Thursday, July 4, 2019

"গুরুচণ্ডালী" সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরীর চিন্তা


গুরুচণ্ডালি : একটি পোস্টমডার্ন বিতর্ক

গুরুচণ্ডালি নামক একটি দোষের কথা আমরা সবাই জানি । ইস্কুলে আজও বহু ছাত্রকে এই দোষের দায়ে পিটুনি খেতে হচ্ছে বা পরীক্ষায় তার নম্বর কেটে যাচ্ছে । বালক বয়সে এই দোষটি নিষিদ্ধ হওয়ায় লেখকরা এই দোষটি এড়িয়ে যাওয়াই কাম্য মনে করেছেন, কেননা এই দোষে বর্ণসংকর জন্মায় । নিষেধ ছিল সাধু ভাষার সঙ্গে চলিত ভাষার মিশ্রণ, ইতর শব্দের সঙ্গে তৎসম শব্দের সন্ধি, সংস্কৃতের সঙ্গে দেশজ অভিব্যক্তির মিলন, শিষ্ট অভিখ্যার সঙ্গে আঞ্চলিক অভিখ্যার সঙ্গম । অলংকারশাস্ত্র অনুযায়ী এটি পতৎ প্রকর্ষতা দোষ । এদিকে আবার  অলংকারশাস্ত্রে কবিতাকে কল্পনা করা হয়েছিল পুরুষরূপে, এবং তার গুণের বদলে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল তার অঙ্গভূষণে । আদিতে কিন্তু যে বাক্যে অনুপ্রাসের পতন বা রচনার শিথিলতা প্রকাশ হতো তাকেই বলা হতো প্রতৎ প্রকর্ষতা দোষ ল সংস্কৃত ভাবসাহিত্যের এই দোষ যে কীভাবে বাংলা ভাষায় উত্তমাধম মিলন বা অসংগত-সংযোগ হয়ে গুরুচণ্ডালিরূপে উদ্ভূত হল, তা উপরিতলে ভাষাসমস্যা মনে হলেও, আসলে তা সময়-বিশেষটির সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতিফলন । বাংলা সাহিত্যে গুরুচণ্ডালি শব্দটা ঠিক তখন দেখা দিয়েছিল তা আমি জানি না, কিন্তু তখন থেকে এই নিষেধটি আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে । ভাষাকে বঞ্চিত করেছে নবতর বাক্যগঠন প্রণালী, নতুন আনকোরা অভিব্যক্তি থেকে, সমৃদ্ধি থেকে ।
আশ্চর্য এই যে, বাংলা ভাষায় পৌঁছে কবিতা আর পুরুষ রইল না । কবে থেকে যে তার যৌন পরিবর্তন ঘটেছে তা গবেষকদের উচিত খতিয়ে দেখা । সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রে কবিতা নামক পুরুষটির দেহ হল শব্দার্থ, রীতি তার হাত-পা, অবয়ব, ধ্বনি তার জীবন, রস তার আত্মা, উপমা রূপক ইত্যাদি তার অলংকার । শ্রুতিকটুতা, অর্থকলইষ্টতা, গ্রাম্যতা, বিরুদ্ধ রসবিভাব পরিগ্রহাদি দোষ না থাকলে সেই কাব্য নির্দোষ এবং পরমসুন্দর পুরুষ বলে বিবেচিত হবে । তত্ত্বটা মেট্রপলিটান, সে সময়কার শহরের, কেননা গরিব ও গ্রাম্যের অলংকার থাকার সম্ভাবনা নেই । লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের ধাক্কায় বাংলা ডিসকোর্স চলে গিয়েছিল উঁচু জাতের বনেদি ঘরের ছেলেদের হাতে, এবং তা কেড়ে নেয়া হয়েছিল তদানীন্তন চণ্ডালদের হাত থেকে ।  কেননা নিতাই বৈরাগি, নীলমণি পাটনি, বলরাম বৈষ্ণব, রামসুন্দর স্যাকরা, ভোলা ময়রা, জগন্নাথ বেনে, কেষ্টা মুচি, জগা কৈবর্ত, ভীমদাস মালাকার, মতি পসারি প্রমুখের ডিসকোর্সকে ধ্বংস করে আবির্ভূত হলেন চট্টোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, দত্ত, সেন, ঠাকুর, মিত্র, বসু, বড়াল প্রমুখ গুরুর দল । বাংলা সাহিত্যের সাবর্ণ ঐতিহাসিকরা তো এককালে কবিওয়ালা ব্যাপারটিকে চণ্ডালসুলভ ঘোষণা করে সাহিত্য থেকে বেমালুম বাদ দিয়েছিলেন ।
যে-পুরুষটির কথা সংস্কৃত সাহিত্য কল্পনা করেছিল, তার সাজগোজের প্রায় সবকিছুই আজ বাংলা ভাষায় তাঁবাদি হয়ে গেলেও, গুরুচণ্ডালি দোষটা কিন্তু তিরিশ বছর বামপন্হী রাজত্বের পরও শিক্ষক-অধ্যাপকদের মাথায় ভুত হয়ে চেপে আছে । পুরুষটির অলংকারের কথা জানতে ইচ্ছে হয় বৈকি : প্রথমে শব্দালংকার :- অনুপ্রাস, যমক, শ্লেষ, বক্রোক্তি, চিত্র, ভাষাসম । তারপর অর্থালংকার :- অতর্দগুণ, অতিশয়োক্তি, অধিক, অধিকারূঢ়, বৈশিষ্ট্যরূপক, অধ্যাবসায়, অনন্বয়োপমা, অনুকূল, অনুমান, অনুমতি, অন্যোন্য, অপহ্নুতি, অপ্রস্তুতপ্রশংসা, অর্থান্তরন্যাস, অর্থাপত্তি, অসংগতি, আক্ষেপ, উৎপ্রেক্ষা, উপময়োপমা, উল্লেখ, একদেশ বিবর্তিন্যুপমা, রূপক, পরিকর, পরিণাম, পরিসংখ্যা, পর্যায়, পর্যায়োক্ত, পুনরুক্তদবাভাস, প্রতিবস্তুপমা, প্রতীপ, বিকল্প, বিনোক্তি, বিভাবনা, বিরোধ, বিশেষ, বিশেষোক্তি, বিষম, ব্যতিরেক, ব্যাঘাত, ভ্রান্তিমান, মীলিত, রসণোপমা, শ্লেষ, সন্দেহ, সম, সমাধি, সমুদয় সহোক্তি, সাঙ্গরূপক, সামান্য, সার, স্মরণ, স্বভাবোক্তি, হেতু ইত্যাদি ।
ভাবা যায় ?
আমরা যারা এখন কবিতা লিখছি, এ সমস্ত জানিও না, আর এসব নিয়ে চিন্তাও করি না । হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্রের সময় পর্যন্ত কিন্তু কবিরা চিন্তা করতেন ; এ-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথও ভেবেছেন । তারপর তিরিশের দশকের কবিতায় পৌঁছে এই অলংকারশাস্ত্রটি নিজেই চলে গেল চণ্ডালের শ্রেণীতে, কেননা ততদিনে ম্যাকলের প্রচেষ্টায় গেড়ে বসেছে ইউরোপের অনুশাসন : সনেট, এলেজি, লিরিক, লিমেরিক, এপিটাফ, সিমিলি, স্টাইল, মেটাফর, ফর্ম, কন্টেন্ট ইত্যাদি-ইত্যাদি । উত্তর-ঔপনিবেশিক কালখন্ডে যে স্মৃতিবিপর্যয় ঘটেছে তাতে আর ঐতিহ্যে ফিরে যাবার সুযোগ নেই বটে, কিন্তু শিষ্টবাদী গুরুর ভাবে, ভাষায়, শব্দে, বাক্যে, অভিব্যক্তিতে, অভিধায়, অভিখ্যায় বর্তমান কালখন্ডে চণ্ডালকে  ঢুকিয়ে দেবার সুযোগ হাতছাড়া করা অনুচিত । আমরা তো দেখছি, বাংলা ভাষায় বহু শব্দের অভাব । কবি ফালগুনী রায় যাকে বলেছিলেন ‘ক্রিয়াপদের কাছে ফিরে আসা’, বাংলা বাক্য সেই নোঙর ছিঁড়ে বেরোতে পারেনি  গুরুবাদী বৈয়াকরণের চোখরাঙানির ভয়ে । সুতরাং ব্যকরণ ভাঙতেই হবে, গুরুচণ্ডালকে মেলাতেই হবে । ব্যকরণ ভাঙাই সাহিত্য । চণ্ডালকে বাদ দিয়ে সহিতত্ব হয় না ।
গুরু আসলে ক্ষমতার কেন্দ্র আর চণ্ডাল হল প্রান্তিক । চণ্ডালের কাজ হওয়া উচিত গুরুকে মসনদ থেকে বিস্হাপিত করা । শাসকের ভাষাকাঠামোকে সতত ফর্দাফাঁই করা দরকার । যেহেতু গুরু ছিল মসনদে আসীন, তার ভাষাকে সর্বজনীন করা স্বাভাবিক ছিল । যেহেতু শাসকশ্রেণি, তাই গুরু ইতিবাচক আর চণ্ডাল নেতিবাচক । চণ্ডাল হল ‘অপর’। যে অপর সে প্রতিপক্ষ । সে অনুকম্পার, সে নিকৃষ্ট, সে সংস্কৃতিহীন, সে ঐতিহ্যহীন । তার বিষয়ে জ্ঞানের দরকার নেই । তার ডিসকোর্স অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য । উত্তরঔপনিবেশিক ভাবুকরা, যেমন এডওয়ার্ড সাঈদ, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, হোমো ভাবা প্রমুখ, ‘অপর’-এর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন যে ‘অপর’ অস্তিত্বটি একটি মৌলিক অহং-এর কাছে অপরিচিত ও বহিঃস্হ, যে সদাসর্বদা ‘অপরকে’ অস্বীকার করে । একদা ইউরোপের ভাবুক ও কবি-লেখকরা, নেটিভদের ‘অপর’ হিসেবে খাড়া করে, নিজেদের উন্নত ও উৎকৃষ্ট প্রমাণের উদ্দেশ্যে, ইউরোপের লোকেদের চিত্রিত করেছিল আত্মসচেতন, শাসন করার উপযুক্ত, ক্ষমতাবান মানুষ হিসেবে । এদেশে গুরুচণ্ডালি দোষ আবিষ্কারকদের মগজে একই খেলা খেলত ।
উত্তরঔপনিবেশিক আলোচকরা উপরোক্ত প্রসঙ্গে জাক লাকাঁর মনঃসমীক্ষণের ভাবনা থেকে সমর্থন আদায় করেছেন । লাকাঁর বক্তব্য হল যে, একজন মানুষ নিজের কাছে নিজের পরিচয় গড়ে তোলে তার সামনের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে । সামনে চাকর থাকলেই তো মনিব হবে মনিব । সামনে নিকৃষ্ট থাকলে মনিব উৎকৃষ্ট । লাকাঁ বলেছেন যে, একজন মানুষের অবচেতনায় থাকা ভাবকাঠামোর সাহায্যে ভাষায় বহিঃপ্রকাশ ঘটে । ঔপনিবেশিক আমলের রচনাবলিতে, ইউরোপিয় সাহিত্যে, নেটিভরা ছিল আসবাব । বাঙলা গল্প-উপন্যাসে আমরা দেখেছি, সমাজ সংস্কার করতে বেরিয়েছে উঁচু জাতের নায়ক । প্রতিটি ডিসকোর্সের কেন্দ্রে থেকেছে গুরুর জাতের লোকেরা, আর চণ্ডাল বা অন্ত্যজরা থেকেছে চাকর বা প্রান্তিক । প্রতিপক্ষ থেকে পক্ষের হিগেমনিতে যাবার জন্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় গণদেবতা-য়  শ্রীহরি পাল পদবি পালটে ঘোষ হয়েছিল, এবং সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোঁড়াই চরিত মানস-এ ঢোঁড়াই হয়েছিল ভকত থেকে দাস । গুরুচণ্ডালি দোষটি, বলাবাহুল্য, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক হিগেমনির কারবার ।
প্রশ্ন ওঠে যে, গুরু ভাবকল্পটাই বা কী আর চণ্ডাল ভাবকল্পটাই বা কী, যে অমন অলঙ্ঘনীয় বাধানিষেধ । জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস বলেছেন, চণ্ডালের অর্থ হল, ‘যে ক্রুদ্ধ হইয়া অনুচিত কর্ম করিতে সমর্থ হয় ; ভীষণ কর্মে উদ্যতকারী ; কঠিনপ্রাণ, নির্দয়, নিষ্ঠুর ।’ ইরেজরা যেমন উপজাতি খুঁজে-খুঁজে চোরডাকাত তকমা দিত, আমাদের ভাষাবিদ আর বৈয়াকরণরা তেমনভাবে চণ্ডালের চরিত্রের সরলীকরণ করে ফেলেছিলেন । অবশ্য শ্রীরামপুরের মিশনারিদেরও তাতে হাত থাকতে পারে । নেটিভদের ভাষা এবং ভাষার মাধ্যমে উপনিবেশবাসীদের মস্তিষ্কে সাম্রাজ্যের মূল্যবোধ চাপানো হয় ১৭৭৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হ্যলহেড সায়েবের দি গ্রামার অব দি বেঙ্গল ল্যাংগোয়েজ, ১৭৯৩ সালে আপ জোন লিখিত ইংরেজি ও বাংলা বোকেবিলরি, ১৭৯৯-১৮০২ সালে দুখণ্ডে ফরস্টারের ভোকাবুলারি, এবং ১৯১৭ সালে মিলার রচিত শিক্ষাগুরু ইত্যাদি গ্রন্হাবলির দ্বারা । বাঙালিরা অভিধান লিখতে বসে, পরবর্তীকালে, এই সমস্ত গ্রন্হ থেকে সূত্র আহরণ করেছিলেন নিশ্চয়ই । অমন যে নির্দয়, নিষ্ঠুর, কঠিনপ্রাণ, ক্রুদ্ধ চাঁড়াল, তার নিজের নামে একটি বাদ্যযন্ত্র ছিল  : চণ্ডালবল্লকী, অর্থাৎ কন্ডোলবীণা ! এই ধরণের সমাজ তার ভাষাকে সমৃদ্ধ করার কথা ভাবে না, এবং ভাষা কেবল মাধ্যম হিসেবে টিকে থাকে । যে-সমাজ উৎপাদন প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দেয়, সেই সমাজ তার ভাষাকেও লাগাতার সৃষ্টি করতে থাকে । ভাষা হল উৎপাদন প্রক্রিয়ার অঙ্গ । চণ্ডাল লোকটা শ্রমিক ।
অধ্যাপক অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে :-
“যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি অনুযায়ী চণ্ডাল হল হিন্দু সমাজের নিম্নতম অস্পৃশ্য জাতি । মনু অনুসারে শূদ্রের ঔরসে ব্রাহ্মণ কন্যার গর্ভে যে জন্মায় সে চণ্ডাল । স্মৃতি অনুযায়ী এদের স্পর্শে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় । ফা-হিয়েন লিখে গেছেন, এরা শহরের বাইরে বাস করত, শহরে আসতে হলে দুটি কাঠি বাজিয়ে সবাইকে সাবধান করে হাঁটত । তন্ত্রে চণ্ডাল বলিদানে ‘মহাসিদ্ধিঃ প্রজায়তে । যোগিনীহৃদয় তন্ত্রে চণ্ডালের শব অতি আবশ্যক ।”
কী ভয়ংকর সামাজিক আচরণ । তার মৃতদেহ চাই, তার শ্রম চাই, অথচ তার ভাষা চাই না । সম্ভবত ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে শূদ্রের দেহসম্পর্ক নিষিদ্ধ করতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের ব্যবস্হাটা চণ্ডালের জন্যে নির্ধারিত করেছিলেন মনু । ভাষার ক্ষেত্রে গুরুচণ্ডালি দোষটা যে কি মারাত্মক ছিল, তা এ-থেকে টের পাওয়া যায় । বাঙালির সমাজে ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে তফসিলি যুবকের বিয়ে আজকাল প্রতিনিয়তই হচ্ছে , কিন্তু ভাষার গুরুচণ্ডালিকে সেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি । প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি শব্দের ও ভাষার বর্ণসংকরকে । প্রাচীন হিন্দু সমাজে নিম্নবর্ণের স্ত্রী গ্রহণ অনুমোদিত ছিল, এবং উচ্চবর্ণের স্ত্রী গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল । তা সত্ত্বেও, ভাষার বৈয়াকরণিক পাঁচিল ভাষাটিকে কুক্ষিগত করার জন্যই । ব্যাসদেব তো নিজেই ছিলেন বর্ণসংকর । ক্ষত্রিয় আর বৈশ্যের ঔরসে ব্রাহ্মণকন্যার সন্তানকে প্রাচীন সমাজে অভিহিত করা হয়েছিল যথাক্রমে সূত ও বৈদেহক রূপে । গুরুর ভাষার সঙ্গে সূতের ও বৈদেহকের ভাষার মিল নিষিদ্ধ ছিল না বলেই মনে হয় ।
এবার গুরু নামক ভাবকল্পটি পরখ করে দেখা যাক । হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এই শব্দটির আঠাশটা মর্মার্থ দিয়েছেন । যে মর্মার্থগুলো মনুর ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক, গুরুচণ্ডালি আলোচনায় সেগুলোই প্রযোজ্যবলে অনুমান করা যায় :- “যিনি গর্ভাধানাদি উপনয়ন পর্যন্ত সংস্কার করিয়া বেদ শিক্ষা দেন, ধর্মোপদেশক, বেদাধ্যাপক, অন্ন দ্বারা প্রতিপালক, মন্ত্রোপদেষ্টা, তান্ত্রিক-মন্ত্রোপদেশক, নিয়ামক, বৃহস্পতি, বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা, পরমেশ্বর, ধনুর্বেদশিক্ষক ইত্যাদি।”
অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ভারতীয় জীবনে প্রাচীনকালে একটি বিশেষ স্হান অধিকার করেছিলেন এঁরা । এমনকী সহজিয়া বৈঢ়্ণব, আউল বাউল, কর্তাভজারাও গুরুকে পরম দেবতা মনে করেন । শিক্ষার জন্য সে সময় শিষ্যকে গুরুগৃহে থাকতে হতো । গুরুর কাছ থেকে ফেরার সময় তাঁর বাসনা অনুযায়ী দিতে হতো দক্ষিণা । উনি বলেছেন যে, তন্ত্র মতে গুরু হবেন শান্ত, দান্ত, সদবঙশীয়, বিনীত, শুদ্ধাচারী, শুদ্ধবেশ, সুবুদ্ধি এবং তন্ত্র-মন্ত্র বিশারদ। যাঁরা গুরু হবার অযোগ্য তাঁরা হলেন রোগি, অধিকাঙ্গ, হীনাঙ্গ, বহুভোক্তা, বহুভাষী, পুত্রহীন ও শঠ । প্রচলিত মতে গুরু দেবতাস্বরূপ বা ইষ্টদেব । গুরু সামনে থাকলে নিত্যপূজা বা অন্য দেবতার পূজা না করে গুরুর পূজা করাই কর্তব্য । লক্ষণীয় যে বহুভাষী হলে তিনি গুরু হবার অযোগ্য ।
গুরুর ডিসকোর্সের বাঁধনহীন ক্ষমতা প্রাগুক্ত ভাবকল্প থেকে বেশ পরিষ্কার, এবং তিনি কেনইবা চাইবেন তাতে  হস্তক্ষেপ করুক নিচু শ্রেণির ভাষা, কেননা ভাষাই তো প্রতিষ্ঠান । ক্ষমতায় অন্তর্ঘাত ঘটাতে হলে ভাষায় ঘটাতে হবে অন্তর্ঘাত । প্রতিষ্ঠানের মালিক, অতএব, বরদাস্ত করবে না গুরুচণ্দালি অন্তর্ঘাত । ওই অন্তর্ঘাত তো স্হিতাবস্হার বিরুদ্ধে প্রান্তিকের দ্রোহ । আন্তোনিও গ্রামশি তাঁর প্রিজন নোটবুকস-এ লিখেছিলেন, সমাজ পরিবর্তনের প্রধম ধাপ হল আইডিয়ার সংঘর্ষ । গুরুচণ্ডালি প্রশ্রয় পেলে শাসকের হিগেমনি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা । হিগেমনি ভাঙতে হলে শিষ্ট ভাষাকাঠামোর অনুপ্রবেশ প্রয়োজন, উত্তমের বিন্যাসে অধমের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন । শাসকের মর্মার্থের দখল নেয়া দরকার । কেননা শাসক চেষ্টা করে শাসিতের ভাষাকে দাবিয়ে দিতে । পার্থ চট্টোপাধ্যায় আর তাপ্তি রায় বলেছেন যে, জেমস লং গ্রামের যাত্রা-অভিনয়কে বলেছিলেন অশোভন, ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর-এ খুঁজে পেয়েছিলেন ইতরতা, পা২চালিগুলোকে তাঁর মনে হয়েছিল লালসা উদ্রেককারী, নোংরা ; বেতাল পঞ্চবিংশতিকে মোটা দাগের । জেমস লং ছিলেন নতুন গুরুশ্রেণির আর নেটিভরা ছিল চণ্ডাল । বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক রামগতি ন্যায়রত্ন অনুমোদন করেননি কালীপ্রসন্ন সিংহের কথ্যভাষা আর প্যারিচাঁদ মিত্রের লেখার ধরন । তাঁর নিষেধ উপেক্ষা করা যে কত প্রয়োজন ছিল তা আজ টের পাওয়া যায় । আর বিলেতের সায়েবদের চাপিয়ে দেয়া নিষেধগুলো যা ক্ষতি করেছে তার তো কোনো লেখাজোখা নেই ।
যাঁর ডিসকোর্সের ক্ষমতা অমন ব্যাপক ও সর্বজনীন ছিল, এবং যাঁর জাল থেকে বেরোবার জন্যে আজও আমাদের সমাজ ছটফট করছে, সেই মনু নামের লোকটির কথা শোনা যাক অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কাছ থেকে । মনু ছিলেন সবসুদ্ধ চোদ্দজন । যিনি মনুসংহিতা লিখেছিলেন, সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে, তিনি স্বায়ম্ভব মনু বা প্রথম মনু নামে খ্যাত । ব্রহ্মার কাছে ধর্মশিক্ষা করে নিজের শিষ্য ভৃগুর মাধ্যমে এই সংহিতা প্রচার করেছিলেন । কেবল ২৬৯৪টি শ্লোক পাওয়া গেছে । ইনি ব্রহ্মার দেহ থেকে জন্মেছিলেন বলে নাম স্বায়ম্ভূব । মনু থেকে মনুষ্য জাতির উৎপত্তি, ফলে নাম মানব । মনুর জন্ম নিয়েও একাধিক গল্প আছে, এবং গল্পগুলির আধিক্য থেকেও স্বায়ম্ভূব মনুর ডিসকোর্সের ক্ষমতার হদিস পাওয়া গেছে । কিন্তু ঠিক কী কারণে তাঁর শ্লোকগুলির নির্বিরোধ ক্ষমতা তা জানা যায় না । তাঁর ক্ষমতার প্রসার জানা যায় তাঁর প্রচারক শিষ্য ভৃগুর গল্প থেকে ।  ব্রহ্মার বীর্য আগুনে পড়লে ভৃগুর জন্ম হয় ।  ইনি ব্রহ্মা এবং শিবকে অপমানের পর সৃষ্টিরক্ষার কাজে অবহেলারত ঘুমন্ত বিষ্ণুর বুকে এমন লাথি মেরেছিলেন যে সেই থেকে বিষ্ণুর বুকে পায়ের ছাপ পড়ে গেছে । এত ক্ষমতাসম্পন্ন শিষ্যের গুরু আরও ক্ষমতাবান ছিলেন নিশ্চই । তাঁর নির্দেশে গুরুরা চাইবেন না যে চণ্ডালের ভাষার ছায়া মাড়াক তাঁদের ভাষা । যে শিক্ষকরা আজকের দিনেও ভাষা্য গুরুচণ্ডালি খুঁত খোঁজেন, তাঁরা মনুসংহিতার বিষবাষ্পে অন্ধ । এদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে ‘মনুবাদের সমাপ্তি’ ঘোষণা হয়ে গেছে, এবং এই ঘোষণাকে সেই ঢঙে পোস্টমডার্ন বলা যায় যে-কায়দায় ফ্রেডরিক জেমিসন বলেছেন যে পোস্টমডার্ন কালখন্ডে পোঁছে শোনা যায় যে, ‘সবকিছু শেষ হয়ে গেল’, যেমন সোভিয়েত দেশ শেষ, বিশ্বযুদ্ধ শেষ, শিল্পসাহিত্য শেষ, কল্যাণকামী রাষ্ট্র শেষ, জ্ঞানতত্ত্ব শেষ, দর্শন শেষ, ইত্যাদি । ভাষাসাহিত্যের ক্ষেত্রে মনুবাদ শেষ হওয়া দরকার ।
শব্দে, অভিব্যক্তিতে, ভাষার গুরু ও চণ্ডালকে মিশ খাওয়াতে পারলে, রোমান ইয়াকবসন যাকে বলেছেন সাইত্যের ডিফ্যামিলিয়ারাইজেশনের কাজ, তা সম্ভব হবে, অভ্যাসের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবে, ভাষার আদরায় ধরে রাখা পৃথিবীর নবীকরণ ঘটাবে , অভিজ্ঞতার ওপর ভাষার দখল দৃঢ়তর হবে, সাহিত্যিক তাঁর কৌশলকে লাগাতার ভাবে নতুন করে তুলতে পারবেন, নতুন প্যারাডাইমের পরিবর্তন ঘটবে, সংস্কৃতির সামাজিক ঐতিহাসিক আর্থিক মাত্রাগুলোর ওপর ভিন্ন আলোকপাত হবে, শব্দের শ্রেণি-বিভেদ কমবে, টেক্সটের প্রসার ঘটবে, বুঝতে পারা যাবে সেই মোচড় যাকে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বলেছেন ‘অপারিয়া’ । অপর শব্দটি থেকে অপারিয়া ।  পোস্টমডার্ন ভাবুকরা প্রয়োগ করেন গ্রিক শব্দ অপোরিয়া, যার আক্ষরিক অর্থ, বলেছেন উনি, যে-ব্যবধানের ওপর সাঁকো বাঁধা যায় না বা অসেতুসম্ভব ব্যবধান ।
কারোর-কারোর হয়তো মনে আছে, ছয়ের দশকের প্রথম দিকে লেখা ‘হাংরি আন্দোলন’-এর একটি ইশতাহারে শব্দের আঁতাত ভেঙে ফেলার কথা বলেছিলুম, যে, বস্তু যদিও থাকে তার প্রাক-শব্দ ও প্রাক-বিশৃঙ্খলা ও অপরূপ অমূর্তাবস্হায়, শব্দের দ্বারা তা দ্যোতিত হয় শব্দ-বিশেষ কর্তৃক অভিষিক্ত হবার পর । গুরু এবং চণ্ডালের মিলনে আমরা পাব সেই সমস্ত সিগনিফায়ার যা দাবিয়ে রাখা হয়েছে স্বায়ম্ভূব মনু’র মৌলবাদী আধিপত্যের দ্বারা, হাজার বছর যাবৎ । সৌরীন ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘ভাষাচ্যুত মানুষ সহজেই কক্ষচ্যুত ।…নিজেকে খুঁজে পেতে গেলে পেতে হবে ভাষারই পথে । নিজেরই ভাষা হারানোর ভাষা আবার আবিষ্কার করে নিতে হবে । এই ভাষার পথই চিন্তার স্বরাজ অর্জনের পথ ।’ বাংলা ভাষার বহু শব্দ, যেহেতু তা প্রয়োগ করতেন অন্ত্যজ শ্রেণি এবং অধিকাংশই ব্যবহৃত হতো কলকাতা-নদীয়া বলয়ের বাইরে, আঞ্চলিকতার তকমা পেয়ে হারিয়ে গেছে ; অথচ আরবি-ফারসি-তুর্কি-ইংরেজির আগন্তুক শব্দ, যেহেতু শাসক অর্থাৎ গুরুর ভাষায়, থেকে গেছে স্হায়ী হয়ে । স্মরণীয় যে,  নতুন গুরুদের আঠারোজন অশ্বারোহী এসে দখল নিয়েছিলেন নদীয়ার আর আঠারোজনের চেয়ে কম শ্বেতাঙ্গ জাহাজে চেপে এসে দখল নিয়েছিলেন তিনটে গ্রামের যা কলকাতায় রূপান্তরিত হয়েছিল ।
ব্যকরণ লেখকরা বাংলা শব্দের যে-উৎসগত শ্রেণিবিভাগ করেছেন, সেখানেও দেখা যাবে আদিগুরু, প্রাক্তনগুরু, গুরু প্রমুখের চাপ । ১. সংস্কৃত অথবা সংস্কৃতজ ; এর আছে তিনটে উপশ্রেণি : ক) তৎসম [ব্যাঘ্র, হস্তী, গুণী, ধর্ম ]; খ) অর্ধ-তৎসম [ভকতি, ধরম, রোদ্দুর, পুজো]; গ) তদ্ভব [চাঁদ, হাত, বউ, রাই, বোন]। ২. দেশি [ডাগর, দরমা, খোকা, পেট, পাঁঠা, মুড়ি ]। ৩. অন্যান্য ভাষা থেকে আগত [আমির, শিকার, শহর, হরফ, শহিদ, বোতাম, অফিস, কলেজ, বাস]। ৪. সংকর বা মিশ্রশব্দ [ভোটদাতা, জজসায়েব, ফুলদানি, অংশীদারি, হেডপণ্ডিত, মাস্টারমশাই ]। সংকর বা মিশ্রশব্দও কিন্তু আদপে গুরুর সঙ্গে গুরুর মিশেল । তা অভিজাতের সঙ্গে অনভিজাতের, ভদ্দরলোকের সঙ্গে ছোটোলোকের, গুরুর সঙ্গে চণ্ডালের মিশেল নয় । আর গুরু এবং চণ্ডালের এই যে ভাষাবিতর্ক, শব্দবিতর্ক, বাচনবিতর্ক, এই দৃশ্যে নারীসমাজের নিজস্ব বাকপ্রণালী একেবারেই বাদ ।
বক্তা নিজে, বক্তার সামনে উপস্হিত শ্রোতা, আর বক্তব্যের পক্ষে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা যেখানে হচ্ছে সেখানে অনুপস্হিত কোনো উক্তি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট, এই তিন ধরনের মানুষকে বলা হয় পুরুষ :- উত্তমপুরুষ, মধ্যমপুরুষ এবং প্রথমপুরুষ । কেন যে তা বলা হয় তা ব্যকরণ লেককরা ভালো বলতে পারবেন । আমার ঠাকুমা যখন আমার মায়ের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ের সম্পর্কে কথা বললেন, তখন আমি টের পেলুম যে আমার ঠাকুমা একজন উত্তমপুরুষ, আমার মা হলেন মধ্যমপুরুষ এবং আমার মেয়ে প্রথমপুরুষ । পাণিনির তুলনায় ব্যকরণে মনুর প্রভাবটাই বোধহয় বেশি, যদিও পাণিনীয় অষ্টাধ্যয়ী-তে লিঙ্গানুশাসন বলে একটা অধ্যায় আছে । ভর্তৃহরি তাঁর বাক্যপদীয় গ্রন্হে, আনন্দবর্ধন তাঁর ধ্বন্যালোক গ্রন্হে এবং  কুম্ভকাচার্য তাঁর বক্রোক্তিজীবিত গ্রন্হে মনুর অনুশাসনকে অমান্য করেননি, করা সম্ভব ছিল না, কেননা তাঁরা তো গুরু, চণ্ডাল নন ।
পাণিনি ছিলেন বৈয়াকরণ মুনি । ভর্তৃহরি ছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্যের বড়ো ভাই । কিন্তু ভর্তৃহরিকে নিয়ে যে চণ্ডাল-ঘেঁষা মিথ প্রচলিত তা বিস্ময়কর । তা কি তিনি জাক দেরিদার আদিপুরুষ বলে ? যা হোক, মিথটা এরকম:-
“পাটলিপুত্রের পণ্ডিত বিদ্যাসাগর জ্ঞানার্জনের খোঁজে বেরিয়ে যখন ক্লান্ত অবস্হায় জিরোচ্ছেন বটগাছের তলায়, তখন সেই বটগাছনিবাসী ব্রহ্মরাক্ষস তাঁর উদ্দেশ্য জানতে পেরে তাঁকে শাস্ত্রজ্ঞ করে তোলেন, এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ক্লান্তি জয়ের মন্ত্র দেন । শিক্ষা শেষে বন থেকে বেরোবার পর মন্ত্রের ক্ষমতা ফুরিয়ে যেতে তিনি মন্দাকিনী নামে একজন নর্তকীর বাড়ির দোরগোড়ায় পুঁথিপত্তর নিয়ে রাত্তিরটা কাটাতে ঘুমিয়ে পড়েন । নর্তকী তাঁকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে সেবা করেন এবং বিয়ে করতে চান । বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মণ বলে শূদ্রানী মন্দকিনীকে বিয়ে করতে অস্বীকার করলে রাজার কাছে বিহিত চাওয়া হয় । রাজা ব্রাহ্মণের পাণ্ডিত্যে অভিভূত হন । যেহেতু উচ্চবর্ণের কাউকে বিয়ে না করে নিম্নবর্ণের মেয়েকে বিয়ে করা চলে না, রাজা তাই রাজকন্যা ( ক্ষত্রিয়া ), মন্ত্রীকন্যা ( ব্রাহ্মণী ), কুলপতিকন্যা (বৈশ্যা) ও মন্দাকিনী ( শূদ্রা ) চারজনের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বিয়ে দেন । চার স্ত্রীর চারটি ছেলে হয় । ব্রাহ্মণকন্যা মালতীর ছেলে বররুচি, ক্ষত্রিয়কন্যা কলাবতীর ছেলে বিক্রমাদিত্য, বৈশ্যাকন্যা সুমঙ্গকলীর ছেলে ভট্টি এবং শুদ্রকন্যার ছেলে ভর্তৃহরি ।”
মিথটির মাধ্যমে তদানীন্তন হাংরি আন্দোলনকারী  ভর্তৃহরির এই শাস্তিই বরাদ্দ করে থাকবেন বৈয়াকরণ-আলংকারিকরা । এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বিক্রমাদিত্যের নবরত্নের অন্যতম বররুচি ছিলেন পাণিনির সূত্রবার্তিককার প্রাকৃত-ব্যকরণ রচয়িতা, অর্থাৎ এসট্যাবলিশমেন্টের লোক । ভরতমল্লিকের মতে ভর্তৃহরি ও ভট্টি একই লোক । কিন্তু মিথে তাঁরা পৃথক । ভট্টি ছিলেন কবি, মহাবৈয়াকরণ, অর্থাৎ সাধুরও ওপরে । কিংবদন্তিটিতে বণিক সম্প্রদায় স্বাভাবিক কারণেই প্রতিষ্ঠা দাবি করেছেন মহাবৈয়াকরণের মাধ্যমে ।
বাংলায় সাধু ভাষার উৎপত্তি কোনো বাণিজ্য এবং শিক্ষা কেন্দ্রকে ঘিরে হয়ে থাকবে । যে ধরনের বাংলা ভাষায় প্রাচীনকাল থেকে সাহিত্য রচিত হয়েছে, বিশেষত গদ্যসাহিত্য, সেই ভাষারীতিকে বলা হয়েছে সাধুভাষা । কথ্যভাষার ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে যে পরিবর্তন ঘটে, সাধুভাষায় তা ছিল না । চাটগাঁ আর মেদিনীপুরের বাঙালি একইরকম সাধুভাষা লিখতেন । যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যারত্ন অনুদিত মনুসংহিতা অনুযায়ী সাধুর অর্থ সৎ, শিষ্ট, অদ্রোহী, সজ্জন । মনুর চাপ থেকে বেরোতে না পারায় এখনকার চলিতভাষাকে বলা হয়েছে শিষ্টভাষা, এবং এই শিষ্টভাষায় যাঁরা আঘাত হানবেন তাঁরা দ্রোহী, অসংস্কৃত । পাণিনি যদিও অবৈদিক সংস্কৃত ভাষার বৈয়াকরণ ছিলেন, বেদবিরোধী এবং মনুবিরোধী ছিলেন না । বৌদ্ধ-সংস্কৃত বহু ক্ষেত্রে পাণিনিকে মানেনি । বুদ্ধদেব পালি ভাষায় উপদেশ দিতেন, যা বোধহয় তাঁর আগে শিষ্টত্ব পায়নি । মানে, তা ছিল চণ্ডালদের ভাষা । গুরুর নয় ।
শব্দার্থের অপকঢ়ফ আর উপকর্ষ থেকে মনে হয় গুরু এবং চণ্ডাল উভয়শ্রেণি নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র শব্দের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন । মহাজন শব্দের মূল অর্থ ছিল মহৎব্যক্তি । কালক্রমে চণ্ডালরা তাকে সুদখোর আর বন্ধকের কারবারি বলে চিনেছে । ইতর শব্দের মূল অর্থ ছিল ভিন্ন বা অপর । মহাজনরা চণ্ডালদের ইতরশ্রেণি চিহ্ণিত করে, তার মানে করে দিয়েছে নীচ, অধম, খারাপ । গুরু শ্রেণির লোকেদের ধারনা তাদের সম্পর্কে সমভাবে ভ্রান্ত বা সম্যকরূপে ভ্রান্ত হওয়ায় হওয়ায় ‘অপরের’ কাছে তারা সম্ভ্রান্ত, এবং মহাজনরা বাধ্য হয়েছে সম্ভ্রান্ত শব্দের অন্তর্গত মূল্যবোধ পালটাতে । সাধু বা শিষ্টবর্গের পাল্লায় পড়ে গৌরচন্দ্রিকা শব্দটির তুমুল রদবদল ঘটেছে, অথচ তার মূল অর্থ ছিল কীর্তনের চৈতন্যলীলা বিষয়ক গান । বাউল শব্দের মূল অর্থ ছিল বাতুল বা পাগল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে তা অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক গুরুত্ব পেয়েছে । গুরুচণ্ডালি নিষেধনামা জারি হলেও, ভাষার মধ্যেই চলতে থাকে ভয়ংকর সংগ্রাম, শ্রেণির, বর্গের, সম্প্রদায়ের, গোষ্ঠীর, এবং তা লাগাতার, অবিরাম । এই সংগ্রামে সাহিত্যিককে নির্ণয় নিতে হয় তিনি অচলায়তনের পক্ষে থাকবেন, না মুক্তধারার পক্ষে ।

No comments:

Post a Comment