্রতিমাসে দশ লাখ টাকা করে চেয়েছিল । এই তো দেশ, যার স্বাধীনতার জন্য আজও আমরা লাৎ খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছি । আমাদের কোনো আইডেনটিটি নেই । সনাতন যে গালাগাল দেয়, তা ইমপোটেন্ট রেজ । ও গালমন্দ করে শরীর সুস্হ রাখে । ইমপোটেন্ট রেজে ভুগে-ভুগে আমার কন্সটিপেশানের ব্যারাম হয়ে গেছে ; রাতে ল্যাক্সেটিভ খাই আর সকালে চোখ বুজে বসে থাকি, যারা আমাদের দুরবস্হার জন্য দায়ি তাদের মাথার ওপর ।
--আমার রেজ ইমপোটেন্ট নয় বলে আমি ফিউজিটিভ, গংগোতা মায়ের গরম রক্ত আর বাঙালি বাবার ঠাণ্ডা রক্তের গুণ । বলল অপু ।
--কার্তিক তোমায় ওর মোটর সাইকেলে বসিয়ে একদিন অবুঝমাড় ঘুরিয়ে আনবে । কুমিয়া মারা যাবার বাৎসরিকে গাছে নতুন কাপড় বাঁধতে যাবার জন্য গোঁ ধরেছিল, আমরা যেতে দিইনি। তুমি সঙ্গে থাকলে সুবিধা হবে, চারিদিকে নজর রাখতে পারবে।

ষোলো
বনবিভাগের বিট মার্শাল : দুজন পোচারের বডি পড়ে আছে স্যার ।
বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : দেখে তো পোচার মনে হচ্ছে না । টিম্বার মাফিয়ার এজেন্ট শালারা, নিশ্চই ।
বনবিভাগের বিট মার্শাল : টিম্বার মাফিয়ার এজেন্টদের আমি চিনি স্যার । এরা বাইরের লোক । কী করে ওখানে গিয়ে পড়ল ? বেঁচে আছে না মরে গেছে !
বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : কেন মিছিমিছি নিজের বিপদ ডেকে আনছ । যা রেগুলার রিপোর্টিং তাই রেকর্ড করে দিও ।
বনবিভাগের বিট মার্শাল : ব্যাস স্যার, কুরুসনার ছেড়ে অনেকটা চলে এসেছি, আর ভেতরে যাওয়া সুবিধার নয়।
বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : চলো ।

সতেরো
রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যাবার বাসে ইতুকে তুলে দিয়ে অমিত বলে দিয়েছিল, বাস থেকে নেমে সোজা গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকবি; সুশান্তজেঠুর দেয়া তোর মোবাইল থেকে একটা ছেলেকে ফোন করে দিয়েছি । তুই মিশনের গেটের কাছে পৌঁছে এই নম্বরে একটা মিস কল দিবি । নারায়ণপুরে নেটওয়র্ক তত ভালো কাজ করে না । ছেলেটা রেসপণ্ড করে ওর নাম বলবে বীরবল মাড়িয়া । হিরো হণ্ডার কালো রঙের স্পেলনডার মোটর সাইকেলে আসবে । ও তোকে নমস্তে ইতু দিদি বললে কোনো বাক্যব্যায় না করে পিলিয়নে বসে পড়িস । ও তোকে যেখানে পোঁছে দেবে, সেখানে তোর সঙ্গে আমার পরিচিতদের দেখা হবে, হয়তো তোর পরিচিতও থাকতে পারে কেউ । চিন্তা করিসনি না, মনে রাখিস, যেখানে ঢুকতে যাচ্ছিস সেটাকে প্রশাসনের লোকেরা বলে জংলি পাকিস্তান।
বাসডিপোয় ইতুর কান্না পায়নি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল । কেঁদে ফেলেছিল অমিত, রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছিল যাত্রীদের চোখ এড়িয়ে । বলেছিল, আর দেখা হবে না, জানি, তোকে শেষবার দেখে নিচ্ছি । উত্তরে ইতু বলেছিল, আমি আমার অতীতকে কলকাতা বিমানবন্দরে প্লেনে ওঠার সময় থেকে কাট-অফ করে দিয়েছি, তুইও তাই করে ফ্যাল । সবাইকে ভুলে গিয়ে যা করবার কর, বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেও তাদের ভুলে যা । গেট রিড অফ অলল মেমরিজ ।
ডেনিমের ট্রাউজার আর ঢিলেঢালা টপ পরেছিল ইতু, পায়ে জগিং করার কেডস, কাঁধে ওর ঝোলা । রায়পুরে দু’বোতল মিনারেল ওয়াটার আর বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে নিয়েছে ।
যে-বাসটায় চেপেছিল সেটার নাম, ইতুর অবাক লাগল শুনে, নৌকরওয়ালা বাস । কন্ডাক্টার টিকিট দিল না কাউকে । স্কুলের অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার হাতে প্রত্যেক যাত্রির কাছে গিয়ে তাদের নামের সামনে ছককাটা ঘরে সই নিয়ে নিল । মাসের শেষে টাকা নেবে । প্যাসেঞ্জারদের পোস্টিং হয়েছে নতুন জেলা-সদর নারায়ণপুরে ; তাদের পরিবারকে নিয়ে যায়নি, নারায়ণপুরে ভালো স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল, মল, মাল্টিপ্লেক্স কিছুই গড়ে ওঠেনি এখনও । ইতুকে কন্ডাক্টার বলল, দিতে হবে না ।
বাস থেকে নেমে হাতেটানা রিকশয় চেপে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে বীরবল মাড়িয়াকে মিসড কল দিয়ে অর্জুন গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ইতু ।
নমস্তে ইতু দিদি, শুনে, কালো মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে, ইতুর নাকে ছেলেটির যৌবনগ্রন্হির ঝাপটের উগ্র গন্ধ নাকে এসে লাগতে প্রায় বমি পেয়ে গেল ; উফ, ফেরোমোন । মুখে থলেটা চাপা দিয়ে সামলাল । কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারল যে এক হাতে ছেলেটির পেট ধরে থাকতে হবে, আরেক হাতে মোটর সাইকেলের হ্যাণ্ডল, নয়তো সড়কের যা অবস্হা, নির্ঘাত ছিটকে পড়বে কোনো পাথরে চাকা পড়লেই । ঘামে ভেজা পেটে হাত রেখে ধরতে, ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, ঠিক করে বসুন, রাস্তা ভালো নয়, এই তো সবে দুটো ব্লক নিয়ে নারায়ণপুর জেলা তৈরি হয়েছে । ইতুর মনে পড়ল অমিত এভাবেই ওর স্কুটারে পেট ধরে বসেছিল, আর নাভিতে সুড়সুড়ি দিয়েছিল ।
যুবকটির পেট, বর্ষায় ভেড়ার লোমের মতন, বেশ ভিজে, উনিশ-কুড়ি বছর বয়স হবে, গায়ের রং মুখের গড়ন দেখে আদিবাসী বলেই মনে হল । ইতু জিগ্যেস করল, দান্তেশ্বরীর মন্দির পড়বে কি রাস্তায় ।
--না দিদি, দান্তেশ্বরী হল বস্তারের দেবী । নারায়ণপুরে অবুঝমাড়িয়াদের দেবী হল কাকসার । বৈগারা রাসনাভাকে পুজো করে, আর গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে । উত্তর শুনে যুবকটিকে কোনো পালটা প্রশ্ন করল না ইতু । নিজেকেই প্রশ্ন করল, মেঘনাদ, এ কোন মেঘনাদ, রামায়ণের মেঘনাদ, যে মেঘনাদকে নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকাব্য লিখেছিলেন ?
যুবকটি বলল, আমার নাম বীরবল মাড়িয়া নয়, আমার ট্রাইবের নাম ওটা । অবুঝমাড়ে দুজাতের গোঁড় থাকে, মাড়িয়া গোঁড় আর মুরিয়া গোঁড় । শহরের লোকেরা মনে করে অবুঝমাড় মানে যে জায়গাকে এখনও জানা হয়ে ওঠেনি । ঠিকই, অবুঝমাড়কে কেউ জানে না । কিন্তু তা অবুঝমাড়ের মানে নয় । মাড় একরকমের শেকড় ।
--ও, বলল ইতু, ভাবল রোদ বাঁচাতে মাথায় গামছা চাপা দেবে কিনা । নাঃ, এখন থেকে তো রোদ বৃষ্টি ঝড় যা-ই হোক, কোনো কিছুর দ্বারা পরাস্ত হলে চলবে না । সহ্য করবে । সহ্য করবেই । সহ্য করতে হবে । ছেলেটিকে বলল, তুমি সামনে দিকে তাকিয়ে চালাও, যা রাস্তার অবস্হা ।
এভাবে কখনও বাইরে-দূরে বেরোয়নি ও, ইতু । সঙ্গে টুথব্রাশ, চিরুনি, তোয়ালে, সাবান অবশ্যই নিত, বাবা-মার সঙ্গে বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবার সময় । বটঠাকুমা বড়দাদু ইউরোপে বেড়াতে যাবার সময়, সেখানে টয়লেট পেপার ব্যবহার করতে হবে শুনে, সঙ্গে একটা প্লাসটিকের মগ নিয়েছিলেন । ও কী করবে, কোথায়ই বা করবে ?
--জানেন, এখানে কেউ আসে না , বেশ দূরে-দূরে প্রায় দুশো তিরিশটা গ্রাম আছে, চার হাজার একর জঙ্গলে ছড়িয়ে, তিরিশ হাজারের বেশি মানুষ, বেশির ভাগই বীরবল মাড়িয়া আর গোঁড়, যাদের খোঁজখবর সরকার নেয় না, জানেই না সরকারি আফসররা । কেন বলুন তো ? হোল ইনডিয়ায় শুধু এইটুকু এলাকার কোনো সার্ভে আজ পর্যন্ত হয়নি, সেনসাস হয়নি । রিপোর্টাররাও বস্তার যেতে চায়, নারায়ণপুরে আসতে চায় না, তাই আমার রোজগার তেমন হয় না । নারায়ণপুর, বিজাপুর আর বস্তার, এই তিন জেলার জঙ্গল এলাকা হল অবুঝমাড় । আপনাকে এ-সব বলছি কেন বলুন তো ? যিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন তিনি বলেছেন যে আপনাকে জায়গাটার ছবি বুঝিয়ে দিতে ।
--ও, আচ্ছা । মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল বলে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল ইতু । তারপর নিজের মোবাইলটা বীরবল মাড়িয়ার হিপ পকেটে ঢুকিয়ে বলল, যিনি তোমাকে পাঠিয়েছেন, তিনি বলেছিলেন মোবাইলটা তোমাকে দিয়ে দিতে ।
--হ্যাঁ, আচ্ছা, ঠিক আছে । অবুঝমাড়কে ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বল আর মাওওয়াদিরা । গ্রামের লোকেদের সঙ্গে মাওওয়াদিরা মেশার চেষ্টা করে । সিপাহি জওয়ানরা এড়িয়ে চলে । আপনাদের শহরের ভিখমাংগা বস্তির চেয়েও বদতর এখানকার জীবন । বিজলি নেই, খাবার জল নেই, স্কুল নেই, ডাক্তার-বইদ নেই, কারোর কিছু হলে চিকিৎসার কোনো উপায় নেই, তা সে আধামিলিট্রি জওয়ান হোক বা মাওওয়াদি জওয়ান, গ্রামের লোকেদের কথা তো ছেড়েই দিন, ওরা জানেই না কাকে ডাক্তার বলে, হাসপাতাল বলে । আফ্রিকাতেও এরকম গয়াগুজরা এলাকা পাবেন না । তবে, শ্বাস নিয়ে, বলল বীরবল মাড়িয়া, শহর মানেই তো চাপা দুর্গন্ধের ম্যানহোল ; যতো বড়ো শহর, তত বেশি ম্যানহোল । এখানের আকাশে যেমন রাতের তারা, আপনাদের শহরে তেমন মাটিতে পাতা ম্যানহোল ।
ইতু নিজেকে প্রশ্ন করল, এখানে কেন আসতে চাইলুম ? বাড়িতে কী ভালো ছিলুম না ? কত বাঙালি বাড়িতেই তো অবিবাহিতা মেয়েরা থাকে যারা সকলের অবহেলায় অবরে-সবরে মুখঝামটা খেয়ে তাদের মাঝে বসবাস করে ক্রমশ ন্যাড়ামাথা বুড়ি হয়ে যায়, স্বজনদের বাচ্চা হলে তাদের সঙ্গে খেলে, সময় কাটায়, বাড়িতে কোনো উৎসব হলে সে-ই খাটাখাটুনি করে, আর অতিথি অভ্যাগতদের সাবাশি পায়, অসুস্হ হয়ে সিঁড়ির তলায় চটে বা সতরঞ্চিতে শুয়ে মরে ভুত হয়ে যায় । নাঃ, একেবারে ভালো ছিলুম না, তার কারণ কোনো কাজই নিজের জন্য করছিলুম না, শুধু বেগার খাটছিলুম । এবার নিজের জন্য কিছু করব । যা হবার হোকগে, সিআরপিএফ-এর গুলি খেয়ে, না খেতে পেয়ে, মাওওয়াদিদের বিশ্বাস অর্জন করতে না পেরে, গ্রামবাসীদের সন্তুষ্ট করতে না পেরে, মরে যেতে হলে মরে যাবো, নিজের জন্য তো মরব । ছেলেটিকে বলল, তুমি চুপ করে গেলে কেন, বেশ ভালোই তো লাগছে শুনতে ।
--কুরসুনার গ্রাম এসে গেল তো, তাই । যে অনজান দুনিয়ায় আপনি ঢুকতে চলেছেন, এই গ্রাম হল তার প্রবেশপথ । ভারত সরকার বলুন, ছত্তিশগড় সরকার বলুন, এখান পর্যন্তই তারা ছিল, অপারেশান হাক্কার পরে কিছুটা বদলালেও, মানুষের মনের ভেতরটা বদলাতে অনেক সময় লাগে । ওই যে স্কুল বিল্ডিং দেখছেন, ওখানে আগে আধামিলিট্রি জওয়ানরা থাকত, তাই স্কুলটা চলে গেছে, ওই যে, ওখানে যে চালাঘর দেখতে পাচ্ছেন, ওখানে । আসলে স্কুলটাকে টেনে নিয়ে গেছে মাড়িয়াদের আৎমা, পূর্ণিমার দিন যদি আসেন, তাহলে নিজের চোখে দেখতে পাবেন যে স্কুলটা একটু-একটু করে দক্ষিণে সরে যাচ্ছে । নতুন স্কুল বিল্ডিংটা পুরো তৈরি হয়নি, অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে । মাওওয়াদিরা নাকি ঠিকেদারকে এমন হুমকি দিয়েছিল যে সে প্রাণ বাঁচিয়ে ভাগলবা । তা নয়, আসলে মাড়িয়াদের আৎমা ঠিকেদারকে বলেছিল যে চলে যাও, নয়ত গুলি খেয়ে মরবে । তবে মাওওয়াদিরা ঠিকেদারের ট্র্যাক্টরটাও কেড়ে নিয়েছিল । ট্র্যাক্টর নিয়ে মাওওয়াদিরা কী করবে জানি না ; এরপর তো ট্র্যাক্টর চালাবার মতন রাস্তা পাহাড় শুরু হবার আগে পর্যন্ত, তারপর ছাগল-গরু চরাবার সরু হাঁটা-পথ ।
কিছুক্ষণ থেমে, শ্বাস নিয়ে, ছেলেটি বলা বজায় রাখল । অবুঝমাড় এমন ভুতাহা জায়গা যে মাওওয়াদিদের শরীরকেও অদৃশ্য ডাইনরা আক্রমণ করে, যতই বন্দুক-কামান থাক, কিছুদিনের মধ্যে খারাপ হয়ে যায়, ওদের কামচলাউ ডাক্তার আছে, আনপঢ়, সে কি আর ডাইনদের সঙ্গে পারে, বলুন । কুরুসনার আধামিলিট্রি ভুতাহা ক্যাম্প দেখলেন, ওখানে একবার হামলা চালিয়েছিল মাওওয়াদিরা ; যারা চালিয়েছিল তারা আন্ধ্রার, এখানকার জঙ্গলে তাদের দুজনের শরীর এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তারা আন্ধ্রার আদিলাবাদে গিয়ে সারেনডার করেছিল, তাও লোকটার বয়স মোটে পঁয়ত্রিশ, নাম ছিল রায়সিদম জাওয়েন্দ্রা রাও উর্ফ লালচন্দ, মেয়েটার বয়স আরো কম, তিরিশ বছর, নাম ছিল কোনগাতি করুণা উর্ফ লতা । মাওওয়াদিরা নিজের বড়ো-বড়ো নাম বদলে নিয়ে ছোটো করে ফ্যালে, অন্য নাম নিয়ে নেয়, নিজের মা-বাপের আদর করে দেয়া নামকে কেন ওদের বন্দুকবাজির সঙ্গে জড়াবে, বলুন ? অবুঝমাড়ের আদিবাসীরা হালউই ভাষায় কথা বলে ; ওরা ছত্তিশগড়িয়া, হিন্দি, তেলেগু কোনো ভাষায় কথা বলতে পারে না, বললে বুঝতেও পারে না ।
--তুমি তো ভালই হিন্দি বলছ ।
--আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে পড়েছিলুম ।
--ছেড়ে দিলে কেন ?
--আধামিলিট্রিরা আমার মাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, বলেছিল আমার মা নাকি মাওওয়াদিদের চর । মাওওয়াদিরাও ভেবেছিল আমার মা নিশ্চই সরকারের চর, নয়তো কেন্দ্রীয় রিজর্ভ পুলিশ বলের ক্যাম্পে কেন গেছে । একবার দু-পার্টির গুলিগোলা চলার সময় মায়ের গায়ে গুলি লাগে । সরকার বলেছিল মাওওয়াদিদের গুলিতে মরেছে । মাওওয়াদিরা বলেছিল, আধামিলিট্রির গুলিতে মরেছে। মা মরে যেতে আমি এক লাখ টাকা মুয়াবজা পেয়েছিলুম, সেই টাকা থেকেই তো এই সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মোটর সাইকেলটা কিনেছি । আপনাদের মতন প্যাসেঞ্জারদের নানা জায়গায় নিয়ে যাই, নিয়ে আসি, তা থেকেই সংসার চলে যায় । আপনাকে ভাড়া দিতে হবে না , আপনার ভাড়ার টাকা আমি কালকেই পেয়ে গেছি ।
--তোমার বাড়িতে কে আছে ?
--বাবা আছে, দিনভর মদ খেয়ে পড়ে থাকে, সালফি মদ, এতো নেশা হয় যে লোকে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় ; ওরকম মদখোরকে কে-ই বা বিয়ে করবে, বলুন, লোকটা যদি সারাদিন আকাশে উড়তে থাকে তাহলে কোনো মেয়েই আসবে না, বৃষ্টি না পড়লে কী করেই বা আকাশ থেকে নামাবে, বলুন । বৃষ্টি শুরু হলে পেণ্ডা খেতি করবে, না নিজের আদমিকে আকাশ থেকে নামাতে ছুটবে । বাবা আমাকেই বলছিল বিয়ে করে নিতে । দুটো ছোটো-ছোটো বোন আছে, তাদের দেখাশোনা করব, বিয়ে দেব, তবে তো আমি বিয়ে করব, কি না ?
--বিয়ে করলে আমায় ডেকো ।
--হ্যাঁ, ডাকব, সে তো এখন অনেক দেরি, দেখুন আপনি কতদিন অবুঝমাড়ে টিকতে পারেন । টিকতে হলে সালফি খেতে হবে ; নোংরা জলের চেয়ে সালফি খাওয়া ভালো, সকাল হবার আগেই খেয়ে নেবেন, সকালের সালফি খেলে আকাশ তাকে নেয় না । সকালের পর সালফি মেঘ হয়ে যায় ।
--সালফি ?
--হ্যাঁ, সালফি হল তাড়ির মতন দেখতে একরকম মদ । তালগাছ বা খেজুরগাছের মতন দেখতে হয় গাছগুলো , যেমন করে চেঁচে নিয়ে তালের বা খেজুরের রস বেরোয়, তেমন করে বের করে গ্রামের লোকেরা । তালের রস পচলে তাড়ি হয়, তেমনই সালফির রস চব্বিশ ঘণ্টার পর সাদা রঙের মেঘ হয়ে যায় । তবে মাওওয়াদিরা হুকুম জারি করে মাড় বাজারে গুটকা, গুড়াকু, বিড়ি, সিগারেট, সালফি বিক্রি বন্ধের কাগজ সেঁটেছে। ওরা যদি কাউকে খেতে দ্যাখে তাহলে তাকে একশো টাকা জরিমানা করে । জরিমানার টাকাটা মাওওয়াদিদের ওষুধ কেনার কাজে লাগায় । বাতের আর গা-হাতপা ব্যথার রোগ খুব হয় অবুঝমাড়ে । আমরা তাই বিয়ার বাহুতি পোকা থেকে তেল বের করে বাড়িতে রাখি । যাদের নতুন বিয়ে হয়েছে তারা ওগুলো শুকিয়ে খায় । নারায়ণপুর বাজারে কিনতে পাবেন ।
--কী পোকা ? কী করকম দেখতে ?
--বিয়ার বাহেতি, লাল টকটকে । সরকারি আফসাররা বলে রেড ভেলভেট মাইট ।
--ওঃ, ট্রমবিডাইডা পোকা । হ্যাঁ, ওর তেলকে হিন্দিতে তিজ বলে, বাতে বা প্যারালিসিসে ব্যবহার করে আয়ুর্বেদিক ডাক্তাররা ।
গাঁয়ের লোকেরা পোকাগুলো শুকিয়ে ইনডিয়ান ভায়াগ্রা হিসেবে খায়, তা জানে ইতু, পড়েছে অলটারনেটিভ মেডিসিনের কোর্সে । পুরুষ পাখিরাও বসন্তঋতুতে খায় পোকাগুলো, প্রজননের জন্য ।
--এর পর আমাদের হাঁটতে হবে ।
--এত ভারি মোটর সাইকেল ঠেলে হাঁটবে কী করে ?
--না, কাছে আধামিলিট্রি চেকপোস্ট আছে ; তারা আপনাকে আমার সঙ্গে দেখে ফেললে যেতে দেবে না । আপনি চুপচাপ এগিয়ে চলে যান, আমি মোটর সাইকেল একটু পরে স্টার্ট দিয়ে আসব ।
পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেরুমাটির পথ আরম্ভ হল, গরুর গাড়ি বা ট্র্যাক্টর চলার মতন চওড়া কাঁচা রাস্তা। শুকিয়ে যাওয়া সরু নদী পেরোবার পর বীরবল মাড়িয়া মোটর সাইকেল চালিয়ে এলে ইতু বসে পড়ল পিলিয়নে । বীরবলের পেট আরও ঘেমেছে, কিন্তু উপায় নেই । দু’পাশে শালগাছের সারি, যাক, ছায়া পাওয়া গেল এতক্ষণে, জংলি জঙ্গলের জংলা ঝাউ । কই, ল্যাণ্ডমাইন, বোমাফাঁদ, মাওওয়াদি, আদিবাসী, কিছুরই তো দেখা নেই । গাছগাছালির রংছড়ানো সৌন্দর্য্যে বেশ খাপছাড়া, লেবুসবুজ পাতাগুলো বনের আশ মেটাতে পারছে না । কোনো গ্রামে পৌঁছোল ওরা, পাটনা শহরে গঙ্গায় যাবার ঘাটের দুধারের ভিকিরিদের ঝোপড়ির মতন কুঁড়েঘর, একটা থেকে আরেকটা বেশ দূরে-দূরে।
--ওগুলো কী ? ঢিবিগুলো । রঙিন কাপড়ে উড়ছে ? একটায় শার্টও ঝোলানো রয়েছে । ইতু জিগ্যেস করল বীরবল মাড়িয়াকে, কয়েকটা ঢিবির দিকে আঙুল দেখিয়ে ।
আঙুল দেখাবেন না, আঙুল দেখাবেন না, আৎমার অপমান হবে । ওগুলো মাড়িয়াদের কবর । কোনো আত্মীয় আৎমার শান্তির জন্য কাপড়ের টুকরো বেঁধে গেছে, কাপড়গুলো অমাবসের রাকছসদের থেকে আৎমাদের রক্ষা করে । বলল বীরবল মাড়িয়া ।
লোহার তোরণের মত দেখতে একটা জায়গায় থামল বীরবল । তোরণের ওপরের টিনে সবুজ রঙের ওপর সাদা রঙে হিন্দিতে লেখা রয়েছে, ভারতীয় সেনা ওয়াপস যাও, বস্তরওয়াসী বাহরি নহিঁ হ্যাঁয় । জঙ মত লড়ো । টিনের সাইনবোর্ডের পেছনে লেখা, বস্তরকে য়ুবায়োঁ, সরকার কে নাজায়জ জঙ কে খিলাফ জনয়ুধ মেঁ শামিল হো জাও ।
মোটর সাইকেল থামিয়ে বাক্সে রাখা একটা কাঁধে ঝোলাবার ব্যাগ বের করে ইতুর দিকে এগিয়ে দিল বীরবল, ইতু বলল, আমার কাছে তো রয়েছে কাঁধে ঝোলাবার থলে ।
বীরবল মাড়িয়া বলল, আপনার ঝোলাটা এই কাঁধব্যাগে ঢুকিয়ে নিন, এটায় ডাক্তারের ক্রস চিহ্ণ আঁকা আছে । আপনাকে যিনি পাঠিয়েছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে ডাক্তারের লাল ক্রস চিহ্ণ আঁকা ঝোলাটা দিই আপনাকে । নিজের ঝোলাটা বীরবলের দেয়া ঝোলায় পুরে নিল ইতু । থ্যাংকস জানিয়ে জিগ্যেস করল, ওই চালাঘরটার ছায়ায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসা যায় কি ?
--ওটা র‌্যাশানের দোকান ছিল । যে লোকটা চালাত সে ছিল বস্তারের গোঁড় , মাওওয়াদিদের আৎমার ভয়ে দোকান তুলে দিয়ে, নারায়ণপুরে চলে গেছে, মরে গেলে মাওওয়াদিরা তাদের আৎমাকে এই জঙ্গলে ছেড়ে যায় । আগে র‌্যাশানের কাজ রামকৃষ্ণ মিশন করত । সরকার ওদের হাত থেকে নিয়ে দোকানদারদের হাতে দেবার পর চালাতে না পেরে আবার রামকৃষ্ণ মিশনকে দিয়েছে ; মিশনের পাঁচটা সেন্টার আছে অবুঝমাড়ে । আসলে দোকানদাররা গড়বড়ি করে টাকা বানাতো র‌্যাশান থেকে, ভাবতো যে গোঁড়-মাড়িয়ারা তো জংলি, ওদের নিয়মমত র‌্যাশান না দিলে টের পাবে না, গোঁড়-মাড়িয়ারা তো আর জানে না যে কত র‌্যাশান ওরা পায় । কিন্তু মাওওয়াদিরা দোকানদারদের গড়বড়ি ধরে ফেলেছিল । হুমকি খেয়ে কেউই আর দোকান চালাবার সাহস করেনি । র‌্যাশান মানে পঁয়ত্রিশ কিলো চাল আর কেরোসিন তেল ।
ছায়ায় আধঘণ্টা জিরিয়ে কয়েক ঢোঁক জল খাবার পর, মোটর সাইকেলটা চালাঘরের কাছে রেখে বীরবল বলল চলুন, আরেকটু এগিয়ে দিই ।
মিনিট পনেরো হাঁটার পর, দুটো নিচুছাদ চালাঘরের গ্রামের মতন একটা জায়গায় পোঁছোলো ইতু আর বীরবল মাড়িয়া । উলঙ্গ বাচ্চারা খেলা করছে, ছেলে-মেয়ে দুই-ই, রুক্ষ চুল, দেখেই বোঝা যায় বহুদিন, বা হয়ত কখনও, স্নান করেনি । শহরে এই বয়সের মেয়েরা কুঁচকি আর বুকঢাকা পোশাক পরে । কয়েকজন শিড়িঙ্গে শিথিল-দাবনা পুরুষ বসে আছে, তারাও প্রায় উলঙ্গ, কৌপিনগোছের ন্যাকড়ায় লিঙ্গ ঢাকা ; বৃন্দাবনের বিধবাদের অনেকে এরকমই শিড়িঙ্গে, বাবা-মায়ের সঙ্গে যখন গিয়েছিল, তখন দেখেছিল ইতু । লোকগুলোর কোনো আগ্রহ হল না ওদের উপস্হিতিতে, সম্পূর্ণ উদাসীন , যেন সত্যিই আকাশে ভেসে রয়েছে । ওদের মধ্যে একজন যুবকও ছিল, তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বীরবল গোঁড় মাড়িয়া ভাষায় কথা বলল । ইতুর দিকে ফিরে বলল, এর পরের গ্রামে যেতে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে । ওরাও এ গ্রামের নয়, কুরুসনারে গিয়ে সালফি খেয়ে এখানে মৌতাত নিচ্ছে । এই অবস্হায় ওরা ভেতরে গেলে মাওওয়াদিরা ধরে ফেললে ফাইন করবে ।
বড় ধাপ থেকে ছোটো হতে থাকা সিঁড়ির মতন ওঠা লাল আর সাদা কয়েকটা স্তুপের দিকে ইশারা করে বীরবল মাড়িয়া বলল, ওগুলো শহিদ-বেদি ; যারা আধামিলিট্রির গুলিতে মারা গেছে তাদের ইয়াদগারে বানানো, বেশিরভাগ বেদি আসলে সমাধি, দেখছেন না বেদির ওপরে টিনের কাস্তে-হাতুড়ি । ইতু নিজেকে বলল, এখানে তার মানে ইঁট, বালি, সিমেন্ট এনে ঘর তোলা যায় ; জায়গাটাকে দুর্ভেদ্য করে না রাখলে হয়ত গ্রামের লোকেরা পাকা আস্তানা তৈরি করতে পারত, যেমন অন্য প্রদেশের আদিবাসীদের বাড়িগুলো ।
মায়ের বাবা-মা, মানে দাদু-দিদা, বেঁচে থাকতে, ছোটোবেলায়, একবার বাবার সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিল ইতু ; সেখানে পাড়ার রাস্তায় ওইরকমই, কিন্তু ছোটো মাপের, কয়েকটা ক্ষয়ে-যাওয়া ইঁটদেঁতো বেদি দেখতে পেয়ে জানতে চাইলে, দাদু বলেছিলেন, ওগুলো শহিদ বেদি, যারা বসিয়েছে তারা নিজেদের, আর যে মারা গেছে তাকে, বোকা বানাবার স্মৃতিকে জিইয়ে রেখেছে । আজকে দাদুর বলা কথাটার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারল ও, ইতু ।
মানুষ যদি এরকমই থাকতে চায়, তাহলে তাতে পৃথিবীর ক্ষতি ছিল কোনো, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছিল ইতু । এই লোকগুলো এখনও বিস্মিত হবার ক্ষমতা রাখে, এখনও এরা কলাকৌশলের ইঁদুরকলে আটকে পড়েনি, এখনও এরা ভড়ংশূন্য, সরল, স্বাভাবিক ; প্রযুক্তির প্রগতিতে এসে যায় না কিছু । সভ্যতা যতো বুড়ো হয়েছে তত বিমূর্ত আর অবাস্তব হয়ে গেছে শহুরে মানুষ, শিকড় থেকে ওপড়ানো, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, যেমন আমি নিজে । মেট্রপলিসের মানুষ আর জৈবিক হৃদয়ের প্রাণী রইল না, তার আবেগের স্বাভাবিকতা আর আন্তরিকতা উবে গেছে । বোধহয় এটা মানুষের নৃবৈজ্ঞানিক ভবিতব্য । সভ্যতা যত সভ্যতর হয়ে চলেছে ততই আমরা হয়ে চলেছি জটিল, খারাপ, অনৈতিক, ভয়াবহ । এই লোকগুলোর আনন্দের পরিভাষা তো এরাই তৈরি করবে, নাকি আমি বাইরে থেকে এসে তাকে বোঝাবো কিসে তাদের আনন্দ । সভ্যতা হয়তো মানুষের যৌবনকে ক্ষইয়ে দিচ্ছে । মানুষ আসলে ভঙ্গুর, ঠুনকো, নশ্বর, তার শরীর অসুস্হ হবেই, ঋতুদের প্রকোপ সামলে চলতে হবে তাকে, সভ্য থাকার কাঁচামাল ফুরিয়ে যাচ্ছে, না-খেয়ে বা আধপেটা-খেয়ে থাকতে হচ্ছে, তার ওপর আবার সন্ত্রাসের আতঙ্ক । কে জানে, আমার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই । দেখি কী হয় । অন্যদের সুখে-আনন্দে-সুস্হতায় যদি জীবন উৎসর্গ করতে পারি, তাহলেই যথেষ্ট ।
ইতুর দোভাষীর কাজ চালিয়ে বীরবল বলল, যুবকটির নাম হরিয়া, ও বলছে যে ওর কোনো কিছুরই দরকার নেই, সবই আছে, রামকৃষ্ণ মিশনের লোকেরা আসলে, পঁয়ত্রিশ কিলো চাল নিয়ে আসে । এক টাকা কিলো চাল কিনতে অসুবিধা হয়না, শুয়োরবাচ্চা , মুরগি, মুরগির ডিম, মহুয়ার ফুল বিক্রি করে যথেষ্ট টাকা হয়ে যায় মাসে । রামকৃষ্ণ মিশনের লোকেরা আসার আগে খবর পাঠিয়ে দেয় ।
গ্রামটার পর পথ ক্রমে ওপর দিকে ওঠা আরম্ভ হল । অঝোর বৃষ্টিতে খসে-পড়া পাথরকে সিঁড়ির মতন সাজিয়ে নেয়া হয়েছে । দুপাশে নানা রকমের চেনা-অচেনা গাছ, ছায়ায় হাঁটতে ভালো লাগছিল ইতুর । তখনই বীরবল বলল, দিদি, আমাকে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে, বিকেল হয়ে গেছে । আপনি আগে যে গ্রাম পাবেন সেখানে অপেক্ষা করুন কিংবা এই সরু পাহাড়ি বনপথ ধরে এগিয়ে যান, আরেকটা বড় গ্রাম আসবে , আমার সেরকমটাই মনে আছে, কয়েক বছর আগে গিয়েছিলুম তো । অন্ধকার হয়ে গেলে কোনো গাছে হাত দেবেন না ; সন্ধ্যার পরে গাছ আর গাছের ডালপালাগুলো সাপ হয়ে যায়, নানা রকমের সাপ, সবুজ, কালো, হলদে, মোটা, রোগা, চিত্তিদার ; আপনাকে সাবধানে হাঁটতে হবে । টর্চ এনে থাকলে জ্বালাবেন না, সাপেরা আলোয় বিরক্ত হয় ।
--সে কি, তুমি যাবে না ? ইতু বুঝতে পারল যে ও এই ছেলেটির ওপর নির্ভর করছিল এতক্ষণ, ওর কল্পকাহিনী খাচ্ছিল । এবার ওকে আত্মনির্ভর হয়ে নির্ণয় নিয়ে এগোতে হবে । কারোর ঘাড়ে চাপার জন্য তো ও বাড়ি ছেড়ে বেরোয়নি । কিছুক্ষণেই সূর্য অস্ত যাবে । একা-একা কী করব এখানে । চিনি না, জানি না কাউকে।
--না, আমি ফিরে যাই, এখানে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না । মাড়িয়া গোঁড়রা জানেই না কাকে ক্ষতি করা বলে । জঙ্গলের ভেতরে শহরের মানুষ পাবেন না । যদি পান তো নিজেকে দূরে-দূরে রাখবেন ।
ইতু হাত তুলে ফির মিলুংগি জানিয়ে এগোলো বনের পথ ধরে । বীরবল চলে গেলে, জুতো আর জিন্স খুলে, প্যান্টিটা ফেলে দিয়ে, পেচ্ছাপ করে নিল । অবিরাম হাঁটার দরুণ প্যাণ্টির ঘষা লাগছিল কুঁচকিতে । ওহ, কতক্ষণ চেপে রেখেছিলুম, বলল হলুদ ফুলের চুমকি-বসানো ঘন-সবুজ ঝোপকে, যে ঝোপটা হয়তো কোনো ভবঘুরে পাখির গু থেকে বৃষ্টির ছাটে দু’হাত মেলে জন্মেছিল । টপ খুলে বডিসও ফেলে দিল । সেই ক্লাস এইট থেকে অভ্যাস, বাইরে থেকে এসে সবচে আগে এই দুটো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া ।
বাঁদিকের বুকটা তুলে দেখল, দ্বিতীয়বার উত্তেজিত হয়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল অমিত, তাই ঘামের দরুন জ্বালা করছিল । একটা ঘৃতকুমারী পাতা ভেঙে, কুঁচকিতে আর বুকে, গোলাপি-জ্বালায় লাগিয়ে নিল ।
বনের ভেতরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দাঁড়িয়ে অবর্ণনীয় ভালোলাগা পেয়ে বসল ইতুকে । দুহাত ওপরে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, আমি ইতুউউউউ..., আমি ইতান..., পৃথিবীর মাটিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন... । দুদিকে দুহাত মেলে দিয়ে, আবার চেঁচালো, আমি ইতু..., আমি আদিমানবী..., আমি ইতু...আমি ইতু...আমি ইতুউউউউ...।
শুকনো পাতার ওপর থেকে পোশাক তুলতে গিয়ে ইতু দেখল, একটা কাঠবিড়ালি নতজানু হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । ইতু, নগ্ন, শুকনো পাতার ওপর বসে কাঠবিড়ালিটাকে বলল, সেতু বাঁধতে এসে থাকলে ভুল করছিস, সব সেতু ভেঙে চলে এসেছি । কাঠবিড়ালিটা পালিয়ে গেলে, জুতো আর পোশাক পরে নিল, কাঁধে ঝোলা, এগোলো বনপথে । হালকা হয়ে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল না আর । এটা জঙ্গল, না বনানীর ধ্বংসাবশেষ, কেমন যেন ছড়ানো-ছেতরানো !
সোফানরম শুকনো-পচা পাতার ওপর হাঁটতে-হাঁটতে ইতুর মনে হল এই জায়গাটা তো ওর চেনা । ওই তো ডুমুর গাছে থোকা-থোকা পাকা ডুমুর হয়ে রয়েছে, পায়ের কাছে বনপথের পাশে-পাশে ঘৃতকুমারীর জঙ্গল, ঘৃতকুমারী, যা এখন কতো দাম দিয়ে কেনে পাবলিক, বহেড়া গাছ, অশোকফুল গোছা-গোছা, ভরাঙ্গিপাতা, ডেভিলস কটন বা উলটকম্বলের গাছ, ইগল উড বা অগরু গাছ, আরে, এলিফ্যাণ্ট ক্রিপার বা সমুদ্রাশোক, সুগন্ধমূল বা গ্রেটার গলাঙ্গল, উইনটার চেরি যাকে সিলেবাসে অশ্বগন্ধা বলা হতো, কত পরিচিত গাছ-গাছড়া, পাটনায় পেতুম শুকনো, কবে কোথা থেকে অশোক রাজপথের ইউনানি দোকানে আসত কে জানে । এখানে দিব্বি রয়েছে অবহেলার ঐশ্বর্যে ঝিলমিলিয়ে, শিশি-বোতল-বয়ামের বাইরে মাথা তুলে, হাতপা ছড়িয়ে।
ঘণ্টাখানেক চলার পর, সন্ধ্যা নেমে আসায়, অজানা এক গাছের গুঁড়ির কাছে, ছায়ায় , জুতো খুলে, বসে পড়েছিল ইতু, বুকের ভেতরে বাজানো ভীতির দামামা দূর থেকে কানের ভেতরে উঠে আসছিল। ওপর থেকে ঝরঝর করে কয়েকটা শুকনো ফুল ঝরে পড়তে চমকে উঠেছিল, তারপর টের পেল যে এটা মহুয়ার গাছ ; তাইতো অমন গন্ধ বেরুচ্ছিল। মহুয়া ফুলের গন্ধে যদি ভাল্লুক আসে, তাহলে ? কোথায় যেতে হবে সুস্পষ্ট বলে দেয়নি অমিত । বলেছিল হাঁটতে থেকো যতটা পারো । পরিচিত কাউকে ঠিকই পেয়ে যাবে । তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। গাছে ঠেসান দিয়ে ঢুলতে লাগল । সারাদিনের রোদের আমেজে বুঁদ গাছের পাতাগুলো অবসাদে ঝিমিয়ে ।
ঘুম ভাঙতে, দেখল, অন্ধকার, আজকে বোধহয় চাঁদ ওঠার রাত নয় । জুতো পরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অন্ধকারে গাছে ডান হাত ঠেকতেই মনে হল সাপের গায়ে হাত দিয়ে ফেলেছে, নরম, মাংসল । দ্রুত হাত সরিয়ে নিল । কী করবে ? গাছগুলো রাতে সাপের আকার নিয়ে নিচ্ছে ! কেউ এলে তাকে দেখতেও তো পাবো না জঙ্গলের অন্ধকারে । হয়তো বিভ্রম, মনে করে, বাঁহাত বাড়িয়ে গাছ অনুমান করে হাত বাড়াতে, সাপের গায়ে ঠেকল, ঠাণ্ডা । সাপের ভয়ে ইতুর বুকের ভেতরের ইঁদুরগুলো দাপাদাপি আরম্ভ করে দিয়েছিল । বুঝতে পারল যে যা ওর অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তা আতঙ্ক, সাপের আকার পাওয়া গাছগাছালির আতঙ্ক ।
হঠাৎ ওর মুখের ওপর সরু নিয়ন আলো পড়তে চোখ ধাঁধিয়ে গেল । কোনো ময়ালের চোখ ?
আওয়াজ আর কন্ঠস্বর শুনে সন্দিগ্ধ ভয়ে সিঁটিয়ে উঠল ইতু । ভাল্লুক ? আরও তিনটে টর্চ জ্বলতে, আঁচ করল ওর চারপাশে জলপাই রঙের উর্দিতে চারজন যুবক আর একজন যুবতী । প্রত্যেকের কাঁধে বন্দুক বা রাইফেল, কে জানে কী, জওয়ানদের কাঁধে ঝুলতে দেখেছে অমন অস্ত্র । আধামিলিট্রি জওয়ান নয়তো ? একজন যুবতী রয়েছে যখন তার মানে এরা সি আর পি এফ জওয়ান নয় বলেই মনে হচ্ছে । যুবতী তো খোঁপাও বেঁধেছে, চুলে তেল দেয় নিশ্চয়ই, চকচক করছে। এখানে জঙ্গলে মাথায় দেবার তেলও পাওয়া যায় নাকি ! চুলটা কেটে ফেললুম, না কাটলেও বোধহয় চলত ।
একজন যুবক এগিয়ে এলো, যাকে দেখে চিনতে পারল ইতু, আরে, এই ছেলেটা তো ওর ক্লিনিকে একবার খাম দিতে আর ওর বাড়িতে একবার খাম নিতে এসেছিল । যাক এরা তাহলে অমিতের পরিচিত । অমিতও এরকম কাঁধে বন্দুক ঝোলায় নাকি ? আমাকেও বন্দুক ঝোলাতে হবে নাকি ? তা তো চাইনি ।
--ডক্টর ঘোষ, ওয়েলকাম, বলল ছেলেটি ।
ইতুর মুখ দিয়ে বেরোল, থ্যাংকস , ম্যায় বহুত ডরি হুই থি, কোই দিখাই নহিঁ দে রহা থা, কাফি অন্ধেরা ভি হো চলা হ্যায় ।
--জানতি হুঁ, আপ সো গয়ে থে দেখকর হম লোগোঁনে নিন্দ সে নহিঁ জাগায়া আপকো । আপ জব অপনা নাম লেকর চিল্লায়েঁ, তভি সে হমলোগ আপকে সাথ হ্যাঁয় । আপ হম লোগোঁ কে সাথ আইয়ে, বলল ওদের সঙ্গের যুবতী । সে-ই বোধহয় এদের নেতা । পিঠের ব্যাগ থেকে দুশো এম এল জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, লাইফ ইজ টাফ ফর অল ইন দিস প্লেস, অ্যান্ড ভেরি ডেঞ্জারাস টু, ইউ হ্যাভ টু গ্র্যাজুয়ালি অ্যাডজাস্ট ।
জল খেয়ে তৃপ্ত বোধ করল ইতু । ওর উলঙ্গ চিৎকার এরা দেখেছে তাহলে । দেখুকগে, কীই বা এসে যায়। এতক্ষণ পর মানুষ দেখতে পেয়ে অসুরক্ষিত থাকার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত লাগল নিজেকে ।
মেয়েটি বলল, আপনি হাঁটার সময়ে মাঝখানে থাকবেন, আমি আপনার দেহরক্ষী, আমার নাম সোনারি । ওদের সঙ্গে হাঁটা আরম্ভ করল, ওর সামনে তিন জন, পেছনে দুজন । গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশে তারা দেখতে পেয়ে দেহরক্ষীদের চেয়ে তাদের টিমটিমে আলোদের বেশি আপন মনে হল ইতুর । সেই সকাল থেকে বেরিয়েছে, রোদের জন্য দ্বিতীয়বার আর পেচ্ছাপ পায়নি, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আর কতক্ষণ হাটঁতে হবে কে জানে, কয়েকটা বিস্কিট আগেই খেয়ে নিলে ভালো হতো । এরা কেউ কথাবার্তাও বলছে না । নিজে থেকে কোন প্রসঙ্গেই বা কথা বলবে, নানা ভাবনা মগজে ঘুরছিল ইতুর। দেহের আলো জ্বালিয়ে পুরুষ জোনাকিরা উড়ে বেড়াচ্ছে মাদি-জোনাকিদের আকৃষ্ট করার জন্য । বনের পাতারা গন্ধ বিলোচ্ছে । নয়নাভিরাম নির্বাক অন্ধকার । বনপথের সহযাত্রীদের পাহারায় হয়ত আরও দেড় ঘন্টা হেঁটেছিল ইতু ।
তখনই, অন্ধকারকে হুশিয়ারি দিয়ে কয়েকবার হুইসিল বেজে থেমে গেল ।
আচমকা গুলিচলার শব্দ আরম্ভ হতে, ইতুর ওপর ঝাঁপিয়ে একজন সঙ্গী যুবক ওকে জঙ্গলের শুকনো পাতার ওপরে উপুড় করে শুইয়ে দিল, ইতুকে বাঁচাবার জন্য দুদিক থেকে ওর দেহকে নিজেদের শরীর দিয়ে ঢেকে নিল বাকি দুজন যুবক । মেয়েটি শুকনো পাতার ওপর উপুড় হয়ে কোনো অচেনা শত্রুর দিকে তাক করে বন্দুক উঁচিয়ে শুয়ে পড়ল ইতুর মাথার কাছে।
অবিশ্বাস্য । এরা আমার কেউ নয়, তবু আমাকে বাঁচাবার জন্য নিজেদের শরীরকে আমার দেহের বর্মে পালটে ফেলল ! মানুষ না রোবোট এরা !
ইতু অনুমান করল দুদিক থেকে গুলি চলছে, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, গুলির আগুন-ফিনকিও দেখতে পাচ্ছে না । ওর মুখ মাটির দিকে, জিভেতে ভয়ার্ত আহ্লাদের স্বাদ । নিজেকে নিঃশব্দে বলল, বোধহয় নতুন জীবন আরম্ভ হল, কিংবা জীবন হয়তো কিছুক্ষণেই শেষ হয়ে যাবে । আর আশ্চর্য, এক্ষুনি হয়তো মরে যাবো, এই ভেবেও ভেতরে-ভেতরে আনন্দ খেলছে।
শুকনো পাতার ছোঁয়াচে গন্ধে, বাড়ি থেকে পালাবার পর প্রথম যখন অমিত ওর ক্লিনিকে এসেছিল সেই দিনকার ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগল ইতুর, হুবহু ।

আঠারো
মালগুজার কর্মচারী : ওই দ্যাখো । সালফি খাবার জন্যে জঙ্গলে ঢুকেছিল, ভ্যায়েনচো, সামলাতে পারেনি, মাতাল হয়ে পড়ে রয়েছে ।
কেন্দুপাতার ফড়ে : সালফি খেয়ে মাতাল হলে তো যেখানে খেয়েছে, তার কাছাকাছি পড়ে থাকত । এখানে আসপাশে কোনো গ্রাম নেই, সালপিখোরদের গেঁয়ো জামাতও নেই ।
মালগুজার কর্মচারী : ভ্যায়েনচো, কেন্দুপাতার চোরাকারবারি নয়তো ?
কেন্দুপাতার ফড়ে : কেন্দুপাতার ব্যাবসার সবাইকে চিনি, চোরাকারবারিদেরও । ওখানে, রাস্তার ধারে খাদে পড়ে থাকবে কেন ?
মালগুজার কর্মচারী : মরুকগে বেওড়াগুলো, ভ্যায়েনচো । আমাদের কী করার আছে ।
কেন্দুপাতার ফড়ে : হ্যাঁ, উঠিয়ে নিয়ে যাবার হলে বনদপতরের লোক বা সিআরপিএফ নিয়ে যাবে । নয়তো খাবে জন্তু-জানোয়াররা । চলুন, চলুন । কদম চলাকে চলিয়ে ।

উনিশ
অমিত বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রথম বার যখন ইতুর সঙ্গে দেখা করতে ওর ক্লিনিকে এসেছিল, সে ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে ইতুর । অবুঝমাড়ের জঙ্গলে, মাটিতে শুকনো জঞ্জালের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে, গুলির অধারাবাহিক শব্দ শেষ হবার পরও, বহুক্ষণ ওভাবে শুয়ে থেকে, সব কিছু মনে পড়ে যাচ্ছিল ইতুর, হুবহু ; পাতাগুলো বোধহয় বয়ে এনেছে অমিতের যৌবনগ্রন্হির নিঃসরনের বুনো গন্ধ ।
অমিতের সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না । হয়তো কেন, নিশ্চিত হবে না ।
বছর আড়াই আগে,আনিসাবাদে, নিজের ক্লিনিকে রোগি আসার অপেক্ষায় হতাশ বসেছিল ইতু, ইতু ঘোষ ; দেখল, ফুটপাতে, ওর ক্লিনিকের সামনেই চেককাটা শার্ট আর ধূসর ট্রাউজার পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে, ওপরে মুখ তুলে । দাড়ি-গোঁফ আর বাবরি চুলে মুখ প্রায় ঢাকা, ইতু বয়স আন্দাজ করল বাইশ-তেইশ হবে, রোগকে যেচে ডেকে আনার সবচেয়ে উদ্দীপক বয়স । উঠে দাঁড়িয়ে, সাদা গাউন পরেই ছিল, টেবিলে রাখা স্টেথোস্কোপটা গলায় ঝুলিয়ে, এগিয়ে গিয়ে ডাকল লোকটাকে, হিন্দিতে, আসুন না, আসুন, আপনাকে দেখেই তো বুঝতে পারছি আপনি বেশ ক্লান্ত, হয়ত কোনো রোগের কারণে ।
সাইনবোর্ডের দিকে আঙুল তুলে লোকটা বলল, ডাক্টর ইতু ঘোষ কা ক্লিনিক, য়ঁহা সভি রোগোঁকা ইলাজ কিয়া জাতা হ্যায়, তারপর ইতুর দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলল, তুই ইতু ঘোষ, গর্দানিবাগের ঘোষবাড়ির মেয়ে, তাই না ?
যুবকের মুখের দিকে না তাকিয়ে, পেছন ফিরে তাকে বলল, হ্যাঁ, আমি ঘোষবাড়ির মেয়ে ইতু, অনেকে ইতি বা ইতান বলেও ডাকে । আপনি ভেতরে আসুন না, শুনবো আপনার শারীরিক সমস্যার কথা, কোনো চিন্তা করবেন না, হেভি অ্যালোপ্যাথিক ডোজের ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসা আমি করি না, আসুন, ভেতরে আসুন ।
লোকটা ভেতরে ঢুকে, ইতুর টেবিলের উল্টো দিকে, রোগির চেয়ারে বসলে, নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে, স্টেথোটা টেবিলে রেখে, টেবিলে ছড়ানো জিনিসগুলো, খোলা-সংবাদপত্র, সাজাতে-সাজাতে ইতু বলল, কি হয়েছে শুনবো, তার আগে আপনার ব্লাড প্রেশার আর পাল্স চেক করে নিই । রোগি তার সমস্যা বর্ণনা করার আগেই, ইতু বলল, দিন আপনার বাঁ হাতখানা এখানে রাখুন তো, বলে ব্লাড প্রেশার মাপার জন্য ফ্ল্যাপটা হাতে জড়িয়ে বলল, আপনি ওনাদের চেনেন ?
--আমি তোকেও চিনি, বলল লোকটা, তুইও আমাকে চিনিস, মুখের পানে আগে তাকিয়ে দ্যাখ, ইডিয়ট । আমার গলার আওয়াজও এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি নাকি ?
যুবকের কথা শুনে তার মুখের দিকে চেয়ে সঞ্চিত বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ইতু, আরে অমিত, চিনতেই পারিনি, দাড়ি গোঁফ রেখে এমন ভোল পাল্টে ফেলেছিস রাসকেল, গলার আওয়াজও বড়দের মতন হয়ে গেছে, সন্ন্যাসী হয়ে গেছিস নাকি ? ফুঁপিয়ে ফেলেছিল, সামলে নিয়ে বলল, সেই যে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলি, আমাকে বলে যাবার প্রয়োজন বোধ করলি না।
--হ্যাঁ, সাধুই হয়ে গেছি প্রায় ?
--বাড়িতে গিয়ে আমার ক্লিনিকের ঠিকানা পেলি ? টিশ্যু পেপারে চোখ পুঁছে বলল ইতু ।
-- গিয়েছিলুম একটু আগে, ভেতরে ঢুকিনি , তাই আমাকে দেখে রোগীর মতন মনে হয়ে থাকবে, হাঁটছি তো অনেকক্ষণ যাবত । বাড়িটা বাইরে থেকে দেখে চলে এলুম । তোদের প্রতিবেশী গোবর্ধন মিশ্রর কাছে খোঁজ করে তোর ক্লিনিকের ঠিকানা পেলুম । মন কেমন করছিল রে সবায়ের জন্য, কিন্তু ওই বাড়িতে আমি তো আনওয়ান্টেড কলঙ্ক । কিছুক্ষণ থেমে, মাথা নামিয়ে অমিত বলল, ওই বাড়িতে আমি একজন বেজন্মা ।
--স্টপ ইট, ভাট প্যাঁদাসনি । কেউই তোকে বেজন্মা বলেননি ।
--তা না হলে তোর সঙ্গে আমার সম্পর্কের স্বীকৃতি দিতে বাধা ছিল কোথায় ? আমার বাবার চেয়ে আমার মা দশ বছরের বড়, আর আমার মা আমার বাবার স্ত্রী নন, অন্য আরেকজনের স্ত্রী, এই তো ? এই কারণেই তো ওনাদের আপত্তি ?
ইতু চিৎকার করে উঠল, না, না, না, না । ক্লিনিকে বসে অমনভাবে চেঁচিয়ে ফেলে, হুঁশ হল, যে, ফুটপাথ দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তারা ওর দিকে অবাক ঔৎসুক্যে তাকাচ্ছে, সম্ভবত ভাবছে যে এ কেমন ডাক্তারনি, রোগিকে বকুনি দিয়ে ভয় পাওয়াচ্ছে । উঠে গিয়ে শাটার নামিয়ে, অমিতের মুখের কাছে মুখ এনে ইতু বলল, ওনাদের বক্তব্য ছিল আমরা দুজনে ছোটোবেলা থেকে ভাইবোনের মতো বড়ো হয়েছি, আমরা বিয়ে করলে ভাইবোনের বিয়ে বলে মনে করবে পাড়াপড়শিরা, বলেছিলেন সকলে । আফটার অল রাঙাকাকু-রাঙাকাকিমা তোর দায়িত্ব নিয়েছিল, ছেলের মতন মানুষ করছিল, তাই । শুনে রাখ, তুই যদি আমার মায়ের পেটের ভাইও হতিস, ইনসেসচুয়াস হলেও, তোর সঙ্গেই রিলেশানশিপ করতুম, কিংবা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে তোর সঙ্গে লিভ ইন করতুম ।
--তুইও জানিস, আমিও জানি ইতু, তোদের বাড়িতে কী ধরণের ট্রিটমেন্ট হতো আমার । তারপর যখন ওনারা জানতে পারলেন যে তুই আমাকে ভালোবাসিস তখন ওনারা ঘেন্না আর রাগ সামলাতে পারেননি ।
অমিতের জামার কলার ধরে ঝাঁকিয়ে ইতু বলল, বানচোদ, তাই তুই আমাকে ফেলে পালিয়ে গেলি; ইনফর্মটুকু করতে পারলি না ? বেশ ককিয়ে কেঁদে ফেলল ইতু, ফিরে গিয়ে বসল নিজের চেয়ারে, টিশ্যু দিয়ে চোখ পুঁছল , মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, কাওয়ার্ড রেনিগেড ।
অমিত : আমি আমার বাবা আর মায়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলুম রে, বিশ্বাস কর, ওনাদের কাছ থেকে জবাবদিহি পাওয়া জরুরি ছিল । কেন ওনারা জাস্ট একজন বন্ধুর বাড়ি আমাকে ডাম্প করে চলে গেলেন, তাও সেই বন্ধু নিজেই কিডন্যাপ হয়ে গিয়েছিল বলে যে বাড়ি তার বউ-বাচ্চাকে স্বীকৃতি দেয়নি ।
চেয়ার ছেড়ে অমিতের কাছে পৌঁছে, এবার ওর দীর্ঘ চুল দু’হাতে ধরে ইতু বলল, তাই বলে তুই আমাকে ডিচ করবি ? আমি কি দোষ করেছিলুম ? আমিই বা কোন রাজকন্যার মতন আছি ওই বাড়িতে ?
অমিত : ডাক্তার হয়েছিস তো ! কনভেন্ট এজুকেশান ঝাড়ার অভ্যাস ছাড়তে পারিসনি দেখছি ।
ইতু : এটা ডাক্তারি ? ভালো করে পড়েছিস বাইরে সাইনবোর্ডে কী লেখা আছে, ইউ ফুল ? বাবা-মা অ্যাকসিডেন্টে মারা যাবার দরুণ এক বছর এম বি বি এস পড়ে ছেড়ে দিতে হয়েছিল । আমি যেটা করেছি সেটা অলটারনেটিভ মেডিসিন । রোগি আসে না, যাও দুচারটে আসে তারা দ্বিতীয়বার আসে না, কেননা আমি রাংতায় মোড়া অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ দিই না ।
অমিত : মিশ্রাজির কাছে শুনেছি, তোর মা-বাবার অ্যাকসিডেন্টের কথা । হ্যাঁ, সাইনবোর্ড দেখেছি, তুই অলটারনেটিভ মেডিসিনের ডাক্তার । বাবা-মায়ের খোঁজে গিয়েছিলুম, অথচ সে বিষয়ে জানতে চাইছিস না ? কেবল নিজের চিন্তা করছিস ?
ইতু, মুঠো থেকে অমিতের চুল আলগা করে বলল, তুই ছাড়া আমার আপন বলতে কে আছে বলতো ওই ফাকিং একান্নবর্তী পরিবারে ? আই অ্যাম সরি, এতদিনে তোকে পেয়ে ক্যারিড অ্যাওয়ে হয়ে গিয়েছিলুম । তোর বাবা-মা কোথায় আছেন ? খুঁজে পেয়েছিস ওনাদের ? কী করে পেলি ?
অমিত : আমাকে কথাই বলতে দিচ্ছিস না । বোস, গিয়ে নিজের চেয়ারে বোস । তোকে আমার দরকার।
অমিত : বাবা আর মা দুজনকেই খুঁজে পেয়েছি । মায়ের হাজবেন্ডকেও খুঁজে পেয়েছি ।
অমিত : আমার মা এই বয়সেও সুন্দরী, পাকাচুল-সুন্দরী । শি ইজ সো সিরিন অ্যাণ্ড ডিগনিফায়েড, কী বলব তোকে, কিন্তু ডিসট্যান্ট, হ্যাঁ, এক্সট্রিমলি ডিসট্যান্ট । জানিস, আমি কলকাতায় নার্সিং হোমে জন্মেছিলুম । নার্সিং হোমের আর কলকাতা কর্পোরেশানের বার্থ সার্টিফিকেট আছে রাঙাবাবার কাছে, অথচ, কখনও সে কথা বলেনি আমাকে । বার্থ সার্টিফিকেটে আমার নাম অমিত বর্মণই লেখানো হয়েছিল ।
ইতু : এই ডাফার, পা দোলাসনি, পা ব্যথা করছে তো চেয়ারে পা তুলে বোস ।
অমিত : ওকে, ওকে, পা তুলেই বসছি । যেদিন সকালে তোদের বাড়ি ছাড়লুম, সোজা বাবার অফিসের কর্মীদের কাছে গিয়েছিলুম, বাবার কনটেমপোরারি একজন বললেন, যে উনি কোনো নকসল্লি ফ্যাকশানের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিলেন । অফিসের এক ক্লাস ফোর স্টাফের কাছে রসিক পাসওয়ান নামে এক পিওনের নাম-ঠিকানা পেয়ে তার কোচাগাঁও গ্রামের দলিত টোলার বাড়িতে গিয়েছিলুম ; সে ওই ফ্যাকশানে ছিল । গিয়ে শুনলুম যে রসিক পাসওয়ান পুলিশের গুলিতে মারা গেছে । শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল । আশঙ্কা করেছিলুম যে তাহলে বাবাও হয়ত মারা গিয়ে থাকবেন আর মাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া হয়ে থাকবে ।
অমিত : ওয়ারিস আলি গঞ্জে স্টেশানে বসে ভাবছিলুম যে এর পর কী করব, কোথায় সুত্র পাবো, যাবোই বা কোথায় ? গর্দানিবাগের বাড়িতে বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যাবার সময় নাকি বলে গিয়েছিলেন যে ওনার আর আমার মায়ের খোঁজখবর যেন কখনও করা না হয় । বাড়িতে কেউ কখনও আলোচনা করেনি ; করল প্রথম যখন ওনারা তোর-আমার সম্পর্কের কথা জানতে পারল । আমার বাবার নাম অতনু চক্রবর্তী আর মায়ের নাম মানসী বর্মণ, ওনারাই সেদিন উত্তেজনার মুখে বলেছিলেন, মনে আছে তোর ? আমি তোর রাঙাকাকুকে কতবার জিগ্যেস করতুম যে আমার পদবী বর্মণ কেন, উনি এড়িয়ে যেতেন, বলতেন কী করবি জেনে ।
অমিত : স্টেশানে প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল পরের ট্রেনের জন্য । ভাবছিলুম শালা যে ট্রেনই আসুক, যেখানেই যাক, চেপে যাব । হঠাৎ কাঁধে কেউ একজন হাত রাখতে, পেছন ফিরে দেখি, বুড়োটে কদমছাঁট বিহারি , মাথায় লাল গামছা বাঁধা, বলল যে তুমি রসিক পাসোয়ানকে খুঁজছ কেন ? আমি বললুম, উনি আমার বাবাকে আর মাকে চেনেন, তাই, আমি ওনার কাছে জানবার জন্য এসেছিলুম যে আমার বাবা-মাকে কোথায় পাবো, তাঁরা বেঁচে আছেন কি না । উনি বললেন, তোমার মুখ অনেকটা তোমার বাবার মতনই । আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি কে, আমার বাবা-মাকে চেনেন ?
অমিত : উনি বললেন ওনার নাম রসিক পাসওয়ান । ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, সেই একই দলিত টোলায়, সেই বাড়িতেই, যেখানে আমাকে বলা হয়েছিল যে রসিক পাসওয়ান মারা গেছে । রসিক পাসওয়ান নামে সত্যি একজন মারা গিয়েছিল পুলিশের সঙ্গে নকসল্লিদের লড়াইতে, কিন্তু সে অন্য রসিক পাসওয়ান ।
ইতু : যাই হোক, বাবা মাকে কোথায় পেলি, কী করেই বা পেলি ? ওনাদের বাড়িতেই ছিলি এতকাল ? আমাকে নিয়ে চল, আমি তোর সঙ্গে ওনাদের বাড়িতেই থাকব ।
ইতু : আমার আর এখানে একদম ভাল্লাগছে না । এখানে থাকতে হলে আমি মরেই যাবো ।
অমিত : আবার তুই নিজের প্রসঙ্গে ফিরে এলি । বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা হল, সে কথা তো জানতেই চাইছিস না । রসিক পাসওয়ান বলল যে আমার বাড়িতে দুচারদিন থাকো, আমি খোঁজখবর নিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো ওনাদের কাছে । দশ দিন থেকে গেলুম ।
ইতু : একজন অচেনা বিহারির বাড়ি দশ দিন থেকে গেলি ? তোকে কিছু করেনি তো ?
অমিত : আমাকে আবার কী করবে ? আমার কাছে পয়সাকড়িও ছিল না তেমন যে লুটপাট করে কেড়ে নেবে । বটঠাকুমা মাঝে-সাঝে যে হাতখরচ দিতেন সেটুকু জমানো টাকাই ছিল । রসিক পাসওয়ানের সঙ্গে দেখা না হলে ভিক্কে করতে হত ।
ইতু : তা নয় । যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলি তখন খিচ্চা-কওলা-চিকনা-লালটু, ইনোসেন্ট-ইনোসেন্ট টাইপ, ছিলি । ওইসব এরিয়ায় ছেলেদের সঙ্গে জোর করে সেক্স করে শুনেছি । এই ক’বছরে অবশ্য রোদে পুড়ে কিছুটা চেবানো-চোয়াড়ে আর ছিবড়ে-মাসকুলার হয়ে গেছিস, যে জন্য দেখামাত্র চিনতে পারিনি ।
অমিত : আমি সিরিয়াস আলোচনা করছি আর তুই তার মাঝে গল্পগাছা নিয়ে আসছিস । লোকটা আর ওর বউ অনেক ভালো । তোদের বাড়িতেও আমার অমন আদর-যত্ন হয়নি । দশদিন পরে, সকালে আমরা বাসে করে গেলুম গয়া । গয়া থেকে ট্রেনে করে লাতেহার, ওটা ঝাড়খণ্ডে পড়ে । দিনের বেলাটা তেতিয়া বিরহোর নামে একজন আদিবাসীর মাটির বাড়িতে কাটিয়ে বিকালে হাঁটা দিলুম তিনজনে । সারারাত উবড়-খাবড় রাস্তা ঠেঙিয়েছি, ভেবে দ্যাখ ।
অমিত : পৌঁছোলুম কাতিয়া নামে একটা জঙ্গলে, রিয়্যাল ঘন-জঙ্গল, গাছের পর গাছ আর ঝোপঝাড়। তাতিয়া ফিরে গেল ; আমাদের আরেকজন কম বয়সী আদিবাসীর জিম্মায় দিয়ে, তার নাম ঝুনাই । সেখান থেকে অনেকটা ওপর দিকে উঠে, অনেকটা, অনেকটা, জঙ্গলের আরও ভেতরে গিয়ে ঝুনাই ফিরে গেল । আরেকজন, তার নামও তেতিয়া, আমাদের নিয়ে গেল আরও ভেতরে খোলামতন একটা জায়গায়, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে ব্যাডমিন্টন কোর্টের মতন অমন একটা খোলা জায়গা রয়েছে, ন্যাচারাল জায়গা । কয়েকটা পলিথিনের তাঁবু দেখতে পেলুম, দু’জন লোক কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে পাহারা দিচ্ছিল । কীরকম তাঁবু জানিস, তোর ক্লিনিকের একটু আগে ফুটপাথে চায়ের দোকান আর ভাতের দোকানে যেমন পলিথিনের তেরপল আছে, তেমন । একটা তাঁবুতে ঢুকে তেতিয়া আস্তে ডাক দিতে, একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন, তিনি বললেন, আবার ম্যালেরিয়া হল নাকি রে, সেরে তো গিয়েছিলি । তেতিয়ার পেছনে আমাদের দেখতে পেয়ে রসিককে বললেন, আচ্ছা, রসিক একজন নতুন ছাত্র এনেছে বলে মনে হচ্ছে । মাস্টারসাহেবকে খুঁজছ তো ? উনি ওইদিকের ছাউনিটায় মিটিং করছেন । শুনেছ তো কয়েকদিন আগে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বল-এর লোকেরা জওয়ানদের শব তোলার কাজে কয়েকজন গ্রামবাসীকে লাগিয়েছিল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বোমা ফেটে মারা গেছে আর কয়েকজনের অঙ্গহানি হয়েছে ।
ইতু : জঙ্গলে স্কুল-মাস্টার কী করেন রে ?
অমিত : ধৈয্য ধর না, সবই তো বলছি । ওই মহিলা আমার মা আর মাস্টারসাহেব আমার বাবা ।
ইতু : মাই গড ! আমি যাবো ওখানে, তুই আমাকে আজই নিয়ে চল । আমি ওনাদের বলব যে আমি তোকে চাই বলে তুই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিস, তোর কোনো দোষ নেই ।
অমিত : মা আমাকে দেখে চিনতেই পারলেন না যে আমি ওনার ছেলে ; শালা মাতৃত্ব নিয়ে লেকচারবাজি সবই ফালতু । আমার তক্ষুনি এত খারাপ লেগেছিল যে হয়ত কেঁদেই ফেলতুম । উনি হিন্দিতে বললেন, তোমাকে বেশ ডিপ্রেসড দেখাচ্ছে । অনেকটা হেঁটে এসেছ তো, ক্লান্ত হয়ে গেছ, ওই শেডটায় যাও, মাস্টারসাহেব আছেন, যাও দেখা করে নাও, ক্লান্তি জুড়িয়ে নাও । রসিক পাসওয়ান ওনাকে বললই না যে আমি ওনার ছেলে । পাশের তেরপলে ঢুকেছি, রসিক পাসওয়ান ওনাকে লাল সেলাম মাস্টারসাহেব বলতেই, উনিও একইভাবে প্রত্যুত্তর দিলেন, আর আমাকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন, গভীরভাবে আমার মুখের পানে তাকিয়ে দেখে তক্ষুনি জড়িয়ে ধরলেন , বাংলাতেই বললেন, এখানে কেন এলে, যেখানে ছিলে ভালোই তো ছিলে । তুমি আমার ছেলে, ওনারা নিশ্চয় তোমাকে বলে থাকবেন, যে কারণে তুমি কমরেড রসিককে সন্ধান করে এখানে ছুটে এসেছ, দাঁড়াও তোমার মাকে ডাকছি, উনি প্রায়ই তোমার প্রসঙ্গ তোলেন আর বলেন যে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছিলুম আমরা । আমি বললুম যে আমার নাম অমিত । ওনাকে ঘিরে যে আদিবাসীরা ছিল, জিগ্যেস করল, আপকা বেটা ? বাবা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু হারিয়ে-যাওয়া ছেলেকে দেখে একজন বাবার যেমন রিঅ্যাকশান এক্সপেক্ট করেছিলুম, তেমন প্রতিক্রিয়া হল না দেখে, মনটা খারাপ হয়ে গেল, ডিফিটেড ফিল করলুম রে ।
অমিত : উনি বলতে লাগলেন, আমি কিন্তু মনে করি কিছুই ভুল করিনি । দেখছ তো অঞ্চলটা ? এখানে একজন শিশুকে লালন করা অসম্ভব । উনি তারপর মানসী মানসী বলে কয়েকবার ডাক দিতে আমার মা এলে, বাবা বললেন, একে চিনতে পারছ ? তোমার ছেলে । মা আমার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, আমিও মায়ের দিকে । উনি কোনো কথা না বলে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে, ব্যাস, জীবনে প্রথমবার নিজের গ্রোনআপ ছেলেকে দেখে, জড়িয়ে, কাঁদাবার কথা । উল্টে, আমারই কান্না পেয়ে গেল । মায়েরা জড়িয়ে ধরলে মগজের মধ্যে যে তুফান আরম্ভ হয় তা জানতে পারিনি কখনও । মা বললেন, তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছ, জবাবদিহি চাইতে, না? আমার কাছে দেবার মতো ব্যাখ্যা নেই । আমি জবাবে বলেছিলুম, আপনি আমাকে এভাবে অনেকক্ষণ জড়িয়ে থাকুন, তাহলে আমার কান্না পাবে না । ওনার হৃৎস্পন্দন যে দ্রুত হয়ে চলেছে, তা টের পেয়ে মনে হচ্ছিল যে যাক, জবাবদিহি পাওয়া গেল । দূরত্ব কিন্তু থেকেই গেছে রে ।
অমিত : বাবা বললেন, মানসী, ডাক্তারসাহেবের কাছে নিয়ে যাও ওকে, দেখাও তোমার ছেলে কত বড় হয়ে গেছে । আমার দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন, অমিত, তুমি এখানেই থাকবে, আমাদের সঙ্গে কাজ করবে, আর ফিরে যাবার দরকার নেই ।
অমিত : মা আমাকে অন্য একটা পলিথিনের তেরপলে নিয়ে গেলেন । সেখানে রোগা, পাকাচুল, চশমাপরা, ফর্সা একজন বসে টেবিলে কিছু লিখছিলেন, তাঁর সামনে দুজন আদিবাসী বসেছিল । মা তাঁকে বললেন, একে চিনতে পারছ ? এ আমার ছেলে । উনি এমনভাবে আমার ছেলে কথাটা বললেন যে বুঝতে পারলুম তার ভেতরে গোপন গর্ব লুকিয়ে আছে, আর কিছুটা ওই পাকাচুল লোকটার প্রতি অবজ্ঞা । লোকটা উঠে আমার মুখের কাছে মুখ এনে চশমা কপালে তুলে বলল, তুই কমরেড অতনুর ছেলে ? কী নাম রেখেছে তোর, অমিতই আছে তো ? ডাক্তারসাহেবের কথা শুনে আমার বেশ ভালো লাগল রে । বাবা-মা তুমি-তুমি করে কথা বলছিলেন, ইন ফ্যাক্ট আজও ওনারা আমার সঙ্গে তুমি-তুমি করে কথা বলেন, আর আমি ওনাদের আপনি-আপনি করে কথা বলি, কিছুতেই তুমি বেরোয় না মুখ থেকে । বুঝতে পারি যে ওনারা একটা অদৃশ্য পর্দা টাঙিয়ে আলাদা করে রেখেছেন আমাকে ।
ইতু : আমি হলে দেখা হতেই বলতুম, মা, বাবা, তোমরা আমাকে অন্যের কোলে ফেলে দিয়ে আর কখনও ফিরে তাকাওনি কেন । তারপর কী হল ? ঘ্যাঙাচ্ছিস কেন, শিট, তাড়াতাড়ি বল ? তুই ওনাদের সঙ্গেই ছিলি এতকাল ? কী করতিস ? আমায় কবে নিয়ে যাবি ?
অমিত : হ্যাঁ, থেকে গেলুম । ডাক্তারসাহেব কী করেন জানিস ? যে সব আদিবাসী ছেলেরা স্কুলে ক্লাস এইট-নাইন পর্যন্ত পড়েছে, তাদের ডাক্তারির প্রথমপাঠ পড়ান, অ্যান্টিবায়টিক দেয়া, কখন অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ওষুধ দিতে হবে, ইনজেকশান দেয়া, ওষুধের নাম, জখম হলে কী ভাবে পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে হবে, এইসব । গরিবদের জন্য, বিশেষ করে আদিবাসীদের জন্য কিলোমিটার-কিলোমিটার তো ডাক্তার পাওয়া যায় না। তাই হাতে-নাতে প্রাথমিক ডাক্তারি শিখে তারা গ্রামে-গ্রামে ডাক্তারি করে, বেয়ারফুট ডাক্তার ।
ইতু : আর তোর বাবা-মা, ওনারা ওই জঙ্গলে কী করেন ?
অমিত : বাবা ক্লাস নেন, আদিবাসী ছেলে-মেয়ে-জোয়ান সবায়ের । হিন্দি, ইংরেজি আর অঙ্ক শেখান । এছাড়া উনি রাজনীতি সম্পর্কে সহজ বিশ্লেষণ করে বোঝান কেন গরিবরা ষাট বছর পরও গরিব থেকে গেল ; তা থেকে মুক্তি পেতে গেলে কী করতে হবে, এইসব তত্ত্বকথা । ওনারা কিন্তু একই জায়গায় থাকেন না ; প্রায় রোজই পলিথিনের তাঁবু আর জিনিসপত্তর গুটিয়ে অন্য কোথাও তাঁবু খাটান । বন্দুকধারীরা পাহারা দ্যায়, কুচকাওয়াজ করে, বন্দুক চালাতে শেখে । অনেক লোক আছে, প্রথম দিন কোনো আইডিয়া হয়নি । একটু-একটু করে জানতে পারলুম ।
ইতু : আর মা ?
অমিত : মা যে ঠিক কী করেন জানি না । আমি তো বাবার তাঁবুতে শুই । মাঝে-মাঝে অলিভ রঙের পোশাকে বন্দুকধারী লোকজন আসে, তারা মায়ের সঙ্গে খুসুরফুসুর কথা বলে, তারপর চলে যায় । সাধারন পোশাকের বন্দুকধারীও দেখেছি আসতে । তখন ওনার ছাউনিতে ঢোকা নিষেধ । বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলুম যে লোকগুলো কারা, কেন আসে, উনি বলেছিলেন, সময় হলে জানতে পারবে, যদি বোধবুদ্ধি গড়ে ওঠে তাহলে তোমাকে ওই কাজগুলোই করতে হতে পারে যা তোমার মা এখন করছেন । আপাতত তুমি দেখতে থাকো আমি কী ভাবে পড়াই, কোন বই পড়ি ; তুমি সেই বইগুলো পড়ো । মাঝে-মাঝে আমিও অঙ্কের ক্লাস নিই, বাবা উপস্হিত থাকেন, আমাকে গাইড করেন । ব্যাস ওইটুকুই, উনি বাবার মতন বিহেভ করেন না । তত্ত্বফত্ত্ব যতটা বুঝেছি, সব ফালতু ।
ইতু : হাঃ, তুই ক্লাস নিস, পড়াশুনায় লো সেকেন্ড ক্লাস ! যাকগে, পড়াচ্ছিস, পড়া । তুই তো বললি এই বয়সেও তোর মা অপরূপ সুন্দরী ?
অমিত : হ্যাঁ, সত্যিই সুন্দরী ; চুল পাকলেই বা । আমি ওনাকে একদিন সাহস করে জিগ্যেস করেছিলুম যে, আপনি তো ডাক্তারসাহেবকে ডিভোর্স দিয়ে বাবাকে বিয়ে করলেই পারতেন, তাহলে আমাকে জন্মের গঞ্জনা শুনতে হতো না । উনি কী বললেন জানিস ?
ইতু : কী ?
অমিত : বললেন, আমি অতনুর এত কাছে চলে গিয়েছিলুম, এত ভালোবেসে ফেলেছিলুম যে বিয়ের প্রয়োজন ছিল না; অতনুও বাড়ি-চাকরি সবকিছু ছেড়ে আমার খোঁজে বেরিয়ে চলে এসেছিল আমার আস্তানায়, তখন আমি আর ডাক্তারসাহেব নওয়াদায় থাকতুম । বললেন, তুমি আমাদের প্রেম থেকে জন্মেছ, গতানুগতিক দৈহিক সম্পর্ক থেকে নয় । তোমার ছোটোবেলায় যদি আমাদের সঙ্গে তোমাকে রেখে মানুষ করতুম তাহলে আমরাও গতানুগতিক সম্পর্কের রুটিনে জড়িয়ে পড়তুম । দেশের জন্য, মানুষের জন্য, যে স্বপ্ন দেখি, তা দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠত ।
ইতু : হোয়াট ডাজ শি মিন ? উনি একটা পোয়েটিক অ্যালিবাই খাড়া করে তোকে বুঝিয়ে দিলেন, আর তুই বুঝে গেলি ? রাবিশ । আমি তো তোর ফ্লেশকে আমার ফ্লেশ দিয়ে কারনিভোরের মতন ভালোবাসি । তুই যখন চলে গেলি তখন এমন হয়ে গিয়েছিল যে তোকে রাস্তায় পেলে সত্যি খুন করে ফেলতুম । একদম ভেঙে পড়েছিলুম ।
অমিত : এখন সামলে নিয়েছিস তো ? আমার বাবাকে তোর কথা বলেছিলুম । উনি বলেছেন, তুই যেহেতু আমার বিশ্বাসের পাত্রী, আমাদের হয়ে কাজ করতে পারবি ।
ইতু : কাজ ? না, না, আমি তোর সঙ্গে যেতে চাই, কাজ-ফাজ করার হয় ওখানে গিয়ে করব, তোর মাকে হেল্প করব, ডাক্তারি করব, আমি তো বেয়ারফুট ডাক্তারের চেয়ে বেশি কমপিট্যান্ট । আমি যে-কোনো অবস্হার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারি, তুই তা জানিস । আই জাস্ট ওয়ান্ট টু গেট আউট অফ দিস মিনিংলেস লাইফ।
অমিত : মানুষের-সেবা, সমাজের-সেবা, গরিবদের সেবা, ওয়েলবিইং অফ ম্যানকাইন্ড, এইসব বক্তৃতা ঝাড়তিস, আর এখন শুধু আমার সঙ্গে যাবার বায়না করছিস । তুই যাবি, তবে এখনই নয় । এখন তুই বাবা-মার জন্য কিছু-কিছু কাজ করবি । সহজ, কিন্তু বিপজ্জনক কাজ । তোর ক্লিনিকে মাঝে-সাঝে একজন লোক সবুজ বা নীল টিশার্ট পরে খাম দিয়ে যাবে, তুই সেটা নিজের কাছে রাখবি, পরে ধূসর বা ছাইরঙের টিশার্ট পরা একজন লোক এসে ওটা কালেক্ট করে নেবে । এটা অত্যম্ত গোপন কাজ ; এ-বিষয়ে তুই কখনও কারোর সঙ্গে আলোচনা করবি না । ভেবে নে, চিন্তা করে বল । আবার বলছি, এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক । যদি ওৎ-পাতা পুলিশ তোকে ওই খামসুদ্দু ধরে তো কী যে হবে তা জানিস তো, মেয়েদের ধরে লকাপে যা-যা হয় ।
ইতু : তোর জন্য সবকিছু করতে পারি । ধরেবেঁধে রেপও যদি ওরা করতে চায়, তো করবে । কিন্তু, দাঁড়া, স্তোক দিয়ে তুই কেটে পড়ছিস না তো ?
অমিত : না । বি সিরিয়াস । এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । ইয়ার্কি হাসিঠাট্টার নয় ।
ইতু : তাহলে বাড়ি চল । চান-টান করে খেয়ে-দেয়ে তারপর যাস । আমি স্কুটার কিনেছি, চল না একবার পুরো গান্ধি ময়দানের চক্কর মেরে গোলঘরের পেছন দিয়ে ঘুরে আসি ; তুই জড়িয়ে বসে থাকবি, আর আমি হ্যাপি ফিলিং নেবো । চল, চল ।
অমিত : কী যে বলিস, এমনিতেই আমি ক্লান্ত । ওই বাড়িতে আমি আর ঢুকতে চাই না রে।
ইতু : সুশান্তজেঠু অত অপমান সহ্য করে, হেনস্হা সহ্য করে, অবহেলা সহ্য করে আসেন । তোকে তো শুধু বলা হয়েছিল যে আমি তোর বোন, তুই যাদের ছেলে তারা নিজেদের মধ্যে বিয়ে করেনি । তোর তো একটা স্পেস আছে বাড়িটায় । এত তাড়াতাড়ি হেরে যাবি কেন ? বি পজেসিভ অ্যাণ্ড অ্যাগ্রেসিভ লাইক মি । বটঠাকুমা আর অন্নমা তো তোকে ভালোবাসেন । ওনারা দুজনে কাঁদছিলেন, যেদিন তুই বাড়ি ছেড়ে চুপচাপ কেটে পড়লি । চল, চল ।
অমিত : ঠিক আছে, চল তাহলে, দেখি ওনাদের প্রতিক্রয়া, আমি তো জন্মেছি লাৎখোর হয়ে, অপমান-ফপমান সব মাথার ভেতর থেকে হাপিশ করে দিয়েছি ।
ইতুর স্কুটারে বসে অমিত ওদের বাড়িতে পৌঁছলে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া তেমন হল না । বটঠাকুমা আর অন্নমা বুকে জড়িয়ে আদর করলেন অমিতকে । বললেন, যে যাই বলুক, যতদিন আমরা দুই বুড়ি বেঁচে আছি ততদিন তুই এই বাড়ির ছেলে । যা চান-টান করে আয়, ব্রেকফাস্ট করা হয়নি তো ?
ইতু টয়লেটে টাওয়েল সাবান রেখে এসেছিল । সুশান্তজেঠুর মা টয়লেটে সুশান্তজেঠুর সযত্নে রাখা অতিপুরোনো পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি রেখে এলেন । স্নান করে আসার পর ডাইনিং টেবিলে অমিতকে ঘিরে বাড়িতে উপস্হিত সবাই ওর উধাও হয়ে যাবার গল্প শুনতে চাইছিলেন, হয়তো ওনাদের অভিনয় । রাঙামা লুচি ভেজে নিয়ে এলেন, সঙ্গে আগের দিন ইতুর রাঁধা আলু দিয়ে ডিমের ডালনা, আর আচার । অমিত ভাবল, একবার জিগ্যেস করে, ওর পোশাক-আশাক জামাকাপড়গুলো কী হল, যে সুশান্তজেঠুর কম বয়সের পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরতে হচ্ছে । আর কী-ই বা হবে, যাকগে, আমি তো আউটসাইডার, নিজেকে বলল ।
--সত্যিই আমি ভবঘুরে সাংবাদিক হয়ে গেছি , ঘুরে বেড়াই, আজ এখানে, কাল সেখানে, কোনো নির্দিষ্ট জায়গা আর নেই । আমি কিন্তু আজকেই চলে যাব । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
--আজ আর যেতে হবে না, কত দিন পরে হারিয়ে যাওয়া ছেলে বাড়ি ফিরল, বললেন বটঠাকুমা । এটা কি তোর বাড়ি নয় নাকি, বল, আমরা কি তোর পর ? আমাদের কোনো অসুবিধা নেই । সুশান্তর বাবা মারা যাবার পর ওনার ঘরটা তো পড়েই আছে, আমি আর ওই ঘরে শুতে পারি না, ইতু শোয়, বললেন সুশান্তজেঠুর মা।
--হ্যাঁ, আমি এই বাড়ির মিউজিকাল চেয়ার । একজনের বিয়ে হয়, তার জন্য ঘর ছাড়তে হয়, আবার আরেকজনের বিয়ে বা বাচ্চা হয়, বা কারোর পরীক্ষা, ব্যাস, নির্দেশ আসে, ইতু এবার বারান্দায় শো, দালানে শো, রান্নাঘরে শো, ডাইনিং টেবিলের পাশে শো, সিঁড়ির তলায় শো । রাঁধুনি না এলে, এটা রাঁধ, সেটা রাঁধ। জমিয়ে রাখা ক্ষোভ চারিয়ে দেবার সুযোগ হাতছাড়া করল না ইতু ।
--ওঃ, এই অবস্হায় আমি কেন আবার জমির লড়াইতে শরিক হই । অমিতের কথায় পরিবেশ ফিরল স্বাভাবিকতায় । বলল, বহুকাল বাড়িতে তৈরি লুচি আর ডিমের ডালনা খাইনি । দুপুরে আর লাঞ্চ করার দরকার হবে না । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
--বাড়ির রান্না খাসনি বলছিস, দুপুরে মাছের ঝোল আর ভাতও তো খেতে হবে তাহলে । বলল ইতু, তারপর অমিতকে বলল, চল মাছের বাজারে যাওয়া যাক, তোর পছন্দের মাছ কেনা যাবে । লুঙ্গি পরেই চল, লজ্জা পাসনি, নেতারা পর্যন্ত লুঙ্গি পরে গান্ধি ময়দানে ভাষণ দিচ্ছে, মিছিলে হাঁটছে , অমিতের হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে তুলে বলল ইতু । বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ইতু বলল, বানচোদ, তুই এসেই যাই-যাই করছিস কেন বলতো ?
সিঁড়ির পাশের স্লোপ দিয়ে স্কুটার নামাতে-নামাতে বাড়ির উল্টো দিকের গেটের দিকে মুখ তুলে ইতু বলল, মিশ্রাজির ছেলেটা অন্ধকার থাকতে সকাল পাঁচটা থেকে মারুতি গাড়ি রিভার্স করতে শেখে আর ঘুম ভাঙিয়ে দ্যায়, রিভার্স হর্নে ভোর থেকে একঘেয়ে সারে জাহাঁসে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা বাজায় ।
একদিকে পা ঝুলিয়ে বসার কারণে ইতুর পেটে অমিতের জাপট কিছুটা নিকটতর হল । ইতু বলল, এই, নাভিতে সুড়সুড়ি দিসনি, ব্যালান্স গোলমাল হয়ে যাবে । অলরেডি তুই আমার জীবনের ব্যালান্স গোলমাল করে দিয়েছিস ।
-- মাছের বাজার এসে গেছে, নাম আর বল কোন মাছ খেতে চাস । তখন প্রস্তাব দিয়েছিলুম যে শহরটা এক পাক ঘুরে নিই, রাজি হলি না, ফর হোয়াটএভার রিজনস ।
--বলব আবার কি, ইলিশ পাওয়া গেলে ইলিশ কেন, খেয়ে নিই, কে জানে আবার কখনও খাওয়া হবে কিনা, ইলিশ কেমন দেখতে তা-ই তো ভুলে গেছি।
ইলিশ কিনে, কাটিয়ে, স্কুটারে পা ঝুলিয়ে বসে, অমিত বলল ইতুকে, রাতটা থেকেই যাবো, বুঝলি । তোকে কিছু-কিছু দায়িত্ব দিয়ে যাবো ।
--তোর নিজের দায়িত্বটাই দে না, এত ভিতু কেন তুই ? অমিতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল ইতু। গান গাইতে শিখিনি, নয়তো মন খুলে একখানা পেলব-পেলব ঢিললা-হিললা টাইপ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতুম । কোন গান জানিস ?
--না, কী করে জানবো ? স্কুলের বন্ধুরা তো সব ছিল হিন্দি গান আর হিন্দি সিনেমার কীট । রাঙামা হিন্দি টিভি সিরিয়ালের পোকা । নবনীতাবৌদি গিটারে হিন্দি ফিলমের সুর বাজাতো ।
--হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে…
--শুনতে পাবে পাবলিক । মাছের বাজার মানেই বাঙালির জমায়েত ; অনেকে তোকে-আমাকে ভালোই চেনে ; হয়ত আমাদের রিলেশানশিপের খবরও ছড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে ।
--বুলশিট, তুই এখনও আমাকে নেগলেক্ট করার ডিজাইন বজায় রেখেছিস কেন বল তো ? তোর দায়িত্ব চাইছি বলে ভয় পেয়ে গেলি নাকি, কাওয়ার্ড ?
--ক্লাস টেন থেকেই তো কত ছেলে তোকে লাইন মারত, নিজেই ঢিল দিসনি, নয়তো দায়িত্ব পেয়ে যেতিস এতদিনে। স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করানোর লাইনে ভোর রাত থেকে দাঁড়িয়ে থাকতিস ।
--স্টপ ইওর জিবারিশ । যত্তোসব ফালতু ছোকরার দল । তোর তো ক্লাস টেনেই গোঁফের রেখা আবছা বেরিয়ে এসেছিল, তবু তুই লাইন মারার সাহসটুকু দেখাতে পারিসনি । আমি না এগোলে তুই বোধহয় চেপেই রাখতিস নিজেকে ।
--তখন বেশ ক্যাবলা ছিলুম রে, তোকে দেখলেই তোর বুকের দিকে চোখ চলে যেত, আড়ষ্ট ফিল করতুম, কথা বলতে পারতুম না, ভাবতুম কোন বিষয়ে কথা বলব । তাছাড়া, মগজে ঢুকে গিয়েছিল যে আমি তোদের বাড়ির চাকরের স্তরের । মালিকের মেয়েকে প্রণয়-প্রস্তাব কোন চাকরেই বা দ্যায় ? ওসব নাটক-নভেলে হয় ।
--শাট আপ, ইউ সাকার..., গালাগাল এসে যাচ্ছে মুখে ।
--কেমন বোকা-বোকা কথা বলছি না আমরা ?
--হ্যাঁ, বর-বউ হতে পারত কিন্তু হল না, এরকম একজোড়া বোকা-বোকির গল্প ।
রাতে, খাওয়া-দাওয়ার পর, ইতুকে বলল অমিত, ও একটা মিটিঙে , বিহারশরিফে, এসেছিল, বাবার সঙ্গে।
--হোলি শিট, তোর বাবাও এসেছিলেন ?
--হ্যাঁ । উনি তো মেশেন না কারোর সঙ্গে ।
--দায়িত্বটা কী তা বললি না তো ? বিছানায় বসে জিগ্যেস করল ইতি ।
--এতো ঘেঁষে বসিস না, আবার গোলমাল হবে শেষকালে ? ভাববেন, ছাড় দেয়া হয়েছে, ব্যাস, মাখামাখি করছে রাতদুপুরে ।
--কারোর অমন মাথাব্যথা নেই; ওসব নিয়ে চিন্তা করিসনি । বরং তোর ঘাড়ে চেপে যদি কেটে পড়ি তো ওনারা বেঁচে যান । হয়তো ওনারা আমাকে এই স্পেসটা সেকারণেই ছেড়ে দিলেন । এখন দেখার যে তুই কীভাবে রেসপণ্ড করিস ।
--এই তো সবে এতদিন পর দেখা হল, তুই বেশ ফ্রিলি গল্প করতে পারছিস , মনের কথা খুলে বলতে পারছিস । আগেই বলেছি, আমি যে কাজটা দেবো সেটা বেশ সিম্পল কিন্তু বিপজ্জনক । ভেবে উত্তর দিস । কাল সকালে আমার যাওয়া পর্যন্ত তোর হাতে সময় থাকবে ।
--কী কাজ, শুনি, ঘোড়ার ডিম বিপজ্জনক । কাউকে বোমা মারতে বা গুলি মারতে বলবি নাকি ? কিংবা সোনার বিস্কুট এখান-ওখান । তা আমি পারব না, আগেই বলে রাখলুম ।
--বলেছি তো, মনে করে রাখ । তোর ক্লিনিকে বা বাড়িতে সবুজ বা নীল শার্ট বা টিশার্ট পরা একজন একটা চিঠি দিয়ে যাবে, হয়ত স্মার্ট নয়, বিহারি বা বাঙালি না-ও হতে পারে সে, ইংরেজিতে একটা-দুটো কথা বলে চিঠিটা দিয়ে চলে যাবে । তুই তা নিজের কাছে রেখে দিবি । পরে, দু-এক সপ্তাহের ভেতর বা মাসখানেক পরেও হতে পারে, ওই খামটা আরেকজন নিতে আসবে, তার গায়ে ছাইরঙা বা ধূসর শার্ট বা টিশার্ট থাকবে ।
--ওঃ, ডাকবাক্সের কাজ, পারব না কেন ? স্মাগলিং-টাগলিং নয়তো ? যেরকম দাড়ি-গোঁফ বাবরিচুল চেহারা করেছিস, দেখে তো স্মাগলার বলেই মনে করবে লোকে । লুঙ্গি পরে তোকে মানিয়েও গেছে ।
--না, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের কাজ ।
--তুই আসবি না ? তুইও তো আসবি, দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে, হলুদ টিশার্ট আর জিন্স পরে, স্মার্টলি । ফর মি ?
--সিরিয়াস ইশ্যু ।
--ওকে, টেকন । কিন্তু আমি কেবল তোর ওই প্রক্সিদের নিয়ে ডিল কোরবো নাকি ? তুই যদি না আসিস তাহলে কেন বেগার খাটতে যাবো উটকো লোকেদের জন্য ?
--তা-ই কর কিছুদিন । কিন্তু আবার বলছি, অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ । ওই খামসুদ্দু তুই ধরা পড়লে যে ধরণের ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বি তা মোটেই সুখকর নয় ।
ইতু নিঃশব্দে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলল, অমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে । তারপর অমিতের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, দায়িত্ব নিলুম, কিন্তু এক শর্তে, ন’মাসে-ছ’মাসে তোকেও আসতে হবে । ইউ মাস্ট, আদারওয়াইজ দি ডিল ইজ ক্যানসেল্ড ।
অমিত আবার এসেছিল, প্রায় এক বছর পরে, ক্লিনিকে, বিনা দাড়ি-গোঁফে, হলুদ টিশার্ট আর জিনস পরে, চোখে রোদ চশমা । তার মাঝে নীল-টিশার্ট ধূসর-টিশার্ট যুবকেরা ক্লিনিকে খাম দিয়ে গেছে আর নিয়ে গেছে, বেশ কয়েকবার । ইতুর কি খাম খুলে দেখতে ইচ্ছে হয়নি কী আছে ভেতরে ? হয়েছে । কিন্তু সেলোটেপে মোড়া চিঠি খোলেনি । নিজেকে বুঝিয়েছে যে অমিতকে জানতে হলে ওর মুখোমুখি বসেই জানতে হবে, গোপন কাজকর্ম, তা যাই হোক, স্মাগলিং বা লুকিয়ে বেড়ানো বিপ্লব, না সিক্রেটিভ কোনো ধার্মিক কাল্ট, কথা বলে জেনে নিতে হবে ।
অমিতের চেহারা বেশ রোদঝামা হয়ে গেছে, স্মার্ট পোশাক সত্বেও, আঁচ করল, ইতির মগজের ডাক্তার । অমিত ক্লিনিকে ঢুকে চেয়ারে বসে স্মিত হাসি ফোটাবার চেষ্টা করলে, ইতি বলল, প্রায় শিশুর আদুরেপনা মিশিয়ে, তোর একটা খাম পড়ে আছে, কেউ নিতে আসেনি তো ?
--খাম, কই দেখা, বিস্ময়ে বলল অমিত ।
--এই যে, দ্যাখ, পড়ে আছে সেই কবে থেকে ।
-- কই দে তো, দেখি ।
টেবিলের ওপর চারভাঁজ করা প্রেসকিপশানের কাগজে, দেখল অমিত, লেখা রয়েছে, ‘যদি বিপদ শেয়ার করি, তাহলে বেডশিট শেয়ার করব না কেন’ ? ইতি বলল, তারিখ দেখেছিস, ছয় মাস আগের । কত এক্সপেক্ট করেছি তোকে । ইন ফ্যাক্ট আমার এই ক্লিনিক চলে না, রোগি আসে মাসে হয়ত দুজন, কখনও আসেই না, তবু খুলে রেখেছি, স্রেফ তুই একদিন হঠাৎ আসবি বলে । আজ থেকে ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেল । চল , বাড়ি চল, বাড়িতেও সবাই বলে যে কেন মাছি মারছিস বসে-বসে, ভাড়া গুনছিস, বাবার দেয়া জমানো টাকা নষ্ট করছিস। তারপর, প্রায় কান্নামাখা কন্ঠস্বরে বলল, কী করে ওনাদের বলতুম যে আমি তোর অপেক্ষায় বোকার মতন হাঁ করে বসে থাকি ।
অমিত থ । অনুমান করতে পারেনি যে রহস্যময় খামগুলোর মাধ্যমে নৈকট্যকে বিপজ্জনক করে ফেলেছে। কাগজের লেখাটার দিকে তাকিয়ে, চুপ করে রইল । বলল, যে ভালোবাসার কথা বলছিস, তা আমি যে জীবন কাটাই, তাতে কতটা প্রযোজ্য, তা যারা এই জীবন যাপন করে কেবল তারাই বুঝতে পারবে । আমি তো ভবঘুরে, বলেইছিলুম তোকে । তোকে তো বলেছি কী ধরণের লাইফ লিড করছি । বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেও তাঁদের সঙ্গে নেই, তাঁরা আমার কেউ নন । এখন মনে হয় আত্মপরিচয়ের সন্ধানে তাঁদের খোঁজে বেরোনোটাই ছিল ব্লাণ্ডার ।
ইতি ক্লিনিকের চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলল, চল, চল, যেতে যেতে কথা বলা যাবে । ক্লিনিক আমি বন্ধ করে দিচ্ছি আজ থেকে, তোর এই মোবাইল ডাকবাক্সে বার্তা ফেলতে হলে মেসেঞ্জারদের আমার বাড়ি আসতে হবে । ইতুর কব্জি শক্ত করে ধরে অমিত বলল, তোর নির্দেশমতো যে পোশাক পরে এলুম সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করলি না ।
--তুই তাহলে শুনতে পাসনি ; চোখ দিয়ে করা মন্তব্য শোনার মতন ইন্দ্রিয় হারিয়ে ফেলেছিস । বোতাম খুলে তোর বুকের চুলও দেখাচ্ছিস, তোর বুকে যে চুল গজিয়েছে কী করে জানব । তা জানার জন্যও তো করাঘাতের অধিকার দরকার, নয়কি, বিপদ শেয়ার করার অধিকার থেকে সামান্য পৃথক অধিকার ?
--তোদের বাড়িতে চড়ুইপাখির বাসা আছে, মনে আছে, দালানের কড়িকাঠের ফাঁকে ? কখনও লক্ষ করেছিস কি যে মাদি চড়ুইপাখিকে ইমপ্রেস করার জন্য পুরুষ চড়ুইপাখিরা তাদের কালো বুক দেখাবার প্রতিযোগীতা করে ?
ক্লিনিকের শাটার নামিয়ে, তালা দিয়ে, ফুটপাতে নেমে, অমিতের দিকে তাকিয়ে ইতু বলেছিল, ঠিক কী বলতে চাইছিস বুঝতে পারলুম না । তুই কি বলতে চাইছিস যে তোর হৃদয় উনিশ শতকের গৌরবগাথায় বর্ণিত মসীলিপ্ত ভিলেনের মতন হয়ে গেছে ? নাকি বলতে চাইছিস যে তুই মাদি চড়ুইপাখিটাকে জয় করতে এসেছিস ? ভুলে যাচ্ছিস কেন যে মাদি চড়ুইপাখিটাই তোকে জয় করার জন্য যুদ্ধ করেছিল । ওহ, ইনটলারেবল, জাস্ট ইনটলারেবল ।
--না সত্যিই অনুমান করতে পারিনি । না, অনুভব করতে পারিনি বললে যুৎসই হয় ।
--বাঃ, আমার কথামতন পোশাক পরে এক বছর পর উদয় হলি, আর অনুভব করতে পারিসনি, ইউ সেল্ফসার্ভিং জোকার ? নিজেকে ভুল বুঝিয়েই কি তুই তোর রহস্যময় জীবনকে মিনিংফুল করে তুলতে চাইছিস?
তারপর যোগ করল, স্কুটারটা বেচে দিয়েছি । ভাড়া গোনার জন্য টাকার দরকার ছিল । বলল ইতু, ফুটপাতে পড়ে-থাকা শালপাতার দিকে তাকিয়ে ।
একটা রিকশাকে হাত দেখিয়ে থামতে বলল অমিত । ইতু বলল, রিকশা ডাকছিস কেন, হাঁট না পাশাপাশি । চল গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি, কতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাইনি । গিয়ে বসি কিছুক্ষণ । কিছু কথা স্পষ্ট করে নে্য়া দরকার, বাড়িতে গেলে দোতলার বারান্দায় বসে গল্প করতে হবে । প্রিভেসি নেই ।
--বিশ্ববিদ্যালয় ? গঙ্গার ধারের কথা ভাবছিস ? কিন্তু গঙ্গা তো দূরে সরে গেছে, সরকার ভাবছে গঙ্গার ধার দিয়ে মেরিন ড্রাইভের মতন পথ বানাবে । তুই তোর শহরে থেকেও জানিস না, দ্যাখ, আমি বাইরে-বাইরে থাকি, থাকি বলা ভুল হল, অ্যাকচুয়ালি থাকিই না কোথাও, তবু জানি শহরের কথা ।
--ও, তুই তাহলে শহরে আসিস, আর দেখা না করে কেটে পড়িস ? আর ইউ চিটিং অন মি ?
--না, শহরে আজকেই এলুম, সেদিনকার পর, এবারেও বাবার সঙ্গে নালান্দাতেই এসেছিলুম, এর-তার মুখে শহরের পরিবর্তনের কথা শুনতে পাই । তোর সঙ্গে দেখা করব বলেই এলুম পাটনায় । এত কাছে এসে ফিরে যেতে পারলুম না । মনের ভেতরের ব্ল্যাংক স্পেসটায় তুই ক্রমশ জায়গা করে নিয়েছিস, বাবা-মায়ের সঙ্গে তো এখনও আপনি থেকে তুমিতে যেতে পারিনি ; ওনারাও তুমি থেকে তুইতে আসতে চাননি । শুধু তুই-ই একমাত্র যে আমার কাছে একই সঙ্গে তুমি আর তুই । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অমিত বলল, চল ওই অমলতাস গাছটার তলায় বসি, রাস্তার দিকে পেছন ফিরে বসা যাবে ।
--কেন ? আমার সঙ্গে বসে আছিস তা কেউ দেখে ফেলতে পারে ?
--তুই আমার সঙ্গে বসে আছিস তা কেউ দেখে ফেলতে পারে, তোর সঙ্গে আমি নয় ।
অমলতাসের হলুদ ফুলের পাপড়ি ছড়ানো চারিদিকে । সিটের ওপর পাখিতে হেগে রেখেছে । তার ওপরই বসল দুজনে । অমিত জিগ্যেস করল, কী বলবি বল ?
অতনুর হাত নিজের কোলে নিয়ে ইতু বলল, আমি সেল্ফ ডেসট্রয় করার জন্য ডেসপারেট হয়ে গেছি । জীবন সম্পর্কে তিতিবিরক্ত । জানি না কী করব । এনজিও জয়েন করার কথা ভাবি । কোনো পারপাস নেই জীবনে । এর চেয়ে কমার্স পড়লে টাকাকড়ির গুণ ভাগ যোগ বিয়োগ নিয়ে থাকতে পারতুম । বাবা-মা মারা যাবার পর আমি রাডারলেস হয়ে গেছি, কোনো নোঙর নেই । ওনাদের ইনশিওরেন্সের টাকাটা এখনও পেলুম না।
অমিতের হাত নিজের ঠোঁটের ওপর চেপে ধরেছিল ইতু, ছাড়িয়ে অমিত বলল, চল, তোর ক্লিনিক আরেকবার খুলতে হবে । পাটনা শহরের পথে, অমলতাস গাছের তলায়, এভাবে কাছ-ঘেঁষটে বসে থাকার চেয়ে তোর ক্লিনিকের নিভৃতি ভালো ।
--হ্যাঁ, আমাদের বাড়ির দোতলার বারান্দার চেয়ে তো অবশ্যই ভালো। আসলে আমার কথাগুলো কী ভাবে তোকে বলব, কোথায় গিয়ে বলব, তোকে দেখামাত্র যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তাতে শাটার নামিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলুম । চল, ক্লিনিকেই যাই ।
রিকশা থেকে নেমে, ক্লিনিকের তালা খুলে শাটার ওঠাতে সাহায্য করল অতনু, বলল, বেশ ভারি তো, রোজই এভাবে খুলিস আর বন্ধ করিস, বলে, শাটারটা নামিয়ে দিল অমিত । নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে ইতু বলল, এবার বল, যা জানতে চাইছি তা বল, কেউ নেই এখানে, কেউ তোর পেছু নেয়নি, রাস্তা একেবারে ফাঁকা ছিল ।
--আমি রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি করি । তোকে তাতে ব্যবহার করি ।
--তাতে কী হয়েছে ! রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি তো আজকাল সবাই করছে, কে করছে না শুনি ? রাষ্ট্রবিরোধী-ফিরোধি বলে কিছু হয় না । দুশ্চিন্তার কী আছে ? সরকার যারা চালায় তাদের কুকর্ম দেখে, আর ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের স্ক্যাম প্রতিদিন কাগজে পড়ে, সব পাবলিকই মনে-মনে রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে পড়েছে । ধর্ষক, খুনি, ডাকাত সকলেই তো দিল্লির তখত-এ-তাউসে পৌঁছোচ্ছে । এই তো সেদিন মহাত্মা গান্ধির নাতি গোপালকৃষ্ণ গান্ধি দিল্লিতে ওনার বক্তৃতায় বলেছেন যে রিলায়েন্স কোম্পানি এত বেশি ক্ষমতা রাখে যে ভারতে তারা একটা সমান্তরাল রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়িয়েছে । তবে ? তুই ভাবছিস বোধহয় আমি কোনো খবরই রাখি না । সারাদিন ক্লিনিকে বসে কী করি ? পাশের কাপড়ের দোকানটা থেকে হিন্দি আর ইংরেজি কাগজ তিনটে এনে সারাদিন পড়ি ।
--বাবা-মা যে রাজনীতি করেন, তা-ই করি ।
--জানি, অতটা বোঝার মতো জ্ঞান আছে আমার । প্রশ্ন হল, আমি কি এখানে একা পড়ে থাকব, তোর ডাকবাক্স হয়ে ?
--আমি তো কোনো নির্ণয় নিতে পারি না, আই অ্যাম জাস্ট এ ওয়ার্কার, ওনারা যে নির্ণয় নিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তুই ভালোই কাজ করছিস । তাছাড়া, কোনো বিষয়ে কথা বলার কোনো ক্ষমতাই নেই আমার । নেতারা কয়েকজন মিলে নির্ণয় নেন, তাঁরা যে কারা তাও আমি জানি না । তবে, শুনেছি, তাঁদের দুজন তোকে যাচাই করে গেছেন । তুই আমার জন্য নয়, তাঁদের জন্য ডাকবাক্সের কাজ করছিলিস। রোগি সেজে তোর অলটারনেটিভ মেডিসিনের ক্লিনিকও তাঁরা দেখে গেছেন ; তোর মতন ডাক্তারই ওনাদের প্রয়োজন, কেননা তুই আসেপাশে যা পাওয়া যায় তাই প্রয়োগ করে উপশম ঘটাবার চিকিৎসাবিদ্যা আয়ত্ত করেছিস, এম বি বি এসও এক বছর পড়েছিলি ।
--তাহলে কবে তুই আমাকে তোদের সঙ্গে নিবি, আই ওয়ান্ট এ ক্লিয়ার আনসার, নো মোর ডিলিড্যালিং ? ক্লিনিকটা আমাকে বন্ধ করতেই হবে, কেননা বাড়ি থেকে কোনো সাহায্য পাই না, ভাড়া দিই বাবা যে টাকা আমার ভাগ্যে বরাদ্দ করে গেছেন তা থেকে, ফিক্সড ডিপোজিট ফুরিয়ে গেছে, তাই স্কুটারটা বিক্রি করতে হল । ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, আই ওয়ান্ট টু গেট আউট অফ দিস রাট, আমার বডি একটু-একটু করে শবের আদল পাচ্ছে ।
রিভলভিং চেয়ারের কাছে গিয়ে মুখ নামিয়ে ইতুর চোখে চোখ রেখে, অমিত বলল, আমি কি তোকে চুমু খাবো ?
ইতু কেঁদে ফেলেছিল, বলল, চড়ুইপাখি তো কালো বুক দেখিয়ে জিতে গেছে । অমিতের অনুমতির অপেক্ষা না করে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে অতনুর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল ইতু, কয়েক সেকেন্ড পর তুলে নিয়ে, রিভলভিং চেয়ারে বসে, ফুঁপিয়ে কাঁদা আরম্ভ করল । বলল, কেঁদে নিই, অনেক দিনের কান্না জমে আছে । কান্না থামার পর সামলে নিয়ে বলল, চল বাড়ি যাই, অন্নমা, মানে সুশান্তজেঠুর মা, তোকে দেখে খুশি হবেন । সুশান্তজেঠু ওনার ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন, তারপর থেকে অত্যন্ত ভেঙে পড়েছেন ।
--তাহলে না যাওয়াই ভালো । সুশান্তজেঠুর অভাব আমাকে দিয়ে মিটবে না। বরং ঘায়ে খোঁচা লেগে আঘাত বেড়ে যাবে । তোদের বাড়ির সবাই শুরুতেই মানিয়ে নিলে অবস্হা এতটা নিরাশাজনক হতো না । সুশান্তজেঠু আর ওনার বউ-ছেলেকে অ্যাকসেপ্ট না করার তো কারণ ছিল না । তোর বাড়ির লোকেরা তো আর ক্রিমিনাল গ্যাঙটাকে নেমন্তন্ন করে আনছিল না ।
--না, সুশান্তজেঠু নাকি ওদের ক্রিমিনাল দলের ডন হয়ে গিয়েছেন, ওনার শশুর নিজের নেতৃত্ব সুশান্তজেঠুর হাতে দিয়ে দিয়েছে।
--হ্যাঃ, ওসব তো তোরা এর-তার মুখে শুনেছিস । তোদের বাড়ি থেকে কেউ কি গিয়েছিল একবার ? গিয়ে দেখতে কে বারণ করেছিল ? ওরা তো তোদের বাড়ির কাউকে খুন বা কিডন্যাপ করত না । যা করার তা তো করেই ফেলেছিল ওরা, সুশান্তজেঠুর সঙ্গে ওদের গ্যাঙ লিডারের মেয়ের বিয়ে দিয়ে । সম্বন্ধটা শুধরে নিলে সকলেরই মঙ্গল হতো ।
--কত রেসপনসিবলি কথা বলছিস রে, ইউ হ্যাভ রিয়্যালি গ্রোন আপ উইথ ইওর চেস্ট হেয়ার । চল না সুশান্তজেঠুর আস্তানায় ট্রিপ মারি ।
--যাবো । সময় হলে যাবো । এবার আমি যাই ।
--এক্ষুনি ?
--হ্যাঁ, আবার তো আসব ।
--ক্লিনিক কিন্তু বন্ধ করে দিচ্ছি । তোর মেসেঞ্জাররা কি আমাদের বাড়ি চিনে নিতে পারবে ? আমাকে চিনতে পারবে ? কয়েকবার তো নতুন মেসেঞ্জার দেখেছি ।
--তারা সব কিছুই পারে ।
--তাহলে পুরোটা কেঁদে নিতে দে, বলে, সান্নিধ্যের সঙ্কোচ কাটিয়ে, অমিতকে জড়িয়ে ধরেছিল ইতু । কান্না শেষ হলে চোখ পুঁছে বলেছিল, চড়ুইপাখিরা বসন্তঋতুতে একশকুড়িবার প্রেম করে, তা জানিস ?
--না, জানা ছিল না ; তবে, সিংহের কেশর কখন বাদামি থেকে কালো হয়ে ওঠে তা জানি ।
--হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস । পরের বার যখন আসবি তখন কাঁধের ওপর অদৃশ্য কালো কেশর নিয়ে আসিস, মনে থাকে যেন । জাস্ট টু রিমাইণ্ড ইউ, সিংহিগন্ধের ঋতুতে সিংহরা দিনভর পনেরো মিনিট অন্তর প্রেম করে ।


শেষ
মোবাইলে বড়জেঠিকে রিং দিয়ে সুশান্ত ঘোষ শুনতে পেলেন ওনার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর, সুশান্ত...সুশান্ত...কাল থেকে তোকে রিং দিচ্ছি...কতবার চেষ্টা করছি...সুইচ অফ আসছিল….তুই কোথায়...অপু কোথায়...কাগজে খবর পড়ে অব্দি ঘুমোতে পারিনি...খেতে বসে রুচি হল না...শুনছিস তো…সাড়া দিচ্ছিস না কেন...সুশান্ত… অপুকে পাঠিয়ে দে...আমি ওকে আমার ঘরে লুকিয়ে রাখব...সুশান্ত শুনতে পাচ্ছিস...কথা বলছিস না কেন...আমার কথা শোন...তুই চলে আয়...বউকেও নিয়ে আয়...আবার সব আগের মতন ঠিক হয়ে যাবে...তিনজনেই চলে আয়...পুলিশ তোদের এখানে খুঁজবে না...পুলিশ জানে তুই ত্যাজ্যপুত্র...শুনতে পাচ্ছিস ? উদ্বেগ উৎকন্ঠা ক্রমে ফোঁপানি এবং ফোঁপানি ক্রমে কান্নায় রূপান্তরিত হলে, সুশান্ত ঘোষ বললেন, এই নাও, শোনো ।
লুঙ্গিতে গোঁজা সেমিঅটোমেটিক পিস্তলটা বের করে একটা গুলি ওপর দিকে চালিয়ে পরখ করলেন কাজ করছে কিনা । গুড, করছে ।
শোকার্ত আতঙ্কিত বেবি, দড়ির খাটে, রাতের পর রাত ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি-মাখা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে, পাশ ফিরে শুয়ে, চাপা ফোঁপানি ছড়িয়ে দিচ্ছিল শরীর জুড়ে, খাটের শিয়র থেকে দীর্ঘ এলোচুল নামিয়ে, কী হল, কী হল, বলতে-বলতে খাট থেকে নেমে, ওনার, সুশান্ত ঘোষের দিকে ছুটে এলে, বেবিকে লক্ষ করে পর-পর দুটো গুলি চালালেন, বুকে আর মাথায় ।
তারিণী মণ্ডলের মতনই, বেবির খুলি ফেটে দুধে-আলতা মগজ ছিৎরে পড়ল । মুখ থুবড়ে পড়ে গেল বেবি, প্রতিদিন শাম্পু-করা সুগন্ধিত চুল উড়িয়ে ।
দেহরক্ষীরা, যারা সুশান্ত ঘোষের পাহারায় চ্যাঁচারির বেড়ার বাইরে আর নৌকোয় বন্দুক হাতে বসেছিল, তারাও কী হল, কী হল, কারা ফায়ার করছে, বলতে-বলতে চালাঘরের দিকে দৌড়োল ।
সেমিঅটোম্যাটিক পিস্তলের নল নিজের ডান কানের ওপর করোটিতে চেপে , তাকিয়ে দেখলেন বালির ওপড় পড়ে-থাকা তাঁর এত বছরের সঙ্গিনী, তারিণী মণ্ডলের মেয়ে বেবির মৃতদেহের দিকে, তারপর ট্রিগার টিপলেন সুশান্ত ঘোষ ।
বালিতে ছিটকে পড়ে-যাওয়া মোবাইলে বড়জেঠির কান্না-মেশানো কন্ঠস্বর আতঙ্কিত আর্তনাদে বলে চলেছে, গুলির আওয়াজ কেন...কী হচ্ছে ওখানে...সাড়া দিচ্ছিস না কেন...সুশান্ত..শুনতে পাচ্ছিস...গুলিগোলা চলছে কেন...কথা বলছিস না কেন...ঠিক আছিস তো...তোর ছেলে কোথায়...সুশান্ত...সুশান্ত...বলছি তো অপুকে পাঠিয়ে দে...তোর বউকে নিয়ে চলে আয়...সুশান্ত...সুশান্ত…
মোবাইলটা উচ্চকন্ঠে কাঁদা আরম্ভ করল উড়ন্ত বালির সদালাপী হাওয়ায়, ঝিরি-ঝিরি রঙ্গপ্রিয় বালির অবাক হাসিখুশি দিয়ে হয়তো ক্রমে ঢাকা পড়ে যাবে আজ রাতের অমনোযোগী অন্ধকারে । বর্ষায় দিয়ারার সঙ্গেই হয়তো চলে যাবে জলের তলায় শেষ কান্নার বর্ষীয়ান স্মৃতি নিয়ে, তারপর একদিন চিকচিকে বসন্তে মাথাচাড়া দেয়া নতুন চরের পলিমাটির ওপর বোবা জেগে উঠবে কোথাও, খুরপি দিয়ে কেয়ারি-করা পলতালতা বা তরমুজলতার হলুদ ফুলের আড়ালে ।

No comments:

Post a Comment