Thursday, July 4, 2019

মলয় রায়চৌধুরীর কাব্যনাট্য : যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের

মলয় রায়চৌধুরীর কাব্যনাট্য :যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের   

                                           
                
পাত্রপাত্রী :
১. কাশ্যপ ফিকির ; বৃদ্ধ : শবের বাগানের কেয়ারটেকার । ২. বদ্যিনাথ ; যুবক : কাশ্যপ ফিকিরের ছেলে । ৩.বিভূতিসুন্দর ; প্রৌঢ় : ষষ্ঠ শতকের সম্রাট হর্ষবর্ধনের গুপ্তচর । ৪. দেবযানী :  আঠারো শতকের যুবতী । ৫. চিনু হাঁসদা ; প্রৌঢ় ; নীলচাষি : ১৮৬০ এর বিদ্রোহে নিহত । ৬. হাঁদু লস্কর ; যুবা ; নীলচাষি : ১৮৬০ এর বিদ্রোহে নিহত। ৭. পাঁচটি শেয়াল ; ২১ শতকের রাজনৈতিক দলচারী । ৮. তিনটি শুয়োর ; ১২ শতকের রাজদরবারের কর্মী। ৯. খুনির দল ; বর্তমান যুগের ভাড়াটে গুণ্ডা ।

মঞ্চদৃশ্য :
[ বিঠোফেনকৃত ওড টু জয় সঙ্গীতে
ছেয়ে আছে পরিদৃশ্য শবের বাগান ।
গাছপালা ঝোপঝাড়ে ঘেরা অন্ধকার
গোরস্তান । লোপাটের জন্য নির্ধারিত
এটি ; শাসকের দ্বারা যারা কুচিহ্ণিত
এবং যাদের মেরে ফ্যালা হয়েছিল
আর সেই সাথে এ-হুকুম ছিল, এরা
মাটির তলায় জ্যান্ত লাশ হয়ে পোঁতা
থাক চিরকাল ; টিকে থাক অবহেলা
ভুগে । শশাঙ্কের দিনকাল থেকে এই
গোরস্তান দেখাশোনা করছে ফিকির
বংশের প্রথম ছেলে পরম্পরা মেনে ।
হয়তো সম্রাট অশোকের হত্যাকৃত
ভাইরাও আছে এই শবের বাগানে ।
এখন যে কেয়ারটেকার তার নাম
কাশ্যপ ফিকির । সন্ধ্যা হতে ভোর ওব্দি
দেখাশোনা কোরে বাড়ি ফেরে সূর্যোদয়ে ।
আজ তার সাথে যুবা ছেলে বদ্যিনাথ
এসেছে বাবার কাছে । কজন মানুষ
প্রতিরাতে কবরের পাথরটা তুলে
কেমন বেরিয়ে আসে দেখতে চাইছে ।
প্রতিটি কবরে আছে নামের ফলক ;
পালি ব্রাহ্মি নাগরি বাংলায় নাম লেখা ।
যুগ অনুযায়ী গোরেতে গ্রাফিতি আঁকা । ]

কাশ্যপ ।।
কাল ঝড় হয়ে গেছে অথচ বৃষ্টির
দেখা নেই ; যতই বা পরিষ্কার করি
চির-গোরস্তান ; সত্যি চিরকেলে এই
মড়াদের জমায়েত মাটির তলায় ;
অনেকে বিভ্রম ছাড়া দিব্বি বেঁচে থাকে ।
শসাঙ্ক রাজার দিনকাল থেকে বা তারও
আগে থেকে বেঁচে আছে লোপাটের লাশ ;
শুনেছে কি কেউ অন্য সমাজে বা দেশে
মরার পরও জলচল চলবে না
এরকম রীতি ? শুধুই এ পোড়ামুখো
লোকগুলোদের তৈরি সমাজে রয়েছে ;
এদেশ শাসন করে কাকতাড়ুয়ারা ।
কত ঝড় বয়ে গেল কত রাজা এলো
আর চলে গেলো, অথচ এ-গোরস্তানে
বেঁচে আছে সেইসব মানুষেরা যারা
অকারণে মরে যেতে বাধ্য হয়েছিল ;
মহারাজ অশোকের ভাইয়েরা আছে–
কেবল মৃতের থাকে বিভ্রমী বাস্তব ।

বদ্যিনাথ ।।
মৃত্যু তো কারোর বাসি স্মৃতির ছত্রাক ;
আমার মস্তিষ্কে কেন একজন নারী
বারবার মৃত্যুর ওপার থেকে ডাকে,
সে কোন রহস্যময়ী আছে এইখানে
যে আমার শরীরের গন্ধে জেগে ওঠে ?

কাশ্যপ ।।
কী ভাবে মরণ এলো সেটা জীবিতের
বাঁচার সমস্যা ; মরার সময়ে ওটা
অবান্তর প্রশ্ন বলে আমি মনে করি;
জন্মাবার মতো মৃত্যুর পথেও ভিড়।

বদ্যিনাথ ।।
কিন্তু বাবা ছোটোবেলা থেকে গোরস্তানে
দেখছি চাকরি করে রোজগার করো,
এখানে না এলে তোমার মনটা কষ্ট
পায় বলে প্রতিরাতে ঝড়বৃষ্টি অনাছিস্টি
যা-ই হোক আসা চাই দেখি ; কী যে কাজ
তাও তো বুঝি না, শুধু পরিষ্কার রাখা,
কতটুকু সময় বা লাগে, বড়োজোর
এক থেকে দেঢ় ঘন্টা, তবু সারারাত
কাটাও এখানে ! কারা এরা ? মরে বেঁচে
রয়েছে তোমার চোখে, এদের আত্মীয়
ধারেকাছে আসে না এখানে কোনোদিন ?
হয়তো এখানে পাবো স্বপ্নে-দেখা নারী
যে আমার পপতিতি প্রশ্বাসে উচ্চারিত ।

কাশ্যপ ।।
ঘৃণাকে অর্জন সকলের কম্মো নয় ।
গুণ্ডা-লেঠেলরা শাসকের কথা মেনে
গুমখুন করে লাশ পুঁতেছে এখানে ;
এদের বাড়ির লোক কাঁদেনিকো তবু ।
পাতালে রয়েছে জেনে চুপ মেরে গেছে ।
লাশেদের চিনি আমি, দাদুর সময়
থেকে দেখছি এদের, তবে দূর থেকে,
আড়ালে নিজেকে ঢেকে । দেখবি কেমন
এক-এক করে কেউ-কেউ বের হবে
আর নিজেদের মধ্যে কইবে কত যে
কথা, তার ঠিক নেই । তার আগে আয়
তাড়িতে ভিজিয়ে রুটি আর মাংস খাই ।
মাটির তলায় গিয়ে সকলেই বাংলা
কথা বলে, ঠিক যেন আজকের লোক ।
পোঁদে বাঁশ না খেলে সত্য অজানা থাকে
একমাত্র মড়ারাই জানে মরে গেলে ।
[ কাঁধের তাড়ির হাঁড়ি ঘাসের ওপর
রেখে, বাপ আর ছেলে তাড়িতে চুবিয়ে
এক মনে রুটি খায় । এত গাছপালা,
চাঁদের রুপালি আলো ঢুকতে চায় না ।
রাত ঘন হলে গাছের আড়ালে গিয়ে
বসে দুইজনে । বহুক্ষণ চুপচাপ ।
একটি কবর থেকে হর্ষবর্ধনের
চর, বিভূতিসুন্দর , শশাঙ্কের বিষে
মরেছিল, বেরোয় জরির মেরজাই
পরে, আর আড়মোড়া ভাঙে । আরেকটি
কবরের চাপা তুলে বেরোয় সুন্দরী
প্রাক-আধুনিকা, শরীরে সেকেলে শাড়ি,
কোমর পর্যন্ত চুল ; রাজধর্ষণের
পর, সামন্ত-চামচাদের গতি-করা । ]

কাশ্যপ ।।
লোকটার নাম নাকি বিভূতিসুন্দর,
গুপ্তচর ছিল রাজা হর্ষবর্ধনের ।
মেয়েতাকে দেখছিস, নাম দেবযানী,
কোনো এক প্রেমিকের জন্য বসে থাকে ।
ওই দ্যাখ বেরোলো দুজন জাতচাষি,
নীলকর সায়েবরা দে-মার দে-মার
দিয়ে, সপরিবারে পুঁতেছে থ্যাঁতা লাশ ।
আওয়াজ করিসনি যেন একেবারে
নয়তো সবাই এরা ধোঁয়ার কুণ্ডলী
হয়ে ঢুকে যাবে যে-যার চিহ্ণিত গোরে ;
চুপচাপ শোন, মৃত্যু কেমন মজার,
শুনে আটখানা হবি এদের কথায় ;
শবের সমস্যা হল তার গান নেই ।

বিভূতিসুন্দর ।।
কি গো দেবকন্যা, এখনো কি দেহজুড়ে
মর্ষকামী শাকসের দুর্গন্ধ রয়েছে
তোর দেহে ? জানলুম শশাঙ্কের দেশ
দুরাচারী মিথ্যাচারী অসাধু মানুষে
ছেয়ে গেছে, কয়েক শতাব্দী কেটে গেল
আরো অবনতি হয়েই চলেছে দেখি ।
বেড়ে গেছে হায়নাগুলোর অত্যাচার ;
গরিবের সংখ্যা দেখি বেড়েই চলেছে,
অথচ হামবড়াই শুনি বিপ্লবের–
গোরের ভেতরে শুয়ে, বড়-বড় কথা
রাজনেতাদের কন্ঠে, কী যে আহামরি,
চিৎকার চেঁচামেচি কুচুটে শ্লোগানে ।
একদা অশোক নাকি অহিংসার বাণী
লিখেছিল কুঁদে-কুঁদে পাথরে-শিলায়,
সে-সব লোপাট হয়ে যাদিঘরে রাখা ।
তারপর, তোর কথা বল । কই তোর
যুবা সে-পুরুষ এলো না তো আজকেও !

দেবযানী ।।
প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি পথ চেয়ে ;
কিছুই যায় না ভোলা । হত্যাকারীদের
স্মৃতিগন্ধ দেহ থেকে যাবে না কখনো ।
কর্তা যায় কর্তা আসে, ভ্রষ্টগণ থাকে
এদেশি সমাজে, চেহারা বদল করে,
কেননা খুনিরা ছাড়া চলে না শাসন ;
নাঋই হয়ে নারী থাকা সবচে কঠিন
আজকের দিনে ; বহু নারী গোরস্তানে
এনে পুঁতে দিচ্ছে শাসকের পেয়াদারা ;
কোনোই বদল তো এদেশে দেখছি না ;
গর্ধভেরা চিরকাল শাসক হয়েছে ।       
  
নীলচাষি চিনু হাঁসদা ।।
নীলচাষ হয়নাকো আর শুনি বটে
কেবল হত্যার চাষ হয় আজকাল ;
সবচে উত্তম শিল্প শবকে সাজানো ।
ফোঁপানি-মাখানো গান ভেসে-ভেসে আসে
কবরের নিরিবিলি শান্তিভঙ্গ কোরে ।
মরেও নিস্তার নেই এই পোড়া দেশে ।
দেবযানী তোমার প্রেমিক এলোনা তো ?

নীলচাষি হাঁদু লস্কর ।।
শাসকের মোসাহেব নিকৃষ্ট লোকেরা
শাসকের দিকে যারা তারা জল্লাদের
দিকে থাকে, তাছাড়া উপায়-পথ নেই ।
যে যুদ্ধ গোষণা করে সে নিজে মরে না ।
দেবযানী তোমার পুরুষ এলোনা তো ?

কাশ্যপ ।।
ওই দ্যাখ তিনটে শুয়োর বের হল,
কুকাজ করেছিল রাজার আমলে
তাই হুকুম-বরদারের গনগনে
লোহার শাবল পেটে নিয়ে মরেছিল ।
আসলে তখন ওরা শুয়োর ছিল না ;
কবরের মধ্যে ঢুকে শুয়োর হয়েছে
জানিনাকো কোন জাদুমন্তরের বলে !
এ এক আজব মাটি ; কখনো শুয়োর
পায় মানুষের রূপ, আবার কখনো
মানুষেরা শুয়োরের মাথা পেয়ে যায় ।

বদ্যিনাথ ।।
আমরা কুমাংস খাচ্চি হবে না তো কিছু ?

কাশ্যপ ।।
কুকাজ কুকথা বলে আর কিছু নেই,
গণিত-বর্জিত দেশে বৃত্ত গোল নয়–
তথ্য বলে কিছু নেই, শুধুই ঘটনা;
এখন তো যা ইচ্ছে খাবার দিনকাল
যা ইচ্ছে করার বলবার পচাযুগ,
কয়েকটা লাশ আসে প্রতিদিন গোরে
যেকানে জায়গা পাই ঠুসে দিই মড়া
আদিতে যারই নাম কবরে থাকুক
তাছাড়া উপায় নেই, বড্ডো স্হানাভাব;
দিনের বেলায় তাই বোবা সেজে থাকি ।

বদ্যিনাথ ।।
তোমার তুলনা নেই, বাপ বটে তুমি ।
দেবযানী নামে ওই যুবতিকে দেবে ?
লাস তো তোমার কেয়ারে চিরকাল ।
একবার ভালোবাসা যথেষ্টের বেশি ;
আমার নামটা ওর মুখের ভেতরে
ফেলে, দেখবো কী হয় শবে মেয়েটির !
আমি যে আমিই তার প্রমাণ তো পাবো ।
মনে হয় বহুযুগ ওই নারীটির
অপেক্ষায়, কাটিয়ে এসেছি আজ এই
শবতীর্থে ; এখানে মিলব দুইজনে ।
হয়তো আমিই ওর প্রেমিক ছিলুম !

কাশ্যপ ।।
মাথামুণ্ডু নেই তোর ভাবনা-চিন্তার ।
কেউই বাস্তব নয়, অন্য জগতের ।
এলাকার মানুষেরা এটাকে নরক
বলে মনে কোরে আড়চোখে চলে যায় ;
আমাকেও ভুত ভাবে, দেখেছিস নিজে ।
অবাস্তব ও জগতে কেবল মড়ারা
বেঁচে থাকে । তুই তো বাস্তবে রয়েছিস ।
তোর চেয়ে তিনশত বছরের বড়ো ।
ভালোবাসা হয়নাকো আঘাতবিহীন,
রক্ত না ঝরলে প্রেম অসম্পূর্ণ থাকে ;
মেয়েটি কুমারী নয় বলে রাখি তোকে ।

বদ্যিনাথ।।
বাস্তব জগতে আছি আধপেটা খেয়ে,
বেকার যুবক আমি । তুমি মরে গেলে
এ-চাকরি পাবো , যা আমার ভাল্লাগে না ।
ওই মেয়েটিকে বড়ো ভালো লেগে গেছে
ওকেই বিবাহ করে বাড়ি নিয়ে যাব,
নয়তো সংসার পাতি ওরই কবরে
ঢুকে, থেকে যাব চিরকাল ওর সাথে ।
যাকে তুমি ভালোবাসো আর যে তোমাকে
ভালোবাসে, জানি তারা সতত পৃথক ।
কী হবে কৌমার্য নিয়ে ? চাই তো প্রেমিকা !

কাশ্যপ ।।
বিপথে হারিয়ে গেলে ছুটে যেতে হবে ।
যদি প্রত্যাখ্যাত হোস নষ্ট হয়ে যাবি ।

বদ্যিনাথ ।।
বিপথে না গেলে রাস্তা খোঁজা অসম্ভব ।
প্রেম নিবেদন কোরে প্রত্যাখ্যাত হবো ।

কাশ্যপ ।।
দরবারি দলচারী দেবে তোকে জেলে ।

বদ্যিনাথ।।
পালাবো সেকান থেকে । কয়েদিরা জানে
জেল মাত্রে পলায়নকারীদের স্বর্গ ।
প্রেমিককে বেঁধে রাখা জেনি অসম্ভব ।

কাশ্যপ ।।
মেবেতি বিধর্মী হতে পারে বলে রাখি ।

বদ্যিনাথ।।
নারীর হয় না ধর্ম । ওটা পুরুষেরা
নিজেদের জননাঙ্গ ঘিরে বানিয়েছে ।
তাছাড়া মৃত্যুর কোনো ধর্মাধর্ম নেই ।
প্রেমেরও কোনো ধর্মাধর্ম হয়নাকো ।
মৃতদেহ দেখে কে বোঝে কী গল্প ছিল ?

কাশ্যপ ।।
সৌন্দর্য দুর্বল করে । বেশ ক্ষতিকর ।

বদ্যিনাথ ।।
ভালোবাসা পেয়ে নারী সুন্দরী হয়েছে ।

কাশ্যপ ।।
সৌন্দর্য যে সন্ত্রাস তা জানিস কি তুই ?

বদ্যিনাথ ।।
সৌন্দর্য মাংসে নেই । অনপনেয় তবু ;
সুন্দরীর ভালো-মন্দ বলে কিছু নেই ।।
ওকে ভালোবেসে আমি মরে যেতে পারি ।

কাশ্যপ ।।
তাড়ি টেনে মগজের মধ্যে তোর যম
ডাকছে বোধয় । যা চাই তা কর গিয়ে,
কেয়ারটেকারি বংশ ধুচবে অন্তত,
অন্য লোকেদের পাপে ভুগতে হবে না ;
হতে পারে তোরই অপেক্ষা করে আছে
আবেগকে খেয়ে ফেলা সবচেয়ে ভালো ।
মৃতেরা যৌনতা হীন মনে থাকে যেন ।

বদ্যিনাথ ।।
যৌনতা কী বস্তু ? উঁচুনিচু মাপজোক
প্রতিরাতে পা ছড়িয়ে মিনিট কয়েক
প্রেম কি পায়ের ফাঁকে মিনিট পনেরো
মাংসে-মাংসে তরলতা আদান-প্রদান ?
[ একটি কবর থেকে পাঁচটা শেয়াল
পতাকা উঁচিয়ে বের হয়ে চিৎকার
ধ্বনিতে জানায়, “গোরস্তান মুর্দাবাদ ;
নয়তো মানুষজন্ম ফিরে দিতে হবে,
চাকুরি-বঞ্চিত হয়ে আর থাকব না ।”
তাদের চেঁচানি শুনে অন্যেরা কবরে
ঢুকে পড়ে তাড়াতাড়ি । নিঃশব্দ কবরে
বাজে বব ডিলানের ‘ব্লাড অন ট্র্যাক্স’ ।
শুয়োরেরা শেয়ালেরা গোরে ঢুকে যায় । ]

কাশ্যপ ।।
ওরা সব রাজনীতি-করিয়ের ঝাঁক,
জানিনাকো কোন দলে ছিল, রোজ দেখি
আজকে এ-চেঁচানি, কালকে অন্য কথা ।
আজকে শেয়াল বটে কাল হবে কাক
তারপর দেখা দেবে হায়েনার রূপে
অথবা হয়তো হবে বুড়োটে শকুন ।
এদেশে প্রেমের আর স্হান নেই কোনো ।

বদ্যিনাথ ।।
যারা রাজনীতি করে প্রেমিক হয় না ।
পাগল উন্মাদ যত নচ্ছার বজ্জাত
ব্যাটারা মরেও পালটায়নি দেখছি,
এদেরই জন্যে দেশ রসাতলে গেল ।
নীল শেয়ালেতে আজ ছেয়ে গেছে দেশ ।
নীল শেয়ালেরা লাল রঙে পালটায়
অথবা সবুজ রঙ নিয়ে শাসকের
সিংহাসন ঘিরে ল্যাজ দুবেলা নাড়ায় ।
কেন যে এদের রক্তে ভালোবাসা নেই ;
শবেদের ওব্দি এরা কলুষে মুড়েছে ।
তাই তো চাইছি ওই সুন্দরীর পায়ে
পড়ে বলি, ‘নিন না আমাকে, আপনার
নাম লেখা গোরে দুজনে বাঁধব জুটি
স্বর্গ-নরকের ; আমি এই নরকের
নর, আপনি স্বর্গের লাশরূপী হুরি ।

কাশ্যপ ।।
তার চেয়ে তুই চেষ্টা কর যাতে মেয়ে
জ্যান্ত হয়ে ফিরে আসে আমাদের মাঝে ;
লাশ থেকে নারী হয়ে স্বর্গ হতে নামে ।
কী করে সম্ভব হবে তা জানি না, তবু
প্রয়াস করতে ক্ষতি নেই ; একজন
মানুষীকে বাঁচার সুযোগ করে দেয়া
যাবে, হলেই বা দেশটা মরার পথে
এগিয়ে চলেছে, তার মধ্যে বেঁচে নেয়া,
যতটুকু সুখ মেলে নরকে থেকেও ।
[ আবার কবর থেকে বের হয় হাঁদু,
চিনু চাষি, বিভূতিসুন্দর, দেবযানী । ]

বিভূতিসুন্দর ।।
সাহসিনী নারী, প্রতিশোধ নিতে হবে
তোমাকে আমাকে, গুমখুনে মৃত যারা
কাটাচ্ছি সময় এই মাটির তলায় ।
ভিন্নরূপে মানব-সমাজে যেতে হবে ।
হয়তো তোমার প্রেমিককে পেয়ে যাবে ।

চাষি হাঁদু লস্কর ।।
কিন্তু সায়েবসুবোরা চলে গেছে শুনি
নিজেদের দেশে গিয়ে খাবার জোটে না
লুটের উপায় পালটে যুদ্ধ লড়ে মরে ।
সত্যি কি প্রেমিক আছে মানব-সংসারে ?

চাষি চিনু হাঁসদা ।।
উপায় পাল্টায় শুধু । ভবিরা ভোলে না ।
প্রতিশোধ নিতে হলে শত্রু পেতে হবে
না্লে মাস্তানি ঢঙে করো খুনোখুনি
আত্মীয়-স্বজনদের কচুকাটা করো ।
তার চেয়ে ভালো গোরে আরামে কাটাও ।
মনে হয় প্রেমিকেরা পৃথিবীতে নেই ।

চাষি হাঁদু লস্কর ।।
গন্ধ পাচ্ছি মনে হল কীরকম যেন
কুমাংস খাবার, হাড় চেবানোর শব্দ ।
জীবিতেরা রক্তমজ্জা চুষে দেশটাকে
ওঠালো বোধয় লাটে, তার শব্দ পাই ।

দেবযানী ।।
মাংস নয়, জীবিত মানুষ কেউ আছে
কাছেপিঠে, তারই শ্বাসের সুরাভাস
থেকে মোদো মরদের গন্ধ ছড়িয়েছে ;
তবে তারা হত্যাকারী নয় মনে করি
কেননা খুনির ঘাম-গন্ধ আমি চিনি ।

বিভূতিসুন্দর ।।
তা্লে কি গন্ধ পাল্টাপাল্টি হয়ে গেছে
জীবন-মৃত্যুর ? গোরস্তানে জীবিতেরা !
সমাজের মাঝে মরা লাশগুলো আজ !

চাষি হাঁদু লস্কর ।।
আমাদের কালে কোনো সমাজ ছিল না ;
মোড়লেরা ছিল, হয়তো এখনো আছে
তাদের মোড়ুলি, ভিন্ন চেহারায় সেজে ;
পোশাক তো দেখি আর সেরকম নেই;
কবরে ঢুকেও বকবক থামেনাকো ।

বিভূতিসুন্দর ।।
হয়তো তোমার কথা ঠিক । প্রতিদিন
যারা আসে, অশ্লীল পোশাক পরে ঢোকে ।
হয়তো সেজন্য তারা শুয়োর শেয়াল
হয়ে রূপ বদলায় মাটির তলায় ।

চাষি চিনু হাঁসদা ।।
আমার তো মনে হয় গুমখুন করা
বলে, শবাচার ঘটেনিকো, তাই ওরা
অমন পোশাক পরে গোরে গিয়ে ঢোকে ।
কিন্তু জীবিতে গন্ধ আছে কাছেপিঠে,
সেই গন্ধ কবরের বুড়োটার নয়,
যে-বুড়োটা প্রতিরাতে ঝাড়পোঁছ করে ।

দেবযানী ।।
আমিও তোমার সঙ্গে একমত । তার
দেহ গতানুগতিক শ্রমে ভিজে থাকে ।
এ-গন্ধ পুরুষ্টু যুবকের তা নিশ্চিত
বলে দিতে পারি; ভয় করে এই গন্ধ ।
এই গন্ধ আমার প্রেমিক প্রতিরাতে
নিজের ঘর্মাক্ত দেহে আনতো লুকিয়ে ।
আমাদের দুজনকে কোটালের চর
খুঁজে বের কোরে, আমাকে ধর্ষণ আর
আমার যুবক প্রেমিককে খুন কোরে
তার দেহ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভাসিয়েছে
রূপনারাণের স্রোতে বহু যুগ আগে ।

কাশ্যপ ।।
ওফ ! অবিস্মরণীয় দুর্ঘটনা ! আমি তোকে
রূপনারাণের তীরে কুড়িয়ে পেয়েছি
বদ্যিনাথ । ওরে আমি অপৌরুষ লোক,
বংশলিপ হয়ে যাবে ভেবে নদী থেকে
তোকে তুলে এনেছি আমার পরিবারে ;
বিবাহ করিনি তাই তোর মুখ চেয়ে ।
যা নারীকে আনতুম সে তো চলে যেতো
জেনে আমি অপৌরুষ বীর্যথলিহীন ।
যা তুই, চলে যা, শবরূপী প্রেমিকার
কাছে, মুক্তি পাক অন্ধকার দেহ থেকে ।
নিয়ার ফেরত ওকে পৃথিবীর ঘামে,
সংগ্রাম সংঘর্ষে ঘেরা জর্জরিত দেশে ।
অন্তত মৃত্যুর চেয়ে শ্রেয় বেঁচে থাকা
জগতের কুবাতাসে নোংরা দ্বন্দ্ব দ্বেষে ।

বদ্যিনাথ ।।
তুমি যদি বীর্যহীন, গণিকার ঘরে
যাও কেন ? কী করো তাদের বাড়ি গিয়ে ?

কাশ্যপ ।।
যন্ত্রণা সংঘর্ষ পরাজয় মেনে নিতে
জীবিতের শরীরের তাপ পেতে যাই ।
নাঋ-সঙ্গমের জন্য যাই না সেখানে ।
নারীটির বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকি,
জানিস কখন ? হা-হা, দিবা দ্বিপ্রহরে
পা গুটিয়ে শিশুর মতন, দুধহীন
গণিকার স্তন থেকে স্নেহসুধা খাই ।
এবার সমাপ্তি চাই এই জীবনের ।
শব-সমাজের থেকে মুক্তি পেতে চাই ।
তুই যা নিয়ায় গিয়ে মেয়েটিকে ঘরে
বা২চিয়ে আনতে যদি পারা যায় ভালো ;
অন্তত একটি প্রাণী ফিরবে জীবনে
নতুবা এদেশ যাবে শবের কবরে ।
ওর গর্ভ ধেকে যদি নতুন মানুষ
জন্ম নেয়, তাহলে বাঁচাবে দেশটাকে ।
নতুবা কবরে ঢুকে আত্মহত্যা কর ;
হরপ্পা-হরফে লেখ মৃত্যু চিরকুট,
মৃত্যুর বয়ান মৃত ভাষাতেই ভালো ।

বদ্যিনাথ ।।
তাই সই, আত্মহত্যা করি, মেয়েতির
পায়ে সঁপে এ-জীবন যা প্রেমে বঞ্চিত ;
উন্মাদ কবিত্ব থাকে মৃত্যুর হৃদয়ে,
জানি না কী হবে তার ফল ; দেবযানী
যদি প্রত্যাখ্যান করে তবু মেনে নেবো ।
কিছুই নিশ্চিত নয়, না জন্ম, না মৃত্যু,
পঁচাত্তর বচরের বুড়োর দুঠোঁট
দেখে, কেউ বোঝে কি সে খেয়েছিল চুমু ?
[ বদ্যিনাথ ছুটে গিয়ে মেবেতির দেহ
দুহাতে জড়িয়ে ধরে । ফলে হতবাক
দেবযানী ছাড়া অন্যান্য সবাই নিজ
আদল পালটে ফেলে ধোঁয়ার কুন্ডলি
হয়ে যা যার কবরে ঢুকে যায় । মৃদু
‘ব্লাড অন ট্র্যাক্স’-এর স্হানে বেজে চলে
বিঠোফেনকৃত ‘ওড টু জয়’ সঙ্গীত । ]

দেবযানী ।।
জানতুম একদিন আসবেই তুমি,
আমার প্রেমের ডাকে ফিরে । আছো
এখানেই আমি জানতে পারছিলুম
তোমার দেহের সেই পরিচিত গন্ধে ।
মনে আছে ? সেই সন্ধ্যা ? রূপনারাণের
তীরে ? আদান-প্রদান করতুম ছোঁয়া ?
বালির ওপরে শুয়ে বিকেলের প্রেম ?

বদ্যিনাথ ।।
ভালোবাসি, ব্যাস এতটুকু আমি জানি
তিনশ বছর ধরে তাই হেথা-সেথা
খুঁজেছি তোমায় দেবযানী প্রিয়তমা ।
যদি বলো তোমার কবরে বাসা বাঁধি
দুইজনে ; নতুবা আমার সঙ্গে চলো
মাটির কুটিরে গিয়ে সংসার পাতি ।

দেবযানী ।।
কত কথা বলা বাকি আছে বদ্যিনাথ
তিনশ বছর একা ভাবতে কি পারো
স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে অপেক্ষায় আমি
চুপচাপ শুয়ে আছি আলিঙ্গনহীন
পুরুষের ছোঁয়া ও আদরহীন দেহে ?

বদ্যিনাথ ।।
জানি সব জানি আমি যুবতি আমার
তাইতো এসেছি নিয়ে যেতে কুঁড়েঘরে
বাঁধব দুজনে বাসা স্বপ্নের সংসার ।
[ বদ্যিনাথ চুমু খায় উন্মদের ঢঙে
ক্রমশ শাড়ির পাক খুলে চুমু খায়
দেহের সর্বত্র যা অপেক্ষা করে ছিল । ]

দেবযানী ।।
যে-সঙ্গম অসম্পূর্ণ ছিল, এসো আজ
তাকে পরিপূর্ণ করি প্রিয় বদ্যিনাথ ।
[ দেবযানী-বদ্যিনাথ ঘাসে আলিঙ্গনে
পরস্পর মগ্ন যখন, ওদের ঘিরে
ফ্যালে জনাকয় লেঠেল-মাস্তান-খুনি । ]

খুনির দল ।।
মার-মার মেরে ফ্যাল মেরে ফ্যাল মার
মেরে ফ্যাল মার-মার মেরে ফ্যাল মার
মার-মার মার-মার মেরে ফ্যাল মার ।
[ তারা কেউ কবরের ডালা খুলে
আবার কেউবা নিকটের গ্রাম থেকে
একযোগে মর্ত্য-পাতালের লোক মিলে
ছোরাছুরি তরোয়াল নিয়ে আক্রমণ
করে ; প্রেমিক ও প্রেমিকার ছিন্নভিন্ন
দেহ ঘাসের ওপরে ফেলে অট্টহাস্যে
গাছে-বসা পাখিদের ওড়ায় আকাশে ।
অর্ধেক কবরে ঢোকে বাদবাকি লোক
নাচতে-নাচতে অন্ধকারে মিসে যায় ।
পুনরায় শোনা যায় ‘ব্লাড অন ট্র্যাক্স’ ।
কাশ্যপ দাঁড়ায় গিয়ে সদ্য খুন-করা
ছেলে আর যুবতীর শবের নিকটে । ]

কাশ্যপ ।।
সঙ্গম করার কালে মৃত্যুর মতন
স্বর্গীয় সুষমা নেই, তাও গোরস্তানে ।
নেশা কোরে সত্য বলেছিল বদ্যিনাথ :
মৃত্যুর হৃদয়ে থাকে উন্মাদ প্রেমিক ।
[ ভোর হয়ে আসে আর মৃদু বাজনায়
শোনা যায় পুনরায় বিঠোফেনকৃত
‘ওড টু জয়’ । প্রেমিক-প্রেমিকার দেহ
ধোঁয়ার নীলাভ আলো হয়ে উড়ে যায় । ]

No comments:

Post a Comment