Thursday, July 4, 2019

মলয় রায়চৌধুরীর জীবনপঞ্জি



মলয় রায়চৌধুরীর  জীবনপঞ্জি
১৯৩৯ : মলয় রায়চৌধুরীর জন্ম পাটনার সরকারি হাসপাতালে, ১৯৩৯ সালে, কিন্তু জন্মদিনটি নিয়ে বিতর্ক আছে । একান্নবর্তী পরিবারের, যাঁরা কেউই স্কুল-শিক্ষিত ছিলেন না,  কারোর মতে ২৯ অক্টোবর এবং কারোর ২ নভেম্বর । মলয়ের মায়ের মতে ১১ কার্তিক, শুক্রবার, যা বিতর্কটিকে আরও জটিল করে তোলে । পরিবারের পুরোহিতের পরামর্শে স্কুলে ভর্তির সময়ে ২৯ অক্টোবর দিনটি ভর্তির বছরে শুভ ছিল বলে ২৯ অক্টোবরই বেছে নেয়া হয় ।  সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের উত্তরপাড়া শাখার বংশধর । ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ ( ১১.জানুয়ারি ১৮৬৬ - ৮ আগস্ট ১৯৩৩) ছিলেন ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার ও আর্টিস্ট ; হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পাটনায় মারা যান । ঠাকুমা কলকাতার পটুয়াটোলার মুখোপাধ্যায় পরিবারের মেয়ে অপূর্বময়ী, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের খুড়তুতো বোন । পাণিহাটি নিবাসী দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ( ১৮৭৭ -১৯২৯ ) ছিলেন রোনাল্ড রসের সহকারি । দিদিমা খড়দা নিবাসী চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ক্ষেত্রপ্রসাদী । মলয়ের সেজমামা লক্ষ্মীকান্ত ( ছ্যান ) ছিলেন এরিয়ানের ফুটবল দলের খেলোয়াড় । মলয়ের মা : অমিতা ( ১৯১৬ - ১৯৮২ ) ; বাবা রঞ্জিত ( ১৯১২ - ১৯৯১ ) । দাদুর মৃত্যুর পর মলয়ের বাবা পাটনায় ফোটোগ্রাফি এবং তা থেকে তৈলচিত্র আঁকার ব্যবসায় আরম্ভ করেন । বাবার ছয় ভাই ও এক বোন । মলয় শৈশবে পাটনার ইমলিতলা পাড়ায় একান্নবর্তি পরিবারের সদস্য ছিলেন । পাড়াটি ছিল গোলটালির চালাবাড়ি-ঘেরা দলিত অতিদরিদ্র পরিবার ও লখনউ নবাবের হারেমের গরিব শিয়া বংশধর অধ্যুষিত । মলয়রা দুই ভাই । মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী ( ১৯৩৩ - ২০১৬ ) প্রথমে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন এবং পরে মলয়ের সঙ্গে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করেন ; চাকুরি থেকে অবসরের পর সমীর কলকাতায় এসে “হাওয়া৪৯” পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন । পাটনায় ম্যাট্রিক পাশ করার পর সমীর কলকাতায়  সিটি কলেজে ভর্তি হন, উত্তরপাড়ার খণ্ডহর-বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে থাকতেন । ইমলিতলা পাড়ায় মলয় ও তাঁর দাদা বাল্যকাল থেকে শুয়োর ও গোরুর মাংস, ছাগলের নাড়িভুঁড়ির বড়া, তাড়ি, দিশি মদ ও গাঁজা ফোঁকার সঙ্গে পরিচিত হন । 

১৯৪৩ - ১৯৪৮ : বাবার পরিচিত ফাদার হিলম্যানের সুপারিশে সেইন্ট জোসেফ কনভেন্ট ক্যাথলিক স্কুলে ১৯৪৩ সালে ট্রানজিশান ক্লাসে ভর্তি হন । স্কুলে ইংরেজিতে কথা বলা বাধ্যতামূলক ছিল এবং প্রতি বৃহস্পতিবার সংলগ্ন গির্জায় বাইবেল পাঠ ও পিয়ানো বাজানোর ক্লাস করতে হতো । এই সূত্রে মলয়ের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের কাহিনিগুলোর  পরিচয় । শিক্ষিকা সিসটার আইরিন ছুটির সময়ে আয়ারল্যাণ্ড গেলে ফেরার সময়ে ওক, এলম, বার্চ, পপলার ইত্যাদি গাছের পাতা, ড্যাফোডিলস, ব্লুবেল, অ্যানেমোন, থিসল ইত্যাদি ফুল নিয়ে আসতেন, সবই শুকনো ; খ্রিস্টধর্মের সন্তদের কার্ড দিতেন ছাত্রদের । মলয়ের বড়োজেঠা প্রমোদ পাটনা মিউজিয়ামে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ‘কিপার অব পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার’ ছিলেন ; মলয় স্কুল ছুটিতে জেঠার সঙ্গে মিউজিয়ামে গিয়ে প্রায়ই সারাদিন কাটাতেন । জাঠতুতো দিদিরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতেন ও গাইতেন । বড়োজেঠা ক্ল্যারিনেট বাজাতে জানতেন । বাড়িতে কলের গান, সেতার,বীণা, হারমোনিয়াম, অরগ্যান, তবলা ছিল । কুড়িজনের পরিবারে মলয়ের বাবা ছিলেন প্রধান রোজগেরে ।১৯৪৬ সালে ইমলিতলা পাড়ায় যখন কলেরা রোগ দেখা দেয় তখন মলয়েরও হয়েছিল ।

১৯৪৯ - ১৯৫৪ : ক্যাথলিক স্কুলে তাঁর বাংলা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে অনুমান করে মলয়কে ব্রাহ্মদের স্কুল রামমোহন রায় সেমিনারীতে বাংলা মিডিয়াম শাখায় ভর্তি করা হয় এবং এই স্কুল থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন । ১৯৪৮-৪৯ সালে ইমলিতলা পাড়ায় শিয়া পরিবারের তরুণী কুলসুম-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে । কুলসুম-আপা তাঁকে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও গালিব শোনাতেন । কলকাতা থেকে ছুটিতে ফিরলে দাদার পরিচালনায় জাঠতুতো দিদিদের বিশাল জমিদারি বাড়ির দালানে নাটক অভিনয় হতো । মলয় অভিনয়ে অংশ নিতেন । রামমোহন রায় সেমিনারীর গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তী তাঁকে ব্রাহ্ম লেখকদের বই পড়তে উৎসাহিত করতেন এবং নির্দেশ দিতেন কোন বইগুলো পড়া উচিত । এই দুই তরুণীর গভীর প্রভাব রয়ে গেছে মলয়ের জীবনে ।  ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে মামারবাড়ি পাণিহাটিতে ছুটি কাটাতে যান এবং সেখানে উদ্বাস্তু পরিবারের কিশোরী ফুলটু ওরফে শেফালীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কারণে মামারা তাঁকে পাটনা ফেরত পাঠিয়ে দেন । হাংরি আন্দোলনের সময়ে পুলিশ মলয়ের মায়ের সুটকেস ভাঙলে তা থেকে ফুলটুকে দেয়া সিসটার আইরিনের খ্রিস্টধর্মী কার্ড ও মলয়ের লেখা প্রেমপত্র পাওয়া যায় ।

১৯৫৫ - ১৯৫৬ : বিহার ন্যাশানাল কলেজে হিউম্যানিটিজ শাখায়  ভর্তি হন । ইমলিতলার বাড়ি ছেড়ে দরিয়াপুরে অর্ধসমাপ্ত বাড়িতে একা থাকা আরম্ভ করেন । তাঁর তিন সহপাঠী তরুণ শূর, বারীন্দ্রনাথ গুপ্ত ও সুবর্ণ উপাধ্যায়ের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয় । বারীনের সঙ্গে তিনজনে রবীন্দ্রসঙ্গীত  গাইতেন । চার বন্ধু মিলে পুনপুন নদীর ধারে তালগাছের জঙ্গলে গিয়ে তাড়ি খেয়ে মাটির হাঁড়ি বাজিয়ে হিন্দি ফিলমের গান গাইতেন ।সুবর্ণ ও মলয় বেহালা বাজানো শেখা আরম্ভ করেন কিন্তু পরীক্ষার চাপে ছেড়ে দেন । ম্যাট্রিকের পর তিনি বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে তরুণ শূরের সঙ্গে বেশ কয়েকবার পালিয়েছেন, তরুণের মামার ট্র্যান্সপোর্ট ব্যবসার ট্রাকে কিংবা নৌকোয় । ন্যাশানাল ক্যাডেট কোরে যোগ দিয়ে কয়েকবার বিভিন্ন ক্যাম্প যান এবং থ্রি নট থ্রি ও বাইশ বোরের রাইফেল চালাতে শেখেন । দরিয়াপুরের বাড়িতে দাদার সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আসেন ও তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। দাদা কলকাতা থেকে ফেরার সময়ে প্রতিবার কবিতার বই আনতেন । মলয়ের একটি নিজস্ব গ্রন্হাগারের সূত্রপাত হয় ।

১৯৫৭ - ১৯৫৮ :  অর্থনীতিতে সান্মানিক স্নাতক পড়া আরম্ভ  । নেপালি সহপাঠিনী ভূবনমোহিনী রাণার উদ্দেশে ইংরেজিতে প্রেমের কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্যের শুরু । কবিতা লিখছেন দেখে বাবা মলয়কে আগফা-গেভার্টের একটি  সুদৃশ্য ডায়েরি দেন। মলয় বাংলায় কবিতা লেখা ও নোটস নেয়া আরম্ভ করেন । বইয়ের তালিকা দিলে বাবা স্হানীয় দোকান থেকে আনিয়ে দিতেন । নমিতা চক্রবর্তীর প্রভাবে মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন । পাণিহাটি গেলে ছোটোমামা বিভাস মার্কসবাদ সম্পর্কিত বহু বই দেন । দাদা চাকুরিতে চাইবাসায় যোগ দেন এবং মলয়ের সঙ্গে দীপক মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় হয় । দীপক মলয়কে সিলেবাসের বাইরে ‘ইতিহাসের দর্শন’ পড়ার পরামর্শ দেন । 

১৯৫৯ -১৯৬০ : অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পড়া আরম্ভ  ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্হান পান । ভারতের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি মার্কস পান । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পাটনায় এলে মলয়ের কাছ থেকে কয়েকটি কবিতা চেয়ে নিয়ে যান ও ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন । ‘ইতিহাসের দর্শন’ নিয়ে লেখা আরম্ভ করেন । এই সূত্রে অসওয়াল্ড স্পেংলারের ‘দি ডিকলাইন অব দি ওয়েস্ট’ বইটি কেনেন এবং সংঙ্কৃতি-সভ্যতা সম্পর্কিত স্পেংলারের বক্তব্য ভারতের উত্তরঔপনিবেশিক সমাজে ফুটে উঠছে বলে তাঁর মনে হয় । এই বক্তব্যের সঙ্গে ব্রিটিশ কবি জিওফ্রে চসারের ‘দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটিতে ‘হাংরি’ অভিধার সাযুজ্য খুঁজে পান ।

১৯৬১ : দাদা সমীরের চাইবাসার মেয়ে বেলার সঙ্গে বিয়ে । কৃত্তিবাসের কবিরা বরযাত্রী । মলয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকুরিতে যোগ দেন । এই চাকুরিতে তাঁকে পচা-গলা ব্যাঙ্কনোট পোড়ানোর দপতরে কিছুকাল কাজ করতে হয়েছিল যার দরুণ তাঁর উচ্চ রক্তচাপ ও ট্র্যাকিকার্ডিয়া হয়, এবং তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন চাকুরিটি ছেড়ে অন্য চাকুরি করার । ‘বিংশ শতাব্দী’ পত্রিকায় ‘ইতিহাসের দার্শন” ধারাবাহিক প্রকাশ । দাদার সঙ্গে আলোচনা আরম্ভ করেন একটি সাহিত্যিক-সংস্কৃতিক আন্দোলন আরম্ভ করার সম্ভাবনা নিয়ে । মলয়ের সঙ্গে কলকাতার একটি পত্রিকা দপতরে হারাধন ধাড়া নামে এক তরুণ লেখকের পরিচয় হয় । নিম্নবর্গের কবিদের নাম তখনকার পত্রিকায় চোখে কখনও পড়েনি বলে হারাধন ধাড়াকে তিনি রাজি করান হাংরি  আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য । মলয় হারাধন ধাড়ার হাওড়ার বস্তিবাড়িতে গিয়ে বুঝতে পারেন যে এটাই হাংরি আন্দোলনের সম্পাদকের উপযুক্ত দপতর হতে পারে । দাদা শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে পাটনায় নিয়ে আসেন । চারজনে মিলে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করেন । দাদার জন্মদিন পয়লা নভেম্বর ১৯৬১ পাটনা থেকে ইংরেজিতে প্রথম হাংরি বুলেটিন প্রকাশিত হয় । হারাধন ধাড়া নাম পরিবর্তন করে দেবী রায় হিসাবে এফিডেভিট করেন । বাংলা সাহিত্যে প্রথম হ্যাণ্ডবিলের মাধ্যমে সাহিত্য ।

১৯৬২ : ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ গ্রন্হের প্রকাশ । প্রকাশক শক্তি চট্টোপাধ্যায় । বইটি জড়ো করে শক্তির উল্টোডাঙার বাড়ির সামনে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে ফ্যালেন মলয় । এপ্রিলে বাংলায় হাংরি ইশতাহার প্রকাশ । পাটনার যুবক সুবিমল বসাক মলয়ের সঙ্গে দেখা করে হাংরি আন্দোলনে যোগ দেন । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, প্রদীপ চৌধুরী  হাংরি আন্দোলনে যোগ দেন ।

১৯৬৩ : হাংরি আন্দোলনের তরফে কাগজের মুখোশ বিতরণ ও পোস্টার প্রকাশ । শম্ভু রক্ষিত, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য, ত্রিদিব মিত্র, আলো মিত্র, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও হিন্দি-মৈথিলি লেখক রাজকমল চৌধারী প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় । তাঁরা আন্দোলনে যোগ দেন । প্রথম কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ’ কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশ । প্রচ্ছদ কার্লোস কোফিন । কিছু কবিতায় CANCELLED ছাপ মারা হয়েছিল বলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইটিকে অস্বীকার করেন  । একাধিক হাংরি বুলেটিন ও স্টেনসিল-ড্রইং প্রকাশ । ১৯৬৩ সালের এপ্রিলে পাটনার বাড়িতে অ্যালেন গিন্সবার্গ এসে কয়েকদিন ছিলেন । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় ‘ইল্লত’ নাটক জমা দিয়েছিলেন, কুমার রায় তাকে আবোলতাবোল বলে ফেরত দেন । একই নাটক ‘গন্ধর্ব’ পত্রিকার সম্পাদক নৃপেন সাহা প্রত্যাখ্যান করেন । ‘ইল্লত’ নাটক প্রকাশিত হয় ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকায় ।

১৯৬৪ - ১৯৬৭ : ‘আমার জেনারেশনের কাব্যদর্শন বা মৃত্যুমেধী শাস্ত্র’ পুস্তিকা প্রকাশ । জেব্রা প্রকাশনী । মলয়ের সম্পাদিত ‘জেব্রা’ পত্রিকা কলকাতার প্রেসগুলো ছাপতে অস্বীকার করায় বহরমপুরের সিগনাস প্রিন্টিং থেকে প্রকাশ । মণীশ ঘটকের সঙ্গে পরিচয় । হাংরি বুলেটিনে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা রচনার জন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অশ্লীলতার অভিযোগে ৪ঠা সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার । কোমরে দড়ি বেঁধে হাতে হাতকড়া পরিয়ে বাড়ি থেকে থানা ও থানা থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় । গ্রেপ্তারির সংবাদে ঠাকুমা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান ।ব্যাংকশাল কোর্টে মামলা আরম্ভ । ‘নাউ’ পত্রিকা দপতরে সমর সেনের সঙ্গে, খালাসিটোলায় কমলকুমার মজুমদারে সঙ্গে ও অশোক মিত্রের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে পরিচয় । পরে ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকা দপতরে সমর সেনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন । গৌরকিশোর ঘোষ বাড়িতে প্রাতঃভোজের নিমন্ত্রণ দেন ।  মলয়ের বন্ধুরা তাঁর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে মামলা থেকে ছাড়া পান । সমীরের শ্যালিকা শীলাকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিয়ের প্রস্তাব দিলে, শীলার বাবার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্রুদ্ধ শক্তি হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন । ‘জেব্রা’ দ্বিতীয় সংখ্যা ও দীর্ঘকবিতার পুস্তিকা ‘জখম’ প্রকাশ । লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি কর্তৃক ‘সিটি লাইটস জার্নাল’-এ ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ । তরুণ সান্যাল ও জ্যোতির্ময় দত্তের সঙ্গে পরিচয় । ব্যাংকশাল কোর্টে মলয়ের ২০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে একমাসের কারাদণ্ডের আদেশ । পাটনার বাড়িতে ওকতাভিও পাজ দেখা করতে আসেন । উচ্চ আদালতে আপিল করে হাংরি আন্দোলনের কলাশিল্পী অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেনারস ও নেপালে চরস-গাঁজার ধোঁয়া আর ব্লটিং পেপারে চোবানো এলএসডির নেশায় হিপি কলোনিতে দুই মাস থাকেন । নেপাল থেকে ফেরার পর বড়োজেঠা মারা যান এবং মলয়কে মুখাগ্নি করতে হয় ।ফণীশ্বরনাথ রেণুর সূত্রে রামধারী সিং দিনকর, এস এইচ বাৎসায়ন অজ্ঞেয়, কমলেশ্বর, ধর্মবীর ভারতী, মুদ্রারাক্ষস, ধুমিল, শ্রীকান্ত বর্মা, সর্বেশ্বরদয়াল সাকসেনা প্রমুখ হিন্দি লেখক, গুজরাতি লেখক উমাশংকর যোশীর সঙ্গে পরিচয় । মারাঠি লেখক অরুণ কোলাটকর, দিলীপ চিত্রে, অশোক সাহানে, নেপালি কবি পারিজাত, তেলুগু কবি নিখিলেশ্বর, মহাস্বপ্ন, জ্বলামুখি এবং ইংরেজি লেখক খুশওয়ন্ত সিংহ প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় ও হাংরি আন্দোলনে তাঁদের সমর্থনলাভ । মলয়কে লেখা চিঠিপত্রের একটি ইংরেজি ও একটি বাংলা সংকলন প্রকাশ করেন ত্রিদিব মিত্র ও আলো মিত্র । ১৯৬৭ সালের জুলাইতে কলকাতা উচ্চ আদালতে মলয় মামলা জিতে যান । পোর্টল্যাণ্ড থেকে ‘সলটেড ফেদার্স’ পত্রিকার বিশেষ হাংরি সংখ্যা প্রকাশ । ‘ইল্লত’ নাটকটি ও হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা আরও দুটি নাটক ‘নপুংপুং’ ও ‘হিবাকুষা’ নিয়ে আশ্বিন ১৪০৫ বঙ্গাব্দে কবিতীর্থ থেকে ‘নাটকসমগ্র’ নামে প্রকাশিত হয় ।

১৯৬৮ : লেখালিখি বন্ধ করে মলয় পড়াশুনায় একাগ্র হন ; তাঁর সংগ্রহের বহু বই যা আমেরিকা থেকে হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, মার্গারেট র‌্যানডাল, ক্যারল বার্জ, বার্নি রসেট, ডিক বাকেন, কার্ল ওয়েসনার, রবার্ট ব্লাই প্রমুখ পাঠিয়েছিলেন তা নিয়মিত পড়া আরম্ভ করেন । মামলার সময়ে তাঁর অনুপস্হিতিতে বহু বই দরিয়াপুরের বাড়ি থেকে চুরি হয়ে যায় । চাকরিতে যোগ দিয়ে যে বকেয়া টাকা পান তা দিয়ে হাইকোর্টের ব্যারিস্টারদের ঋণ মেটান । নোট পোড়ানোর বিভাগ থেকে রেহাই পান চাকুরিতে যোগ দিয়ে । তাঁকে পাঠানো হয় নাগপুর অফিসে নতুন প্রশিক্ষণের জন্য । মলয় পরিচিত হন রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় সলিলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এবং পরিচয়ের তিন দিনের মাথায় বিয়ের প্রস্তাব দেন । সলিলার বাবা-মা ছিলেন না, মামার বাড়িতে থাকতেন, প্রস্তাবে  রাজি হয়ে যান এবং বাড়ি নিয়ে যান । বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে পাটনায় পৌঁছোলে কোনো অনুষ্ঠান হয়নি, কেননা সেসময়ে মেজজ্যাঠার মৃত্যুজনিত অশৌচ ছিল । 

১৯৬৯ - ১৯৮২ : রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকুরি ছেড়ে মলয় অ্যাগ্রিকালচারাল রিফাইনান্স অ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনে সিনিয়র অ্যানালিস্টের কাজে লখনউতে যোগ দেন এবং সেই থেকে  সারা ভারতের গ্রামগঞ্জের চাষি, তাঁতি, খেতমজুর, হাতের কাজ করিয়ে, ছুতোর প্রমুখ দরিদ্র জনগণের আর্থিক উন্নতির বিভিন্ন প্রকল্পে জড়িয়ে পড়েন । পরিচিত হন ধান, ডাল, তেলবীজ, জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা, তুলো, আখ ইত্যাদির প্রজাতি ও চাষের সঙ্গে । নানা প্রজাতির গোরু, মোষ, ছাগল, শুয়োর, মুর্গি, মাছ ইত্যাদির প্রজনন ও বৃদ্ধি এবং জলপ্রকল্পের সঙ্গে । পরিচিত হন ভারতের চতুবর্ণের ভেতরে প্রায় কয়েক হাজার বিভাজিত বর্ণের সঙ্গে ।  ঘোরাঘুরির সময়ে তিনি সব সময়ে নিজের সঙ্গে রাখতেন সাম্প্রতিকতম চিন্তাভাবনার বই । চাকুরিজীবনে অত্যধিক হাঁটাচলার কারণে তাঁর পায়ে ভেরিকোজ ভেইনস দেখা দেয় । অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় নকশাল আন্দোলনে যোগ দিলে তাঁরা বেনারস ছাড়েন । করুণানিধানকে মলয়ের দাদা পাটনায় রঙিন মাছের দোকান খুলে দেন । নব্বুই দশকে তাঁর দাদা “হাওয়া৪৯” পত্রিকা প্রকাশ আরম্ভ করলে সেই সমস্ত গ্রন্থপাঠ মলয়ের কাজে দিয়েছিল । ১৯৬৯ সালে তাঁর মেয়ে  অনুশ্রী এবং ১৯৭৪ সালে ছেলে জীতেন্দ্রর জন্ম । অন্যান্য নেশা ছেড়ে প্রতি সন্ধ্যায় কেবল হুইস্কি ও আবসাঁথ পান করতেন । লখনউতে নিজের বাগানে নিজেই চাষ করার সঙ্গে পরিচিত হবার উদ্দেশে নানা ধরণের বীজ পোঁতেন ও গাছ লাগান । 

১৯৮৩ - ২০১৯ : মহাদিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক উত্তম দাশ স্ত্রী মালবিকাকে নিয়ে মলয়ের লখনউয়ের বাড়িতে আতিথ্য নেন এবং হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছা ও মলয়ের পুরোনো কবিতা গ্রন্হাকারে প্রকাশের আগ্রহ দেখান । মলয়কে নিমন্ত্রণ জানান সপরিবারে তাঁদের বারুইপুরের বাড়িতে আতিথ্য নেবার । হাংরি আন্দোলনের পর মলয় প্রথমবার কলকাতায় গেলেন । ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় নথিপত্রসহ উত্তম দাশের প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার পর পাঠকেরা প্রকৃত ঘটনা জানতে পারেন । কলকাতায় মলয়ের অনুপস্হিতির সুযোগ নিয়ে অনেকেই নানা কাহিনি ফেঁদেছিলেন । মলয়ের হাংরি আন্দোলনের স্মৃতিকথা ‘হাংরি কিংবদন্তি’ নামে ১৯৯৬-৯৭ সালে ঢাকায় ‘মীজানুর রহমানের পত্রিকায়’ ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল ; গ্রন্হাকারে কলকাতার দে বুকস, আবিষ্কার প্রকাশনী ও প্রতিভাস থেকে প্রকাশিত হয়েছে । লখনউতে থাকাকালীন পার্থসারথী চৌধুরী অফিসের কাজে এসে তাঁর আতিথ্য নেন। লখনউ থেকে তিনি একপাতার ‘মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা’ প্রকাশ করতেন যাতে ছবি এঁকে দিতেন প্রকাশ কর্মকার, যিনি তখন এলাহাবাদে থাকতেন । তিরিশটি দ্বৈতকর্ম প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৮৭ সালে মলয় মুম্বাইয়ে নাবার্ডে যোগ দেন ও ১৯৯৪ সালে “হাওয়া৪৯”-এর কাজে দাদাকে সাহায্য করার জন্য  কলকাতার অফিসে বদলি হন । পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি ট্যুরে তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন যাতে তাঁর স্ত্রী চাষি-তাঁতি-উপজাতি ইত্যাদি  পরিবারের বাড়ির ভেতরে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন । “হাওয়া৪৯” পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় মলয়ের লেখা প্রকাশিত হয়েছে । ‘বর্ণসংকর’ ও ‘অপর’ সংখ্যায় তিনি নিষাদ হেমব্রম ছদ্মনামে বিষয়টি নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন ।কলকাতা ফিরলে শিবনারায়ণ রায় তাঁকে ডেকে পাঠান ও ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় লিখতে বলেন । হাংরি আন্দোলনের ইশতাহারগুলো নিয়ে উত্তম দাশ ১৯৮৫ সালে প্রকাশ করেন ‘ইশতাহার সংকলন’, ১৯৮৬ সালে সেই সময়ের কবিতাগুলো নিয়ে প্রকাশ করেন ‘কবিতা সংকলন’। হাংরি আন্দোলনের পরে লেখা কবিতা নিয়ে ১৯৮৭ সালে মহাদিগন্ত থেকে প্রকাশিত হয় ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’যার প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন যোগেন চৌধুরী ; ১৯৯১ সালে দীর্ঘ কবিতার পুস্তিকা ‘হাততালি’ । ১৯৯৫ সালে ‘কবিতা পাক্ষিক’ থেকে প্রকাশিত হয় ‘চিৎকারসমগ্র’ । সেই বছরেই ‘কবিতীর্থ’ থেকে প্রকাশিত হয় কবিতার পুস্তিকা ‘ছত্রখান’ । ১৯৯৬ সালে ‘কৌরব’ থেকে প্রকাশিত হয় কবিতার বই ‘যা লাগবে বলবেন’ ।১৯৯৬ সালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পিয়ারলেস হাসপাতালে আইসিইউতে মাসখানেক ছিলেন, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করাতে হয়; ভুল ওষুধের কারণে তিনি আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হন ; তারপর থেকে কলম ধরে লিখতে পারেন না, কমপিউটারে এক আঙুলে টাইপ করে লেখেন । ২০০০ সালে আরেকবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং কবি ও জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ তাঁর চিকিৎসা করতেন । ২০০৭ সালে হেরেডিটারি রোগ হাঁপানিতে আক্রান্ত হন । ১৯৯৮ সালে নিজের কয়েকটি কবিতার আলোচনা করে ‘কবিতা’ পাক্ষিক থেকে প্রকাশ করেন “অ’ । ২০০০ সালে গ্রাফিত্তি থেকে প্রকাশিত হয় কবিতার বই ‘আত্মধ্বংসের সহস্রাব্দ’ । ২০০১ সালে সৃষ্টি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ‘পোস্টমডার্ন আহ্লাদের কবিতা”। ২০০৩ সালে কবিতা ক্যাম্পাস থেকে ‘কৌণপের লুচিমাংস’ । এই সময়ে তাঁর সঙ্গে কেদার ভাদুড়ীর পরিচয় ও প্রতি সন্ধ্যায় আড্ডা ; কেদার ভাদুড়ীর একটি সাক্ষাৎকার নেন প্রায় চল্লিশ পৃষ্ঠার । সুবিমল বসাক ও দীপঙ্কর দত্তেরও দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন । উদয়ন ঘোষ তাঁর মেয়ের কাছে নাকতলায় থাকতে এলে তাঁর সঙ্গে হৃদ্যতা হয় । মলয়ের নিজের করা কবিতার অনুবাদগ্রন্হ ‘সিলেকটেড পোয়েমস’ রাইটার্স ওয়র্কশপ থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে । এই পর্বে তিনি অনুবাদ করেছেন অ্যালেন গিন্সবার্গের হাউল ( ১৯৯৪ ) ও ক্যাডিশ ( ১৯৯৫ ), জাঁ ককতোর ‘ক্রুসিফিকেশান’ ( ১৯৯৬ ) ‘ত্রিস্তান জারার কবিতা ও ডাডা ম্যানিফেস্টো’ ( ১৯৯৬ ) ব্লাইজি সঁদরার ‘ট্রান্স সাইবেরিয়ান এক্সপ্রেস’ ( ১৯৯৭ ), উইলিয়াম ব্লেকের ‘ম্যারেজ অফ হেভেন অ্যাণ্ড হেল’ ( ১৯৯৮ ), সালভাদর দালির ‘আমার গুপ্তকথা ( ২০০১ ), পল গঁগার ‘আত্মজীবনী ( ১৯৯৯ ) । শার্ল বদল্যার’, আর্তুর র‌্যাঁবো’ ও অ্যালেন গিন্সবার্গের জীবনী লেখেন যা কবিতীর্থ থেকে প্রকাশিত হয় । আমেরিকার গেল পাবলিশার্স তাঁদের আত্মজীবনী সিরিজে ১৯৯১ সালে মলয়ের জীবনী প্রকাশ করেন । মুম্বাইতে তাঁর সঙ্গে আরনেস্তো কার্দেনালের পরিচয় হয় ।

বিভিন্ন সময়ে দেয়া তাঁর সাক্ষাৎকারগুলো একত্রিত করে অজিত রায়ের সম্পাদনায় “হাংরি সাক্ষাৎকারমালা” নামে মহাদিগন্ত থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে । পরবর্তী সাক্ষাৎকারগুলো অরবিন্দ প্রধানের সম্পাদনায় গ্রাফিত্তি থেকে প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে । ২০১৭ পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজিতে দেয়া তাঁর সমস্ত সাক্ষাৎকার প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘কথাবার্তা সংগ্রহ’ নামে প্রতিভাস থেকে প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে ; যাঁদের নেয়া সাক্ষাৎকার সংকলিত হয়েছে তাঁরা হলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ, মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়, সোনালি মিত্র, গোলাম রব্বানি, নাসের হোসেন, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, রাহুল দাশগুপ্ত, স্বপনরঞ্জন হালদার, অনুপম মুখোপাধ্যায়, দেবাশিস সাহা, উমাপদ কর, অলোক বিশ্বাস, সুদীপ ঘোষ, আলেকজান্ডার জোরগেনসেন, কুমার বিষ্ণু দে, সুদক্ষিণা চট্টোপাধ্যায়, গার্গী ঘোষদস্তিদার, তাপস মিত্র, সায়ন্তনী পাল, প্রবুদ্ধ ভট্টাচার্য, মৃণালকান্তি রক্ষিত, প্রণবেন্দু দেবনাথ, দেবপ্রসাদ সরকার, বাপী চক্রবর্তী, শ্যামল শীল, পার্থ মুখোপাধ্যায়, মন্দিরা পাল, গোপীনাথ কর্মকার, আভাস মিত্র, সৈয়দ সমিদুল আলম, কুণাল মণ্ডল, ফরজানা ওয়ারসি, অদ্রীশ বিশ্বাস, শংকর সরকার, দীপেন রায়, বাসব দাশগুপ্ত, বিবেকানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও অরুণেশ ঘোষ । মন্দিরা পাল-এর সূত্রে পুনেনিবাসী রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গে পরিচয়, যিনি ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ রিভিউ করেছিলেন । ‘দাহপত্র’ থেকে ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘নিজের নেয়া নিজের সাক্ষাৎকার’ । ২০১৩ সালে ‘সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী” থেকে প্রকাশিত হয় ‘ছোটোলোকের কবিতা’ ।  তাঁর তিনটি অগ্রন্হিত কাব্যনাট্য ‘ভালোবাসার উৎসব’, যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের’ এবং ‘ভরসন্ধ্যা’ ২০১৪ সালে ‘বকলম’ পত্রিকায় প্রকাশিত । কবিতীর্থ থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রেমের কবিতার বই ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো’ ।

মলয়ের প্রথম উপন্যাস ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে, “হাওয়া৪৯” পত্রিকায় ; পুস্তকাকারে হাওয়া৪৯ প্রকাশনী থেকে একই বছরে । দ্বিতীয় উপন্যাস ‘জলাঞ্জলি’ ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘একালের রক্তকরবী’ পত্রিকায় ; পুস্তকাকারে একই প্রকাশনী থেকে ১৯৯৭ সালে । ‘নখদন্ত’ উপন্যাস ২০০২ সালে হাওয়া৪৯ পত্রিকায় প্রকাশিত ও সেখান থেকেই গ্রন্হাকারে পরের বছর ; বইটি গুরুচণ্ডালী প্রকাশনী আবার ছেপেছে ২০১৬ সালে । গুরুচণ্ডালী থেকে বেরিয়েছে ডিটেকটিভ বই ‘অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস’ ২০১২ সালে, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ ২০১৩ সালে ও ‘নিজের বাছাই’ ২০১৮ সালে । ‘নিজের বাছাই’তে অন্তর্ভুক্ত ‘নাম নেই’ ও ‘নেক্রোপুরুষ’ উপন্যাস, বর্ধমানের সাঁইবাড়ির ঘটনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর প্যাশটিশ ও ‘সুর্পনখা-বাল্মীকি সংবাদ’ কাব্যনাট্য।  প্রথম গল্পের বই ‘ভেন্নগল্প’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে, দিবারাত্রির কাব্য প্রকাশনী থেকে । তৃতীয় উপন্যাস ‘নামগন্ধ’ প্রথমে প্রকাশিত হয় ঢাকায়, সাহানা প্রকাশনী থেকে ১৯৯৯ সালে । চতুর্থ পর্ব ‘ঔরস’ প্রকাশিত হয় ‘আগামীকাল’ পত্রিকায় এবং পঞ্চম পর্ব ‘প্রাকার পরিখা’ দমদম জংশন পত্রিকায় ২০১৮ সালে । এবাদুল হক ২০০০ সালে প্রকাশ করেন “অতিবাস্তব গল্পগাছা” । দুটি বইয়ের গল্পগুলো একত্রে কবিতীর্থ থেকে প্রকাশিত হয় ‘গল্পসংগ্রহ’ নামে । ‘কোয়ার্ক’ থেকে ২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘অপ্রকাশিত ছোটোগল্প’ অন্তর্ভুক্ত হয়নি গল্পসংগ্রহ বইতে । ’দমদম জংশন’ পত্রিকায় ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘হৃৎপিণ্ডের সমুদ্রযাত্রা’ উপন্যাস । স্মৃতিকথা ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ প্রথমে কোয়ার্ক থেকে প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে এবং পরবর্তী পর্ব ‘এই অধম ওই অধম’ কবিতীর্থ থেকে । দুটি একত্রে ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা, নামে চর্চাপদ থেকে প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। স্মৃতিকথার পরবর্তী পর্ব ‘ছোটোলোকের যুববেলা’ প্রকাশিত হয়েছে ‘রাবণ প্রকাশনী’ থেকে ২০১৫ সালে । শেষ পর্ব ‘ছোটোলোকের জীবন’ কলকাতায় ‘আখর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ; গন্হভূক্ত হয় ঢাকার ‘ভিন্নচোখ’ প্রকাশনীর বই ‘স্বনির্বাচিত মলয় রায়চৌধুরী’তে। রাবণ প্রকাশনী থেকে ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় একটিমাত্র বাক্যে লেখা রাজনৈতিক উপন্যাস ‘ভিড়পুরুষ ও নরমাংসখোরদের হালনাগাদ’ । ‘চন্দ্রগ্রহণ’ পত্রিকায় ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা’ উপন্যাস । ‘রাহুকেতু’, ‘লাবিয়ার মাকড়ি’ ও ‘ঔরস’  একত্রে ‘তিনটি নষ্ট উপন্যাস’ নামে প্রতিভাস থেকে প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে । ‘জঙ্গলরোমিও’ উপন্যাস ‘কোয়ার্ক প্রকাশনী’ থেকে ২০১৬ সালে । হাংরি আন্দোলনের গল্পকার অবনী ধরকে অন্যেরা উপেক্ষা করতেন জেনে তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর লেখা সব কয়টি গল্প একত্রিত করে সম্পাদনা করেন ও শর্মী পাণ্ডের প্রকাশনী থেকে প্রকাশের ব্যবস্হা করেন ।

মলয়ের প্রথম প্রবন্ধের বই ‘পোস্টমডার্নিজম’, ১৯৯৫ সালে ‘হাওয়া৪৯’ থেকে প্রকাশিত । ‘পরাবাস্তববাদ’ প্রকাশিত ১৯৯৭ সালে ধুর্জটি চন্দের ‘এবং প্রকাশনী’ থেকে । ‘আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবাত্রা’ ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত  ‘কবিতা পাক্ষিক’ থেকে । ‘মতান্তর’ প্রকাশিত ২০০০ সালে শংকর সরকারের ‘অতএব প্রকাশনী’ থেকে । ‘পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন’ প্রকাশিত ২০০০ সালে সুকুমার চৌধুরীর ‘খনন প্রকাশনী থেকে । মুর্শিদ এ এম-এর ‘আবিষ্কার প্রকাশনী’ থেকে ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’ প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড ২০১১ সালে । কবিতীর্থ থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’। অধীর বিশ্বাসের ‘গাঙচিল’ থেকে ২০১৬ সালে ‘রচনাসংগ্রহ’ প্রথম খণ্ড ; পরবর্তী খণ্ডগুলো আর প্রকাশ করতে চাননি প্রকাশক ।

মলয়ের হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা কবিতা নিয়ে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন বিষ্ণুচন্দ্র দে এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম ফিল করেছেন স্বাতী ব্যানার্জি । ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো হিডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছেন । বিবিসির চ্যানেল থ্রি রেডিওর পক্ষে ডোমিনিক বার্ন তাঁর সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করেছেন। আমেরিকার উটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে ২০১৪ সালে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ফিল্ম তৈরি করেছেন । তাঁর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা নিয়ে ২০১৫ সালে ফিল্ম তৈরি করেছেন মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়  । কবিতাটি ইউটিউবে নিজস্ব ঢঙে আবৃত্তি করেছেন তনুময় গোস্বামী, শিবাশিস দাশগুপ্ত, আরাফত রাণা, অ্যালেন সাইফুল, নুর হোসাইন, রাজীব চৌধুরী ও কৃষ্ণেন্দু মুখার্জি । মলয়কে কেন্দ্র করে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী হাংরি আন্দোলন নিয়ে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে একটি বই লিখেছেন যা ২০১৮ সালে পেঙ্গুইন র‌্যানডাম হাউস থেকে প্রকাশিত হয়েছে । রাহুল দাশগুপ্ত ও বৈদ্যনাথ মিশ্রের সম্পাদনায় ‘দমদম জংশন পাবলিকেশান’ থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে দশজন গবেষকের বিশ্লেষণের সংকলন ‘লিটারেচার অব হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট - আইকনস অ্যাণ্ড ইমপ্যাক্ট’ । মলয় কোনো পুরস্কার ও সম্বর্ধনা নেন না । ২০০৩ সালে অনুবাদের জন্য দেয়া সাহিত্য অকাদেমির পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । একাকীত্বের পরিসর ও চিকিৎসার সুবিধার জন্য মলয় ২০০৯ সাল থেকে স্ত্রীর সঙ্গে মুম্বাইয়ের কাণ্ডিভালি শহরতলিতে ছেলের ফ্ল্যাটে থাকেন । তাঁর ছেলে ও মেয়ে বিদেশে থাকেন ।


No comments:

Post a Comment