Monday, July 15, 2019

নাইজেরিয়ার সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবের পরাবাস্তব কবিতা ( ১৯৩০ - ২০১৩ ) অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

নাইজেরিয়ার সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবের পরাবাস্তব কবিতা ( ১৯৩০ - ২০১৩ )
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
শকুনেরা
ধূসরতায়
আর এক পশলা বৃষ্টিতে এক হতাশ
সকাল অগ্রদূতদের দ্বারা অনালোড়িত
সূর্যোদয়ে এক শকুন
অনেক উঁচু গাছের ভাঙা
হাড়ের ডালে বসে 
কাছে ঘেঁষে বসল
ওর সঙ্গীর মসৃণ
চোট-খাওয়া মাথায়, একটা নুড়ি
এক ডালে শেকড়-পোঁতা
কুৎসিত পালকের জঞ্জালে
আদর করে ঝুঁকলো
শকুনির দিকে । কালকে ওরা পেয়েছিল
জলভরা গর্তে একটা ফোলা লাশের
দুটো চোখ আর নাড়িভুঁড়িতে 
যা ছিল তা খেয়েছিল । পেট
ভরে খেয়ে ওরা বেছে নিলো
ওদের বিশ্রামের দাঁড়
বাকি ফাঁপা মাংসের দিকে
শীতল চাউনির সহজ
দূরবিন চোখের আওতায়…

অদ্ভুত
সত্যিই প্রেম কেমন অন্য
উপায়ে এতো সুনির্দিষ্ট
একটা কোনা তুলে নেবে
শব রাখার ওই বাসায়
সাজিয়ে-গুছিয়ের গুটিয়ে বসবে সেখানে, হয়তো
ঘুমিয়েও পড়বে -- শকুনির মুখ
দেয়ালের দিকে মুখ করে !

...এইভাবেই বেলসেন ক্যাম্পের 
কমাণ্ডান্ট দিনের শেষে বাড়ি 
গেলেন সঙ্গে পোড়া মানুষের
ধোঁয়া বিদ্রোহ করে নাকের
চুলে ঝুলে আছে যা থামবে
রাস্তার ধারে মিষ্টির দোকানে
একটা চকোলেট তুলে নেবে
তার কচি খোকার জন্য
বাড়িতে অপেক্ষা করছে
বাবা কখন ফিরবে…

বদান্য দূরদর্শিতার
গুণগান করো যদি চাও
যে এমনকি মানুষখেকো
রাক্ষসকেও একটা ছোটো
জোনাকি উপহার দ্যায়
কোষে মোড়া কোমলতা
নিষ্ঠুর হৃদয়ের তুষার গুহায়
নয়তো সেই বীজানুর জন্যেই
হাহুতাশ করো স্বজাতীয় প্রেমে
যাতে চিরকালের জন্য 
প্রতিষ্ঠিত করে হয়েছে
অমঙ্গল ।

জবাব
শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেললুম
সন্ত্রাসের ঝালর-বসানো মোহ
যা আমার প্রাচীন চাউনিকে বেঁধে রাখে
ওই ভিড়ের মুখগুলোর সঙ্গে
যা লুটতরাজের আর দখল করে আমার
অবশিষ্ট জীবন এক অলৌকিকতায়
শাদা-কলার হাতের নির্দেশের মাঝে
আর নাড়িয়ে দিলুম এক সস্তা 
ঘড়ির মতন আমার কানের কাছে
আর আমার পাশে মেঝেয় ছুঁড়ে
ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালুম । আমি
তাদের কাঁধ আর মাথাকে
ওপর-নিচ করালুম এক নতুন
সিঁড়ি দিয়ে আর ঝুঁকলুম
ওদের ঘেমো সারিতে
আর উঠে গেলুম মাঝের হাওয়া পর্যন্ত
আমার হাত কঠোরতার জন্য এতো নতুন
পাকড়াও করতে পারলুম এক 
ঝঞ্ঝাটে দিনের বন্ধুরতা
আর তেষ্টা মেটালুম উৎসের
যা তাদের পাগুলোকে উথালপাথাল 
খাওয়াচ্ছিল । আমি এক নাটকীয়
অবনমন আরম্ভ করলুম সেইদিন
পেছন দিক ফিরে গুঁড়িমারা ছায়ায়
ভাঙা মৌতাতের টুকরোয় । আমি
খুলে ফেললুম অনেকদিনের বন্ধ জানালা
আর দরোজা আর দেখলুম আমার চালাঘর
ইন্দ্রধনুর ঝাঁটায় নতুন সাফসুথরো করা
সূর্যের আলো আবার আমার বাড়ি হয়ে গেল
যার নিয়তিনির্দিষ্ট মেঝেতে অপেক্ষা করছিল
আমার গর্বিত চঞ্চল জীবন ।

উড়াল
( নিই ওসুনদারের জন্য ) 
দ্রাঘিমায় কিছু-একটা ক্ষমতার লালসাকে প্রশ্রয় দ্যায়
নিছক বাড়ির ছাদটুকু আমিরের জন্য যথেষ্ট
বৈভবশালী পাগড়ির দামি পাক থেকে বিলিয়ে দেন
ধুলোয় হামাগুড়ি দেয়া কৃষকদের
বিরল দুর্বোধ্য মাথা নাড়া যা প্যাঁচানো থাকে
রাজকুমারীয় বিষণ্ণতায় ।
আমিও জেনেছি
ওই ঝলসানো আদিম ক্ষুধাবোধ,
জীবন প্রকাশ করার দ্রুতি
এক দীর্ঘ পিছুহটা প্রবৃত্তি ।
যদিও দড়িবাঁধা আর হাতকড়া পরানো
সেই দিন আমি চূড়া থেকে হুকুম দিলুম ।
তিন তলা জগতের এক সেতু খাপ খেয়ে যায়
আমার উন্মাদ গর্বিত মূর্তির সঙ্গে যা আমি হয়েছি।
ভাসমান মেঘের এক ম্যাজিক লেপ
নিজের শাদা কোমলতাকে ওড়ালো আর ঘষল
আমার পায়ের তলায় পেশাদার পরীর আঙুলের মতন
আর ব্যাণ্ডেজের কাপড়ের ছাঁকনি দিয়েঢ
এক মহানগরের বিস্ময় প্রকাশ করল
সে ম্যাজিক পরীর দেশের আয়তনের ।
চাউনিকে বিভিন্নভাবে মাপজোক করে
আমি মেঘগুলোকে ভাসিয়ে দিলুম
এক স্হির চারণভূমির ওপরে, মিনারের ওপরে
আর মাস্তুল আর ধোঁয়া-পালক চিমনিতে ;
কিংবা পৃথিবীটাকেই উল্টে দিলুম, ছেড়ে দিলুম
তা থেকেই, এক ভবঘুরে ফেরারিকে
অবিচল আকাশের তলায় । তারপর এলো
জগতের ওপরে এক আচমকা ঔজ্বল্য,
তা ছিল বিরল শীতের হাসি, আর আমার
মেঘ-জাজিমের ওপরে একটা কালো ক্রশ আঁকা
যা ইন্দ্রধনুর অক্ষিগোলকে আটক । যাতে এলো
খ্রিষ্টজন্মের অসাধারণত্ব -- তাছাড়া কেই বা আসতো
ধূসর অখেলোয়াড়সুলভ তর্ক, অবিশ্বস্ত
বিদ্যাবাগিশের উৎসর্গ-করা টেকো অবাধ্য ঘোষণা ?
কিন্তু কি তুলনাহীন সৌন্দর্য ! কি গতি !
রাতের এক রথ নিয়েছে আতঙ্কের উড়াল
সেই দিনের আচার-বিচার সম্পর্কে আমাদের 
রাজকীয় ঘোষণা থেকে ! আর আমাদের কল্পনার
মিছিল ঘোড়ায় চেপে এগিয়েছে। আমরা এক প্রাচীন
লোভকে দমিয়েছি যা যুগ যুগ পড়ে থেকে কুঁকড়েছিল
যতক্ষণ না মহিমাময় শোভাযাত্রা দেখে ক্লান্ত চোখ
ফিরে এলো বিশ্রাম নেবার জন্যে ওই ক্ষুদ্র
কিংবদন্তিতে যা জীবনের পোশাককে টেনে নিয়ে গেল
সব জায়গা ছেড়ে আমার আসনের তলায় ।

এখন আমি ভাবি আমি জানি কেন দেবতারা
উচ্চতার ক্ষেত্রে পক্ষপাত করেন -- পাহাড়ের
শীর্ষকে আর গম্বুজকে, গর্বিত ইরোকো গাছগুলোকে
আর কাঁটার পাহারা-দেয়া বোমবাক্সকে,
কেন মামুলি গৃহদেবতারা
কঠিন কাঠের দাঁড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বসবেন
ঝুরঝুরে কড়িকাঠ  থেকে বিপজ্জনকভাবে ঝোলানো
চালাবাড়ির চালে যা আরামে বসে আছে
পৃথিবীর নিরাপদ মাটিতে ।

প্রতিশ্রুতি-ভীতি
হুররে ! তাদের জন্য যারা কিচ্ছু করে না
কিছুই দেখে না অনুভব করে না যাদের
হৃদয়ে বসানো আছে দূরদর্শিতা
পাতলা ঝিল্লির মতন গর্ভের উন্মুখ
দরোজায় যাতে বীর্যক্রোধের কলঙ্ক
না ঢুকতে পারে । আমি শুনেছি পেঁচারাও
জ্ঞানের গোলক পরে থাকে তাদের
চোখের চারিধারে প্রতিরোধ হিসেবে
প্রতিটি অসুরক্ষিত চোখ দ্রুত আড়াল পেতে চায়
আলোর ছোঁড়া কাঁকর থেকে । অনেকদিন আগে
মধ্য প্রাচ্যে পনটিয়াস পাইলেট
সবার সামনে তাঁর শাদা হাতের অবদান 
ধুয়েছিলেন যা বিখ্যাত হয়েছিল । ( তাঁর আগের
আর পরের রোমের কর্তাদের মধ্যে তাঁকে ছাড়া আর
কাকে নিয়ে আলোচনা হয়েছিল প্রতিটি
রবিবার পাঠানো প্রচারকদের ধর্মবিশ্বাস ? ) আর
প্রচারকদের কথা বলতে হলে সেই অন্য লোকটা
জুডাস অমন মূর্খ ছিল না মোটেই ; যদিও
বড়ো বেশি বদনাম হয়েছিল পরের প্রজন্মের
লোকেদের দ্বারা তবু তথ্য তো থেকেই যায় যে
তারই একা ওই  নানা-পোশাক জমঘটে
যথেষ্ট বোধবুদ্ধি ছিল এই কথা বলার
একটা মারাত্মক আন্দোলন যখন ও দেখল
আর তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল, একটা সুন্দর
ছোটো পুঁটলি ওর কোটের পকেট ফুলিয়ে রেখেছে
লেনদেনের ব্যাপারে -- ব্যাটা বেশ বিচক্ষণ ।

প্রেমচক্র
ভোরবেলায় আস্তে আস্তে
সূর্য নিজের কুয়াচ্ছন্ন দীর্ঘ 
বাহুর আলিঙ্গন ফিরিয়ে নেয় ।
খোশমেজাজ প্রেমিক-প্রেমিকারা
 প্রেমের ঘষাঘষি-কারবারের 
কোনোরকম স্বাদ বা ক্বাথ 
ফেলে যায় না ; পৃথিবী
শিশিরে সুগন্ধিত
সুবাসে জেগে ওঠে
নরম-চোখ আলোর
ফিসফিসানিতে…
পরে যুবক তার 
গুণাবলীর সমতা খুইয়ে ফেলবে
স্বর্গের বিশাল জমি চাষ করার
সময়ে আর তার ফল ফলাবে
যুবতীটির তপ্ত ক্রোধের
ফুলকির ওপরে । বহুকাল যাবত
অভ্যস্ত অমনধারা আবদারে
যুবতীটি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে
সন্ধ্যার জন্য যখন আরেক রাতের
চিন্তাভাবনা যুবকটির প্রফুল্লতা
পুনরুদ্ধার করবে 
আর যুবতীটির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা
যুবকটির ওপরে ।

প্রজাপতি
গতি হল উৎপীড়ন
ক্ষমতা হল উৎপীড়ন
ওজন হল উৎপীড়ন
প্রজাপতি সুরক্ষা খোঁজে মৃদুতায়
ভারহীনতায়, ঢেউখেলানো উড়ালে
কিন্তু এক চৌমাথায় যেখানে নানারঙা আলো
গাছেদের থেকে হঠকারী নতুন রাজপথে পড়ে
আমাদের অভিসারী এলাকার সংযোগ ঘটে
আমি দুজনের জন্য যথেষ্ট খাবার সঙ্গে করে আনি
আর অমায়িক প্রজাপতি নিজেকে উৎসর্গ করে
উজ্বল হলুদ আত্মবলিদানে
আমার কঠিন সিলিকন ঢালের ওপরে ।

উদ্বাস্তু মা আর ছেলে
কোনো ম্যাডোনা আর
শিশু ছুঁতে পারবে না
মায়ের কোমলতার ওই ছবিটিকে
একজন ছেলের খাতিরে ওনাকে দ্রুত ভুলে যেতে হবে।
বাতাস দুর্গন্ধে কটু হয়ে উঠেছিল
না-ছোঁচানো শিশুদের আমাশার
যাদের ক্ষয়ে যাওয়া পাঁজর আর শুকনো
পাছা ফুলে ফাঁপা তলপেট নিয়ে 
দাঁড়াতে চেষ্টা করছিল । অনেকেরই
মা বহুকাল যাবত পালন করা বন্ধ
করে দিয়েছে কিন্তু এর নয় । মা
দাঁতের পাটির মাঝখানে ভুতুড়ে 
হাসি ধরে রেখেছিল আর দুই চোখে
এক ভুতুড়ে মায়ের গর্ব যা আঁচড়ে দিচ্ছিল
করোটিতে টিকে থাকা মরচেরঙা চুল
আর তখনই --

দুই চোখে গান নিয়ে -- যত্নে আরম্ভ করল
সিঁথেকাটা...আরেক জীবনে এই কাজ
হতো প্রতিদিনের ঘটনা যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ
নয়, ওর সকালের খাবার আর স্কুলে যাবার 
আগে ; এখন মা

একটা ছোটো কবরে
ফুল রাখার মতন কাজটা করছিলেন ।





Saturday, July 6, 2019

চিলে-র কবি পাবলো নেরুদা-র কবিতা ( ১৯০৪ - ১৯৭৩ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

চিলে-র কবি পাবলো নেরুদার কবিতা ( ১৯০৪ - ১৯৭৩ ) । 
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

কেবল মৃত্যু
চারিদিকে ছড়িয়ে আছে নীরব কবর
শব্দহীন হাড়ে-ঠাশা অজস্র গোরস্তান
সুড়ঙ্গ বোনায় ব্যস্ত হৃদয়,
এক অন্ধকার, অন্ধকার ভূগর্ভপথ :
ভাঙা জাহাজের মতন আমরা প্রাণকেন্দ্রের অতল পর্যন্ত মারা যাই,
যেন হৃদয়-বরাবর ডুবে চলেছের
অথবা ত্বক থেকে আত্মার দিকে ভেতরে-ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছে

রয়েছে শবদেহের কাতার
পায়ের পরিবর্তে চটচটে পাথরফলক,
হাড়ের ভেতরে আছে মৃত্যু
বিশুদ্ধ এক শব্দের মতন,
কুকুরহীন কুকুরডাকের মতো
কোনো ঘণ্টাধ্বনি থেকে মুক্ত, বিশেষ কবরগুলো
বৃষ্টির আর্তনাদের মতন এই আর্দ্রতায় ফেঁপে উঠছে।

অনেক সময়ে যখন একা থাকি, আমি দেখতে পাই,
পাল তুলে ভেসে যাচ্ছে কফিনগুলো
বেরিয়ে পড়েছে ফ্যাকাশে মৃতদের নিয়ে,  বিনুনিবাঁধা মৃত নারীরা,
দেবদূতের মতন শাদা পাঁউরুটিঅলা,
দলিল-প্রমাণকের সঙ্গে বিবাহিত দুই মেয়ে,
মৃতদের আকাশমুখো নদী বেয়ে উঠে যাচ্ছে কফিনগুলো,
নিজের উৎসমুখের দিকে মদ-কালো নদী,
মৃত্যুর সঙ্গে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তাদের পাল,
মৃত্যুর শব্দহীন আওয়াজে ভরা ।

শব্দের দিকে আকৃষ্ট হয় মৃত্যু
পা-হীন চটিজোড়ার মতন, মানুষহীন পোশাকের মতন,
দরাজায় রুনুঝুনু টোকা দেয়, আঙুলহীন আর রত্নহীন
চলে আসে হাঁ-মুখহীন চিৎকার তুলতে, জিভ নেই, গলা নেই।
তবু তার পদধ্বনি তো শুনতে পাওয়া যায়
আর তার পোশাক প্রতিধবনি তোলে, ঠিক যেন গাছের ফিসফিস ।

আমি কিছুই জানি না, আমি অবিদিত, দেখতে পাচ্ছি না কিছু
কিন্তু আমার মনে হয় তার গানের রঙ ভিজে ভায়োলেট ফুলের মতো,
মাটি-পৃথিবীর সাথে সুপরিচিত ভায়োলেট ফুল,
কেননা মৃত্যুর মুখের রঙ সবুজ
কেননা মৃত্যুর দৃষ্টির রঙ সবুজ
ভায়োলেট পাতার গায়ে এচিং-করা আর্দ্রতা
আর যন্ত্রণায় কাহিল শীতের বর্ণে রাঙানো তার কবর ।

কিন্তু মৃত্যু তো সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, ঝাড়ুগাছায় চেপে
মাটিপৃথিবীকে চেটে বেড়ায় শবদেহের খোঁজে---
ওই ঝাড়ুখানাতেই আছে মৃত্যু,
মৃতের খোঁজে তা যেন মৃত্যুর জিভ,
মৃত্যু-ছুঁচ খুঁজে বেড়াচ্ছে তার সুতো।
মৃত্যু আমাদের পালঙ্কে শুয়ে আছে :
অলস তোষকের ওপরে, কালো রঙের কম্বল,
পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে আর হঠাৎই উড়তে শুরু করে,
চাদরগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে অজানা আওয়াজে
বেশ কিছু বিছানা বন্দরের দিকেও উড়ে যায়
যেখানে নৌ-সেনাপতির পোশাকে অপেক্ষা করছে মৃত্যু।

চিলের আবিষ্কারক
দক্ষিণ আলমগারে থেকে সে নিয়ে এলো তার আগুনের গুঁড়ো ।
আর সমগ্র এলাকা জুড়ে, বিস্ফোরণ আর সূর্যাস্তের মাঝে,
ও ঝুঁকে রইল, দিনভর আর রাতভর, যেন রেখাচিত্র দেখছে
কাঁটাঝোপের ছায়া, ক্যাকটাস ও মোমের ছায়া,
স্প্যানিশ লোকটা নিজেরই শুকনো চেহারার সঙ্গে দেখা করছে,
নজর রাখছে এলাকার অন্ধকার দখল-কৌশলের দিকে ।
নিশাকাল, তুষার, আর বালিতে গড়ে উঠেছে
আমার রুগ্ণদেশের নকশা,
দীর্ঘ তীরের কিনারায় পড়ে রয়েছে নৈঃশব্দ,
তার সামুদ্রিক দাড়ি থেকে ফেনা ঝরে পড়ে
রহস্যময় চুমু দিয়ে ঢাকা থাকে ওর কয়লার বিশাল ।
তার আঙুলে অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতন জ্বলজ্বলে সোনা
আর সবুজ চাঁদের মতন ঝলমলে তার রুপো।
গোমড়ামুখ উপগ্রহের পুরু ছায়ায় ঢাকা । 
স্প্যানিশ লোকটা একদিন গোলাপের পাশে,
অলিভ অয়েলের পাশে, মদের পাশে, প্রাচীন আকাশের তলায় বসে,
এই খিটখিটে পাথরখণ্ডের কথা ভেবে দেখলো না
যেটি সমুদ্র-ঈগলের গুয়ের তলা থেকে জন্মাচ্ছিল ।

পোশাকের জন্য গাথাকবিতা
প্রতিদিন সকালে তুমি অপেক্ষা করো
পোশাক, চেয়ারের ওপরে,
আমার শ্লাঘা মেটাবার জন্য,
আমার ভালোবাসা,
আমার আশে, আমার শরীর
যাতে তোমায় পূর্ণ করে,
আমি ঘুমকে সবেমাত্র ছেড়েছি,
জলকে বলেছি এখন চলি তাহলে
আর প্রবেশ করেছি তোমার আস্তিনে,
আমার পা দুটো
তোমার ফাঁপা পায়ের খোঁজ করে,
আর তাই
তোমার অক্লান্ত আনুগত্যের আলিঙ্গনে
আমি খড়ের মাড়াই করতে বেরিয়ে পড়ি,
কবিতায় প্রবেশ করি,
জানালার বাইরে তাকাই,
জিনিসপত্রের দিকে,
পুরুষ, নারী,
ঘটনাপ্রবাহ ও সংঘর্ষ
আমি যা আমাকে সেরকমই গড়তে থাকে,
আমার বিরোধিতা করে,
চোখ খুলে দ্যায়,
স্বাদ এনে দ্যায় হাঁ-মুখে
আর এভাবে,
পোশাক,
তুমি যা আমি তোমাকে সেরকমই গড়ে তুলি,
তোমার কনুই হতে টান দিয়ে,
সেলাইয়ে জায়গায় আঁটোসাঁটো,
আর তাই তোমার জীবন স্ফীত হয়ে ওঠে
আমারই জীবনের মূর্তচেহারা ।
তুমি উত্তাল
এবং হাওয়ায় আলোড়ন তোলো
যেন তুমি আমার আত্মা,
ভালো লাগছে না এরকম সময়ে
তুমি আমার হাড়
আঁকড়ে থাকো
ফোঁপরা, রাতের বেলায়
অন্ধকার, ঘুম,
মানুষ তাদের মায়াপুরুষদের সঙ্গে
তোমার আর আমার ডানা হয়ে যায় ।
আমি প্রশ্ন করি
কোনও একদিন কি
একটা বুলেট
শত্রুপক্ষের দিক থেকে
তোমাকে আমার রক্ত দিয়ে ভেজাবে
আর তারপর
তুমি আমার সঙ্গে মারা যাবে
কিংবা হয়তো
না-ও হতে পারে
অমন নাটকীয়
বরং অতি সাধারণ,
তুমি ক্রমে অসুখে পড়বে,
পোশাক,
আমার সাথে-সাথে, আমার শরীরের সঙ্গে
একসাথে
আমরা প্রবেশ করব
পৃথিবীর মাটিতে ।
এই সমস্ত চিন্তায়
প্রতিদিন
আমি তোমায় অভিবাদন করি
শ্রদ্ধায়, আর তারপর
তুমি আমায় জড়িয়ে ধরো অথচ আমি তোমায় ভুলে যাই
কেননা আমরা একাত্ম
অবিরাম মুখোমুখি দুজনে
এক সাথে বাসতাসের, রাতের বেলায়,
পথে-পথে অথবা সংঘর্ষে,
একদেহ
হয়তো, হয়তো, একদিন নিথর ।

এই এপিটাফ এক আলোয় গড়া জানোয়ারের
এবং আজ হারিয়ে যাওয়া অরণ্যের গভীরে
সে শত্রুর আওয়াজ শুনতে পায় আর পালায়
অন্য কারোর কাছ থেকে
সেই অশেষ কথোপকথন থেকে
যে বৃন্দগান সবসময়ে আমাদের সঙ্গে থাকে তা থেকে
এবং জীবনের অর্থময়তা থেকে
কেননা এই একবার, কেননা কেবল একবার, কেননা
একটি শব্দমাত্রা অথবা একটি নৈঃশব্দের বিরামকাল
অথবা একটি ঢেউয়ের অবরোধহীন ধ্বনি
সত্যের মুখোমুখি আমাকে ছেড়ে চলে যায়
এবং তখন আর ব্যাখ্যা করার জন্য কিছু বাকি নেই,
বলার মতো আর কিছু নেই : এইই সবকিছু ।
অরণ্যের দরোজাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । 
পাতাদের উন্মুক্ত করে সূর্য পাক খেয়ে চলে
চাঁদ ওঠে কোনো শাদা রঙের ফলের মতন
আর মানুষ তার নিয়তির কাছে মাথা নত করে।