Thursday, July 4, 2019

মলয় রায়চৌধুরী : জিঙ্গোইজমের নরক হয়ে উঠছে ভারত



“জরা মুল্ককে রাহবরোঁকো বুলাও
ইয়ে কুচে ইয়ে গলিয়াঁ ইয়ে মঞ্জর দিখাও
জিনহে নাজ হ্যায় হিন্দ পর উনকো লাও
জিনহে নাজ হ্যায় হিন্দ পর ওয়হ কহাঁ হ্যাঁয়
কহাঁ হ্যাঁয় কহাঁ হ্যাঁয় কহাঁ হ্যাঁয়”
                                 সাহির লুধিয়ানভি

ভারতে তো বটেই, পৃথিবীর বহু দেশে  কিছু মানুষ স্বদেশ, কৌম, ধর্ম, ভাষা, জাত, এথনিসিটি, জাতীয়তা, ভূখণ্ড সংক্রান্ত তাদের মারকুটে মতামত অন্যান্য মানুষের ওপর  জোর জবরদস্তি চাপিয়ে দিতে চাইছে, যার দরুন সমাজে ও রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ভয়ংকর অশান্তি দেখা দিয়েছে, পারস্পরিক সম্পর্কে চিড় ধরা আরম্ভ হয়েছে, এমনকি মারামারি, খুনোখুনি, এলাকা থেকে তাড়ানো, রাহাজানি, ধর্ষণ, নারীদখল, বোমা মেরে বহুমানুষকে হত্যা, শহর ধ্বংস ইত্যাদি রোজকার ব্যাপার হয়ে উঠেছে। ভারতে ‘রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদীরা’, যাঁরা স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করছেন তাঁদের কন্ঠরুদ্ধ করে দিচ্ছে, সুযোগ পেলে হত্যা করে, যেমন করা হয়েছে নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গি ও গৌরী লঙ্কেশের ক্ষেত্রে ; যারা খুন করছে তারা ধরা পড়ছে না । হত্যাকারীরা সংলাপ, আলোচনা, সমঝোতা, বোঝাপড়ার পথে যেতে চায় না ; বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা তাদের কাম্য নয়, তাদের পথ বলপ্রয়োগের, হানাহানির, তার কারণ তারা বেশিরভাগই দক্ষিণপন্হী  দলের অশিক্ষিত হ্যাঙার্স অন, হাফ-লিটারেট রাজনীতিকদের পোষ্য, প্রশাসনের ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত, হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞানগম্যি নেই। বস্তুত তাদের কাণ্ড-কারখানা দেখে মনে হয় হিন্দুদের বহুত্ববাদী ধর্মকে তারা অ্যাব্রাহামিক করে তুলতে চাইছে ।

এর আগেও বহু দেশে এথনিক ক্লিনজিং নাম দিয়ে ভিন্ন জাত বা ধর্ম বা কৌম, বা ভাষার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যেমন তুর্কির অটোমানদের দ্বারা লক্ষ-লক্ষ আরমেনিয়দের হত্যা, আমেরিকায় ১৯১৯ সালে রেড সামার আফ্রিকানদের হত্যা, হিটলারের জার্মানিতে এবং স্তালিনের সোভিয়েত রাশিয়ায় ইহুদিনিধন, যুগোস্লাভিয়ার সেব্রেনিৎসায় মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছে পরিকল্পনা করে ; টুটসি আর হুটুরা নিজেরা লড়ে কতোজনকে মেরে ফেলেছে তার ইয়ত্তা নেই, ধর্মের ভিত্তিতে খুনোখুনি করে সুদান ভাগাভাগি হয়ে গেছে, বর্মায় রোহিঞ্জিয়া মুসলমানদের এলাকাছাড়া করা হয়েছে, হচ্ছে। সিংহলি ভাষা তামিলদের ওপর চাপিয়ে দেবার প্রতিক্রিয়ায় তিরিশ বছর ধরে শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধে অজস্র মানুষ মারা গেছে, ভারত তার ফয়সালা করতে গিয়ে নিজেদের সৈন্যদের সেই তামিলদের গুলির মুখে ঠেলে দিয়েছিল, তারপর একজন প্রধানমন্ত্রীকে সেই তামিলরাই মানব বোমায় ছিন্নভিন্ন করেছে । স্পেনে ক্যাটালোনিয়া অঞ্চলের মানুষ চাইছে স্পেন থেকে পৃথক হয়ে যেতে, কেননা স্পেনে তাদের ভাষা আর সংস্কৃতি বিপন্ন বলে মনে করে তারা ; ভারতের মতন প্রতিটি অঞ্চলের ভাষা আর সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দিলে শ্রীলংকায় যা ঘটেছিল আর স্পেনে যা ঘটছে তা ঘটত না । পারস্পরিক খুনোখুনির উদ্দেশে আফগানিস্তান, কোলোমবিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, কঙ্গো, ইরাক, মালি, মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, ফিলিপিনস, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন প্রভৃতি দেশে বালকের সৈন্যবাহিনি গড়া হয়েছে ।

ধর্মের ভিত্তিতে ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল, কেননা জিন্না ও অন্যান্য মুসলিম লিগ নেতা মনে করতেন যে হিন্দু আর মুসলমান দুটি পৃথক ‘নেশান’ । তারপর পাকিস্তান ভাষার ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত হলো, দুটো নেশনের জন্ম হলো। এখন পাকিস্তানে বালোচ আর পাঞ্জাবিরা লড়ছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ইত্যাদি দেশে  সুন্নিরা কুর্দ, ইয়াজিদি, শিয়াদের সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধ করছে । সুফিসন্তদের সমাধিগুলো বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে । পশ্চিমবাংলায় ফকিরদের ( মুসলমান বাউল ) গ্রামের মুসলমান সমাজ থেকে, এমনকি গ্রাম থেকে, বের করে দেয়া হচ্ছে, তার কারণ ফকিররা শরিয়ত মানেন না, মসজিদে নামাজ পড়তে যান না, দেহতত্বে বিশ্বাস করেন, গান গেয়ে বেড়ান । মুসলমান সমাজে তাঁরা The Other.

দেশপ্রেম, ধর্মপ্রেম, জাতিপ্রেম, শ্রেনিপ্রেম, কৌমপ্রেম এখন সম্পূর্ণ প্রথক চেহারা নিয়ে দেখা দিয়েছে ; বস্তুত সন্দেহ হয় যে আলোকপ্রাপ্তির প্রভাব শেষ পর্যন্ত পৃথিবীকে কি অন্ধকারপ্রাপ্তির দিকে টেনে নিয়ে গেল ! ‘ওরা-আমরা’ বিভাজনটা যেন হঠাৎ আরও তীব্রভাবে চাগিয়ে উঠেছে ; ‘ওরা’ বলতে কারা, তাও  জোর করে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে। বাচ্চাদের হাতে রাইফেল ধরিয়ে বলা হচ্ছে ‘ওরা’দের জবাই করতে । পৃথিবীজুড়ে ব্যক্তিমানুষের মগজে এই ব্যাপারটা নিয়ে যা ঘটছে তাকে জিঙ্গোবাদ বললে বুঝতে সুবিধা হয় । এই জিঙ্গোবাদের দরুন আরেকজন মানুষ বা মানুষের দল শান্তিতে থাকতে পারছে না, তাতে জিঙ্গোবাদীদের কিছু যায় আসে না । তারা নিজের বা নিজেদের সিদ্ধান্ত বা মতামতকে সবার ওপরে স্হান দিতে চায় ।

আমার শৈশব কেটেছে অন্ত্যজ বিহারি ও অত্যন্ত গরিব মুসলমান অধ্যুষিত পাটনার ইমলিতলা পাড়ায় । দেশভাগের আগে বিভিন্ন জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলেও, আমাদের ইমলিতলা পাড়ায় হয়নি, বস্তুত টের পাওয়া যায়নি যে ধর্মের ভিত্তিতে হানাহানি চলছে বিভিন্ন গ্রামে আর শহরে, চোর-পুলিশ খেলার সময়ে যে-কোনো বাড়িতে, এমনকি পাড়ার মসজিদে গিয়েও লুকোনো যেতো।  ঠাকুমা উত্তরপাড়ায় থাকতেন, ওনারও দাঙ্গার কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়নি, কলকাতা থেকে পিসিমা-পিসেমশায় উত্তরপাড়ায় এসে ওনার কাছে আরঙ্কিত ঘটনা শুনিয়ে গিয়েছিলেন । ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন রায় সেমিনারিতে পড়ার সময়ে বাংলার শিক্ষক অধিকারীবাবু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই দেশাত্মবোধক কবিতাগুলো মুখস্হ করতে বলতেন, কিন্তু ভারতবর্ষ বা বঙ্গদেশকে ভালোবাসবার কোনো নির্দেশ তিনি কখনও দেননি বলে, কবিতাগুলো কেবল মুখস্হ করাতেই সীমিত থেকে গিয়েছিল, এমনকি ভারতবর্ষ ও বঙ্গদেশকে  নারী হিসাবে পূজনীয় করে তোলা হয়েছে, তার দিকেও তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি, তারা দুজন আলাদা নাকি একই নারী, তাও বলতে পারেননি । জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ তোলেননি ।

যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ
উঠিল বিশ্বে সে কী কলরব, সে কী মা ভক্তি, সে কী মা হর্ষ।
সেদিন তোমার প্রভাতে ধরায় প্রভাত হইল গভীর রাত্রি,
বন্দিল সবে জয় মা জননী, জগত্তারিণী, জগদ্ধাত্রী
ধন্য হইল ধরণী তোমার চরণকমল করিয়া স্পর্শ।
জননী, তোমার বক্ষে শান্তি, কণ্ঠে তোমার অভয় উক্তি,
হস্তে তোমার বিতর অন্ন, চরণে তোমার বিতর মুক্তি,
জননী! তোমার সন্তান তরে কত না বেদনা কত না হর্ষ,
জগৎপালিনি জগত্তারিণি! জগজ্জননী! ভারতবর্ষ।

বঙ্গ আমার জননী আমার
ধাত্রী আমার, আমার দেশ
কেন গো মা তোর শুষ্ক নয়ন?
কেন গো মা তোর রুক্ষ কেশ?
কেন গো মা তোর ধূলায় আসন?
কেন গো মা তোর মলিন বেশ?
শত কোটি সন্তান যার
ডাকে উপচে আমার দেশ।
কিসের দুঃখ, কিসের দৈন্য,
কিসের লজ্জা, কিসের ক্লেশ?
শত কোটি মিলিত কন্ঠে
ডাকে যখন আমার দেশ।।
উদিল যেখানে বৌদ্ধ আত্মা
মুক্ত করিতে মোক্ষ দ্বার,
আজিও জুড়িয়া অর্ধ জগৎ
ভক্তি প্রণতঃ চরণে যার।
অশোক যাহার কীর্তি ছায়িল
গান্ধার হতে জলধি শেষ
তুই কিনা মা গো তাদের জননী?
তুই কিনা মা গো তাদের দেশ।।
একদা যাহার বিজয় সেনানী
হেলায় লঙ্কা করিল জয়
একদা যাহার অর্ণবপোত
ভ্রমিল ভারত সাগরময়।
সন্তান যার ত্বিব্বততীর
জাপানে গঠিল উপনীদেশ
তার কি না ধুলায় আসন,
তার কি না এই চ্ছিন বেশ?
উদিল যেখানে মোরজ মন্ত্রে
নিমাই কন্ঠে মধুর ও তান
ন্যায়ের বিধান দিল রঘুমনি,
চন্ডীদাস ও গাইল গান
যুদ্ধ করিল প্রতাপাদিত্য
তুই কিনা সেই ধন্য দেশ,
ধন্য আমরা যদি এ শিরায়
রহে যদি তাদের রক্ত লেশ।।
যদিও মা তোর দিব্য আলোকে
ঘিরে আছে আজ আঁধার ঘোর
কেটে যাবে মেঘ নবীন গরিমা
মাতিবে আবার ললাটে তোর।
আমরা ঘুচাবো মা তোর কালিমা
মানুষ আমরা, নহি তো মেষ
দেবী আমার, সাধনা আমার
স্বর্গ আমার, আমার দেশ।।

এই কবিতাগুলোয়  দেশাত্মবোধকে ভূগোলের বাইরে এনে রক্তমাংসের দেবীর রূপ দেয়া হলো, যার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন হেনরি ডিরোজিও : My country ! In the days of the glory past, A beautious halo arched thy brow’. ফরাসি বিপ্লবের পর স্বদেশকে নারীরূপে উপস্হাপন করলো ফরাসী চিত্রকর আর ভাবুকরা ; ব্রিটেনও তাই করলো ‘রুল ব্রিটানিয়াকে’ নারীরূপ দিয়ে, পেছনে সিংহ, হাতে ত্রিশূল । বঙ্কিমচন্দ্র পেলেন মা হিসাবে দেশকে, এবং  ১৮৮২ সালে আনন্দমঠ উপন্যাসে মিশ্রভাষায় লিখলেন বন্দে মাতরম । শ্রীঅরবিন্দ বন্দে মাতরম গানটিকে বলেছিলেন ‘বঙ্গদেশের জাতীয় সঙ্গীত’ । লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে ১৯০৫ সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আঁকলেন ভারতমাতা, হিন্দুদের দেবী লক্ষ্মীকে বৈষ্ণবীর আঙ্গিকে । রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ ভারতবর্ষকে ভারতমাতার আখ্যা দেবার পর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতার স্হান নিয়েছে সিংহের ওপরে বসে থাকা, ডান হাতে অভয় ও বাঁ হাতে রক্তবর্ণ পতাকা-ধারিণী ভারত মাতা । হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতা এবং মুসলমানদের বঙ্গভঙ্গ সমর্থনের সময় থেকে বঙ্গসমাজে প্রচ্ছন্নভাবে একটি দীর্ঘস্হায়ী বিভাজন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল । পার্টিশানের দাঙ্গায় অনেকের মগজে গেড়ে বসে গেল জিঙ্গোবাদ । উল্লেখ্য যে জিন্না নিজে ও তাঁর মুসলিম লিগ ব্রিটিশ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে অংশ নেননি, যেমন নেননি ১৯২২ সালের পর থেকে ভি ডি সাভরকর ও হিন্দু মহাসভা । কম্যুনিস্ট পার্টি, স্তালিনের নির্দেশে, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশ নেয়নি ।

পাকিস্তান নামের নেশনকে প্রথমে মুসলমানদের চেতনায় গড়ে তুলতে হয়েছিল, হিন্দুদের দেশজ চেতনা থেকে ভিন্ন এক চেতনা হিসাবে । ইহুদিদের চেতনায় দুই হাজার বছরের বেশি নেশন ছিল, কিন্তু কোনো ভূখণ্ড ছিল না । ১৯৪৭ সালে তারা ইজরায়েল নামে একটি ভূখণ্ড পায় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ত্বকের ও ভাষার ইহুদি সেখানে একত্রিত হয়ে চেতনায় ঘুমন্ত নেশনটিকে গড়ে তোলে, তাতে ভারতীয় ইহুদিরাও গিয়ে যোগ দিয়েছে, হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে আর ইহুদি ভাষাকে প্রাণ দিয়েছে । আমেরিকাতেও পৃথিবীর বহু দেশ থেকে মানুষেরা গিয়ে জড়ো হয়েছে, মিশে গেছে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে, কিন্তু তা সত্ত্বেও, স্যামুয়েল হান্টিংটন যাকে বলেছেন White Anglo-Saxon Protestant Nation, আমেরিকা মোটামুটি তাই-ই থকে গেছে । ভারতবর্ষেও, রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, শক হুন পাঠান এবং আরও মানুষ এসেছে, আর এমনভাবে মিশেছে যে পার্থক্য করা কঠিন  । ভারতবর্ষ, সোভিয়েত রাষ্ট্র অথবা যুগোস্লাভিয়ার মতন পরস্পরবিরোধী সংস্কৃতি, ধর্ম আর জাতির ভূখণ্ড ছিল না ।

এই ভারতবর্ষ ও বঙ্গদেশ,  কবির চেতনায় গড়ে ওঠা ভারতবর্ষ এবং বঙ্গদেশ এবং তার প্রতি ভালোবাসাও একটি নবতর চেতনা । ভারতবর্ষ বহুকাল যাবত ছিল, ভুখণ্ড হিসাবে ছিল, সেই ভূখণ্ডের মানুষেরা বাইরে কোথায় কী ঘটছে তা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না, তাঁদের চেতনায় ভারতবর্ষ নামের ভূখন্ডটি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল বলে মনে হয় না  । বিষ্ণু পুরাণ, বায়ু পুরাণ, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এ ভারতবর্ষের উল্লেখ আছে । সেই ভারতবর্ষ ছিল আধ্যাত্মিক বোধের ভারতবর্ষ, যাকে গান্ধি বলেছেন ‘আধ্যাত্মিক জাতীয়তা’, যে বোধ থেকে সেই সময়ের মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছিল দক্ষিণের সেতুবন্ধ রামেশ্বরম, পূর্বের জগন্নাথ, উত্তরের হরিদ্বার এবং পশ্চিমের সোমনাথ, তারা নিজেদের হিন্দু নামের একটি একক ও নিরেট আধ্যাত্মিকতায় পরস্পরকে বেঁধে রাখতো কিনা তার নিশ্চয়তা নেই, যদিও চারটেই ছিল তীর্থক্ষেত্র ।

হিন্দু বা হিন্দুত্ববাদ নামে তখনকার ভূখণ্ডটিতে একটিমাত্র ধর্মও হয়তো ছিল না ; ছিল শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি বিভাজন । ১৯৯৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রথম হিন্দুত্ব ও হিন্দুত্ববাদকে পরিভাষা দিয়ে ব্যাপারটাকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করে । ১৯৯৫ সালে একটি রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, No meaning in the abstract can confine it to the narrow limits of religion alone, excluding the content of Indian culture and heritage. The term ‘Hindutwa’ is related more to the way of life of the people in the sub-continent. এই প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা মামলায়  বিচারপতি ভারুচা এবং বিচারপতি আহমদির দেয়া রায়ে এই বক্তব্যটির ওপর জোর দেয় : Hinduism is a tolerant faith. It is that tolerance that has enabled Islam, Christianity, Zorostrianism, Judaism, Buddhism, Jainism and Sikhism to find shelter and support upon this land. এই রায় সত্ত্বেও কিছু মানুষ, মূলত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ, বজরঙ্গ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, লাভ কমাণ্ডো, হিন্দু যুব সেনা, স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ ইত্যাদির সদস্যরা হিন্দুত্ববাদ নামে একটি একক ও নিরেট ধর্মের ওপর গুরুত্ব দিতে চায়, বহু দেবদেবী থেকে বেছে নিয়ে রামকে সেই একক ও নিরেট ধর্মের ছত্রপতি করে তুলতে চায় । ভারতে এখন যা ঘটছে তাকে ভারতীয় জনতা পার্টির পত্রিকা ‘অরগ্যানাইজার’-এর সম্পাদক আর. বালাশংকর বলেছেন ‘সাস্কৃতিক রেনেসঁস’।

প্রথমে ক্যাথলিক স্কুল আর পরে ব্রাহ্ম স্কুলে পড়েছিলুম ; সেখানেও জিঙ্গোবাদের পারস্পরিক বিভাজনের রেশ ছিল না । এখন ভারতবর্ষের জিঙ্গোবাদে বাঙালি হিন্দু আর শিখরা ততো আগ্রহী নয়, যতোটা অন্যান্য রাজ্যের নাগরিকরা, অথচ দেশভাগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সিন্ধি ও বাঙালি হিন্দু আর শিখরা । শিখরা খালিস্তানের দাবি নিয়ে অমৃতসরের হরমন্দির সাহেব মন্দিরে একত্রিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তা মূলত কংগ্রেসদলের ভুল রাজনৈতিক চালে, এবং তার প্রতিফল হলো ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যু । তারপর ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর বদলা নিতে কয়েক হাজার শিখকে দিল্লিতে মেরে ফেলা হলো । খালিস্তানের দাবি শিখদের নিয়ে গেছে মাদকের নেশায়, আর প্রতিটি গ্রাম ও শহরে মাদকের নেশায় মজে গেছে যুবক-যুবতীরা। হয়তো লালকৃষ্ণ আদবানির স্মৃতিতে চোদ্দোপুরুষের ভিটে থেকে উৎখাত হবার ঘা শুকোয়নি বলেই বাবরি মসজিদের ঘটনায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন । ভেঙে ফেলার আগের  বাবরি মসজিদ আমি দেখেছিলুম, একটা ঝোপের ভেতরে পরিত্যক্ত, লোকজন নেই, কেবল লাঠি পাশে রেখে একজন হোমগার্ড ঘুমোচ্ছিল, দিনভর ভক্তরা এসে পুজো দিয়ে গিয়েছিল বলেও মনে হয়নি । সেই মসজিদ নিয়েই আরম্ভ হয়ে গেল পারস্পরিক বিভাজন ; দাউদ ইব্রাহিমের মতন চোরাকারবারি ডনরাও ধার্মিক হয়ে উঠল আর মুম্বাইতে বোমা ফাটিয়ে কয়েকশো মানুষকে মেরে পাকিস্তানে পালালো, কেননা পাকিস্তানের চোখে ভারতবর্ষ হলো ‘ওরা’দের দেশ, ‘শত্রূ নেশন’ ।

‘ওরা-আমরা’ বিভাজন ভারতীয় সমাজে বেশ প্রাচীন, ওরা অর্থাৎ যারা ‘অপর’ বা ‘দি আদার’ । অরবিন্দ প্রধান সম্পাদিত ‘অপর : তত্ব ও তথ্য’ গ্রন্হে ‘আমাদের ভাষায় অপর’ প্রবন্ধে সুদক্ষিণা চট্টোপাধ্যায় প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য থেকে তথ্য সংগ্রহ করে  ‘অপর’ ভাবকল্পটির মর্মার্থ এইভাবে দিয়েছেন:
১. অন্য, ভিন্ন, ইতর, পৃথক ( ষড়বংশ্যা মনোবহপরে — মনুসংহিতা )
২. অধিক, তদ্ব্যতীত, দ্বিতীয় ( কৃতদারোহপরান দারান ভিক্ষিত্বা যোহধিগচ্ছতি — মনুসংহিতা )
৩. উত্তমভিন্ন, অর্থাৎ মধ্যম
৪. অর্বাচীন, অর্বাককালিক, পরবর্তিকালিক ( অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ — গীতা )
৫. বিজাতীয়, অন্যজাতীয়
৬. পশ্চিম, প্রতীচ্য ( পূর্বাপরৌ তোয়নিধি — কুমারসম্ভব )
৭. তদভিন্ন ( ভারতচন্দ্র )
৮. নিকৃষ্ট, অশ্রেষ্ঠ ( অপরেয়মিতস্তন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম — গীতা )
৯. অধর্ম ( নাহং বেদ পরস্তস্মিন নাপরং ন সমং বিভো — শ্রীমদ্ভাগবত )
১০. প্রতিকূল, বিরোধী
১১. বিপ্রকৃষ্ট, দূর
১২. অনুত্তম, অনুত্তর, অন্যাদৃশ
১৩. অন্যলোক, সাধারণ লোক

ওই একই গ্রন্হে ‘অপর : হেগেল, অস্তিবাদ ও উত্তরআধুনিকতা’ প্রবন্ধে প্রদীপ বসু লিখেছেন “মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা আজ সীমাহীন । যে আমাদের গোষ্ঠীভূক্ত নয়, যার ধর্ম আলাদা, যে জাতিতে ভিন্ন, যার ভাষা পৃথক, যার গাত্রবর্ণ স্বতন্ত্র, যার লিঙ্গ পরিচয় অন্যরকম, এককথায় যে আমার অপর, আমার বা আমাদের থেকে ভিন্ন, তাকে ধ্বংস করো । জাতিবিদ্বেষ, গণহত্যা, সংখ্যালঘুপীড়ন, বর্ণবৈষম্য, জাতিভেদ, লিঙ্গবৈষম্য, ভয়াবহ হিংসা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তাক্ত পৃথিবী । অপর সম্পর্কে অজ্ঞতা, ঔদাসীন্য ও বিদ্বেষ সর্বব্যাপী ।”

প্রদীপ বসু উপরোক্ত প্রসঙ্গে হেগেলের বক্তব্য আলোচনা করেছেন, “হেগেলের দর্শনে ‘অপর’ হল আত্ম ( self ) -এর বিরোধী । প্রথমে আত্মর নেতিকরণ হিসেবে এল অপর ( other  ) । হেগেল দুই চৈতন্যের মুখোমুখি এই সংঘাতকে বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘ফেনোমেনলজি অফ স্পিরিট’ গ্রন্হের ‘মাস্টার অ্যান্ড স্লেভ’ অধ্যায়ে । হেগেল দেখান অন্যের আত্মচৈতন্যের মধ্যেই কেবল কোনো আত্মচৈতন্য পরিতৃপ্ত হয় । আত্মচৈতন্য বা আত্মপরিচয় উদ্ভূত হতে পারে কেবল অন্যদের সাথে মুখোমুখি সংঘাতের মধ্যে দিয়ে । সুতরাং অপরের উপস্হিতি না থাকলে আত্মর ধারণা গড়ে উঠতে পারে না । হেগেল দেখালেন কীভাবে দুই আত্মচৈতন্য একে অন্যকে খারিজ করার জন্য সংগ্রাম করে, যাতে নিজেদের নিশ্চয়তা প্রমাণ করতে পারে । হেগেলের অপর ধারনায় মানুষ সব কিছুকেই আপন অধিকারে নিজের দখলে আনতে চায় । অবশেষে ওই বস্তু বা জীব বা মানুষটি তার নিজের হয়ে ওঠে । ওই বস্তু বা জীব বা মানুষটির আর কোনো নিজস্ব অস্তিত্ব থাকে না । ওই প্রাথমিক আকাঙ্খার মধ্যেই আত্মগোপন করে আছে একটি মৃত্যু-বাসনা ( ডেথ ড্রাইভ ) । এই হননের তাড়নাই তাকে তার আপন অস্তিত্বের যাত্রায় জাগিয়ে নিয়ে চলে — আরও অধিকার, আরও সাম্রাজ্য, আরও বিষয়।”

হেগেলের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে উত্তরআধুনিক ভাবুকদের বক্তব্য আলোচনা করতে গিয়ে প্রদীপ বসু ওই প্রবন্ধে লিখেছেন, “হেগেল অপরকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, উত্তরআধুনিক দার্শনিকরা তার তীব্র সমালোচনা করেছেন। একথা তাঁরা অনেকেই বলেছেন যে অপরের এই ধরণের নেতিকরণই বিংশ শতাব্দীর ভয়াবহ হত্যালীলাগুলিকে দার্শনিক ও ভাবাদর্শগত প্ররোচনা যুগিয়েছিল।” প্রশ্ন হল যে দার্শনিকরা তাঁদের দর্শন যেমনভাবেই উপস্হাপন করুন না কেন, একদল মানুষ বা নেশন বা কান্ট্রি কেনই বা আরেকদল মানুষ বা নেশন বা কান্ট্রিকে দর্শনের আশ্রয় নিয়ে ধ্বংস করতে চাইবে ? একদল মানুষ মানে যৌথ আত্মচৈতন্য বা সবাই মিলে নেশন বা কান্ট্রিকে ভালোবাসা । আমাদের দেশে ‘অপর’ ভাবকল্প তো অনেক কালের, কিন্তু আমরা তো প্রাগাধুনিক কালখণ্ডে দল বেঁধে অন্য বাইরের ভূখণ্ড আক্রমণ করতে যাইনি । যা করবার রাজা বা শাসক করত, রাজত্ব বাড়াবার জন্য, সাধারণ মানুষ সৈন্য হিসাবে রাজার দলে যোগ দিত । মোগলদের সৈন্যদলে ছিল তখনকার হিন্দুরা ; ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য দলে ছিল হিন্দু-মুসলমানরা ; ব্রিটিশ, ফরাসি, ওলন্দাজ, পর্তুগিজদের সৈন্যদলে ছিল তারা । তাহলে কী এমন হল যে একদল ভারতীয়রা একুশ শতকে পৌঁছে গ্রাম-গঞ্জ-শহরের আনাচে-কানাচে শত্রু খুঁজে বের করতে লাগল ?

আর এখন ভারতবর্ষে প্রেম নামের যুবক-যুবতীর সম্পর্কটাই নানাভাবে আক্রান্ত ; উনিশ শতকের মনীষীদের প্রয়াস মুছে যাচ্ছে, তার বদলে দেখা দিচ্ছে এক ভয়ংকর মানবজীব, দেশে-দেশে। ইরাকে আর আফগানিস্তানে ভিন্ন গোষ্ঠীর যুবতীদের নিলামে কিনে ছাগলদের মতন শেকল বেঁধে নিয়ে চলেছে বুড়োটে পুরুষ, এমন ছবি আমরা প্রায়ই দেখি । কলকাতায় ২০০৭ সালে রিজওয়ানুর রহমান নামে এক দরিদ্র ঘরের যুবকের প্রেমে পড়েছিল কোটিপতির মেয়ে প্রিয়াঙ্কা টোডি ; রিজওয়ানের ওপর কেবল টোডিদের নয়, কলকাতা পুলিশ প্রশাসনও চাপ দিয়ে মেয়েটিকে টোডিদের বাড়িতে ফেরত এনে যুবকটিকে এমন পর্যদুস্ত করেছিল যে তাকে রেল লাইনের ধারে মৃত পাওয়া গেল । তখন সিপিএমের রাজত্ব যারা আদর্শগতভাবে সংখ্যালঘু ও দরিদ্রের পক্ষে এবং নারীর অধিকারকে সমাজে প্রতিষ্ঠা দেবার বার্তা নিয়ে গদিতে বসেছিল । এই ঘটনার পরে-পরেই বাংলাদেশী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে কলকাতা থেকে উৎখাত করা হলো, কেননা কিছু ভারতীয় মোল্লা তসলিমার পশ্চিমবঙ্গে থাকার বিরোধিতা করেছিল । রাজনৈতিক গুণ্ডারা প্রশাসনের ছত্রছায়ায় নন্দিগ্রাম, সিঙ্গুর, বিরাটিতে গণধর্ষণ চালিয়েছিল । মালদা সীমান্তে আফিমচাষি আর নকল নোটের চোরাকারবারীরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে নিজেদের গা বাঁচাবার তরকিব করে ফেললে । এখন সারা ভারতবর্ষে নারীকে কোনঠাসা করে ফেলা হচ্ছে আর বলা হচ্ছে যে তাদের ইচ্ছানুযায়ী তারা চললে ‘ভারতীয়’ সংস্কৃতি দূষিত হবে।

২০১৩ সালে ষাটজন মানুষ, যার মধ্যে চল্লিশজন ছিলেন মুসলমান, জিঙ্গোবাদী দাঙ্গায় খুন হলেন উত্তরপপদেশের মুজফফরনগর আর শামলি জেলায় । চল্লিশ হাজার মুসলমান দাঙ্গা আক্রান্ত এলাকা ছেড়ে পালালো । জাট আর মুসলমানরা দেশভাগের দাঙ্গার সময়েও ওই এলাকায় শান্তি বজায় রেখেছিল । দাঙ্গার চার বছর পরেও তাদের পারস্পরিক অবিশ্বাস দূর হয়নি, যার দরুন এতোকালের অর্থনৈতিক বনেদ ভেঙে পড়েছে । চার বছর যাবত মিটমাটের প্রয়াস বিফল হয়েছে । এক পক্ষের মানুষ অন্য পক্ষের এলাকায় থাকতে রাজি নয় । যারা নিজেদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিল, তারা বাড়ি ফিরতে চায় না ।

দিল্লিতে ২০১৭ জানুয়ারি খুন হলো অঙ্কিত সাক্সেনা কেননা সে একটি মুসলমান যুবতীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল ; যুবতীটির বাড়ির লোকেরা অঙ্কিতকে ঘিরে কচুকাটা করে ফেলল, মেয়েটি এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে । একই সময়ে রাজস্হানের ভিলওয়াড়ায় এক জাট বিধবা মহিলার  মৃত্যু হলে তার শেষকৃত্যের জন্য জাঠরা বাধার সৃষ্টি করে, তার কারণ ওই মহিলা একজন দলিতকে বিয়ে করেছিলেন । মেয়েদের যে ‘মাল’ বলে অপমান করা হয় তা এইজন্য যে তারা সাংস্কৃতিকভাবে ও সামাজিকভাবে পরিবারের ও গোষ্ঠীর অস্হাবর সম্পত্তি । এর মূলে রয়েছে পুরুষের যৌথ-সন্ত্রাস সৃষ্টির ক্ষমতা । জাট-খাপদের নেতা নরেশ টিকায়েত সুপ্রিম কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে হুমকি দিয়ে বলেছে যে তাদের নির্দেশের বাইরে রাষ্ট্র যদি ব্যবস্হা নেয় তাহলে তারা কন্যাসন্তান পয়দা হতে দেবে না । যুবতীদের নিজের ভবিষ্যৎ নিজে নির্ণয় করাকে খাপের নেতারা বলছে ‘স্মার্টফোন-মোমো-জিনস সংস্কৃতি’। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পুরোনো দিনের প্রযুক্তিমূর্খ প্রবীণরা তাল রাখতে পারছে না । কন্যাভ্রুণ নষ্ট করায় জাটরাই এগিয়ে আছে, যৌনচাহিদা মেটাবার জন্য বাংলাদেশ থেকে পাচার করা যুবতীদের কিনে এনে বাড়ির পুরুষদের ‘বউ’ হিসাবে পোষা হচ্ছে । তাদের নির্দেশের বাইরে কেউ বিয়ে করলে তারা দুজনকেই হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। বর্ণিকা কুণ্ডু নামে একটি মেয়েকে চণ্ডিগড়ে জনৈক জাট রাজনীতিকের দুজন  ছেলে তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বর্ণিকা কুণ্ডুও জাট হবার কারণে নিজের গোষ্ঠীর সমর্থন পেয়ে যায় । পশ্চিমবঙ্গে একজন স্বামী যৌতুক পায়নি বলে স্ত্রীর কিডনি বিক্রি করে তা আদায় করেছে । রাজস্হানে জনৈক দলিত যুবক গোঁফ রেখেছিল বলে উচ্চবর্ণের যুবকরা তাকে পিটুনি দিয়ে তার গোঁফ কামিয়ে দেয় ।

ভ্যালেনটাইনস ডে পালনের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে নানা হিন্দুত্ববাদী রক্ষণশীল সংগঠন, বিশেষ করে হিন্দিভাষী এলাকায়। বজরঙ দল গড়ে তুলেছে ‘লাভ কমাণ্ডো’ যাদের কাজ হলো মুসলমান যুবক আর হিন্দু যুবতীদের চিহ্ণিত করা, যারা গোপনে সম্পর্ক গড়ে তুলছে, তারা এর নাম দিয়েছে ‘লাভ জিহাদ’, অর্থাৎ প্রেমের টোপ ফেলে হিন্দু যুবতীদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা । একে জিঙ্গোবাদী ফোবিয়া বলা যেতে পারে । এক ধর্মের মানুষকে আরেক ধর্মে ধর্মান্তরিত করার ঘটনার আতঙ্ক । বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতন, এই হিন্দুত্ববাদীদের দাবি হল যে মুসলমানের সংখ্যা বেড়ে গেলে তারা আবার একটা পৃথক পাকিস্তানের দাবি করবে, কেননা এমনিতেই তারা চারটে মেয়েকে বিয়ে করতে পারে । দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সুনীল কুমারের মতে, ব্যাপারটা অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করায় সীমিত নয়, তা দলিতের সঙ্গে উচ্চবর্ণের বিয়েকে মান্যতা দিতে চায় না, এবং তা হরিয়ানায় সীমাবদ্ধ নয়, তা দেখা যাবে অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, তামিলনাডু, কর্নাটক, পণ্ডিচেরি, গুজরাট, মহারষ্ট্রতেও । জাটদের যেমন রয়েছে খাপ, তেমনই রাজস্হান, অন্ধ্র, মধ্যপ্রদেশে রয়েছে সমাজ-পঞ্চায়েত। পশ্চিমবঙ্গে আছে সালিশি-সভা ।

মহারাষ্ট্রে স্কুলপাঠ্য ইতিহাসের বই থেকে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে যথাসম্ভব ছেঁটে ফেলে শিবাজীর বীরগাথাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে । ইতিহাস বইতে থাকলেই যে তা বালক-বালিকার মনকে প্রভাবিত করবে, তা মনে হয় না, কেননা আমরাও সেই ইতিহাস পড়েই  প্রকৃত ঘটনাগুলোকে যাচাই করে নিতে শিখেছি । ধর্মের সঙ্গে মিশেল দিয়ে জাতীয়তাবাদের একটা বিকল্প ন্যারেটিভ তৈরি করার চেষ্টা যে চলছে তা অনুমান করা যায় । একজন মন্ত্রী বললেন যে ডারউনের বিবর্তনের তত্বটায় বিশ্বাস করা উচিত হবে না । হরিয়ানার স্কুলে শিক্ষকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে ছাত্ররা গায়ত্রী মন্ত্র পড়ার পর যেন ক্লাস শুরু করে । মুসলমানরা এখন ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান দিতে চায় না, যদিও স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে দিত ; এই ব্যাপারটা নিয়েও কাজিয়া চলছে, তা মেটাবার চেষ্টা করেছিলেন সঙ্গীত নির্দেশক এ.আর.রহমান, তাঁর ‘মা তুঝে সালাম’ গানটির মাধ্যমে, কিন্তু তাকে দেওবন্দিরা পাত্তা দেয়নি। দেওবন্দিদের উৎপত্তি কিন্তু মহাবিদ্রোহের সময়ে বহাদুর শাহ জাফরের সমর্থনে ভারতেই ।

ভারতীয় মুসমানদের সমাজ সম্ভবত অন্যান্য ভারতীয় ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় বেশি পুরুষতান্ত্রিক । কোনো মুসলমান মেয়ে কোনো হিন্দু যুবককে বিয়ে করতে চাইলে সেই যুবককে ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়, জানিয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনেতা শেহলা রশিদ, যখন কিনা যে যার ধর্ম বজায় রেখে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী বিয়ে করতে পারেন, যে যার ইচ্ছামতো ধর্মাচরণ করতে পারেন । চিত্রাভিনেত্রী নার্গিসের মা ছিলেন ঠুংরি গায়িকা জদ্দনবাঈ, বাবা ছিলেন মোহিয়াল ব্রাহ্মণ উত্তমচাঁদ মোহনচাঁদ, বাবা হিন্দু হলেও নার্গিস নিজেকে মুসলমান মনে করতেন ; নার্গিস বিয়ে করেন মোহিয়াল ব্রাহ্মণ পরিবারের যুবক সুনীল দত্তকে, তাঁরা যে যার ধর্মাচরণ করতেন ; মৃত্যুর পর নার্গিসকে গোর দেয়া হয় মুম্বাইয়ের বড়া কবরিস্তানে, যদিও তাঁর বাবা ছিলেন ব্রাহ্মণ ; সুনীল দত্তের দেহ দাহ করা হয় হিন্দু মতে । দারা সিংহের ছেলে বিন্দু দারা সিংহ বিয়ে করেছিলেন তাবুর বোন ফারহাকে, এবং বিন্দু ও ফারহা যে যার ধর্ম পালন করতেন ; বিন্দু ফারহাকে ডিভোর্স দিয়ে একজন রুশ অর্থোডক্স চার্চে বিশ্বাসী যুবতীকে বিয়ে করেছেন এবং যে যার নিজের ধর্মাচরণ বজায় রেখেছেন । কিশোর কুমার বিয়ে করেছিলেন মধুবালাকে এবং ইসলামধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে গোর দেয়া হয়েছে তাঁদের পৈতৃক নিবাস খাণ্ডওয়ায় । তাঁদের বিয়ের সময়ে ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে কোনো হইচই করেনি হিন্দু সমাজ, যেমনটা করেছে কারিনা কাপুর আর সৈফ আলি খানের বিয়েতে কিংবা কেরালার হিন্দু যুবতী আখিলার সঙ্গে মুসলমান যুবক শেফিন জাহানের বিয়েতে, যা কেরালার উচ্চ আদালত নাকচ করে দিয়েছিল । স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে কেরালায় মুসমানরা এখনকার মতন উগ্র স্বভাবের ছিল না, যদিও কেরালার অধিকাংশ মুসলমান টিপু সুলতানের সময়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিল ; তারা আরব দেশগুলোয় চাকরি করতে গিয়ে ফিরে আসছে উগ্রতা নিয়ে। কেরালায় একজন খ্রিস্টান অধ্যাপকের তৈরি প্রশ্নপত্রের বিরোধিতা করেছে কয়েকজন মুসলমান যুবক, অধ্যাপকের দুই হাত কেটে ফেলে ।   সুমন চট্টোপাধ্যায় এক মুসলমান যুবতীকে বিয়ে করে কবীর সুমন হয়ে গিয়েছিলেন, তার সঠিক ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি ।

এই যে ‘লাভ জিহাদ’ নামের আতঙ্ক, একে বলা যেতে পারে Xenophobia বা না জানা মানুষের প্রতি ভীতি বা অজ্ঞাতব্যক্তিভীতি। অজ্ঞাতব্যক্তিভীতি  হল কোন বহিরাগত বা অপরিচিত মানুষের থেকে ভয় বা অবিশ্বাস। অজ্ঞাতব্যক্তিভীতির প্রভাব গোষ্ঠীর ভিতরের মানুষের,  গোষ্ঠীর বাইরের মানুষের ওপর বা বিষয়ে সম্বন্ধ, অনুভূতি ইত্যাদিতে দেখা যায়। নিজের পরিচয় হারানোর ভয়, কর্মকাণ্ডের ওপর সন্দেহ, উগ্রতা, এবং তার উপস্থিতি নাকচ করে আগে থেকে ধারণা করে নিয়ে পবিত্রতা রক্ষা ইত্যাদি এর অন্তর্গত। অজ্ঞাতব্যক্তিভীতিকে “অন্য সংস্কৃতির অসমালোচনামূলক উৎকর্ষ” হিসাবে দেখানো যায়, যেখানে কোনো একটি সংস্কৃতিকে “অবাস্তব, রূঢ়বদ্ধভাবে  বিদেশী” আখ্যা দেওয়া হয়।  অজ্ঞাতব্যক্তিভীতি এবং বর্ণবাদের (racism) ভেদ না বুঝে কখনো কখনো দুটি শব্দকে অন্যটির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। কারণ বহুক্ষেত্রে, একই রাষ্ট্রের লোক একই বর্ণ বা জাতির হয়। সেইজন্য, অজ্ঞাতব্যক্তিভীতিকে বহিরাগত সংস্কৃতির বিরোধ বলে মনে করে পৃথক করা হয়। আমাদের দেশে সমস্যা হল যে হিন্দুরা মুসলমানদের সম্পর্কে এবং মুসলমানরা হিন্দুদের সম্পর্কে, পরস্পরের ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশেষ খবর রাখেন না, তাঁরা পরস্পর অজ্ঞাত, একে অন্যের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেন না । একই ব্যাপার দলিত ও উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে  দেখা যায় ।

পশ্চিমবঙ্গে তিরিশ বছরের বামপন্হী প্রভাবে নিম্নবর্ণ আর উচ্চবর্ণের পারস্পরিক ঘৃণা ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম । হিন্দুত্ববাদী দেশভক্তিও পশ্চিমবঙ্গকে সেইভাবে কামড়ে ধরেনি যেমনটা উত্তর আর পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলোর  মানুষের মগজে ঘটেছে । তার কারণ সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের শাসক বামপন্হীরা সোভিয়েত দেশকে ভালোবাসতো ; সোভিয়েত দেশ চরিত্রহীন হবার পর চীনকে ভালোবাসতো ; চীন চরিত্রহীন হয়ে গেলে ভিয়েতনামকে ভালোবাসতো, ভিয়েতনাম চরিত্রহীন হলে পরে ভেনেজুয়েলাকে ভালোবাসতো, ভেনেজুয়েলা চরিত্রহীন হয়ে যাবার পর কিউবাকে ভালোবাসতো, কিউবা চরিত্রহীন হবার পর আলবানিয়াকে ভালোবাসতো । তারপর তো তারা নিজেরাই চরিত্রহীন হয়ে উঠলো আর গদি থেকে নির্বাসিত হলো । রুশরা যেমন রাশিয়াকে ভালোবাসে, চীনারা যেমন চীনকে ভালোবাসে, ভিয়েতনামিরা যেমন ভিয়েতনামকে ভালোবাসে,আমাদের দেশের বামপন্হীরা যদি তেমনকরে তাদের নিজের দেশকে ভালোবাসতো তাহলে এই যে জিঙ্গোবাদীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আর দেশকে ভালোবাসার নতুন পরিভাষা তৈরি করছে, তাকে সামাল দেয়া যেতে পারতো । ভারতের বামপন্হীদের আত্মধ্বংস কেবল তাদের নয়, সাধারণ মানুষেরও ক্ষতি করেছে, সামাজিক ভারসাম্য আক্রান্ত হয়েছে ।

Jingoism শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ পেলুম না । চেম্বার্স ডিকশানারিতে এর মানে দেয়া আছে ranting patriotism, overenthusiastic patriotism, agressive patriotism. প্যাট্রিয়ট শব্দের মানে দেয়া আছে someone who loves and serves their fatherland or country devotedly. প্যাট্রিয়ট শব্দটার উৎপত্তি ষোড়শ শতকের গ্রিসে, patriotes শব্দ থেকে, যার অর্থ স্বদেশবাসী । সংসদের অভিধানে জিঙ্গোইজম বা জিঙ্গোবাদের মানে দেয়া আছে bellicose patriot বা সংগ্রামপ্রিয় দেশপ্রেম । Patriot শব্দের মানে দেয়া আছে দেশভক্ত ; Patriotic শব্দের মানে স্বদেশভক্তিপূর্ণ, স্বদেশবাসীর হিতসাধক । সংসদ অভিধান জানাচ্ছে যে শব্দটির উৎস গ্রিক শব্দ patriotes যার অর্থ of one’s fathers. অভিধানগুলো কিন্তু জাতিয়তাবাদের কথা বলছে না, যদিও জিঙ্গোবাদের ভেতরে জাতীয়তাবাদ  দিব্বি লুকিয়ে আছে । সোভিয়েত রাষ্ট, আশা করা গিয়েছিল, জাতীয়তাবাদ থেকে মুক্তি পাবে, কিন্তু দেখা গেল সবায়ের মাথার ওপরে রুশভাষীরা উঠে বসে আছে, এবং তারাই যেন বিশুদ্ধ সাম্যবাদী । কমিউনিস্ট চীনের সময় থেকে হানভাষীরা সবায়ের মাথার ওপরে চেপে বসে গেছে, আর এখন তো চীন একটি প্রায়-সাম্রাজ্যবাদী দেশ । অবশ্য দেশ, দেশপ্রেম, প্রেম, কৌম, ধর্ম, এথনিসিটি, জাতীয়তার মতন নতুন সাম্রাজ্যবাদের জন্যও অভিধা দরকার ।

অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশানারিতে দেয়া আছে যে patriotism হল love of, or zealous devotion to one’s own country, মানে অন্যান্য দেশের চেয়ে নিজের দেশকে বেশি ভালোবাসা । ঘুরিয়ে বলতে হয়, অন্য দেশরাও আছে, কিন্তু তাদের ততো ভালোবাসা যাবে না, অর্থাৎ অন্য দেশ আমার দেশের তুলনায় নিম্নমানের । ওই অভিধানেই হোরেশিও স্মিথ-এর এই বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, patriotism is too often the hatred of other countries disguised as the love of one’s own. সম্ভবত ইহুদিদের নিজস্ব ‘ভূখণ্ড’ দাবির কাহিনির ভেতরে লুকিয়েছিল ‘দেশ. এবং ‘ওরা’-আমরা’ বিভাজন, কেননা তিনটি আব্রাহামিক ধর্মের উৎস ইহুদিদের লোহিত সাগর বিভাজন, ফ্যারাওয়ের ক্রিতদাসত্ব থেকে মুক্তি আর নিজেদের ভূখণ্ড বা ‘দেশ’ প্রতিষ্ঠা । ওই ভূখণ্ড ছিল নেশন অর্থাৎ ‘জাতি’র বা জাতীয়তা ধারণার বীজ । জাতি আর জাতিয়তার ভাবকল্প আমাদের ধারনায়  এনেছিল ইউরোপিয়রা । কিন্তু নেশন বলতে race বোঝায় না ।

কয়েকজনের কাছে জানতে চেয়েছিলুম, তাঁরা জিঙ্গোইজম বলতে কী বোঝেন । প্রিয়া সেনের মতে তা ‘সংগ্রামী দেশপ্রেম’ । মনীষ সিংহরায়ের মতে তা ‘উগ্র দেশপ্রেম । দেবর্ষী দাশের মতে তা ‘অন্ধদেশভক্তিবাদ’ । শাশ্বত সেনের মতে তা ‘উগ্র জাতীয়তাবা’দ । ঋজুরেখ চক্রবর্তীর মতে তা ‘স্বদেশোন্মত্ততা’ । ঋজুরেখ চক্রবর্তীর অভিধাটি সম্ভবত শব্দটিকে ব্যাখ্যা করে । নারী-পুরুষ প্রেমে পাগল হয়, আত্মধ্বংসের পথে যায়, কিন্তু তাকে কি উগ্রপ্রেম বলা যায়? দেশের জন্যও প্রেমকে উগ্র হতে হবে কেন ! তাছাড়া কাকেই বা দেশ বলা হয় ? কবে থেকে একটা ভূখণ্ডকে ব্যক্তিমানুষ ‘দেশ’ বলা আরম্ভ করেছে ? কান্ট্রি, নেশান, ন্যাশানালিজম, প্যাট্রিয়ট, প্যাট্রিয়টিজম? ভারতবর্ষ কবে থেকে আমাদের দেশ হয়ে উঠলো, কান্ট্রি, নেশান ?

বাবা উত্তরপাড়ার বাড়িকে বলতেন ‘দেশের বাড়ি’ । আড়াইশো বছরের পুরোনো বারোঘর-চার সিঁড়ির ওই বাড়ির খণ্ডহরটাই ছিল তাঁর দেশ ; তার বাইরে, তাঁর শশুরবাড়ি পানিহাটি, তাঁর মামার বাড়ি কলকাতা তাঁর কাছে দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পেতো বলে মনে হয় না । তাও, ঠাকুমা যতোদিন বেঁচে ছিলেন, ততোদিনই খণ্ডহরটা দেশের বাড়ি ছিল । ঠাকুমা মারা যাবার পর ওই খণ্ডহর সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ফুরিয়ে গিয়েছিল, আমরাও নিজেদের অংশ প্রোমোটারকে বিক্রি করে দিয়েছিলুম, এখন সেখানে আবাসন উঠেছে, যাঁরা সেখানের ফ্ল্যাটে থাকেন তাঁরা কেউই আমাদের পরিচিত নন । উত্তরপাড়ার বাড়িকে বাবা ভালোবাসতেন, কেননা সেখানে তাঁর মা থাকতেন । উত্তরপাড়ার জন্য তাঁর উগ্রপ্রেম ছিল না । ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পূর্ববঙ্গে ফেলে আসা তাঁর গ্রামের বাড়িকে বলতেন ‘দেশের বাড়ি’, সম্পূর্ণ পূর্ববঙ্গকে দেশ বলতেন না । ইমলিতলার বাড়িতে কাজের লোক শিউনন্দন যখন নিজের গ্রামে যেতো তখন বলতো ‘মুলুক-এ’ যাচ্ছে । সাহির লুধিয়ানভির কবিতাটাতেও মুল্ক-এর প্রসঙ্গ রয়েছে । শিউনন্দন মুলুক বলতে যা বোঝাতে চাইতো, সাহির লুধিয়ানভির মুল্ক তা থেকে আলাদা।

ন্যাশানালিজম বা জাতীয়তা,  যার বিস্ফোরণ আচমকা সমাজের ওপরতলা থেকে নিচেতলায় পৌঁছে গেছে, তা এদেশে এনেছিল ব্রিটিশরা । একটি বিশেষ ভূখণ্ড, যে ভূখণ্ডের লোকেরা সবাই একই ভাষায় কথা বলে, যাদের সবায়ের ধর্ম এক, এবং যে দেশটি আরেকটি দেশকে শত্রু হিসাবে চিহ্ণিত করে নিয়েছে , সেইটিই হল নেশন । রোমের ক্যাথলিক দাপট থেকে আলাদা হয়ে ব্রিটেন প্রটেস্ট্যাণ্ট দেশ হবার পর তারা ইউরোপে ক্যাথলিক ফ্রান্সকে খুঁজে পেয়েছিল শত্রু হিসাবে। একই ব্যাপার ঘটেছিল ফ্রান্সে, সেদেশে প্রটেস্ট্যান্টদের আর ইহুদিদের সন্দেহ করা হতো । আরেকটি দেশকে ঘৃণা করা হল জাতীয়তাবোধ ও  দেশভক্তির বনেদ । জিন্নার পাকিস্তান উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল যাতে ভারত দুই দিকে দুটো শত্রুদেশ পায়, অথচ পাকিস্তানে কেউই উর্দুভাষী ছিল না, ভারত থেকে সেদেশে আশ্রয় নেয়া উদ্বাস্তুদের ভাষা ছিল উর্দু, অর্থাৎ গুজরাতিভাষী জিন্নার মতন ‘মোহাজিরদের’ ভাষা, মুশররফের ভাষা । তাছাড়া পাকিস্তানে বাঙালিদের সংখ্যা সেদেশের অন্যান্য ভাষাভাষীদের চেয়ে বেশি ছিল, সেই তর্কে বাংলা সেদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা হওয়া উচিত ছিল ।

পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত তা করতে পারেনি বটে কিন্তু ভারতকে শত্রূ চিহ্ণিত করে, সেদেশে মুসলমান সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীদের মদত দিয়ে, মুম্বাইতে একদল সন্ত্রাসবাদীকে পাঠিয়ে তাজ হোটেল আর মুম্বাইয়ের বিভিন্ন জায়গায় জনসাধারণের ওপর গুলি চালিয়ে মারার পরিকল্পনা তৈরি করে,  ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের জন্ম দিতে সফল হয়েছে, যারা আগে থাকতেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের উদ্যোক্তা এম. এস. গোলওয়লকরের ‘বাঞ্চ অফ থটস’ গ্রন্হে নির্দেশিত ঘরের শত্রু তিন বিভীষণকে দেগে রেখেছিল — মুসলমান, খ্রিস্টান আর কম্যুনিস্ট । রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদীরা নিজের দেশেই শত্রুদেশের ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের খুঁচিয়ে তো বের করছেই, সেই সঙ্গে খ্রিস্টধর্মীদের জীবনও অতিষ্ঠ করে তুলেছে, একজন অস্ট্রেলিয় যাযককে তারা পুড়িয়ে মেরেছিল । শত্রুর ধর্মাবলম্বীরা গরুর মাংস খায়, সুতরাং গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করো, যারা লুকিয়ে খাচ্ছে তাদের বিষয়ে খবর পেলেই ঠেঙিয়ে খুন করো ।

ভারতীয় সংবিধানে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠা করার কোনো সুযোগ নেই ; ভারতের মানুষ নানা ভাষায় কথা বলে, তারা নানা ধর্মে বিশ্বাস করে, নানা দেবী-দেবতা বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে,  অথবা একেবারেই করে না, তাদের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা স্বীকৃত, তাদের পোশাকও যে যার মতো করে পরে, খাওয়া-দাওয়া ভিন্ন । দেশটা বহুত্ববাদী, তাকে একক নিরেট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা করে তোলা যাবে না । আমেরিকা নিজেদের ধাঁচের গণতন্ত্র ইরাক, লিবিয়া আর সিরিয়ায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সেই দেশগুলোকে ভাজা পাঁপড় চুরোর মতন ধ্বংস করে ফেলেছে । আমেরিকাকে সব সময় বিশ্বে শত্রু খুঁজে বেড়াতে হয় । সৈন্য পেতে তাদের দেশে অসুবিধা হয় না, কেননা অশিক্ষিতদর সংখ্যা সেদেশে তুলনামূলকভাবে বেশি। ব্রিটেন যেমন ন্যাশানালিজম রপ্তানি করেছিল, আমেরিকা তেমনভাবে জিঙ্গোবাদ রপ্তানি করে চলেছে । ১৮৮১ সালে ‘জেন্টলম্যানস ম্যাগাজিন’ লিখেছিল, “the jingo is the aggregation of the bully. An individual may be a bully; but in order to create Jingoism, there must be a crowd.” আওরঙ্গজেব ছিলেন Bully, এবং হিন্দুদের তিনি কাফের বলে মনে করতেন, ‘ধিম্মি’ নয় ; খ্রিস্টান আর ইহুদিরা ছিল ধিম্মি । হিন্দুত্ববাদীরা আওরেঙ্গজেবের হিন্দুবিরোধী কাজকারবার, যেমন কাশির বিশ্বনাথ মন্দির আর মথুরার কৃষ্ণ মন্দির ভেঙে সেখানে মসজিদ স্হাপন ইত্যাদি,  প্রচার করার মাধ্যমে শত্রুপক্ষের আচরণের ওপর আলো ফেলতে চাইছে । এই হিন্দুত্ববাদ হলো উনিশ শতকের ইউরোপের রাজনৈতিক ভাবনার সঙ্গে পনেরো শতকের তুর্কি, পারস্য, ইরাক আর মিশরের রাজনৈতিক ভাবনার খিচুড়ি ।

খৃষ্টপূর্ব ৫০০ সালে গৌতম বুদ্ধের সময়ে ভারতবর্ষ নামের ভূখণ্ডের প্রতি ভালোবাসার কাহিনি শোনা যায় না ; বুদ্ধ তো এসেছিলেন বর্তমান নেপাল থেকে, সেই ভূখণ্ডটিও পৃথক চেতনার জাগরণ গড়ে তোলেনি বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যদের চেতনায় । হিউএন সাঙ সপ্তম শতকে যখন এই ভূখণ্ডে এসেছিলেন তখন লক্ষ্য করেছিলেন যে এখানকার অধিবাসীরা বাইরের জগতের সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর রাখে না । হয়তো সেকারণেই পালি ও সংস্কৃত ভাষায় গ্রিস ও চীনের অধিবাসীদের উল্লেখ নেই ; ভূখণ্ডটির  প্রতি ভালোবাসা নিয়ে সংস্কৃত সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য কাব্য নেই । ‘মহাভারত’ মহাকাব্যের পঞ্চপাণ্ডব সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে গেলেও, দেশপ্রেমের উল্লেখ করেননি, তাঁরা কেবল পাঁচটি গ্রামের মালিকানা চেয়েছিলেন ।

ভূখণ্ডটির প্রতি ভালোবাসার কবিতা প্রথম লেখেন আমির খসরু, ১৩১৮ সালে, ফারসি ভাষায়, ‘নুহ সিহফির’ নামে । কবিতাটি তিনি আরম্ভ করেছেন এই বলে যে, এই দেশ তাঁর জন্মভূমি, তাঁর নিবাসস্হান, এবং তিনি এই দেশের মূল অধিবাসী । এই দেশের মানুষেরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে, জানিয়েছেন তিনি, এবং সেই ভাষার তালিকা থেকে স্পষ্ট যে তিনি দেশটা ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন । ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলাও আছে । আমির খসরু আরবি, ইরানি, তুর্কি ও গ্রিক সংস্কৃতি ও দেশগুলোর কথা জানতেন এবং তাঁর কবিতায় ব্যক্ত করেছেন যে ওই দেশগুলোর প্রকৃতি ও সংস্কৃতির তুলনায় তাঁর জন্মভূমি ‘হিন্দ’-এর সংস্কৃতি উন্নত, প্রকৃতি অনেক সদয় । তিনি লিখেছেন যে ইরান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাধারণ মানুষকে তুষার-শীতে ও অসহ্য-গ্রীষ্মে কষ্ট পেতে হয়, যা ‘হিন্দ’-এর সাধারণ কৃষকদের পোহাতে হয় না ; এই ভূখণ্ডে প্রতিটি ঋতুতে ফুল ফোটে ; এখানের প্রাচীন বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যা অন্যান্য ভূখণ্ডের চেয়ে উন্নত । তিনি লিখেছেন যে এদেশের মানুষের ধর্ম খ্রিস্টধর্মীদের চেয়ে শ্রদ্ধেয় । তিনি বলেছেন, এই ভূখণ্ডের মানুষ বিশ্বকে তিনটি বিশেষ জিনিস দিতে পেরেছে, তা হলো সংখ্যা ( হিন্দসা ), শুন্য, পঞ্চতন্ত্র নামের কাহিনি যা সারা জগতে ছড়িয়ে পড়েছে, এবং সর্বোপরি, দাবাখেলা । আমির খসরু সংস্কৃত ভাষার গুণগান করেছেন, যে ভাষায় বেদ লেখা হয়েছে । তাঁর দেশপ্রেমে এই ভূখণ্ডের কারোর প্রতি কটুক্তি বা বিদ্বেষ নেই । ১৩০০ সালে যখন খসরুর মায়ের মৃত্যু হলো তখন তিনি লিখেছিলেন, “মা যেখানে-যেখানে তোমার পায়ের ধূলো পড়েছে, তা আমার কাছে স্বর্গ ।”

সম্রাট আকবর ( ১৫৫৬ – ১৬০৫ ),  তাঁর রাজত্বের অধিবাসীরা যাতে গোলমাল না করে, আর সবাই মিলেমিশে থাকে, তাই ‘সুলহ-ই-কুল’ ( চরম প্রশান্তি ) নামে একটি রাজ্যশাসন প্রণালী তৈরি করেছিলেন, একটি কূটনীতি, যার অন্তর্গত তাঁর রাজত্বে সবাইকে তাদের সাংস্কৃতিক বিকাশের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল । মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁর রাজ্যের মানুষ তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডকে ভালোবাসুক । আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্হে ‘হিন্দুস্হানের বিবরণ’ নামে একটি অধ্যায়ে ভারতের সংস্কৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান, ভাষা, অঞ্চলসমূহ, এবং সমাজ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছিলেন, যাতে আকবরের কর্মীদের এই দেশ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান হয়, আর যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী ও অন্য দেশ থেকে এসেছে, তাদের সুবিধা হয় । আকবর সংস্কৃত সাহিত্যের কাজগুলোকে ফারসি ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্হা করেছিলেন । আকবরের গড়া বনেদে দেশবাসী তাদের ভূখণ্ডকে ভালোবাসা কাকে বলে তা ক্রমে ঠাহর করা আরম্ভ করেছিল, কিন্তু আওরঙ্গজেব গদিতে বসার পর মোগলদের প্রতি বর্ণহিন্দুরা তো বটেই, নিম্নবর্ণের মানুষও আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে থাকে এবং মোগলদের বিজাতীয় মনে করার বীজ অঙ্কুরিত হওয়া আরম্ভ হয় । এখন যে জিঙ্গোবাদ দেখা দিয়েছে তা কেবল বিজাতীয় খুঁজেই নিশ্চিন্ত নয়, নিজের সমাজেই ‘অপর’ খুঁজতে হন্নে হয়ে উঠেছে ।

ব্রিটিশরা আসার পর ১৮৫৭ সালে যে মহাবিদ্রোহ দেখা দিল, তা মূলত উত্তরভারতে সীমিত ছিল, দেশকে ভালোবাসার সূত্রপাত ঘটা সম্ভব হয়নি, যার কারণ, রামমোহন রায়, লিখেছেন,  ইংরেজদের দ্বারা বর্ণ বিভাজনকে জিইয়ে তোলা । ১৮৭১ সালে, প্রথম লোকগণনার সময়ে, ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশ ছিল যে সমস্ত নেটিভকে হিন্দুদের চারটি বর্ণে চিহ্ণিত করে ফেলতে হবে, যারা যে কাজে লিপ্ত তাদের সেই কাজের বর্ণে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে । যাদের ক্ষেত্রে বর্গীকরণ সম্ভব হবে না, কর্তৃপক্ষ তাদের ‘আউটকাস্ট’ অথবা ‘অ্যাবঅরিজিন’ বর্গে ফেলবেন ( B.S.Cohn, An Anthropologist among the Historian, 1987 ) এর ফলে চতুবর্ণের সঙ্গে Caste systemকে গুলিয়ে ফেলা হয় । বর্ণব্যবস্হা হিন্দুধর্মের পূর্ববর্তী ।

Jonathan P Parry তাঁর Caste and Kinship in Kangra, 1979  গ্রন্হে একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন ; তিনি দেখিয়েছেন যে ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপে, জনগোষ্ঠীগুলোর casta ( caste ) যা তরলায়িত ছিল, তা চতুবর্ণে কেমন করে হয়ে গেছে অপরিবর্তনীয় :
জাত                                                                         বর্ণ
১.ব্রাহ্মণ ( ভূস্বামী ও পুরোহিত )                                     ব্রাহ্মণ
২. ভোজকি ( মন্দিরের পুরোহিত )                                   ব্রাহ্মণ
৩. রাজপুত ( ভূস্বামী ও যোদ্ধা )                                     ক্ষত্রিয়
৪. মহাজন ( ব্যবসায়ী )                                                বৈশ্য
৫. তুরখান ( ছুতার )
৬. লোহার ( কামার )
৭. সোনার ( স্যাকরা )
৮. নাই ( নাপিত )
৯. কুমহার ( কুমোর )
১০. গার্থ ( চাষি )
১১. কোলি ( চাষি )
পাঁচ থেকে এগারো পর্যন্ত জাতগুলো কাংড়ায় শূদ্রবর্ণে চিহ্ণিত হলেও, ভারতের কোথাও-কোথাও সোনাররা বৈশ্য ও অন্যেরা ক্ষত্রিয় ।
১২. যোগি ( ভিক্ষুক ও তপস্বী )                                       কাংড়ায় যোগিরা শুদ্র । কিন্তু বহু অঞ্চলে তাঁরা
ব্রাহ্মণ অথবা বৈষ্ণব
১৩. জুলাহা ( তাঁতি )
১৪. সানহাই ( বাদ্যযন্ত্রবাদক )
১৫.ডুম্মা ( চুবড়ি ইত্যাদি প্রস্তুতকারক )
১৬. চামার
১৭.  ভাঙ্গি  ( সাফাইকর্মী )
তেরো থেকে সতেরো পর্যন্ত সবাই কাংড়ায় শুদ্র
.
পর্তুগিজদের casta থেকে caste  শব্দটির উৎপত্তি । পর্তুগিজরা পেশা অনুযায়ী ভারতীয়দের চিহ্ণিত করেছিল । ইংরেজরা সমাজে বিভাজনের সূত্র খুঁজে পেয়ে কাস্টগুলোকে পেশা অনুযায়ী সাবকাস্টেও টুকরো করে ফেললো । এমনকি মুসলমানদেরও জীবিকা অনুযায়ী সাবকাস্টে টুকরো করে ফেলতে সফল হলো, যে কারণে শেখ-সৈয়দরা  তাঁতি, কামার, কুমোরদের পরিবারে বিয়ে দেন না । হিন্দু দলিত সমাজকে কাস্ট থেকে কাস্তায় ফেরত নিয়ে যাবার জন্য বি আর আম্বেদকর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন । তা সত্ত্বেও আদিবৌদ্ধ ও দলিতদের মাঝে বিভাজন রয়ে গেছে । অরুন্ধতী রায়-এর ‘দি গড অফ স্মল থিংস’ পড়লে জানা যায় যে ভারতীয় খ্রিস্টানদের সমাজেও বর্ণবিভাজন দিব্বি বহাল রয়েছে । শিখদের মধ্যেও বর্ণবিভাজন প্রবেশ করেছে বলেই নিম্নবর্ণের শিখ গডম্যানরা নিম্নবর্ণের শিখদের নিজেদের দিকে টানতে সফল হয়েছে, যেমন গুরমিত রাম রহিম সিং । শিখদের বর্ণবিভাজন মুছে ফেলার জন্য গুরু গোবিন্দ সিংহ লঙ্গরের ব্যবস্হা করেছিলেন, যাতে সবাই একসঙ্গে বসে খেতে পারে, রান্নাঘরে সবাই কাজে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু উচ্চবর্ণের শিখরা বর্ণবিভাজন থেকে বেরোতে পারেনি । সিন্ধিদের টানতে পেরেছিল আশারামবাপু, যে এখন জেলে । বাঙালিদের সমাজেও নিম্নবর্ণের জন্য আছেন নানা গুরুঠাকুর । বস্তুত জিঙ্গোবাদের ঘুণপোকা কুরে খেয়ে ফেলছে ভারতীয় সমাজকে ।

ভারতীয় জিঙ্গোবাদীরা জাতীয়তাবাদের ও দেশপ্রেমের একটি বিকল্প ন্যারেটিভ গড়ে তুলতে চাইছে, যার সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলুম না । স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করা হয়ে গেছে বিপজ্জনক, অচেনা কারোর সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা সুবিধার নয় । লোকে ভয়ে মুখ খুলতে চায় না । ডিসেন্ট বা মতানৈক্যকে একদল লোক, যারা নিজেদের হিন্দু ধর্মের রক্ষাকারী হিসাবে ঘোষণা করেছে, তারা তাদের মতের সঙ্গে মেলে না এরকম কথাবার্তা শুনতে রাজি নয় । কেউ-কেউ আবার নির্দিষ্ট কাউকে হত্যা করলে হত্যাকারীকে পুরস্কৃত করার কথা সাংবাদিক ডেকে জানিয়ে দিচ্ছে । কোনো ফিল্ম রিলিজ হবে না হবে না, ফিল্মে কোনো সংলাপ থাকবে না থাকবে না, তার নির্ণয়ও নিয়ে ফেলছে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদীরা । দেশপ্রেমের নামে, ধর্মের সঙ্গে মিশেল দেয়া  জাতিয়তাবাদের এই বিকল্প ন্যারেটিভটা ঘৃণার, এটা একরকম মানসিক বিকার ।

No comments:

Post a Comment