Thursday, July 4, 2019

লা ফাঁফারলো : শার্ল বদল্যার-এর উপন্যাস । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী


লা ফাঁফারলো : শার্ল বদল্যার-এর উপন্যাস । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

+-+99850696_140
স্যামুয়েল ক্র্যামার, যিনি প্রথম দিকে ম্যানুয়েলা দে মঁতেভেরদে বেনামে কয়েকটা রোমান্টিক বোকামি সই করেছিলেন — রোমান্টিসিজমের সোনালি দিনগুলোয় — তিনি ফ্যাকাশে এক জার্মান বাবা এবং ময়লা এক চিলে মায়ের পরস্পরবিরোধী ফসল । এই দ্বৈত শুরুর সঙ্গে যোগ করুন ফরাসি শিক্ষা আর সাহিত্যিক প্রেক্ষাপট, আর আপনি অবাক হবেন — কিংবা, হয়তো, পরিতুষ্ট ও মানসিকভাবে তৃপ্ত — তাঁর চরিত্রের অদ্ভুত জটিলতার কথা শুনে । স্যামুয়েলের আছে  বিশুদ্ধ, ভ্রূকোঁচকানো, কালোকফির ফোঁটার মতন চকচকে দুই চোখ, উদ্ধত ও অবজ্ঞাছাপ নাক, বেহায়া কামুক ঠোঁট, চৌকো স্বৈরাচারী থুতনি, আর রাফায়েলকে নকল-করা মাথাভর্তি চুল । — লোকটা একইসঙ্গে ভীষণ অলস, করুণা-জাগানো উচ্চাকাঙ্খী, এবং খ্যাতি-পাওয়া অভাগা ; কেননা সারাজীবনে উনি আধখ্যাঁচড়া ধ্যানধারণা ছাড়া আর কিছুই বড়ো একটা ভাবতে পারেননি । কুঁড়েমির যে সূর্য ওনার চারিপাশে চোপোরদিন রোদ ছড়ায় তা ওনাকে ক্ষইয়ে দিয়েছিল, আর খেয়ে ফেলেছিল ওনাকে দেয়া স্বর্গের যৎসামান্য প্রতিভার খোরাক । প্যারিসের এই ভয়ঙ্কর জীবনে আমি যে সমস্ত আদ্দেক-বিশাল মানুষদের দেখেছি, স্যামুয়েল সেইসব জমঘটিয়া  চালু চিজের চেয়ে বেশি-কিছু ছিলেন — দুনিয়ার বাইরে একজন , খেয়ালি জীব, যাঁর কবিতা ওনার রচনার চেয়ে চেহারায় বেশি খোলতাই হতো, এমনই একজন যিনি, দুপুর একটা নাগাদ, তাপ পোয়াবার কয়লার আগুনের ঝলক আর ঘড়ির টিকটকের মাঝে, সব সময় মনে হতো যেন নপুংসকতার একজন দেবতা — একজন আধুনিক, উভলৈঙ্গিক দেবতা — নপুংসকতায় এমন বিশাল, এমন নিদারুণ যে তাঁকে মনে হতো মহাকাব্যিক !
আমি কেমন করেই বা আপনাকে বোঝাই, এই ছায়া-লোকটাকে স্পষ্ট দেখতে সাহায্য করি, দমকা আলোয় আচমকা ডোরাকাটা — একই সঙ্গে ঢিমেতালে আর উদ্যমী — কঠিন পরিকল্পনায় ফলপ্রসূ আর পরিত্যক্তগুলোয় উপহাসাস্পদ ; একজন লোক যাঁর আপাত-আত্মবিরোধীতা প্রায়ই তাঁর সাদাসিধেভাবকে দখল করে নিতো, আর যাঁর কল্পনা তাঁর একাকীত্ব ও চরম কুঁড়েমির সমান ছিল বিশাল ? স্যামুয়েলের স্বাভাবিক ব্যারামের একটা ছিল তাঁদের সমান মনে করা যাঁদের তিনি শ্রদ্ধা করতেন ; কোনো ভালো বই বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়ার পর, ওনার অনৈচ্ছিক সিদ্ধান্ত হতো, “হ্যাঁ, এটা এতো ভালো যে আমিই লিখে ফেলতে পারতুম !” আর সেখান থেকে নির্ণয়ে পৌঁছোতেন, “সুতরাং এটা আমারই লেখা !” –কেবল একটা হাইফেনের দূরত্ব, এই যা ।
আধুনিক পৃথিবীতে, লোকে যা আঁচ করে তার চেয়ে এই ধরণের চরিত্রের সংখ্যা বেশি ; পথে, জনগণের পার্কে, পায়চারির রাস্তায়, আবাসনগুলোতে, আর কুঁড়েদের স্বর্গে এইরকম জীব গিজগিজ করছে। আর তারা এই ছাঁচের সঙ্গে এমন খাপ খেয়ে গেছে যে বিশ্বাস করে যে তারাই এটা আবিষ্কার করেছে ।
আজকে তাদের সবায়ের দিকে তাকিয়ে দেখুন, খেটেখুটে প্লোটিনাস বা পোরফিরির ( দুজনেই ছিলেন নিও-প্ল্যাটনিক দার্শনিক ) রহস্যময় কাগজে মানে খোঁজার চেষ্টা করছে ; কালকে ওরা নিজেদের  জোলো আর ফরাসি চরিত্র সম্পর্কে অবাক হবে, যে বিষয়ে ছোটো ক্রেবিলঁ ( ইনি ছিলেন ঔপন্যাসিক যাঁর গোলমেলে চরিত্র প্লেটিনাস ও পেরিফিরির সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল ) বেশ ভালোভাবে বর্ণনা করে গেছেন । কালকে ওরা জেরোম কারদানোর ( ইনি ছিলেন ইতালীয় বহুবিদ্যাবিশারদ যিনি গণিত, জ্যোতিষ, ওষধি সম্পর্কে বই লিখেছিলেন কিন্তু যিশু খ্রিস্টের জন্মছক লিখে বিপদে পড়েন )  সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বার্তালাপে ব্যস্ত ছিল । আর এখন স্টার্ন-এর সঙ্গে তারা হাসাহাসি করছে, কিংবা র‌্যাবেলের সঙ্গে খানাপিনা আর বাগাড়ম্বরে হইচই করছে । আর এসবের মাঝে নিজেদের ভোলবদলে তারা এতো সন্তুষ্ট যে ভবিষ্যতে ওই সমস্ত প্রতিভাধরদের ছাপিয়ে গিয়ে কোন দৃষ্টিতে তাদের মাপা হবে তা নিয়ে চিন্তিত নয় । — এক বোকা আর সন্মানজনক ধৃষ্টতা ! আর বেচারা স্যামুয়েল ছিলেন ঠিক তাই । জন্মসূত্রে বিশিষ্ট ভদ্রলোক, সময় কাটাবার ক্ষেত্রে এক ধরণের বজ্জাত  — মেজাজে অভিনেতা — গোপনে নিজের খাতিরে তুলনাহীন ট্র্যাজেডি কিংবা, বলা যায়, ট্র্যাজিকমেডির খেলা খেলতেন । যদি আমোদ-প্রমোদ ওনার পাশ কাটিয়ে যেতো আর ওনাকে কাতুকুতু দিতো, তা উনি অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন, আর আমাদের ভদ্রলোক দিলখোলা হাসিও জোর করে হাসতেন । যদি কোনো স্মৃতি ওনার চোখে জলের ফোঁটা আনতো, উনি আয়নার সামনে গিয়ে নিজের কান্না দেখতেন । যদি কোনো তরুণী নিষ্ঠুর আর কমবয়সী ঈর্ষায় ওনাকে ছুঁচ বা ছুরি দিয়ে খোঁচাতো , স্যামুয়েল নিজের ছুরি বের করে জখমটাকে গর্বের জৌলুশ ঢুকিয়ে গভীর করে নিতেন, কিংবা যখন মনে পড়তো কারোর কাছে ওনার কুড়ি হাজার ফ্রাঁ দেনা রয়েছে, উনি আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতেন, “কি যে এক দুঃখি, শোচনীয় ভাগ্য যে একজন প্রতিভাধরকে লক্ষ-লক্ষ ফ্রাঁ দেনার দায়ে বিরক্ত করা হচ্ছে !”
কিন্তু তা সত্বেও, মনে করবেন না যে উনি সত্যকার অনুভব বোধ করার অযোগ্য ছিলেন, আর আবেগ শুধু ওনার চামড়ার ওপর হালকাভাবে ডানা ঝাপটাতো । উনি নির্দ্বিধায় অচেনা মানুষকে নিজের জামা খুলে দিয়ে দিতে পারতেন, যে মানুষটাকে উনি মুখ দেখে, আর হ্যাণ্ডশেক করার পর, কালকেই নির্ণয় নিয়েছেন যে লোকটা ওনার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের অন্যতম । মন আর আত্মার ক্ষেত্রে উনি জার্মানদের অলস প্রকৃতির  চিন্তাশীলতা প্রদর্শন করতেন ; আবেগের ক্ষেত্রে, ওনার মায়ের তড়বড়ে আর টলমলে আকুলতা দেখা যেতো ; আর জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ওনার ছিল ফরাসি লোকদেখানেপনার সব কয়টা অভ্যাস।
দুশো বছর আগে মৃত কোনো লেখক বা শিল্পীকে নিয়ে বিতর্কে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নিজেকে জখম করে নিতেন । আর এককালে উনি যেমন গভীর ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন, পরের দিকে হয়ে গেলেন গোঁড়া আস্তিক।
যতোজন শিল্পীর কাজে উনি মনোনিবেশ করেছিলেন আর যতো বই পড়েছিলেন তাঁদের সবাই ওনার মধ্যে জড়ো করা আছে, আর তবু, এই মহান কর্মশক্তি সত্বেও, উনি ছিল চিরকেলে মৌলিক । উনি সদাসর্বদা ছিলেন অমায়িক, খেয়ালি, অলস, ভয়ঙ্কর, সন্ন্যাসী, অশিক্ষিত, অপরিচ্ছন্ন, ছিনাল স্যামুয়েল ক্র্যামার, রোমান্টিক ম্যানুয়েলা দে মঁতেভেরদে । একজন বন্ধুর প্রতি উনি যতোটা মোহাচ্ছন্ন হতেন, যতোটা একজন তরুণীর প্রতি, আর কোনো নারীকে ভালোবাসতে হলে কমরেড মনে করে ভালোবাসতেন । যাবতীয় সূক্ষ্ম অনুভূতির যুক্তি যেমন ওনার আয়ত্বে ছিল তেমনই নীচ প্রতারণার বিজ্ঞানও, অথচ তা সত্বেও কোনোটায় উনি সফল হতেন না কারণ যা সম্ভব নয় তাতে উনি বড়ো বেশি বিশ্বাস করতেন । ব্যাপারটা কি অবাক হবার মতো ? — কেননা উনি  যা অসম্ভব তার প্রক্রিয়ার কল্পনায় চব্বিশ ঘণ্টা সময় কাটাতেন ।
স্যামুয়েলের, এক সন্ধ্যায়, বাড়ির বাইরে বেরোবার খেয়াল হলো ; বাতাস বেশ মনের মতন ছিল আর সুগন্ধিত । মাত্রাধিক্যের প্রতি ওনার প্রকৃতিগত রুচির সঙ্গে তাল রেখে, স্বাতন্ত্র্য ও  অপচয়ের রুটিন ছিল সমানভাবে জোরালো আর দীর্ঘ, আর বহুকাল হতে চলল বর্তমানে উনি নিজের ভাড়াকরা-বাসার প্রতি অনুগত থেকেছেন । মায়ের কাছ থেকে পাওয়া আলস্য, দোআঁশলা কুঁড়েমি ওনার শিরার ভেতর দিয়ে চলাচল করার দরুণ ঘরের ওলোটপালোট , ওনার পোশাক-আশাক আর ওনার বড্ডো নোংরা জটপড়া চুল ওনাকে বিরক্ত করে না । নিজেই জামাকাপড় কাচেন, চুল আঁচড়ান, দেখিয়ে দিতে পারেন কেমন করে কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি পোশাকের ভেতরে আবার বসবাস করছেন আর সেই সব মানুষের আত্মবিশ্বাস যাদের জন্য সৌষ্ঠব হল প্রতিদিনকার ব্যাপার তা ওনার রয়েছে ; তারপর উনি জানালা খুললেন । ধুলোপড়া ঘরটাতে ফেটে পড়ল এক গরম, সোনালি দিন । বসন্তকাল হঠাৎ  আগাম হদিশ ছাড়াই কয়েক দিনে এসে পড়ায় স্যামুয়েল অবাক হলেন । উষ্ণ মৃদু বাতাস, মিষ্টি সুবাসে গর্ভবতী, উনি শ্বাসে ভরে নিলেন — আর একটা ঝটকা ওর মাথায় উঠে গেলো, পরমানন্দ আর কামনার উদ্রেক জাগিয়ে, আরেক অংশ বেমালুম চুয়ে পড়ল ওনার হৃদয়ে, পাকস্হলীতে, আর যকৃতে । নির্ণয় নিয়ে, দুটো মোমবাতিকে নেভালেন, যার একটার শিখা সুইডেনবোর্গ-এর ( সুইজারল্যাণ্ডের দার্শনিক ) বই ঘিরে কিছুক্ষণ কাঁপলো, আরেকটা শিখা সেই সব বইয়ের ওপরে কাঁপতে লাগলো যেগুলো পড়া কখনই কাজের নয়, যদি না কারোর সত্যকে জানবার সীমাতিরিক্ত রুচি থাকে ।
ওনার একাকীত্বের ঢিবি থেকে, ফালতু কাগজপত্রে ভারাক্রান্ত, পুরোনো বইয়ের ডাঁই আর ওনার দ্বিবাস্বপ্নে ছয়লাপ, স্যামুয়েল লক্ষ্য করেছেন কোনো এক বিশেষ আদরা আর চেহারা লুক্সেমবুর্গ বাগানের পথে পায়চারি করে, এমন একজনের মতন দেখতে যাঁকে উনি গ্রামে থাকার সময় ভালোবেসেছিলেন — সেই বয়সে যখন একজন ভালোবাসাকে ভালোবাসে ।
যুবতীটির গঠন, বহুদিনের ব্যবহারে যৎসামান্য পূর্ণতাপ্রাপ্ত আর মোটা হয়ে গিয়ে থাকলেও, তখনও একজন শ্রদ্ধেয় নারীর পুরোদস্তুর শোভন মাধুর্য বজায় ছিল ; মহিলাটির চোখের গভীরে এখনও পাওয়া যাচ্ছিল সেই তরুণীর চোখের জলের উচ্ছ্বাস । মহিলাটি আসেন আর ফিরে যান, সব সময়ে এক উপযুক্ত মার্জিত চাকরানির সঙ্গে, যার চাউনি আর ধরনধারন দেখে যদিও মনে হয় সে চাকরানি নয়, সে একজন সঙ্গী । মহিলাটি ফাঁকা জায়গা খোঁজেন, আর বিধবার দুঃখি আদলে বসে থাকেন, অনেক সময়ে বিক্ষিপ্তচিত্ত হাতে একটা বই নিয়ে,  যা উনি কখনও পড়তেন না ।
স্যামুয়েল ওনাকে লিয়ঁর ( বদল্যার বয়ঃসন্ধির সময়ে এই পাড়ায় থাকতেন )  পাড়ায় চিনতেন, তরুণী, সতর্ক, ক্রীড়াময়ী, আর রোগা । মহিলাটিকে খুঁটিয়ে দেখে, আর বলতে গেলে, যাতে চিনতে পারেন, উনি একের পর এক স্মৃতির ছাল ছাড়িয়ে মেয়েটির সম্পর্কে কল্পনায় যা বেঁচে আছে তাকে পুনরুদ্ধার করতে চাইলেন ; নিজের কাছে বর্ণনা করলেন, সবিস্তারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, যৌবনের সম্পূর্ণ উপন্যাস, যা এতোকাল জীবনের অন্যান্য কাজকারবারে আর আবেগের অলিগলিতে হারিয়ে গিয়েছিল ।
সেইদিন সন্ধ্যায়, উনি মহিলাটির সামনে নত হয়ে শুভেচ্ছা জানালেন, কিন্তু যথেষ্ট সতর্ক আর নির্বস্তুক ভঙ্গীতে । যেতে-যেতে, পেছন থেকে সংলাপের এই টুকরোগুলো শুনতে পেলেন :
“মারিয়েত, ওই লোকটা সম্পর্কে তুমি কী ভাবো ?” কিন্তু এই কথাগুলো এমন আনমনা কন্ঠস্বরে বলা হয়েছিল যে সবচেয়ে বিদ্বেষপরায়ণ শ্রোতাও এতে এমন কিছু পাবে না যে মহিলাটিকে ভর্ৎসনা করা যায় ।
“লোকটাকে আমার খুবই ভালো লাগে, ম্যাডাম । ম্যাডাম কি জানেন ওনার নাম স্যামুয়েল ক্র্যামার ?”
এবং বেশ বকুনি দেয়া কন্ঠস্বরে : “কেমন করে তুমি জানলে, মারিয়েত ?”
এই কারণেই, পরের দিন, একটা বেঞ্চে পাওয়া মহিলাটির বই আর রুমাল বেশ যত্ন করে সামলে রাখলেন স্যামুয়েল, যা মহিলাটি হারাননি, কেননা তিনি রুটির টুকরো নিয়ে চড়ুইপাখিদের ঝগড়া কাছ থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, কিংবা হয়তো গুল্মঝোপের ভেতরে যে লতাপাতা তার সম্পর্কে ভাবছিলেন । অনেকসময়ে এরকম হয় যে দুটি আত্মার মাঝে কথাবার্তা শুরু হতে পারে,  ভাগ্য যাদের একই স্তরে তুলে এনেছে, যদিও মহিলাটির শোনার ও জবাব দেবার ইচ্ছেতে স্যামুয়েল আদ্ভুত আনন্দে আলোড়িত হলেন ।
“আমার কি সেই সৌভাগ্য আছে, ম্যাডাম, যে আপনার স্মৃতির এক কোনায় আমি এখনও আছি ? কিংবা আমি এতোই বদলে গেছি যে আপনি আমার মধ্যে শৈশবের সেই বন্ধুকে চিনতে পারছেন না যার সঙ্গে আপনি চোর-পুলিশ আর স্কুল-পালানোর খেলা খেলতেন ?”
“একজন মহিলা,” মহিলাটি অর্ধেক হাসি মাখিয়ে বললেন, “লোকজনকে চেনার অধিকারকে অতো তাড়াতাড়ি উপভোগ করে না ; তাই আপনাকে ধন্যবাদ, মসিয়ঁ, সেই আনন্দময় আর সুন্দর স্মৃতিগুলোকে জাগিয়ে তোলার সূত্রপাত ঘটানোর জন্য । তাছাড়া…প্রতি বছরের জীবনযাপনে কতো ঘটনা ঘটে, কতো ভাবনাচিন্তা উদয় হয়….আর আমার তো মনে হয় অনেক বছর কেটে গেছে তারপর ?”
“অনেক বছর,” স্যামুয়েল বললেন, “যা আমার ক্ষেত্রে কখনও ধীরগতিতে, আবার কখনও তাযাতাড়ি বিদায় নিয়েছে, কিন্তু নিজের মতো করে তারা ছিল নিষ্ঠুর!”
“কিন্তু তাদের কবিতা?” চোখের হাসি বজায় রেখে মহিলা বললেন।
“চিরকাল, ম্যাডাম !” স্যামুয়েল জবাবে বললেন, হাসতে হাসতে । “কিন্তু আপনি কি পড়ছেন?”
“ওয়ালটার স্কটের ( বদল্যারের আগের প্রজন্মে ওয়ালটার স্কটের ঐতিহাসিক উপন্যাস ফ্রান্সে জনপ্রিয় ছিল ) একটা উপন্যাস ।”
“এবার আমি মাঝে-মাঝে আপনার ধারাবাহিকতা ভাঙার কারণ বুঝতে পারছি ! ওহ, বড়োই একঘেয়ে লেখক !  কবর খুঁড়ে ধুলো বের করার ধারাবিবরণীকার ! প্রাচীন ব্যাপারের টুকিটাকি বর্ণনার খুঁতখুঁতে মাল, যতো রকমের পুরোনো আর বাতিল জিনিশ হতে পারে তার ডাঁই — অস্ত্রশস্ত্র, টেবিলের ওপরের বাসনকোসন, আসবাবপত্র, গথিক সরাইখানা, আর রোমাঞ্চকর দুর্গ, যেখানে প্রাণহীন ম্যানেকিনরা আঁটোসাঁটো পোশাক আর জমকালো কোট পরে ঘুরে বেড়ায়— একঘেয়েমিতে ক্লান্ত আঠারো বছরের কুম্ভীলকও দশ বছর পরে আবার ছুঁয়ে দেখার কথা স্বপ্নেও ভাববে না ; ঢালহাতে বীরদের অসম্ভব মধ্যযুগীয় সহচর, আর বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রেমিক-প্রেমিকারা— হৃদয়ের সত্য নেই, অনুভবের দর্শন নেই ! আমাদের উচ্চমানের ফরাসি ঔপন্যাসিকদের থেকে কতো আলাদা, যাঁদের রচনায় প্রাকৃতিক বস্তুর বর্ণনাতেও তাঁরা আবেগ আর নৈতিকতা দেখান ! কেই বা পরোয়া করে প্রাসাদের চাকরানি গলাবন্ধ পরে আছে নাকি উদিনোর নকশাকরা পেটিকোট, যতোক্ষণ তার কান্না আর রাষ্ট্রদ্রোহ বিশ্বাসযোগ্য ? কোমরে ছোরা গোঁজা প্রেমিক বেশি আগ্রহ জাগায় নাকি যে ভিজিটিঙ কার্ড রেখে গেছে, আর একজন স্বৈরাচারি লোক কালো কোট পরে কম কাব্যিক ভয় দেখায় নাকি যে চামড়া আর লোহার পোশাক পরে আছে সে ?”
স্যামুয়েল, বুঝতেই পারছেন, সেই শ্রেনির মানুষ যাঁদের বলা হয় “গম্ভীর” — আবেগহীন আর অসহ্য, এমন মানুষ যাদের কাজকর্ম তাদের কথাবার্তাকে নষ্ট করে দেয় ; এমন মানুষ যাদের কাছে প্রতিটি সুযোগ, প্রতিটি পরিচিতি, এমন কি পথের ধারে গাছের তলায় আরম্ভ হওয়া গল্পগুজব, একজন ছেঁড়াজামা লোকের সঙ্গেও, নিজেদের মতামত প্রকাশ করার সুবর্ণ সুযোগ পায়।
ফেরিঅলা, পর্যটক শিল্পোদ্যগী, ফাটকা বাজারের সবজান্তা, আর “গম্ভীর” কবিদের পার্থক্য হল বিজ্ঞাপন আর উপদেশের ; শেষের লোকগুলোর দোষ একেবারে ফালতু ।
মহিলাটি সরলভাবে বললেন, “মসিয়ঁ স্যামুয়েল, আমি কেবল একজন সাধারণ পাঠিকা, মানে একজন হাবাগোবা । তাই আমি সহজেই সবকিছুতে আনন্দ পাই । বরং আপনার কথা আলোচনা করা যাক : আমাকে যদি আপনার কোনো বইয়ের যোগ্য পাঠিকা বলে মনে করেন তাহলে খুবই খুশি হবো ।”
“কিন্তু, ম্যাডাম, কেমন করেই বা তা হবে…?” বড়ো বেশি আত্মম্ভরী কবি অবাক হয়ে উত্তর দিলেন।
“যে লোকটা আমাকে পড়ার বই দেয় সে বলছিল যে সে আপনার নাম কখনও শোনেনি।” মহিলাটি মিষ্টি করে হাসলেন, মন্তব্যের খোঁচাকে নরম করার উদ্দেশে ।
“ম্যাডাম,” স্যামুয়েল নীতিগর্ভ জবাবে বললেন, “উনিশ শতকের সত্যকার জনগণ মহিলাদের দ্বারা সংগঠিত ; কুড়িজন অধ্যাপক আমাকে যে মহত্ব দিতে পারবেন না, আপনার অনুমোদনে আমি তা পাবো ।”
“তাহলে মসিয়ঁ, আমি আপনার দেয়া কথার ওপর নির্ভর করছি । — মারিয়েত, আমার ছাতা আর স্কার্ফ আনো  ; ওঁরা বাড়িতে অপেক্ষা করছেন । আপনি হয়তো জানেন আমার স্বামী তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরেন ।”
মহিলাটি সংক্ষিপ্ত মাধুর্যে প্রণত হলেন, তাতে কোনোরকম আপস-প্রবণতা দেখা গেল না, যদিও সে আচরণ ছিল যথোচিত সন্মানপূর্ণ ।
স্যামুয়েল অবাক হলেন না যে পুরোনো প্রেমিকা এখন দাম্পত্য বাঁধনের নিয়মে আটক । ভাবপ্রবণতার বিশ্বজনীন ইতিহাসে, এই ধরনের ব্যাপার জরুরি । মহিলাটির নাম এখন ম্যাডাম দে কোসমেলি, এবং ফাবোর্গ সঁ-জারমেইনের উঁচুদরের অভিজাত পাড়ায় তিনি থাকেন ।
পরের দিন, স্যামুয়েল মহিলাটিকে দেখতে পেলেন, ফুলগাছের চারাগুলোকে মধুর ভঙ্গীতে এবং প্রায় দুঃখি চেহারায় ঝুঁকে পরখ করছেন, আর নিজের ‘ওসপ্রেজ’ কাব্যগ্রন্হটি তাঁর দিকে এগিয়ে দিলেন, তা এমনই এক সনেট সংকলন যা আমরা সবাই লিখেছি আর পড়েছি, যে বয়সে আমাদের ধ্যানধারণা ছিল ছোট্ট আর মাথার চুল লম্বা ।
স্যামুয়েল জানতে আগ্রহী ছিলেন যে ওই ‘ওসপ্রেজগুলো’ দুঃখি সুন্দরীর আত্মাকে নাড়া দিয়েছে কিনা, আর এই সমস্ত বজ্জাত পাখিদের চেঁচামেচি তাঁর পক্ষে ওকালতি করেছিল কিনা ; কিন্তু কয়েক দিন পরে মহিলাটি তাঁকে রূঢ় সারল্য এবং সততায় বললেন : “মসিয়ঁ, আমি একজন নারীমাত্র, এবং তার দরুন আমার মতামতের গুরুত্ব যৎসামান্য ; কিন্তু মনে হয় লেখকদের দুঃখদুর্দশা আর প্রেমের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দুঃখদুর্দশা আর প্রেমের মিল নেই । নিঃসন্দেহে, আপনি বেশ সুরুচিপূর্ণ প্রণয় নিয়ে লেখেন, যা নারীদের মনে হবে নিখুঁত চমৎকারিত্বপূর্ণ, এমনই চমৎকারীত্বপূর্ণ যে তাকে হয়তো ভয় পাওয়া উচিত । মায়েদের সৌন্দর্যের গান আপনি যে শৈলীতে গেয়েছেন তার ফলে আপনি তাদের মেয়েদের অনুমোদন থেকে বঞ্চিত হবেন । আপনি বলেছেন যে ম্যাডাম অমুকের সঙ্গে আপনি প্রেমে পাগল, যিনি কিনা, তাঁর সন্মান বজায় রাখার জন্যই বলছি,  নিজের ছেলেমেয়ের মোজা আর দস্তানা রিপু করার তুলনায় আপনার বই পড়ায় কম সময় দেন। কিন্তু, এর ঠিক উলটো, এবং কোনো রহস্যময় কারণে, আমি বুঝে উঠতে পারছি না, আপনি আপনার আধ্যাত্মিক ধুপধুনো বজায় রাখেন অদ্ভুত প্রাণীদের জন্য, যারা সেই মহিলাদের চেয়েও কম পড়েন, আর আপনি প্ল্যাটনিক আহ্লাদে সেইসব অন্ধকার জগতের সুলতানাদের জন্য, যাদের উচিত ছিল, আমার মনে হয়, একজন কবির সংবেদী দৃষ্টির সামনে পড়ে গেলে, জঙ্গলে আগুনলাগার পর গরুরা যেমন জেগে উঠে চোখ মেলে দ্যাখে, তার চেয়ে বড়ো বড়ো চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকানো । আর তারপর আমি বুঝতে পারছি না কেন আপনি শবযাত্রার বিষয় এবং অঙ্গের গঠনতন্ত্রসংক্রান্ত বর্ণনায় দুর্বলতা দেখান । যখন কারোর বয়স কম আর তার রয়েছে, যেমন আপনার আছে, প্রকৃত কর্মগুণ এবং খুশি থাকার জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় আয়োজন, আমার মনে হয় খুবই স্বাভাবিক হতো যদি আপনি আপনার মেধাকে অভিশাপে প্রয়োগ না করে আর ‘ওসপ্রেজ’-এর সঙ্গে কথা না বলে, স্বাস্হ্যের উৎসবপালন করতেন, আর মার্জিত ভদ্রলোকের আনন্দে থাকার কথা বলতেন ।”
আর কেমন করেই বা স্যামুয়েল ক্র্যামার তার প্রতিক্রিয়া জানালেন ? “ম্যাডাম, অনুগ্রহ করুন, বা আমাদের অনুগ্রহ করুন, কেননা আমার মতো অনেক বেরাদর আছেন ; সবকিছুর প্রতি এবং নিজের সম্পর্কে ঘৃণা আমাদের এই পর্যায়ে এনেছে । তার কারণ আমরা সহজাত প্রক্রিয়ায় সম্ভ্রান্ত এবং সুন্দর হয়ে ওঠার জন্য যে হতাশায় ভুগি, আমাদের মুখে অদ্ভুত প্রলেপ মাখিয়ে রাখতে হয় । আমরা  হৃদয়চর্চার জন্য নিজেদের প্রতি যে অধ্যাবসায় খরচ করেছি, তাদের কুৎসিত বাড়বৃদ্ধি ও আঁচিলকে অনুবীক্ষণের তলায় ফেলে যাচাই করতে হয়, যেগুলোকে আমরা নিজেরাই বাড়তে আর গজাতে দিয়েছি, ফলে অন্য মানুষের মতন কথা বলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে । তারা কেবল বাঁচার জন্যই বেঁচে থাকে, আর আমরা, হায়, আমরা বেঁচে থাকি জানবার জন্য । এখানেই আসল রহস্য । বয়স কেবল কন্ঠস্বরকে বদলায়, আর চুল ও দাঁতকে ধ্বংস করে ; আমরা পালটে দিয়েছি স্বাভাবিক বাচনভঙ্গী, আমরা এক এক করে উপড়ে ফেলেছি, শ্রদ্ধেয় মানুষের অন্তরে যে ছলাকলাহীন স্বল্পভাষিতার শূকরলোমের চাদর থাকে, তাকে । আমরা সেই উন্মাদ মানুষদের মতন মনের ভেতরে ঢুকে গেছি, যারা তাকে বোঝবার চেষ্টায় পাগলামিকে বাড়িয়ে তোলে। বছরগুলো কেবল রক্তমাংসের দেহকে দুর্বল করে, কিন্তু আমরা অনুভবের আকার বদলে দিয়েছি। অভিশাপগ্রস্ত, রুগ্ন বাবারা যাঁরা আমাদের প্যাংলা ডিগডিগে পেঁচোয়-পাওয়া করে তুলেছেন, আমরা এমনই নিয়তির মার খেয়েছি যে মরাবাচ্চা ছাড়া কিছুই প্রসব করি না!”
“আবার সেই ‘ওসপ্রেজ!” বললেন মহিলা । এদিকে আসুন তো, আপনার বাহুটা আমায় ধরতে দিন, আর বসন্তঋতু বেচারা এই ফুলগুলোকে কেমন হাসিখুশি রেখেছে, তাদের সমাদর করা যাক!”
ফুলগুলোক প্রশংসা করার বদলে, স্যামুয়েল ক্র্যামার, যাঁর মনের মধ্যে প্রবাদ আর বাক্য উপচে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল, কয়েকটা বাজে পংক্তি, যা  সুষ্ঠুভাবে লিখেছিলেন, তাদের গদ্যের মতন গুছিয়ে, অস্বীকার করা আরম্ভ করলেন । মহিলাটি স্যামুয়েলকে অবিরাম বকবক করতে দিলেন ।
“কতোই না পরিবর্তন — আর স্মৃতি ছাড়া একই মানুষের কতোটুকুই বা অবশিষ্ট থাকে! কিন্তু কেবলমাত্র স্মৃতি নতুন ব্যথা নিয়ে আসে । সেইসব সুন্দর দিনগুলো, যখন এক সকাল নিজের সঙ্গে আমাদের হাঁটুর ব্যথা আনতো না, স্বপ্নের ভারে মন্হর কিংবা অনমনীয়, যখন প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আমাদের স্পষ্ট চোখে হাসি ফুটতো, যখন আমরা যুক্তি দিতুম না বরং স্রেফ বেঁচে থাকতুম আর হুল্লোড় করতুম ; যখন আমাদের দীর্ঘশ্বাস মৃদু, নিঃশব্দে আর গর্বহীনভাবে ছড়িয়ে পড়তো, তাদের কথা মনে করুন ! কতোবার যে আমি দেখেছি, আমার কল্পনায়, হেমন্তের সেই সব সুন্দর সন্ধ্যায়, যখন তরুণ হৃদয়গুলো নতুন গাছের মতন একইভাবে আচমকা বেড়ে ওঠে, প্রেমের বিদ্যুতে আক্রান্ত হয়ে ওপর দিকে গজিয়ে উঠতে থাকে । তখন আমি দেখি, আমি অনুভব করি, আমি শুনি ; বড়ো প্রজাপতিগুলোকে চাঁদ জাগিয়ে দেয় ; উষ্ণ বাতাস রাতের ফুলগুলোর পাপড়ি খুলে দেয় ; ঝর্ণায় জলেরা ঘুমিয়ে থাকে । আপোনার হৃদয়ে শুনতে পাবেন, দ্রুত, আচমকা রহস্যময় পিয়ানোর নৃত্যসঙ্গীত । জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে ঝড়ের আনা সুগন্ধ ; ভিজে বাতাসে ভীত না হয়ে, এই সময়ে বাগান সেজে ওঠে লাল এবং শাদা পোশাকে । স্কার্টের ঝুলে অনুগত ঝোপগুলো কাঁটা আটকে দেয় ; এক ধরণের ঘুর্ণিবাতাসে বাদামি চুল স্বর্ণাভ চূর্ণকুন্তল মেলামেশা করে ! — আপনার কি এখনও মনে আছে ম্যাডাম, বিশাল খড়ের গাদা, কতো সহজে পিছলে যেতো, বুড়ি নার্সের ধিমেতাল কাজ, আর আপনার কাকিমার নেকনজরে যে ঘড়ি বিরাট খাবার ঘরে সবাইকে তড়িঘড়ি ডেকে আনতো ?”
ম্যাডাম দে কোসমেলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যামুয়েলকে নিরস্ত করলেন, এবং মুখ খোলার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন, বলাবাহুল্য লোকটাকে থামার অনুরোধ করার জন্য, কিন্তু উনি আবার বকবক আরম্ভ করে দিয়েছিলেন ।
“সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হল,” স্যামুয়েল বললেন, প্রতিটি প্রেমের অসুখি অবসান ঘটে, আর যতো দৈবভাবে ডানার উড়াল আরম্ভ হয় তার তুলনায় আরও অসুখি অবসান ঘটে । যতোই আদর্শমূলক হোক না কেন, কোনো স্বপ্ন নেই, যা স্তন আঁকড়ে থাকা লোভী বাচ্চায় শেষ হয় না ; লুকোবার জায়গা থাকে না, অমন স্বাদু আর অস্পষ্টতার জন্য কোনো আশ্রয় থাকে না, যেখান থেকে টেনে এনে কুঠার আক্রমণ করবে না । এটা তো কেবল বস্তুগত ধ্বংস ; আরেকরকম আছে, আরও মমতাহীন আর গোপন, যা অদৃশ্য ব্যাপারগুলোকে আক্রমণ করে । ভেবে দেখুন, যাকে আপনি বেছে নিয়েছেন তার ওপর ঘেঁষে হেলান দেবার মুহূর্তে, আর যখন আপনি তাঁকে বলেন, ‘চলো দুজনে উড়ে চলে যাই, আর আকাশের গভীরতার সন্ধান করি’— এক অপ্রশম্য , গম্ভীর কন্ঠস্বর আপনার কানের কাছে ঝুঁকে বলে দেবে যে আমাদের আবেগ মিথ্যুকের, সুন্দর মুখশ্রী আমাদের দৃষ্টিক্ষীণতার সৃষ্টি, আর সুন্দর আত্মাগুলো আমাদের অজ্ঞানতার উৎপাদন, আর এমন একদিন নিশ্চয়ই আসবে যখন সেই প্রতিমা, যাকে এখন সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তা আদপে কেবল ঘৃণারই নয়, বরং অবজ্ঞা ও অভিঘাতের বিষয়বস্তু মনে হবে !”
“আর বলবেন না, মসিয়ঁ,” বললেন ম্যাডাম দে  কোসমেলি ।
মহিলাটি নিঃসন্দেহে প্রভাবিত হয়েছিলেন ; স্যামুয়েল টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর ছুরি পুরোনো আঘাতকে খুঁচিয়েছে, আর উনি বকবক চালিয়ে গেলেন, নির্দয়ভাবে ।
“ম্যাডাম,” উনি বললেন, স্মৃতির আঁটোসাঁটো দুর্দশায় মাধুর্য থাকে, আর দুঃখের মাদকতায় কেউ কেউ আরাম খুঁজে পান ।— এই বিষণ্ণ হুঁশিয়ারিতে, অনুগত আত্মাগুলো চিৎকার করে উঠবে : ‘হে ভগবান, আমার স্বপ্ন অক্ষত ও বিশুদ্ধ থাকতে আমাকে এই জায়গা থেকে তুলে নিন ; আমি আমার আবেগকে তার পুরো সরলতা-মাখিয়ে জগতসংসারকে দিয়ে যেতে চাই, আর আমার মাথার মুকুটের ফুলগুলোকে তাজা রাখতে চাই।’ কিন্তু মোহমুক্তির ফলাফল ভয়ঙ্কর । মৃত প্রেম থেকে জন্ম নেয়  লাম্পট্য এবং কুৎসিত নপুংসকতা : আত্মার লাম্পট্য ও হৃদয়ের নপুংসকতা, যার একটি কৌতূহলে নির্ভর করে বাঁচে, এবং অন্যটি অবসাদে । আমরা সবাই কম-বেশি পর্যটকদের মতন যারা বহু দেশ ঘুরে বেড়িয়েছে ; তারা সূর্যকে দ্যাখে, যা একসময় তাদের চলার রাস্তায় সুন্দরভাবে সৌষ্ঠবের সোনালি রোদ বিছিয়ে দিয়েছিল, এখন সমতল দিগন্তে ডুবে গেছে । তারা অজানা জঞ্জালে ভরা নোংরা পাহাড়ের ওপর বসে, হাল ছেড়ে দিয়ে, আর বনগোলাপের ঝাড় থেকে ওঠা সুগন্ধকে বলে যে ফাঁকা আকাশে তারা অযথা উড়ে যাচ্ছে; কয়েকটা দুর্দশাগ্রস্ত বীজকে বলে, তারা এই শুকনো জমিতে ব্যর্থ অঙ্কুরিত হচ্ছে ; পাখিদের বলে, যে পাখিরা মনে করে তাদের বিবাহ কারোর আশীর্বাদপূত, তারা শীত ও ভয়ানক বাতাসে চাবকানো দেশে নীড় তৈরি করে ভুল করছে । তারা মরুভূমির পথে আবার চলা আরম্ভ করে, যা তারা জানে যে এইমাত্র যে পথ পেরিয়েছে ঠিক তার মতোই, যুক্তি নামের ফ্যাকাশে মায়াপুরুষ রক্ষীর সঙ্গে, যে তার উষর চলার পথে নিভু লন্ঠনের আলো দেখায়, আর যে, থেকে-থেকে যখন আবেগের তৃষ্ণা ফিরে আসে, মানসিক ক্লান্তি দিয়ে তেষ্টা মেটায়।”
হঠাৎ স্যামুয়েল শুনতে পেলেন গভীর দীর্ঘশ্বাস আর ফোঁপানির শব্দ,  যা লুকোনো সম্ভব হয়নি, আর উনি ম্যাডাম দে কোসমেলির দিকে ফিরে চাইলেন ; মহিলাটি শব্দ করে ফোঁপাচ্ছিলেন, আর চোখের জল লুকোবার মতন প্রতিরোধশক্তি ওনার ছিল না ।
স্যামুয়েল নিঃশব্দে কিছুক্ষণ ওনার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আচরণে নম্রতা, তোষামোদ দেখিয়ে ; নির্দয়, ভণ্ড অভিনেতা মহিলার সুন্দর চোখের জল সম্পর্কে গর্ববোধ করছিলেন, দেখছলেন যেন তা ওনারই সৃষ্টি করা, ওনার সাহিত্যিক সম্পত্তি । এই দুঃখের প্রকৃত মর্মার্থ বুঝতে উনি ভুল করলেন, ঠিক যেমন ম্যাডাম দে কোসমেলি তাঁর প্রতি ওনার চাউনিকে ভুল বুঝলেন । এক মুহূর্তের জন্য ভুল-উপলব্ধির একক খেলা চলল, তারপর স্যামুয়েল ক্র্যামার ওনার হাত নিজের দুই হাতে ধরে রইলেন, যা মহিলাটি বিশ্বাস করে স্যামুয়েলের হাতে ছেড়ে দিলেন ।
“ম্যাডাম,” কিছুক্ষণ নিরবতার পর স্যামিয়েল আরম্ভ করলেন — সেই ধ্রুপদী নিরবতা যা গভীর আবেগের নির্দেশক — “সত্যকার জ্ঞানে আশার তুলনায় অভিশাপ কম থাকে । আশার দৈব উপহার ছাড়া, কেমন করেই বা আমরা মানসিক অবসাদের কুৎসিত মরুভূমি পার হবো যার কথা আমি একটু আগেই বললুম ? যে মায়াপুরুষ আমাদের সঙ্গে থাকে সে যুক্তিবোধের মায়াপুরুষ ; আশার পবিত্র জল ছিটিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়া যায়, তা হলো ধর্মশাস্ত্রের প্রথম অন্তর্নিহিত শক্তি ।
এমন এক মনোরম দার্শনিকতা আছে যা সবচেয়ে বাজে জিনিশ থেকেও আরাম আনতে পারে।
অন্তর্নিহিত শক্তি যেমন পাপশূন্যতার চেয়ে বেশি মূল্যবান, এবং যেমন সুস্হ বাগান থেকে ফল সংগ্রহ করার চেয়ে মরুভূমিতে বীজ বপন করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই সম্পর্কের মাধ্যমে উন্নত আত্মার নিজেকে আর প্রতিবেশীকে বিশুদ্ধ করে তোলা ভালো । আর যেমন ক্ষমার অযোগ্য বিশ্বাসঘাতকতা হয় না, তেমনই এমন কোনো ভুল নেই যা  মাফ করা যায় না, এমন কোনো স্মৃতিভ্রংশ নেই যাকে অতিক্রম করা যায় না ; এ হল প্রতিবেশীকে ভালোবাসা আর তার ভালোবাসা পাওয়ার বিজ্ঞান, আর ভালোভাবে বেঁচে থাকার শিল্প । আত্মা যতো সূক্ষ্ম, ততো তা মৌলিক সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করতে পারে ; আত্মা যতো দরদী, এবং দৈবিক আশার সামনে নিজে খুলে ধরে, ততো সে অন্যের মাঝে খুঁজে পায় প্রেমের উদ্দেশ্য, তা যতোই ময়লা হোক না কেন ; এ হলো পরার্থবাদীতার কাজ, এবং একজনের তুলনায় আরেকজন পর্যটক অনেক বেশি দেখে থাকবে, উষর মরুভূমিতে যন্ত্রণাক্লান্ত আর পথভ্রান্তির ভ্রমে, আবার ফিরে পাবে তার বিশ্বাস  আর ভালোবাসা যা সে হারিয়ে ফেলেছিল, এবার আরও তেজোময়তায় কেননা সে নিজের আর প্রেমিকের আবেগ পরিচালন-প্রণালীর শিক্ষক ।”
ম্যাডাম দে কোসমেলির মুখ একটু  পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল ; তাঁর দুঃখ এখন জলে ভেজা সূর্যের মতন আশায় ঝকমকে, আর স্যামুয়েল তখনও ওনার বক্তৃতা শেষ করেননি, ম্যাডাম  শিশুর উৎসাহী ও সরল ব্যগ্রতায় বললেন ।
“তা কি প্রকৃতই সত্য, মসিয়ঁ,  তা কি সম্ভব, যে প্রকৃতই শাখা-প্রশাখা আছে যা সহজে একজন হতাশ বেপরোয়া মহিলা আঁকড়ে ধরতে পারেন ?”
“নিশ্চয়ই, ম্যাডাম।”
“ওহ, আপনি আমাকে সবচেয়ে সুখি নারী করে তুলবেন যদি আমাকে উপযুক্ত মনে করে আপনার রেসিপি দেন !”
“তা মোটেই সহজ নয়,” নির্দয়ভাবে স্যামুয়েলের জবাব  ।
ভাবপ্রবণতার এই বাড়বাড়ন্তের সূত্রে, প্রত্যাশার উদ্ভব হয়েছিল, আর তার ফলে দুজনের হাতকে মিলিয়েছিল, তা এমনই যে যৎকিঞ্চিত ইতস্তত করার আর শালীনতার ভান করার পর স্যামুয়েলের যখন মনে হলো ভালোভাবে তর্ক উপস্হাপন করতে পেরেছেন, ম্যাডাম দে কোসমেলি নিজের পক্ষের জ্ঞাপন এই ভাবে আরম্ভ করলেন :
“আমি যতোটা জানি, মসিয়ঁ, ওই নিঃসঙ্গতায় এক কাব্যিক আত্মাকে যে যন্ত্রণাভোগ করতে হয়,
এবং আপনার মতো উচ্চাকাঙ্খী হৃদয় কেমন করে নিজেকে একাকীত্বে খেয়ে ফেলছে বুঝতে পারি ; কিন্তু আপনার দুঃখযন্ত্রণা, যা কেবল আপনারই, তার উৎস, আপনার ভাষার জাঁকজমকের তলায় । আমি যেটুকু বুঝতে পেরেছি, তা অদ্ভুত, অতৃপ্ত, এবং প্রায় এমন প্রয়োজনের যা পাওয়া একেবারে দুষ্কর । আপনি যন্ত্রণাভোগ করেন, সত্য ; সম্ভবত আপনার যন্ত্রণাবোধ আপনার মহনীয়তার সৃষ্টি করে, আর তা আপনার কাছে তেমনভাবেই দরকার যেমন অন্য লোকেদের কাছে আনন্দ ।— এখন, একটু প্রসন্ন হয়ে শুনুন, আর যে মুশকিলগুলো সহজে বোঝা যায় তাদের সম্পর্কে সহমর্মীতা প্রকাশ করুন — গেঁয়ো দুঃখদুর্দশা ? আমি আপনার কাছে পরামর্শ চাইছি, মসিয়ঁ ক্র্যামার, আপনার কাছে, একজন পণ্ডিত ব্যক্তি, বৌদ্ধিক জগতের মানুষ — পরামর্শ এবং সম্ভবত এক বন্ধুর কাছে সাহায্য । আপনি জানেন সেইসব দিনগুলোয় যখন আপনি আমাকে চিনতেন তখন আমি ভালো মেয়ে ছিলুম, আপনার মতোই একটু স্বপ্নালু, কিন্তু ভীতু আর সম্পূর্ণ বাধ্য ; আপনার তুলনায় আমি আয়নায় নিজেকে কম দেখতুম, এবং আমার জন্য প্রতিবেশির বাগান থেকে বুক ফুলিয়ে চুরি করা আপনার দেয়া পিচ আর আঙুর পকেটে রাখতে বা খেতে ইতস্তত করতুম। আমি কখনও কোনো অভিলাষকে প্রকৃত স্বীকারযোগ্য ও সম্পূর্ণ মনে করতুম না যতোক্ষণ না তার অনুমতি আমাকে দেয়া হয়েছে, আর আপনার মতো একজন মার্জিত যুবককে আমি বাইরে বাগানের চেয়ে আমার বুড়ি কাকিমার সামনে জড়িয়ে ধরতে বেশি পছন্দ করতুম । বিবাহযোগ্য প্রতিটি যুবতীর জন্য যা জরুরি, মানে প্রণয়ের ভান  এবং চোখের সামনে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা, আমার কাছে বেশ দেরি করে এসেছিল । যখন আমি পিয়ানোর সঙ্গে একটু গান গাইতে শিখলুম, আমাকে যথেষ্ট যত্ন নিয়ে পোশাক পরানো হতো, আর পিঠ সোজা রাখতে শেখানো হতো ; আমাকে জিমনাস্টিক্স শেখানো হতো, আর নিষেধ করা হতো যে ফুলগাছ পুঁতে বা পাখি পুষে আমি যেন হাত নোংরা না করি। আমাকে বাচ্চাদের গল্পলেখক বেরকঁ ছাড়া আর কাউকে পড়তে বারন করা হতো আর আমাকে ভালোভাবে সাজগোজ করিয়ে খারাপ অপেরা দেখতে নিয়ে যাওয়া হতো । যখন মসিয়ঁ দে কোসমেলি পল্লীভবনে এলেন, ওনার সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য আমার মনে তখনই গভীর অনুভূতির তীব্র সঞ্চার হয়েছিল ; ওনার কর্মশক্তিসম্পন্ন যৌবনের সঙ্গে আমার বুড়ি খিটখিটে কাকিমার তুলনা করে, তাঁর মধ্যে আমি পেলুম মর্যাদাসম্পন্ন সুন্দর বৈশিষ্ট্য, আর উনি আমাকে বেশ সন্মানজনক বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তাছাড়া লোকেরা আরও আকর্ষক গুণাবলীর কথা বলল: এক ভীরু বন্ধুর বোনকে বাঁচাবার জন্য দ্বন্দ্বযুদ্ধে একটা হাত ভেঙে ফেলেছিলেন ; পুরোনো গরিব বন্ধুদের প্রচুর টাকাকড়ি ধার দিয়েছেন, আরও কে জানে কতো কি । নিজের চারিধারে উনি আদেশের আবহাওয়া গড়ে তুলতেন যা ছিল একই সঙ্গে অমায়িক আর অপ্রতিরোধ্য, সেই আবহ আমাকে দখল করে নিয়েছিল । পল্লীভবনে আসার আগে উনি কেমন জীবন যাপন করতেন ? আমার সঙ্গে শিকারে যাবার আগে বা আমার পিয়ানো বাজানোর সাথে নিজের তৈরি গান গাওয়ার আগে উনি কি অন্যান্য আনন্দের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন ; ওনার কি রক্ষিতা ছিল ? আমি সেসব কিছুই জানতুম না, এবং তা জানার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি । আমি ওনাকে ভালোবাসার জন্য মনস্হির করে নিয়েছিলুম, একটি মেয়ের তাবৎ বিশ্বাস নিয়ে,  যার কখনও তুলনা করার সুযোগ হয়নি, আমি ওনাকে বিয়ে করলুম — যা আমার কাকিমাকে সবচেয়ে বেশি পুলকিত করেছিল । যখন আমি ধর্মত ও আইনত ওনার স্ত্রী হলুম, আমি ওনাকে আরও বেশি ভালোবাসতে লাগলুম — আমি ওনাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতুম, তা নিশ্চিত । আমি কি ভুল করেছিলুম, আমি কি সঠিক ছিলুম ? কেই বা বলতে পারে ? এই প্রেমে আমি বিভোর ছিলুম, আর ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে তার হদিশ না থাকার দরুন আমি ভুল ছিলুম । — ওনাকে বিয়ে করার আগে কি ভালো করে জানতুম ? না, একেবারেই না ; কিন্তু আমার মনে হয় একটি সরল মেয়ে যে ধ্বংস-হওয়া নারীর অযোগ্য প্রেমিক বেছে নেবার বদলে, অবিচক্ষণ নির্ণয়ে বিয়ে করে ফ্যালে, তাকে দোষারোপ করা যায় না । একজন ও আরেকজন — যে দুর্দশায় আমরা আক্রান্ত !— আমরা দুজনেই অনুপদিষ্ট । এই অভাগী বলির প্রাণী, যাদের আমরা বলি বিবাহযোগ্যা মেয়ে, লজ্জা সম্পর্কে শিক্ষিত নয়, অর্থাৎ, পুরুষের অসচ্চরিত্রতা সম্পর্কে জ্ঞান তাদের নেই । আমার মনে হয় এই বেচারী মেয়েদের উচিত, বিয়ের বাঁধনে আটক পড়ার আগে, দুজন পুরুষের নিজেদের মধ্যে জীবন বিষয়ে কথাবার্তা লুকিয়ে শোনা, বিশেষ করে মেয়েদের নিয়ে । অমন ভয়াবহ পরীক্ষার পরে, তারা কম বিপজ্জনকভাবে নিজেদের বিয়ের সর্বনেশে ঝুঁকিতে সঁপে দিতে পারে, তাদের ভবিষ্যত স্বৈরাচারীর শক্তি ও দুর্বলতা তখন তারা জেনে ফেলেছে ।”
স্যামুয়েল বুঝতে পারছিলেন না ঠিক কোন দিকে এই সুন্দরী বলির প্রাণী এগোচ্ছেন ; কিন্তু উনি আঁচ করতে পারছিলেন যে ম্যাডাম নিজের স্বামীর সম্পর্কে অনেক বেশি কথা ফাঁস করা আরম্ভ করেছেন, নিজেকে সত্যকার বিভ্রান্ত নারী প্রমাণ করার জন্য ।
কয়েক মিনিট চুপচাপ থাকার পর, মহিলা যেন  সবচেয়ে অন্ধকারময় ঘটনাটি বলতে ভয় পাচ্ছেন, উনি আবার বলা আরম্ভ করলেন : “একদিন, মসিয়ঁ দে কোসমেলি প্যারিসে ফিরে যেতে চাইলেন ; আমার নাকি দীপ্তিমতি হবার অধিকার ছিল, আর আমি যে সৌষ্ঠবের পাত্রী, তার চৌহদ্দিতে লোকে আমাকে দেখুক । একজন সুন্দরী শিক্ষিতা মহিলা, আমার স্বামী বললেন, প্যারিসের সম্পত্তি । সমাজে নিজেকে কীভাবে তুলে ধরতে হয় তা  জানা উচিত, আর তার প্রভার ছিটেছটা পড়া উচিত তার স্বামীর ওপরে ।— অভিজাত আত্মা ও সুস্বভাবের একজন মহিলার জীবনে একমাত্র গৌরব হল তার সঙ্গে বসবাসের সঙ্গীর অংশ হওয়া, স্বামীর কর্মদক্ষতার সহায়তা করা, এবং সর্বোপরি, তাকে সবাই ততোটাই সম্ভ্রম করুক যতোটা সে তার স্বামীকে সম্ভ্রমযোগ্য করে তোলে।
—নিঃসন্দেহে, আমার কাছে, তাঁর আদেশ মেনে, এটাই ওনাকে মহানন্দ দেবার সবচেয়ে সরল ও অমোঘ উপায় ছিল  ; জানতে পারা যে আমার প্রয়াস ও আমার আনুগত্য ওনার দৃষ্টিতে আমাকে উচ্চতা দিচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর প্যারিসের সঙ্গে এঁটে ওঠার জন্য আমার আর কোনোকিছু নির্ণয়ের দরকার ছিল না — যে শহর সম্পর্কে আমি প্রবৃত্তিগতভাবে আশঙ্কিত ছিলুম— যেন সেখানে আমার স্বপ্নের দিগন্তে ছিল অন্ধকারময়, ঝকমকে মায়াপুরুষ যা আমার বেচারা ছোটো প্রেমিকার হৃদয়কে কুঁকড়ে দিচ্ছিল।— আর সেখানে, স্পষ্টত, সেটাই আমাদের যাত্রার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল। একজন স্বামীর আত্মম্ভরিতা তার প্রেমে-পড়া নারীর মধ্যে সততা সৃষ্টি করে । হয়তো উনি নিজেকে মিথ্যা স্তোক দিয়েছিলেন, সম্ভবত এক ধরনের সরল বিশ্বাসে, আর না বুঝেই নিজের বিবেককে ঠকিয়েছিলেন ।— প্যারিসে, নিকট বন্ধুদের জন্য কয়েকটা দিন নির্ধারিত ছিল, যাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে মসিয়ঁ দে কোসমেলি শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়লেন নিজের স্ত্রীকে নিয়ে । বোধহয় উনি নিজের স্ত্রী সম্পর্কে বিরাগে আক্রান্ত হলেন, কেননা মেয়েটি তাঁকে অত্যধিক ভালোবাসতো ; যে কেউ তা দেখলেই টের পেতো । বন্ধুদের উনি অপছন্দ করা আরম্ভ করলেন সম্পূর্ণ বিপরীত কারণে ; একঘেয়ে কথাবার্তার আনন্দ, যাতে আবেগের জায়গা ছিল না, তা ছাড়া তাদের কাছে দেবার মতো আর কিছুই ছিল না । শিগগিরই, তাঁর কাজকারবারের মুখ অন্যদিকে মোড় নিলো । বন্ধুদের পরে এলো ঘোড়া আর জুয়াখেলা । সমাজের দহরম-মহরম আর আলাপ-আলোচনা, যারা বাঁধন এড়িয়ে যেতে পেরেছে তাদের দেখে, আর যারা তাদের বুনো ব্যস্ত যৌবনের অগুন্তি গল্পগাছা ওনাকে শোনাতে লাগলো, ওনাকে তাপ পোয়াবার আগুন আর খবরের ফিরিস্তি থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলো । উনি, সেই লোকটি, যাঁর হৃদয় ছাড়া আর কোনো ভালোবাসার সম্পর্ক ঘটেনি, হয়ে উঠলেন ব্যাবসাপাতির মানুষ । বৈভবশালী এবং পেশাহীন, উনি এখন নিজের পুরো সময় সদাব্যস্ত ভিড়ের অসারতায় ভরে তুললেন । সেইসব পতিপত্নীসংক্রান্ত প্রশ্ন — “কোথায় যাচ্ছো ?”— “কখন ফিরবে ?”– “তাড়াতাড়ি ফিরে এসো”– সবই আমায় গিলে ফেলে গলায় আটকে নিতে হতো, কেননা এখন ইংরেজ জীবন — হৃদয়ের মৃত্যু — ক্লাব ও সঙ্গীমহল ওনাকে সম্পূর্ণ শুষে নিয়েছিল । সাজগোজ করার ও ফুলবাবুগিরি ফলাবার জন্য যে কষ্টকর প্রয়াস উনি করতেন তা প্রথমদিকে আমার মন খারাপ করেছিল ; স্বাভাবিক যে আমায় তুষ্ট করা লক্ষ্য ছিল না । আমিও তাই  চেষ্টা করলুম আরও বেশি সুন্দরী হবার, একজন ছিনাল হবার, ওনার ছিনাল, যেমন উনি সবায়ের জন্য ছিলেন ; অতীতে, আমি তাঁকে সবকিছু দিতে চেয়েছিলুম, দিয়েছিলুম, আর এখন আমি চাইছিলুম তার জন্য উনি আমার কাছে অনুরোধ-উপরোধ করুন । আমি আমার মৃত আনন্দের ছাইকে জাগিয়ে তুলতে চাইছিলুম, তাদের জীবনে ফেরত আনার চেষ্টা করছিলুম ; কিন্তু আমি প্রকৃতপক্ষে ছলাকলায় দক্ষ নই এবং অসততায় একেবারে অনিপুণ, কেননা উনি আমার প্রয়াসকে লক্ষ্য করছেন বলে মনে হতো না।— আমার কাকিমা, ঈর্ষান্বিত বুড়িদের মতন নির্দয় দর্শকের ভূমিকায় নেমে গিয়েছিলেন, যখন কিনা একসময় তাঁরা ছিলেন অভিনেত্রী, আর যে আনন্দ তাঁরা উপভোগ করতে পান না, তা জোর করে কল্পনা করে নেন, আমাকে জানাবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন, এক খুড়তুতো ভাইয়ের মাধ্যমে, যে আমার স্বামী নাটকের একজন ঠশকি অভিনেত্রীর জালে আটকা পড়েছেন । আমি প্রতিটি নাটক দেখা আরম্ভ করলুম, এবং মঞ্চে কোনও সামান্য সুন্দরী এলেও, তার মধ্যে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে কেঁপে উঠতুম । শেষ পর্যন্ত, সেই একই খুড়তুতো ভাইয়ের মাধ্যমে, আমি জানতে পারলুম, তার নাম সুন্দরী ফাঁফারলো, একজন নর্তকী, যাকে যতো সুন্দরী দেখতে, ততো সে গবেট ।— লেখক হিসাবে, আপনার নিশ্চয়ই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে থাকবে । — আমি নিজের মুখশ্রী আর দেহ নিয়ে বেশি ভান করি না আর গর্ববোধও করি না ; কিন্তু আমি আপনাকে দিব্বি দিয়ে বলতে পারি, মসিয়ঁ ক্র্যামার, বহু রাত্রিতে তিনটে বা চারটের সময়ে সকালে, স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে অবক্ষয়িত, আমার চোখ না-ঘুমিয়ে আর কান্নায় লাল, আমার স্বামীর বিশ্বস্ততা ও কর্তব্যে ফিরে আসার জন্য প্রার্থনার পর, আমি ঈশ্বরকে জিগ্যেস করেছি, আর আমার বিবেক, আর আয়নায়, আমি কি এই বজ্জাত ফাঁফারলোর মতো সুন্দরী নই? আমার আয়না আর আমার বিবেক জবাবে বলেছে, “হ্যাঁ তুমি সুন্দরী” । নিজেকে গৌরবান্বিত করতে ঈশ্বর আমাকে নিষেধ করেছেন, কিন্তু একটা সঙ্গত বিজয়ের জন্য করেননি । কেন, তাহলে, দুই সমান সুন্দরীর মধ্যে, পুরুষরা সেই ফুলকে পছন্দ করে যাকে সবাই শুঁকেছে, অন্যজনকে বাদ দিয়ে, যে বিশ্বস্তভাবে বিয়ের বাগানের ব্যক্তিগত পথে অত্যন্ত গোপনে লুকিয়ে থেকেছে ? আর কেনই বা এই মহিলারা, যারা নিজের দেহকে সৌষ্ঠব করে তুলেছে— যে দেহ-ঐশ্বর্যের চাবি কেবল একজন সুলতানের আয়ত্বে থাকা উচিত — আমাদের চেয়ে বেশি ভক্তদের আকর্ষণ করে, আমরা যারা একটিমাত্র ভালোবাসার অসুখি শিকার ? কোন সে ঐন্দ্রজালিক চমৎকারিত্ব যার দ্বারা এই প্রাণীদের চারিপাশে অসচ্চরিত্রতা  মহিমাচ্ছটা গড়ে তোলে? আর সততা, বিশেষ কয়েকজনকে কেন বিসদৃশ বিকর্ষণের পাত্রী করে তোলে ? আমাকে ব্যাখ্যা করে বোঝান, আপনি তো পেশার কারণে জীবনের যাবতীয় ঝোঁক আর তার বিভিন্ন কারণের কথা জানেন !”
স্যামুয়েল জবাব দেবার সময় পেলেন না, কেননা মহিলা তাঁর বক্তব্যের আকুলতা বজায় রাখলেন:
“মসিয়ঁ দে কোসমেলির বিবেকে কিছু গাম্ভীর্যপূর্ণ তর্ক আছে, যেমন ঈশ্বর যদি কোনো কমবয়সী ও বিশুদ্ধ মানুষের অধঃপতনের ব্যবস্হা করে থাকেন, তাহলে তা অন্য কাউকে আনন্দ দেবার জন্য। যদি মসিয়ঁ দে কোসমেলি আজ রাতেই মারা যান, তাহলে তাঁকে বহুবার ঈশ্বরের কাছে দয়াপ্রার্থনা করতে হবে ; তার কারণ তিনি, তাঁর নিজের দোষে, তাঁর স্ত্রীকে কুৎসিত অনুভূতি শিখিয়েছেন — ঘৃণা, প্রণয়ীকে অবিশ্বাস, এবং প্রতিশোধের স্পৃহা । — আহ, মসিয়ঁ ! আমি দুঃখে অনিদ্রায় অস্হির রাত কাটাই ; আমি প্রার্থনা করি, অভিশাপ দিই, ঈশ্বরনিন্দা করি । যাজক বলেন যে আমাদের উচিত আত্মসমর্পিত হয়ে ক্রস বহন করা ; কিন্তু প্রেম যখন উন্মাদনায় পর্যবসিত হয়েছে, তখন আত্মসমর্পণের প্রশ্ন ওঠে না, আর বিশ্বাস ভেঙে গেছে । গির্জায় আমার স্বীকৃতি শোনার যাজক নারী নন, এবং আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি, আমি ওনাকে ভালোবাসি, মসিয়ঁ, পায়ের তলায় পিষে দেয়া রক্ষিতার সমস্ত আবেগ আর সমস্ত দুর্দশা নিয়ে ভালোবাসি। এমন কিছু নেই যা আমি চেষ্টা করিনি । যে সাধারণ ভদ্র পোশাক পরলে উনি পছন্দ করতেন, তা ছেড়ে দিয়ে আমি নাটকের মেয়েদের মতন বিদকুটে আর ব্যয়বহুল সাজসজ্জা করেছি । এবং আমি, যে সাধ্বী স্ত্রীর সন্ধানে তাঁকে ভাঙাচোরা পল্লীভবনে যেতে হয়েছিল, সেই আমি বেশ্যার জামাকাপড়ে ওনার সামনে নিজেকে জাহির করেছি ; তখন আমি হৃদয়ে মৃত্যুকে অনুভব করেছি, তখন আমি নিজেকে করে তুলেছি চতুর আর প্রাণবন্ত । আমি আমার হতাশাকে সাজিয়ে তুলেছি ঝলমলে হাসিতে। কিন্তু হায়, উনি কখনও চেয়ে দেখেননি । মসিয়ঁ, আমি এমনকি ঠোঁট আর গালে রুজ মেখেছি ! — আহ, বুঝতেই পারছেন, এটা এক গতানুগতিক কাহিনি, সব দুর্দশাগ্রস্তের মতন একই গল্প — এক আঞ্চলিক উপন্যাস !”
মহিলা যখন ফোঁপাচ্ছিলেন, স্যামুয়েলের তখনকার হাল,  লুকোবার জায়গার খোঁজে তার্তুফের (মলিয়ের-এর নাটকে ধর্মীয় ভণ্ড ) মতন, যেন এই মহিলার সাধ্বী কান্না,  যা তাঁর হৃদয় ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছিল, আর হতবুদ্ধিকর ভণ্ড কবির কলার ধরে টান মারতে চাইছিল । ম্যাডাম দে কোসমেলির বেপরোয়া ভাব, তাঁর স্বাধীনতা এবং তাঁর আস্হা স্যামুয়েলকে সাহস যোগালেও অবাক করেনি । স্যামুয়েল ক্র্যামার, যিনি প্রায়ই অন্য লোকেদের চমকে-দেয়া কথা বলেছেন, নিজে কখনও তেমন চমকে আক্রান্ত হননি । উনি দিদেরোর বাণীকে ব্যবহার করে তার সত্যতা প্রমাণ করতে চাইলেন : “বিশ্বাসহীনতা অনেক সময়ে মূর্খের কদভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়, এবং অল্পেই বিশ্বাসীরা বৌদ্ধিক জগতের মানুষ প্রতিপন্ন হয় । বুদ্ধিমান মানুষেরা সম্ভাব্যতার অপরিমেয়তাকে গভীরভাবে যাচাই করে। মূর্খেরা ভাবেই না যে ঠিক তার সামনে যা রয়েছে তা সম্ভব কিনা । বোধহয় এর দরুন তা একজনকে ভিতু করে তোলে আর অন্যজনকে গোঁয়ারগোবিন্দ ।”

এতেই সবকিছুর ব্যাখ্যা মেলে । কয়েকজন খুঁতখুঁতে পাঠক, যাঁরা সত্যের প্রতি ভালোবাসাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন, নিঃসন্দেহে সমালোচনার জন্য এই কাহিনিতে অনেককিছু পাবেন, যখন কিনা আমার একমাত্র পরিশ্রম ছিল নামগুলো পালটে দেয়া আর বিশদকে আলোকিত করা ; কেমন করেই বা, তাঁরা বলবেন যে, স্যামুয়েল, একজন নিম্নশৈলীর কবি আর নীচ নৈতিকতার মানুষ, ম্যাডাম দে কোসমেলির পর্যায়ের এক নারীর সঙ্গে সুদক্ষ ব্যক্তির মতন কথাবার্তা বলতে পারে? ওয়ালটার স্কটের উপন্যাসের প্রসঙ্গ তুলে মহিলাটিকে রোমান্টিক ও ফালতু কবিতার তোড়ে ভাসিয়ে দিতে পারে ? এবং ম্যাডাম দে কোসমেলি, শোভন ও সাধ্বী স্ত্রী, কেমন করেই বা তিনি প্রতিদানে স্যামুয়েলকে, পরিমিতিবোধ এবং সন্দেহ ছাড়াই, নিজের গোপনতা আর দুর্দশার কথা অবিরাম শুনিয়ে যেতে পারেন ? এর জবাবে আমি বলব যে ম্যাডাম দে কোসমেলির সুন্দর সত্তাটি সারল্যের, এবং স্যামুয়েল হলো সাহসী প্রজাপতি, গ্রীষ্মকালের ছারপোকা আর কবিদের মতন; সে  প্রতিটি আগুনে ঝাঁপায়, আর সব জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে । দিদেরোর বাণী থেকেই টের পাওয়া যায় কেন একজন ছিলেন অতো খোলামেলা, অন্যজন ততো রূঢ় ও ততো উদ্ধত । এ থেকে স্যামুয়েল জীবনে যে সাঙ্ঘাতিক ভুলগুলো করেছেন তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, একজন মূর্খ অমন অবিবেচকের মতন ভুল করতো না । জনগণের সেই অংশ, যদের সত্তা ভয় দিয়ে গড়া, তারা স্যামুয়েলের মতন চরিত্রকে বুঝতে পারবে না, যে লোকটা অপরিহার্যভাবে অল্পেই বিশ্বাসী আর কল্পনাবিলাসী ছিলেন, যতো দূর সম্ভব তিনি বিশ্বাস করতেন — একজন কবি হয়ে, তার জনগণের মধ্যে — আর মানুষরূপে, তার আবেগের সাহায্য নিয়ে বিশ্বাস করতেন ।
কিছুদিনের মধ্যেই স্যামুয়েল ভাবতে আরম্ব করেছিলেন যে এই মহিলাটি একজন শক্তিমতী, তাঁকে দেখতে যেমন তার চেয়ে বেশি গভীর, এবং এই মনখোলা কর্তব্যনিষ্ঠাকে সরাসরি আক্রমণ করা সঠিক কাজ হবে না ।  স্যামুয়েল নতুন করে নিজের রোমান্টিক বুকনি মহিলাটির সামনে ঝাড়া আরম্ভ করলেন । নিজের মূর্খতার জন্য লজ্জিত, এবার স্যামুয়েল ডেকাডেন্ট হবার নির্ণয় নিলেন; কিছুক্ষণ যাবত শিক্ষালয়ের যাজকের প্রাদেশিক ভাষায় নিজের গুপ্ত আঘাতের কথা বললেন, কিংবা আরও আঘাত সৃষ্টি করে, আরও বড়ো ঘা, ব্যথাহীনভাবে তাদের গরম লোহার সেঁক দিলেন । ভালমোঁ ( পিয়ের শোদেরলো দ্য লাকলোস-এর বইয়ের নারী-ফোসলানো চরিত্র ) কিংবা লাভলেস-এর ( স্যামুয়েল রিচার্ডসনের বইয়ের নারী ফোসলানে চরিত্র ) মতন  পাকা ক্ষমতা যাঁদের নেই, যিনি সৎ নারীকে ফোসলাতে চান, যে নারী কোনোরকম সন্দেহ করছেন না, সেই লোকগুলোর হাস্যকর ও বেঢপ আচরণের সঙ্গে পরিচিত, যারা নিজেদের হৃদয় উপহার দেবার জন্য বলে, “দয়া করে এই অসম্ভব ব্যাপার গ্রহণ করুন।” স্যামুয়েল যে কতো মূর্খ ছিলেন তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন থেকে আমাকে এই ঘটনাটাই রেহাই দেবে । ম্যাডাম দে কোসমেলি, ভালোবাসার পাত্রী সেই এলমিরার ( তার্তুফের স্ত্রী )মতন সততার পরিচ্ছন্ন ও বিচক্ষণ দৃষ্টিতে, তখনই প্যাঁচ কষে নিলেন যে এই আনাড়ি নীচমনাটাকে নিজের আর স্বামীর সন্মান বাঁচাবার জন্য কেমন করে ব্যবহার করবেন । তিনি স্যামুয়েলের অস্ত্র দিয়ে তাকেই আঘাত করলেন; স্যামুয়েলকে তাঁর হাত ধরে চাপ দিতে দিলেন ; দুজনে মিলে বন্ধুত্বের আর প্ল্যাটনিক কথাবার্তা বললেন । তিনি “প্রতিশোধ” শব্দটি বিড়বিড় করে আওড়ালেন ; তিনি বললেন যে, মহিলাদের জীবনে যে দুর্দশাগ্রস্ত সংকট উৎপন্ন হয়, অনেকেই স্বেচ্ছায় তাদের হৃদয়ের অবশিষ্টাংশ প্রতিহিংসা-গ্রহণকারীকে দিয়ে দেবেন, হৃদয়ের সেই অংশ যা খলনায়ক ফেলে গেছে তা দিয়ে দেবেন — সেইসঙ্গে অন্যান্য অসম্ভব কথাবার্তা এবং নাটুকে সংলাপ চালিয়ে গেলেন । সংক্ষেপে, তিনি নৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণয়ের ভান করলেন, আর আমাদের সৃজনীশক্তিচ্যুত যুবক, যিনি  জ্ঞানীর তুলনায় হাবাগবা ছিলেন, ফাঁফারলোকে মসিয়ঁ দে কোসমেলির কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তাঁকে ওই বারাঙ্গনা থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিলেন — এই আশায় যে কাজটির দাবি অনুযায়ী পরিবর্তে সৎ মহিলাটির বাহুডোর পাবেন ।— কেবল কবিরাই এই ধরণের দানবিকতা আবিষ্কারের জন্য সরল হয় ।
এই হাস্যকর গল্পের বিশদ ব্যাপার হলো , যা চারটি চরিত্রের মাঝে অভিনীত নাটকের মাঝে ঢোকানো কৌতুককর ব্যাপারের মতন, তা হল স্যামুয়েলের সদ্যরচিত সনেট সংক্রান্ত ; কেননা, সনেটের ক্ষেত্রে, স্যামুয়েল ছিলেন সংশোধনাতীত : একটা ছিল ম্যাডাম দে কোসমেলির জন্য লেখা, যাতে স্যামুয়েল অতিন্দ্রিয়বাদী শৈলীতে তাঁর বিয়াত্রিচের মতন সৌন্দর্যের, তাঁর কন্ঠস্বরের, তাঁর চোখের স্বর্গীয় শুদ্ধতার, তাঁর আচরণের নম্রতার, ইত্যাদি গুণগান করে লিখেছিলেন, আরেকটা ছিল  ফাঁফারলোর জন্য লেখা, যাঁকে স্যামুয়েল টুকরো-টুকরো মাংসে রাঁধা মশলাদার ছলনাময়ী হিসাবে ভেবেচিন্তে তুলে ধরলেন, যাতে বেতো রুগির টাকরাতেও রক্ত চলকে ওঠে, এমন এক কাব্যিক জনার যাতে উনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ, এবং যাতে উনি প্রথম থেকেই সম্ভাব্য আন্দালুসীয় উদ্ভটতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন । এবার, নর্তকীর ডেরায় পৌঁছোল প্রথম টুকরো-টাকরা, যিনি এই বাকতাল্লার সংগ্রহ চুরুটের ডিবেতে ফেলে দিলেন; দ্বিতীয়টা পৌঁছোলো বেচারি পরিত্যাক্তার কাছে, যিনি প্রথমে বড়ো-বড়ো চোখে পড়লেন, তারপর বুঝতে পারলেন আসলে ঠিক কী ঘটেছে, এবং তাঁর যাবতীয় দুঃখদুর্দশা সত্বেও দিলখোলা হাসি হাসতে বাধ্য হলেন, যেমন ভালো দিনগুলোয় হাসতেন।
স্যামুয়েল নাট্যগৃহে গেলেন  ফাঁফারলোকে মঞ্চে দেখার জন্য । নারীটিকে হালকা-চলন, চমৎকার, প্রাণশক্তিসম্পন্ন, সাজসজ্জায় অত্যন্ত রুচিশীল দেখে, তারিফ করলেন যে মসিয়ঁ দে কোসমেলি বেশ ভাগ্যবান, যিনি এইরকম একটি নমুনায় নিজেকে ধ্বংস করার সুযোগ পেয়েছেন।
স্যামুয়েল নর্তকীর বাড়ি দু-বার গেলেন — বাসার সিঁড়ির ধাপে মখমল বসানো , পর্দা ও জাজিমে সাজানো, শহরের নতুন গাছপালায় ছাওয়া এলাকা ; কিন্তু নিজের পরিচয় দেবার মতন কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পেলেন না । ভালোবাসার ঘোষণা ব্যর্থ হতে পারে, এমনকি বিপজ্জনক । যদি বিফল হয়, আরেকবার আসতে পারবেন না । আর তাছাড়া, স্যামুয়েল জানতে পারলেন মেয়েটি দর্শনার্থীদের আমল দেন না । কয়েকজন নিকটবন্ধু মাঝে-মাঝে তাঁর কাছে আসেন । এতো চমৎকারভাবে আশ্রিত ও রাখা, একজন নর্তকীর বাসায় গিয়ে স্যামুয়েল কীই বা বলবেন কিংবা করবেন, আর প্রেমিকের দ্বারা যিনি এমন উপাস্য ? কীই বা আনবেন ওনার জন্য, স্যামুয়েল দরজি নন, পোশাক নির্মাতা নন, ব্যালে-শিক্ষক নন, কোটিপতিও নন ? — স্যামুয়েল তাই একটা সহজ ও অপরিণত পাঁয়তাড়া আঁটলেন :  ফাঁফারলোকে ওনার কাছে আসতে হবে । সেই যুগে, আজকের তুলনায় তখনকার দিনে গুণগান বা নিন্দা করা সমালোচনামূলক প্রবন্ধের বেশ গুরুত্ব ছিল । সংবাদপত্রের “ক্ষমতা”, একজন নামকরা উকিল যেমন সম্প্রতি এক দুঃখজনক কুখ্যাত মামলার ( রক্ষিতা লোলা মন্তেজকে কেন্দ্র করে বুভালোঁঁ ও দুজারিয়ের দ্বন্দ্বযুদ্ধ যাতে দুজারিয়ে মারা যায় ) সময়ে বলেছেন, তখনকার দিনে এখনকার তুলনায় অনেক বেশি ছিল ; কয়েকজন বুদ্ধিমান মানুষ এককালে সাংবাদিকদের কাছে হার মেনেছিলেন, তাদের দুর্বিনীত মাথা-ঘোরানো কাজকারবারের কোনো সীমা ছিল না । স্যামুয়েল অতএব নেমে পড়লেন — যিনি সঙ্গীতের একটা শব্দও জানতেন না — গীতিময় নাটকের বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় নামলেন।
তখন থেকে, এক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রে  ফাঁফারলোকে প্রতি সপ্তাহান্তে টুকরো-টুকরো করা হতে লাগলো । অবশ্য, আপনি বলতে পারেন না, কিংবা ইঙ্গিত করতে পারেন না, যে, ওনার পা, কনুই, বা হাঁটুর আকৃতি খারাপ ; মোজার ভেতরের পেশিগুলো পাকানো, তা লিখলে নাকের ডগায় চশমা ঝোলানো লোকেরা চেঁচিয়ে বলতো, এটা ঈশ্বরীনিন্দা ! তার বদলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলো যে তিনি অশিষ্ট, মামুলি, রুচিহীন, ব্যালে নাচে জার্মান আর স্পেনীয় কায়দা আমদানির চেষ্টা করেন ; স্পেনীয় করতাল, নালবসানো জুতো, জুতোয় উঁচু গোড়ালি — এবং  তিনি পদাতিক সেনার মতন মদ খান, তিনি ছোটো কুকুরদের আর চাকরের মেয়েকে খুব ভালোবাসেন — এবং তাঁর ব্যক্তিজীবনের অন্যান্য নোংরা ঘটনা, যে ব্যাপারগুলো নিয়ে কয়েকটা ছোটো সংবাদপত্র প্রতিদিন চরে খায় আর পুষ্ট হয় । সাংবাদিকের পেশায় যা আজব কৌশল, যারা অসদৃশ ব্যাপারের তুলনা করতে ভালোবাসে, তাঁর সঙ্গে এক বায়বীয় নর্তকীর বৈষম্য দেখানো হলো যে সদাসর্বদা শাদা পোশাক পরে, এবং যার মার্জিত ভঙ্গীমা দর্শকদের বিবেককে কখনও তাড়িত করে না । অনেকসময়ে, যখন ফাঁফারলো বিশেষ করে কোনো কঠিন লাফ দিতে সফল হয়েছেন, তিনি চেঁচিয়ে উঠে সামনের সারির দর্শকদের দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে ওঠেন ; হাঁটার সময়েও নাচার সাহস প্রদর্শন করেন । তিনি কখনও তেমন রুচিহীন সুতির পোশাক পরেন না যার ফলে কোনো কিছু না দেখালেও আপনি সবকিছু দেখতে পাবেন।
তিনি এমন বস্তু পছন্দ করেন যা কোনোরকম আওয়াজ সৃষ্টি করে, লম্বা স্কার্ট, মচমচে, ঝিলমিলে, টিনের গয়নায় সাজানো, যাকে স্বাস্হ্যবতী হাঁটুর সাহায্যে ওপরে তোলা যায়, আর ঘটিহাতা বক্ষবন্ধনী । তিনি নাচতেন, কানবালা পরে নয়, বরং বড়ো ঝুলন্ত দুল পরে যাকে আমি বলব প্রায় ঝাড়লন্ঠন । তিনি স্কার্টের সঙ্গে জেনেশুনে ঝুলিয়ে রাখতেন গোছাগোছা পুতুল,  বুড়ি জিপসিদের মতন, যারা ভয়দেখানো কায়দায় আপনার ভবিষ্যত বলে দেবে, যাদের আপনি দুপুরবেলায় রোমান ধ্বংসাবশেষে পাবেন ; এই সমস্ত মজার ছোঁয়া, সংক্ষেপে, যা রোমান্টিক স্যামুয়েল, ফ্রান্সে অলক্ষিতে ঘুরে বেড়ানো শেষ রোমান্টিকদের একজন, আবেগ দিয়ে ভালোবাসতো । এতোই যে, ফাঁফারলোকে তিন মাস যাবত অবিরাম অপমান করে, উনি সারানোর অসাধ্য ব্যারামে, তাঁর প্রেমে পড়ে গেলেন, আর মেয়েটি তাঁর দিক থেকে জানতে চাইলেন এই দানবটা কোন লোক, যার হৃদয় পেতলের, এই বাচাল, এই বুভুক্ষু সত্তা যে তাঁকে তাঁর রাজকীয় প্রতিভার দাবি থেকে বঞ্চিত করার গোঁ ধরে আছে ।
আমাদের উচিত সুন্দরী ফাঁফারলোর সুবিচার করা,  তাঁর দিক থেকে ব্যাপারটা ছিল কেবল কৌতূহলের, তার বেশি কিছু নয় । অমন একজন মানুষের মুখের মাঝখানে কি নাক আছে, আর বাদবাকি প্রাণীদের সঙ্গে কি তার কোনোরকম মিল আছে । তিনি যখন স্যামুয়েল ক্র্যামার সম্পর্কে যৎসামান্য তথ্য যোগাড় করতে পারলেন, যখন জানতে পারলেন যে লোকটা আর সবায়ের মতন মামুলি, সামান্য বোধ আর সামান্য গুণাবলীও আছে, তাঁর অস্পষ্টভাবে মনে হলো , এ ব্যাপারে তেমন রহস্যময় কিছু নেই, আর প্রতি সোমবারের এই ভয়ঙ্কর প্রবন্ধগুলো হয়তো সাপ্তাহিক ফুলের তোড়া, কিংবা কোনো নাছোড় আগ্রহীর ভিজিটিং কার্ড । এক রাতে স্যামুয়েল ওনার সঙ্গে সাজঘরে দেখা করলেন । দুটো পেল্লাই মোমবাতি আর তাপ পোয়াবার আগুন কাঁপা-কাঁপা আলো ফেলছিল খাসকামরায় চারিধারে ঝোলানো রঙচঙে পোশাকে।
এই এলাকার রানি, মঞ্চ ছেড়ে যেতেই, সাধারণ নশ্বরের সাধারণ পোশাক পরে নিয়েছিলেন, পা মুড়ে বসেছিলেন চেয়ারে, তাঁর আদরযোগ্য পায়ে-পরা জুতোর ফিতে নির্লজ্জভাবে বাঁধছিলেন । ওনার দুই হাত, পুরু কিন্তু বলিষ্ঠ, জুতোর ফুটো দিয়ে  মাকুর কর্মতৎপরতায় ফিতে পরাচ্ছিল, স্কার্টটা যে নামানো উচিত সে দিকে খেয়াল ছিল না । ওই পা, ইতিমধ্যে, স্যামুয়েলের জন্য, হয়ে উঠেছিল অনন্তকালীন আকাঙ্খার জিনিস । দীর্ঘ, রোগাটে, বলিষ্ঠ, শিরা-পাকানো, একসঙ্গে সবই, তাতে ছিল নিখুঁত সৌন্দর্য এবং লাম্পট্য আকর্ষণের সমৃদ্ধি । চওড়া জায়গাটায় লম্বালম্বি কাটলে, পা দিয়ে এক ধরণের ত্রিকোণ তৈরি হতে পারত, যার শীর্ষবিন্দু ছিল জঙ্ঘাস্হি, আর যার নরম গোলাকার পায়ের ডিম গড়ে তুলছিল উত্তল বনিয়াদ । একজন আসল পুরুষের পা বেশ শক্ত, এবং দেভেরিয়ার আঁকা নারীদের পা বড়োই কোমল । এই মনোরম ভঙ্গীতে,  ফাঁফারলোর মাথা, পায়ের দিকে নামানো, প্রাচীন রোমের রাজ্যপালের মতন খোলা ঘাড়, দম্ভপূর্ণ ও শক্তিময়, যা ওনার কাঁধের হাড়ের খাঁজকে কল্পনা করতে দিচ্ছিল, শ্যামল অতিরিক্ত মাংসে ঢাকা । ওনার ভারি পর্যাপ্ত চুল, দুই দিক থেকে সামনে ঝুলে পড়ে বুকে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল আর দৃষ্টিকে ঢেকে দিচ্ছিল, যার দরুন উনি বারবার তাদের পেছনে ঠেলে দিচ্ছিলেন । মহিলাটি এবং তাঁর পোশাক মোড়া ছিল উদ্ধত ও মোহময় অধীরতায়, সেই বিরক্ত শিশুর মতন যার মনে হয় সবকিছু তাড়াতাড়ি হচ্ছে না, এক অধীরতা যা অবিরাম নতুন নতুন দৃষ্টিপথ তৈরি করছিল, রেখা ও রঙের নতুনতর প্রভাব আনছিল।
স্যামুয়ে। শ্রদ্ধা জানিয়ে অপেক্ষা করলেন — কিংবা শ্রদ্ধার ভান করে থামলেন, কেননা, এরকম এক শয়তান মানুষের, সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো কখন অভিনেতাটা তাকে দখল করে নেবে ।
“আহ, আপনি এসেছেন, মসিয়ঁ,”, উনি যা করছিলেন তা না থামিয়ে বললেন, যদিও কয়েক মিনিট আগে  স্যামুয়েলের আসার কথা তাঁকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল । “আমার মনে হয়, আপনি আমাকে কিছু জিগ্যেস করবেন ?”
তাঁর বাক্যের শ্রদ্ধা-জাগানো ঔদ্ধত্য বেচারা স্যামুয়েলের হৃদয়ে সরাসরি প্রবেশ করল ; ম্যাডাম দে কোসমেলির সঙ্গে থাকলে স্যামুয়েল এক সপ্তাহ ধরে রোমান্টিক ম্যাগপাইয়ের মতন কিচিরমিচির করতে পারতেন : এখানে,  নম্রকন্ঠে উত্তর দিলেন :
“হ্যাঁ, ম্যাডাম।” আর স্যামুয়েলের চোখে জল এসে গেল ।
এটা দারুন সফলতা ; সুন্দরী ফাঁফারলো হাসলেন ।
“আপনাকে কোন পোকায় কামড়েছে, মসিয়ঁ, যে আপনি আমাকে অমন করে ছিঁড়ে ফেলছেন ? কী এক জঘন্য পেশা…..”
“জঘন্যই তো, ম্যাডাম । তার কারণ আমি আপনাকে ভক্তি করি।”
“সেটাই আমার মনে হয়েছিল,”  ফাঁফারলো জবাব দিলেন । “কিন্তু আপনি একজন দানব, এগুলো ঘৃণ্য কৌশল ।— আমরা বেচারি মেয়েরা ।” যোগ করলেন উনি, হাসতে হাসতে । “ফ্লোরা, আমার ব্রেসলেট নিয়ে যাও। আপনার হাতটা দিন, আর আমার ঘোড়ার গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে চলুন, আর বলুন, আপনি কি মনে করেন আমি আজকে রাতে ভালো নেচেছিলুম ?”
বাহুতে বাহু গলিয়ে দুজনে বাইরে বেরোলেন, দুই পুরোনো বন্ধুর মতন । স্যামুয়েল প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন, বা অন্তত ওনার মনে হলো ওনার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। — উনি হয়তো বড়োই অদ্ভুত, কিন্তু এখন উনি নিঃসন্দেহে হাসির খোরাক নন ।  আনন্দে ডগমগ, ম্যাডাম দে কমেলিকে নিজের সফলতার কথা বলতে উনি ভুলে গেলেন, ভুলে গেলেন একা বসে থাকা ওনার ছোট্ট ঘরে একটু আশার কথা পাঠাতে ।
কয়েকদিন পরে, ফাঁফারলো তাঁর জন্য উৎসাহীদের ব্যবস্হা করা এক প্রশস্ত মঞ্চে কলোম্বাইনের ভূমিকায় ( কমেদিয়া দেল আর্তের নায়িকা ) নাচলেন । বহু মনোরম রূপে  তিনি আবির্ভূত হলেন, কলোম্বাইন থেকে মার্গারিতে ( ফাউস্ত ) থেকে এলভিরা ( মোৎসার্ট ) থেকে জেফিরাইন ( লোকসঙ্গীত ) অনায়াসে কয়েক প্রজন্মের চরিত্র বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সাহিত্য থেকে তুলে নিয়ে নিজস্বতা দিলেন । একজন খ্যাতিমান সঙ্গীতকার অসাধারণ সুর দিতে রাজি হয়েছিলেন যাতে বিষয়বস্তুর নতুনত্বের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায় । ফাঁফারলো বদলে-বদলে কখনও শ্রদ্ধেয়া, কখনও ভুতশিশু, কখনও বা খেলায় মগ্ন নারী । ওনার শিল্পে উনি ছিলেন মার্জিত, অভিনয় করছিলেন পা ব্যবহার করে আর নাচছিলেন চোখ দিয়ে ।
প্রসঙ্গক্রমে, আমরা উল্লেখ করতে পারি যে আজকাল নৃত্যশিল্পকে বড়োই অবজ্ঞা করা হয় । মহান সংস্কৃতিগুলো, প্রাচীনকাল থেকে আরম্ভ করে এবং ভারতবর্ষ ও আরবদেশকে অন্তর্ভূক্ত করে, একে কবিতার সমান চর্চা করেছে । কোনো-কোনো পৌত্তলিক গোষ্ঠীর কাছে সঙ্গীতের চেয়ে নৃত্য ততোটাই উন্নত যতোটা দৃশ্যমান ও তৈরি-করা জগত, অদৃশ্য ও না-বানানো জগতের তুলনায় উন্নত।— এটা কেবল তাদের কাছেই স্পষ্ট হয় যারা বুঝতে পারে যে ছবি আঁকায় ভাবকল্পনা যোগায় সঙ্গীত ।— সঙ্গীতের যাবতীয় রহস্যকে মেলে ধরতে পারে নৃত্য, এবং অতিরিক্ত গুণ হলো যে এটা মানবিক ও স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান । নৃত্য হলো বাহু ও পা-যুক্ত কবিতা; — তা উপাদান — শুভ, অপরিসীম, প্রাণচঞ্চল — চলিষ্ণুতার দ্বারা অলঙ্কৃত । — দক্ষিণ ফ্রান্সের ধ্রুপদি নৃত্যসঙ্গীতের মানসপ্রতিমা হলেন তেরপিসকোর ; আমার অনুমান, তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গী, এবং তাঁর পা দুটি গমের সোনালি ক্ষেতে প্রায়ই নৃত্য করত ; তাঁর দেহভঙ্গীমা, নিখুঁত মূর্ছনার প্রতিরূপ, ভাস্কর্যের দৈবী উপাদানের যোগান দিতো । কিন্তু ক্যাথলিক ফাঁফারলো, যিনি তেরপিসকোরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে সন্তুষ্ট নন, শিল্পের আধুনিক দৈবতার সাহায্য নিলেন । পরীদের দেহকাঠামোর সঙ্গে কুয়াশার মিশেল ঘটল এবং জলপরীরা কম বাষ্পীয় ও কম উদাসীন হয়ে উঠলো । তিনি একইসঙ্গে ছিলেন শেক্সপিয়ারিয় খামখেয়াল ও ইতালীয় বিদূষকের তৈরি নারী ।
কবি আনন্দবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন ; ওনার মনে হচ্ছিল  নিজের সামনে প্রথম যৌবনের স্বপ্নগুলো দেখতে পাচ্ছেন । স্যামুয়েল হয়তো ওনার সাজঘরের চারিপাশে বোকার মতন তিড়িংনাচ লাফাতে পারতেন, এমনকি যে উন্মাদ মাদকতা ওনার ওপর চেপে বসেছিল, আত্মহারা হয়ে কোনো জিনিসে মাথা ঠুকে ফাটিয়ে ফেলতে পারতেন ।
একটা ছোটো আর ভালোভাবে বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি কবি আর নর্তকীকে দ্রুত সেই ছোটো বাসায় নিয়ে গেল যার বর্ণনা আমি আগে দিয়েছি ।
আমাদের ভদ্রলোক নর্তকীর পায়ে আর হাতে জ্বরগ্রস্ত নিঃশব্দ চুমু খেয়ে তার প্রশংসা  করলেন।— আর ফাঁফারলোও মুগ্ধ হয়েছিলেন বৈকি, কেবল ওনার আকর্ষণের ক্ষমতার জন্য নয়, বরং এর আগে উনি কখনও এমন অদ্ভুত পুরুষকে দেখেননি, পরিচিত হননি এমন বৈদ্যুতিক কামের আবেগের সঙ্গে ।
রাত ছিল গোরস্তানের মতন কালো, আর  মেঘের দলকে বাতাস এমন দোলাচ্ছিল, তাদের থেকে ঝেড়ে ফেলতে লাগলো শিলা আর বৃষ্টির স্রোত  । ঝোড়ো হাওয়া চিলেকোঠাকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল আর চূড়া থেকে ভেসে আসছিল গোঙানি । নর্দমা, যা কিনা গতকালের প্রেমপত্র আর হুল্লোড়ময় শবের বিছানা, নিজের সঙ্গে হাজার গোপনতা ভাসিয়ে নিয়ে গেল পয়ঃপ্রণালীর দিকে ; হাসপাতালগুলোয় পরমানন্দে পড়তে লাগলো মরণশীলতা, এবং সেইন্ট জাক রাস্তায় চ্যাটারটন ও স্যাভেজরা ( আঠারো দশকের দুজন দুস্হ ফরাসি কবি ) লেখার টেবিলের ওপরে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া তাদের আঙুল শক্ত মুঠোয় ধরে থাকলেন— যখন আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে কৃত্রিম, সবচেয়ে অহংকারী, সবচেয়ে কামুক, সবচেয়ে অর্থগৃধ্নূ আর চালাক লোকটা বিরাট খাবার টেবিলে রাতের ভোজের জন্য হাজির হলেন, সঙ্গে অতীব সুন্দরী নারী যাঁকে প্রকৃতি চোখের আনন্দের জন্যে কখনও গড়েছিল ।  স্যামুয়েল জানলা খুলে অভিশপ্ত শহরের দিকে ওনার বিজয়ী চোখ বোলাতে চাইছিলেন ; তখনই, চাউনি নামিয়ে ওনার সামনের বিভিন্ন উপভোগ্যের দিকে দৃষ্টি পড়তে, দ্রুত এগিয়ে গেলেন ভোজ্যবস্তুর দিকে ।
এই ধরণের জিনিসপত্রের মাঝে, স্বাভাবিকভাবে ওনার বাকপটু হয়ে ওঠার কথা ; এবং ফাঁফারলোর তাঁকে মনে হলো প্রায় সৌম্যকান্তি, মাথার ওপরে চুলের জংলি জট আর মূল্যনির্ধারকের নাক সত্বেও।
খাবার সম্পর্কে স্যামুয়েল আর ফাঁফারলোর  মতামত মিলে গেল এবং এলিট প্রাণীদের জন্য জরুরি পুষ্টিকর প্রণালী সম্পর্কেও মতের মিল হলো । মোহিনীর খাদ্য তালিকা থেকে বর্জিত ছিল সাদাসিধে মাংস আর স্বাদহীন মাছ । শ্যাম্পেন সাধারণত তাঁর টেবিলকে অপমান করতো না । সুন্দর ফুলের তোড়ার পাশে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ বোরদৌ সেলাম করতো বার্গ্যাণ্ডির নামিদামি সারিকে , ওভের্ন, আঁজু এবং দক্ষিণ ফ্রান্স থেকে ওয়াইন, আর জার্মানি, গ্রিস, স্পেন থেকে বিদেশি ওয়াইন। স্যামুয়েলের বলার অভ্যাস ছিল যে এক গেলাস খাঁটি ওয়াইনকে একগোছা কালো আঙুরের মতন দেখতে হওয়া উচিত, আর তা যেমন খাওয়া দরকার তেমনই পান করা দরকার ।— ফাঁফারলো চাইতেন মাংস রাঁধা হোক রক্তমাখা আর ওয়াইন হবে কার্যকর । কিন্তু তা সত্বেও, উনি কখনও মাতাল হতেন না । —দুজনেই কন্দক ছাতাফলের ( ট্রাফল ) আন্তরিক ও নিগূঢ় প্রশংসার ভান করলেন । কন্দক ছাতাফল, যা পৃথিবীর  দেবী সিবেল-এর গুপ্ত ও রহস্যময় উদ্ভিদ, সেই স্বাদু অসুখ, যা দেবী তাঁর নাড়িতে সবচেয়ে দামি ধাতুর চেয়ে বেশি দিন লুকিয়ে রাখেন, সেই সূক্ষ্মবস্তু যা কৃষিবিদদের জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে, ঠিক যেমন সোনা করেছিল অপরাসায়নিক প্যারাসেলসাসকে, কন্দক ছাতাফল প্রাচীন ও আধুনিক জগতের মাঝে তফাত তৈরি করেছে, যা এক গেলাস চিওস পান করার পর, একটি সংখ্যার পর অজস্র শূন্যের মতন প্রভাব গড়ে তোলে।
সস, রান্নার মশলা, এবং গন্ধমাখানো খাবার সম্পর্কে যদি বলতে হয়, তা হবে এক গুরুগম্ভীর প্রশ্ন যার জন্য বিজ্ঞানের পত্রিকার মতন একটা পুরো অধ্যায় দরকার পড়বে, তবে আপনাদের আমি আশ্বস্ত করতে পারি যে সেগুলো ছিল সামঞ্জস্যে যথাযথ, আর সর্বোপরি প্রকৃতির ঔষধালয়কে রান্নার কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তায় ব্যবহৃত । আদা-পেঁয়াজ-রসুন, ইংল্যাণ্ডের গুঁড়োমশলা, জাফরান, উপনিবেশের রান্নার জিনিস, খাবারের ওপরে ছড়ানো অদ্ভুত গুঁড়ো, সবকিছুই ওনাদের মনের মতন মনে হলো, তার সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় কস্তুরি আর ধুপের সুগন্ধ । ক্লিওপেট্রা যদি বেঁচে ফিরে আসতেন, আমি নিশ্চিত যে তিনি তাঁর গোমাংস আর মৃগমাংসের ফিলেকে আরবের সুগন্ধে ভিজিয়ে নিতেন । নিঃসন্দেহে, বিষয়টা নিন্দার যে আজকালকার সবচেয়ে ভালো রাঁধুনিরাও বিশেষ ও ইন্দ্রিয়সুখের জন্য তৈরি আইনে তেমন রাঁধতে বাধ্য নন, যাতে তাঁরা তাঁদের রান্নার জিনিসের রাসায়নিক গুণাগুণ বুঝতে পারেন, আর জানেন না কেমন করে আবিষ্কার করতে হয়, প্রেমিককে খাওয়াবার উৎসবের মতন গুরুত্বপূর্ণ অবস্হায়, সেই সব রান্না-সম্পর্কিত উপাদান যা দেহকে উদ্দীপ্ত করে এবং তাড়াতাড়ি জৈব-প্রণালীতে পৌঁছে যায়, বিষের মতন, ইথারের মতন বায়বীয় । একটা কৌতূহলের ব্যাপার, কেমন করে ভালোভাবে থাকা যায় সে-বিষয়ে তাঁদের মতের মিল, দুজনের একই রকমের পছন্দ পরস্পরকে কাছে নিয়ে এলো ; ইন্দ্রিয়চেতনার গভীর বোধ,  স্যামুয়েলের প্রতিটি চাউনি ও প্রতিটি শব্দে আলোকিত হচ্ছিল, তীব্র প্রভাব ফেললো ফাঁফারলোর ওপর । স্যামুয়েলের কথাগুলো, অনেকসময়ে রূঢ় ও পরিসাংখ্যিক, কখনও বা ফুলের বা শ্যাশের মতন সুগন্ধিত ও কমনীয়, কথাবার্তার এই অদ্ভুত প্রবাহ, যার গোপনীয়তা কেবল স্যামুয়েলই জানতেন, এই চমৎকার নারীর শুভ অনুগ্রহে শেষ হলো । সেই সঙ্গে, তীব্র ও গভীর সন্তুষ্টির বোধ বাদ দিয়ে নয়, যা স্যামুয়েল ঠাহর করতে পারলেন, মহিলাটির শোবার ঘর খুঁটিয়ে দেখার পর, ঘরের সাজসজ্জা আর পর্দায় পাওয়া গেল পছন্দ ও সংবেদনের নিখুঁত মিলন।
স্যামুয়েল একেবারে পছন্দ করতেন না — আর আমার মতে তিনি এই ব্যাপারে সঙ্গত, বাসার অন্দরমহলের স্হাপত্যে  আমদানি-করা ছুঁচোলো সমকৌণিক নকশা । পুরোনো দুর্গের বিশাল ঘরগুলো আমার ভীতিসঞ্চার করে, আর আমি সেখানকার নিবাসীদের জন্যে দুঃখ পাই, গোরস্তানের মতন শোবার ঘরে প্রেম করতে বাধ্য হয় তারা, ওই প্রকাণ্ড শববহনের কফিনের ওপরে যাকে ওরা বলে বিছানা, কিংবা পেল্লাই মনুমেন্টের ওপরে, যার ছদ্মনাম চেয়ার । পম্পেইয়ের ব্যক্তিগত ঘরগুলো ছিল একহাত মাপের ; মালাবার সমুদ্রতীরের ভারতীয় ধ্বংসাবশেষও তেমন ব্যবস্হার কথা বলে । সেই ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং জ্ঞানী লোকেরা ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন । একটা অত্যন্ত সংকীর্ণ জায়গাতেই আন্তরিক অনুভূতিগুলো গভীরতা পায় ।
ফাঁফারলোর শোবার ঘরও বেশ ছোটো ছিল, নিচু ছাদ, নরম জিনিসপত্রে ঠাশা, যা ছিল সুগন্ধিত এবং ছোঁয়া বিপজ্জনক ; ঘরের আবহতে খেলছিল সেই অদ্ভুত সুবাস   যা যে-কাউকে একটু-একটু করে মরতে ইচ্ছুক করে তুলবে, যেন সে কাচের চাষঘরে রয়েছে । বেগুনি অথচ একাধিক রঙে রঙিন লেসবসানো আর কাপড়ের তালের ওপরে খেলা করছিল আলোর বাতি । দেয়ালে, এখানে-সেখানে,  পেইনটিঙে আলো ফেলে তা সৃষ্টি করছিল স্পেনীয় রোমাঞ্চকর নাটক : বড়ো বেশি কালো পটভূমিতে বড়ো বেশি শাদা মাংস । আর তাই এই আনন্দবিহ্বল বাসার গভীরতা থেকে, যা যুগপৎ অসৎ জায়গা ও পবিত্র আশ্রয়, স্যামুয়েল দেখলেন যে  হৃদয়ের নতুন ঈশ্বরী এগিয়ে আসছেন ওনার দিকে, নারীর নগ্নতার সমগ্র ঔজ্বল্য ও পবিত্র উৎকর্ষ নিয়ে ।
কোথায় এমন পুরুষ আছে যে তার পার্থিব দিনগুলোর অর্ধেক দামে, নিজের স্বপ্নে, প্রকৃত স্বপ্নে, দেখতে চাইবে না, তার সামনে অবগুন্ঠনহীন দাঁড়িয়ে, তার কল্পনায় লালিত খেয়ালে, সাধারণের নোংরা দৃষ্টি থেকে সুরক্ষিত রাখার  পোশাকের স্তরগুলো, একের পর এক পড়ে যাচ্ছে ?
আর তবু, দেখুন, এখানে স্যামুয়েল হঠাৎই আক্রান্ত হলেন এক উদ্ভট খামখেয়ালে, নিজেকে দেখলেন রাগি বাচ্চার মতন চেঁচিয়ে উঠতে : “আমি কলোম্বাইনকে চাই, আমাকে কলোম্বাইন এনে দাও ; আমাকে অবিকল তার মতন এনে দাও যে সেই রাতে তার অসাধারণ পোশাকে আর তার রজ্জুনর্তকীর বক্ষবন্ধনী পরে  আমাকে পাগল করে দিয়েছিল !”
সুন্দরী ফাঁফারলো, প্রথমে অবাক, যে পুরুষকে বেছে নিয়েছেন তাঁর অস্বাভাবিকতায় নিজে সঁপে দিতে বিহ্বল, ঘণ্টি বাজিয়ে ফ্লোরাকে ডাকলেন ; ফ্লোরা মিথ্যেই বোঝাবার চেষ্টা করল যে সকাল তিনটে বাজে, সবকিছুই নাট্যগৃহে তালাবন্ধ আছে, দারোয়ান গভীর ঘুমে, আবহাওয়া আতঙ্কজনক — ঝড় গর্জন চালিয়ে যাচ্ছিল — কিন্তু যে মালকিন নিজেই অন্যের নির্দেশ মানছেন তাঁর নির্দেশ তো মানতে হবে, আর চাকরানি বেরিয়ে পড়ল ; সেই সময়ে ক্র্যামার, এক নতুন ভাবনার বশবর্তী, ঘণ্টি বাজিয়ে জোর গলায় বলে উঠলেন : “আর রুজ আনতে ভুলো না !”
এই চারিত্রিক বিশেষত্ব, ফাঁফারলো এক সন্ধ্যায় তাঁর বন্ধুদের কাছে বর্ণনা করছিলেন, যাঁরা  স্যামুয়েলের সঙ্গে তাঁর প্রণয়ঘটিত ব্যাপার সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন, আমাকে একেবারেই অবাক করেনি ; ওসপ্রের লেখককে আমি এই ঘটনায় যথাযথ চিনতে পারলুম । স্যামুয়েল সবসময় রুজ ভালোবাসতেন, আর নীলকান্তমণি আর শাদা রঙ, সব রকমের চুমকিবসানো পোশাক। উনি মহানন্দে গাছেদের আর আকাশকে নতুন করে রঙ করে দিতে পারতেন, এবং ঈশ্বর যদি গোপনে প্রকৃতির পরিকল্পনা ওনাকে জানাতেন, উনি হয়তো তার সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলতেন।
স্যামুয়েলের ভাবকল্পনা ছিল কলুষিত, আর হয়তো বিশেষ করে সেই কারণেই প্রেম তাঁর কাছে ইন্দ্রিয়পরায়ণতা কম ও যুক্তিযুক্ততা বেশি ছিল । তা ছিল, সবার ওপরে, সৌন্দর্যকে সমাদর, এবং তার জন্য বাসনা মেটাবার আকাঙ্খা ; উনি মনে করতেন প্রজনন হলো প্রেমের কলুষ, গর্ভাবস্হা হলো মাকড়সার ফাঁদ । উনি কোথাও লিখেছিলেন “দেবদূতরা উভলিঙ্গ এবং বন্ধ্যা ।”— মানবদেহকে উনি এমনভাবে ভালোবাসতেন যেন তা বস্তুর সামঞ্জস্য, চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এমন স্হাপত্যের উদাহরণ ; এবং এই চরম বস্তুবাদ, বিশুদ্ধ ভাবকল্পনা থেকে বেশি দূরত্বে ছিল না। কিন্তু, সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে, যা ভালোবাসার কারণ, তাতে ছিল, উনি বিশ্বাস করতেন, দুটি উপাদান : অঙ্গরেখা এবং প্রলোভন — এবং অঙ্গরেখা যতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ওনার কাছে প্রলোভন এই রাতে ছিল রুজ ।
সুন্দরী ফাঁফারলো অতএব ওনার কাছে অঙ্গরেখা ও প্রলোভন দুয়েরই প্রতিনিধি ছিলেন ; আর যখন, বেপরোয়া ও বিজয়িনী শান্ত প্রণয়িণী নিজের বিছানার ধারে বসে, স্যামুয়েলের গায়ে আলতো করে হাত রাখলেন, স্যামুয়েল ওনার দিকে চেয়ে দেখলেন, স্যামুয়েল যেন সৌন্দর্যময়ীর স্পষ্ট চোখের ভেতরে অনন্তকালকে দেখতে পাচ্ছিলেন, আর ওনার নিজের দুই চোখ মনে হয় ভেসে যাচ্ছিল বিশাল দিগন্তে ।
আর, অনেকসময়ে অসাধারণ পুরুষদের ক্ষেত্রে, তাঁরা স্বর্গোদ্যানে একাই থাকেন, তাঁদের সঙ্গে সেখানে কেউই বসবাসের যোগ্য হয় না ; এবং ঘটনাক্রমে যদি লোকটা জোর করে কাউকে ভেতরে টানার চেষ্টা করে, মহিলাটি সদাসর্বদা তাঁর একটু পেছনেই থাকবেন ; এবং যে স্বর্গে তিনি একা রাজত্ব করেছিলেন, তাঁর ভালোবাসা দুঃখে পরিণত হওয়া আরম্ভ করল,  আর সে নীল আকাশের বিষাদপূর্ণ চিন্তারোগে ভুতে পেলো, একজন নিঃসঙ্গ রাজার মতন ।
কিন্তু স্যামুয়েল কখনও নারীটিকে নিয়ে ক্লান্ত হননি, এবং একেবারেই নয়, যখন উনি প্রণয়িনীর গোপন বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, ভোরের ঠাণ্ডায় ফুটপাথে জোরে জোরে পা ফেলে, তখন ঠোঁটে চুরুট আর পকেটে হাত ঢুকিয়ে অহঙ্কারের আনন্দ উপলব্ধি করেছিলেন — যার বর্ণনা আমাদের বিখ্যাত আধুনিক ঔপন্যাসিক ( বালজাক )  কোথাও করে গেছেন ।
হৃদয়ের বদলে, স্যামুয়েলের ছিল এক অভিজাত বুদ্ধি, এবং অকৃতজ্ঞতার বদলে, ওনার আনন্দ উপভোগ ওনার মধ্যে জন্ম দিয়েছিল এক উপাদেয় আরাম, এক ধরণের কামনার ভাবাবেশ, যা সম্ভবত ভালোবাসার চেয়ে সূক্ষ্ম ব্যাপার, সাধারণ মানুষ যেমন ভালোবাসাকে মনে করে । তাঁর দিক থেকে, ফাঁফারলো সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলেন, বিশেষজ্ঞের আদর খরচ করেছিলেন স্যামুয়েলের জন্যে, কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই পুরুষটা অমন সেবা পাবার যোগ্য। স্যামুয়েলের ভাষার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলেন ফাঁফারলো, রহস্যমূলক অথচ অশুদ্ধ ও কাঁচা নোংরামি মাখানো কথাবার্তায়। ফাঁফারলোর জন্য অন্তত এগুলোতে ছিল নতুনত্বের আকর্ষণ।
নর্তকীর প্রেমে পড়ার ফল দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল ।  কয়েকটা অনুষ্ঠান রদ করতে হয়েছিল, কিছু মহড়ায় আবহেলা করছিলেন নর্তকী ; বহু পুরুষ ঈর্ষা করতে আরম্ভ করেছিল স্যামুয়েলকে।
এক রাতে, হয়তো ঘটনাচক্রে, মসিয়ঁ দে কোসমেলির অবসাদ, কিংবা তাঁর স্ত্রীর প্যাঁচালো ছলনা, দুজনকে একসঙ্গে তাপ পোয়াবার আগুনের পাশে এনেছিল—দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ থাকার পর, যা সংসারে ঘটে থাকে, যখন কারোর পরস্পরকে কোনো কথা বলার থাকে না, আর অনেককিছু লুকোবার থাকে —পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো চা মামুলি ফাটা টিপটে  মসিয়ঁকে দেবার পর, যে টিপট হয়তো মহিলার কাকিমার বাড়ির সময়কার — দশ বছর আগে প্রচলিত গান পিয়ানোর টুকরো-টাকরা বাজনায় মসিয়ঁকে শোনাবার পর — মহিলা মসিয়ঁকে বললেন, নৈতিক উৎকর্ষে মিষ্টি আর বিচক্ষণ কন্ঠস্বরে, যাতে তা সৌজন্যপূর্ণ মনে হয়, সেইসঙ্গে এই ভয়ে যে অনুরাগের উদ্দেশ্যকে চটিয়ে না ফ্যালেন—বললেন মসিয়ঁর জন্য তিনি অত্যন্ত দুঃখিত,  তিনি অনেক কেঁদেছেন, নিজের জন্য ততোটা নয় যতোটা মসিয়ঁর জন্য ; তিনি, তাঁর বশ্যতায় পুরোপুরি অনুরক্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন, আশা করেছিলেন যে অন্তত অন্য কোথাও মসিয়ঁ ভালোবাসা খুঁজে পাবেন, যা তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে আর চাইছেন না; নিজেকে পরিত্যক্ত পাওয়ার চেয়েও মসিয়ঁর প্রতি তাঁর প্রেমিকার বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি আরও বেশি যন্ত্রণা পেয়েছেন ; এটা নানান কারণে স্ত্রীর নিজের ভুল, যে তিনি প্রণয়ী স্ত্রীর দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে নিজের স্বামীকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেননি ;  এখন, তিনি রক্তাক্ত ঘা সারিয়ে তোলার জন্য তৈরি, এবং দুজনে যে ধৃষ্টতা করেছেন তার সম্পূর্ণ দোষ নিজের ওপর নিতে চান, ইত্যাদি—- এবং মধুমাখানো এই শব্দগুলোর পেছনে ছিল প্রেমের দ্বারা ওসকানো এক ষড়যন্ত্র । মহিলা ফোঁপালেন, আর তা বেশ ভালোভাবেই ; আগুন তাঁর চোখের জল আর মুখাবয়বকে আলোকিত করে তুলেছিল, সুন্দর করে তুলেছিল দুঃখের কারণে ।
মসিয়ঁ দে কসমেলি কোনো কথা না বলে উঠে চলে গেলেন ।  পুরুষরা নিজেদের ভুলের ফাঁদে পড়ে নিজেদের মনস্তাপকে ক্ষমাপ্রার্থনায় বড়ো একটা পালটে ফেলতে চায় না । যদি মসিয়ঁ ফাঁফারলোর বাসায় যেতেন, নিঃসন্দেহে আবিষ্কার করতেন বিশৃঙ্খলার অবশেষ, চুরুটের শেষ টুকরো, আর খবরের কাগজ ।
একদিন সকালে, ফাঁফারলোর অপমানকর কন্ঠস্বরে স্যামুয়েলের ঘুম ভাঙলো ; যে বালিশে ফাঁফারলো মাথা রেখেছিলেন সেই বালিশ থেকে পরিশ্রান্ত মাথা তুললেন স্যামুয়েল, ফাঁফারলো ওনাকে যে চিঠিটা দিলেন তা পড়ার জন্য : “ধন্যবাদ, মসিয়ঁ, হাজারবার ধন্যবাদ, আমার আনন্দ ও আমার কৃতজ্ঞতা এক সুন্দরতম জগতে আপনার খাতায় জমা পড়বে । আমি তা গ্রহণ করছি । আমি আমার স্বামীকে ফেরত নিয়ে যাচ্ছি, আপনার হাত থেকে, আজ রাতে আমি ওনাকে আমার সঙ্গে কোসমেলির জমিদারিতে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে আমি আমার স্বাস্হ্য আর আমার জীবন ফিরে পাবো, যার জন্য আমি আপনার কাছে ঋণী । গ্রহণ করুন, মসিয়ঁ, অনন্তকালীন বন্ধুত্বের জন্য আমার প্রতিশ্রুতি । আপনার সম্পর্কে আমি সদাসর্বদা এতো উচ্চধারণা পোষণ করি যে আমি জানি অন্য কোনো রকমের পরিশোধের পরিবর্তে আপনি এই বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দেবেন।”
স্যামুয়েল, লেসবসানো চাদরের ওপরে হাতপা ছড়িয়ে, কল্পনাযোগ্য শীতলতম ও সুন্দরতম কাঁধে হেলান দিয়ে, অস্পষ্টভাবে মনে করলেন, আর কিছুটা কষ্ট করে স্মৃতিতে জড়ো করতে চাইলেন, ষড়যন্ত্রের উপাদানগুলো,  যা উনি পরিণতির দিকে নিয়ে এসেছেন ; কিন্তু স্যামুয়েল শান্ত গলায় বিড়বিড় করে বললেন, “আমাদের প্রণয় কি সত্যিই আন্তরিক ? কেই বা নিশ্চিত করে বলতে পারে যে সে ঠিক কী চায়, আর নিজের হৃদয়ের ব্যারোমিটারকে যথাযথ পড়তে পারে ?”
“তুমি কি বলছ ? তোমার কাছে ওতে কি লেখা আছে ? আমাকে দেখতে দাও,” ফাঁফারলো বললেন।
“ও কিছু নয়,” স্যামুয়েল জবাব দিলেন ।  “এক শ্রদ্ধেয় মহিলার কাছ থেকে একটা চিঠি, এমন একজন যাঁকে আমি কথা দিয়েছিলুম যে তোমাকে আমার প্রণয়ের পাত্রী করে ফেলবো।”
“তোমাকে তার দাম দিতে হবে,” জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন ফাঁফারলো।
একথা বোধহয় সত্য যে ফাঁফারলো ভালোবাসতেন স্যামুয়েলকে, কিন্তু তা অন্যের হৃদয়ের কাছে অজানা ভালোবাসা, এমন ভালোবাসা যার গভীরতম এলাকায় ছিল তিক্ততা । স্যামুয়েলের কথা বলতে গেলে, ওনার শাস্তি খাপ খেয়ে গিয়েছিল ওনার অপরাধের সঙ্গে । স্যামুয়েল অনেক সময়ে কামপ্রণয়ের অভিনয় করতেন ; ওনাকে তা করতে বাধ্য করা হয়েছিল ; কিন্তু তা শ্রদ্ধেয় তরুণীদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ স্বচ্ছ, শান্ত, তীব্র প্রেম ছিল না, বরং এক ভয়ঙ্কর প্রেম,  নিরানন্দ ও লজ্জাজনক, রাজনর্তকীদের অসুস্হ প্রেম । ঈর্ষার যাবতীয় অত্যাচারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন স্যামুয়েল, আর সেই অপকৃষ্ট দুঃখদুর্দশা যার মধ্যে আমাদের ছুঁড়ে ফেলে দেয় চিকিৎসার অসাধ্য এক অপরিহার্য অসুখ — সংক্ষেপে, যে পঙ্কিল বিয়েকে আমরা বলি উপপত্নীগ্রহণ তার সমস্ত আতঙ্ক ভোগ করছিলেন স্যামুয়েল ।—আর ফাঁফারলোর কথা বলতে হলে, তিনি প্রতিদিন সতেজ আর মোটা হতে লাগলেন ; তিনি হয়ে উঠলেন বলিষ্ঠ সুন্দরী, চকচকে ত্বক এবং ছলনাময়ী, অনেকটা সান্ত্বনাদায়িকা পথচারিনীর মতন । কিছুদিন পরেই উনি ইসটারের আগের চল্লিশদিনের উপোস করবেন, আর নিজের গির্জার এলাকায় দান বিলোবেন । আর তারপর, হয়তো, স্যামুয়েল, প্রায় মৃত, একটা বাক্সে তাঁকে পেরেক পুঁতে রাখা হবে, নিজের ভালোদিনগুলোয় উনি যেমন বলতেন, আর ফাঁফারলো, খ্রিস্টের সেবিকার মতন আদল-আদরায়, কোনো যুবক মালিকের মাথা ঘোরাবেন।— ইতিমধ্যে, ফাঁফারলো জেনে গেছেন কেমন করে বাচ্চা পয়দা করতে হয় ; উনি মহানন্দে দুটি যমজ বাচ্চার জন্ম দিলেন। — স্যামুয়েল চারটি বিজ্ঞানের বইয়ের বাবা হলেন : তার একটি চারজন খ্রিস্টের সুসমাচার লেখকদের একজনকে নিয়ে– আরেকটি রঙের প্রতীকত্ব নিয়ে — অন্য আরেকটি বিজ্ঞাপনের নব্যপ্রণালী নিয়ে — আর চতুর্থের নাম আমি মনেও আনতে চাই না। শেষ বইটি সম্পর্কে ভয়ের ব্যাপার হলো যে তাতে ছিল প্রচুর কর্মপ্রেরণা ও তেজ, এবং ঠাশা কৌতূহল । স্যামুয়েলের এমন দুঃসাহস,  যে বইটার মলাটে উৎকীর্ণ ছিল, “সোনার অভিশপ্ত লোভী”!
—ফাঁফারলো চাইছিলেন যে তাঁর প্রেমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হোন, আর পাঁয়তাড়া কষে বিভাগীয় মন্ত্রীকে রাজি করাতে চাইছিলেন যাতে স্যামুয়েলকে সন্মানের ক্রুশ পুরস্কার দেয়া হয় ।
বেচারা ওসপ্রেসের কবি ! বেচারা ম্যানুয়েলা দে মঁতেভেরদে ! — অনেক নীচে নেমে গেছেন।– আমি সম্প্রতি শুনেছি উনি একটা সমাজবাদী পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছেন আর রাজনীতিতে ঢুকতে চান। — এক ইতর মনের মানুষ ! দার্শনিক মসিয়ঁ নিসার্ড যেমন বলেছেন !

No comments:

Post a Comment