Friday, January 6, 2023

My maternal grandfather Kishorimohan Bandyopadhyay

 

ইনি আমার দাদামশায়, মায়ের বাবা, কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়

কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭ - ১৯২৯) ব্রিটিশ ভারতের এক জন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও স্যার রোনাল্ড রস-এর সহ-গবেষক ছিলেন। রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী হিসাবে অ্যানোফিলিস মশাকে চিহ্নিত করে ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কার পান। কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৯০৩ সালে সম্রাট সপ্তম এডোয়ার্ডের স্বর্ণপদক দ্বারা পুরস্কৃত করা হয়।

জন্ম ও পরিবার

কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা শহরের এন্টালি পাড়ায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক আদিনিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলায়। মহারাজা প্রতাপাদিত্যের পতনের পর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বৈষ্ণব অধ্যুষিত তদানীন্তন পানিহাটি গ্রামে বসবাস আরম্ভ করেন। তাঁর পিতামহ দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এক জন খ্যাতনামা আয়ুর্বেদাচার্য এবং সাংখ্য দর্শনে পারঙ্গম ব্যক্তি ছিলেন। কিশোরীমোহনের বাবা ননীলাল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষার শিক্ষক।

শিক্ষা

পানিহাটিতে প্রাথমিক শিক্ষার পর কিশোরীমোহনকে কলকাতার মাতুলালয়ে ইংরেজি স্কুলে পড়ার জন্য পাঠানো হয়। স্কুলের প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি ভালো ফলাফল করতেন। মাতুলালয় থেকেই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের স্নাতক হন। রোনাল্ড রস তাঁর পরীক্ষার ফলাফল ও সমাজসেবামূলক কাজকর্মের অভিজ্ঞতার জন্য বহু ছাত্রের ইন্টারভিউ এবং হাতেনাতে গবেষণাগারে কাজ দেখার পর কিশোরীমোহনকে নির্বাচন করেছিলেন। পানিহাটি সংলগ্ন গ্রামাঞ্চল থেকে জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের কিশোরীমোহন রোনাল্ড রসের কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতেন। রোগীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল কিশোরীমোহনের আয়ুর্বেদাচার্য ঠাকুরদার রোগী। কিশোরীমোহন নিজেও তাঁর নবলব্ধ বিজ্ঞানের শিক্ষা ও ঠাকুর্দার আয়ুর্বেদের ওষুধের সঙ্গে সামঞ্জস্য খোঁজার প্রয়াস করতেন এবং স্বদেশি ও বিদেশি ওষুধের এই মেলবন্ধনও তদানীন্তন ইউরোপীয় ডাক্তারদের তাঁর প্রতি আগ্রহান্বিত করেছিল ।

কর্মজীবন

ঠাকুর্দার সঙ্গে থাকার সময়ে যখন কিশোরীমোহন প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ছিলেন তিনি আয়ুর্বেদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠছিলেন। গরিব ও দুঃস্থ রোগীদের অবস্থায় তিনি বিপন্ন বোধ করতেন। কলকাতায় যাওয়ার পর গরিব ছাত্রদের নিঃশুল্ক গৃহশিক্ষা দিতেন। বিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার পর তিনি রোনাল্ড রসের সঙ্গে মহানাদ ও কলকাতায় তাঁর সহ-গবেষক রূপে চাকরি করেছেন। রস স্বদেশে চলে যাওয়ার পর কিশোরীমোহন ম্যালেরিয়া রোগ সম্পর্কে বাংলার গ্রামে-গ্রামে প্রচারের কাজ নেন। সেই সূত্রে তাঁর বন্ধু বিধানচন্দ্র রায় তাঁকে স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত করে নেন এবং কিশোরীমোহন আন্দোলনকারীদের বার্তাবাহক হয়ে ওঠেন।

ম্যালেরিয়া-বিরোধী অভিযানে কিশোরীমোহন গ্রামাঞ্চলের দুঃস্থ গরিব চাষি তাঁতি জেলে কামার কুমোরদের আর্থিক অবস্থার প্রতিকার হিসাবে পানিহাটির কয়েক জন বাল্যবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে স্থাপন করেন পানিহাটি কোঅপারেটিভ ব্যাংক। তিনি বিশেষ করে তাঁতিদের সম্পর্কে চিন্তিত ছিলেন। বিলাত থেকে মিলে তৈরি কাপড় আসার পর তাঁতিদের প্রায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মিলে তৈরি কাপড়ের মশারি হয় না বলে গরিবদের পরিবারে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন তিনি। অত্যাধিক কর্মকাণ্ডের দরুণ তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে এবং ১৯২৯ সালে তিনি ম্যানেনজাইটিস রোগে মারা যান।

সম্মাননা

রোনাল্ড রস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের এক প্রতিনিধিদল উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর নেতৃত্বে লর্ড কার্জনের সঙ্গে দেখা করে কিশোরীমোহনকেও আবিষ্কারের জন্য সম্মানিত করার অনুরোধ জানান। প্রতিনিধি দলে ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, শিবনাথ শাস্ত্রী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায়। লর্ড কার্জন বিষয়টি ব্রিটিশ সরকারের গোচরে আনলে দিল্লি দরবারের সময়ে দিল্লিতে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে ১৯০৩ সালে ডিউক অফ কনট কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্বর্ণপদক তুলে দেন।

সূত্র : বিশ্বের সেরা ১০১ বিজ্ঞানীর জীবনী, আ. ন. ম. মিজানুর রহমান পাটওয়ারি, মিজান পাবলিশার্স, ঢাকা


Thursday, November 11, 2021

দেবজ্যোতি রায়-এর দুটি বইয়ের আলোচনা করেছেন মলয় রায়চৌধুরী

দেবজ্যোতি রায়-এর ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ আর ‘নষ্ট আত্মার নোটবই’ : মলয় রায়চৌধুরী মানুষ ক্রোধ, গ্লানি, দুঃখ, ভয়, স্পৃহা, বিষণ্ণতা, যন্ত্রণা, হতাশা, দুর্যোগ ইত্যাদিতে ছেয়ে থাকার সময়ে যদি লেখালিখি বা ছবি আঁকাকে তা প্রকাশের মাধ্যম করেন তখন তিনি নিছক সাহিত্য-শিল্প করেন না, ফিকটিশাস ব্যাপার ছকতে পারেন না । তা এমন এক মানসিক রাসায়নিক বিক্রিয়া যা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উদ্ভূত, যেমন পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’, অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’, লুই ফার্দিনাঁ সিলিনের ‘জার্নি টু দি এণ্ড অফ দি নাইট’ , মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’, সালমান রুশডির ‘দ্য সাটানিক ভারসেস’, হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’, মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ’, সন্তোষ রাণার ‘রাজনীতির এক জীবন’, বিমল সিংহের ‘লংতরাই’, আরভিঙ হায়ওয়ের ‘ব্ল্যাক বয়েজ অ্যাণ্ড নেটিভ সানস’, রিচার্ড রাইটের ‘ব্ল্যাক বয়’ ইত্যাদি । সাহিত্য হয়তো সান্ত্বনা দিতে পারে, কিন্তু প্রতিটি পাঠক সান্ত্বনার জন্য পড়েন না । দেবজ্যোতির প্রথম বইটা, যদিও প্রকাশক বলেছেন উপন্যাস, তা কিন্তু নয়, ফিকশান নয়। এটিকে বলা যায় বিলডুংসরোমানের একটি উপবর্গ ; ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সমাজে মিথ্যার পুনরাবৃত্তি, সমস্ত অশোভনতা, মেলোড্রামা এবং দৃষ্টিভঙ্গির ক্লাস্ট্রোফোবিয়া প্রকাশ্যে আনতে চেয়েছেন দেবজ্যোতি, দেখিয়েছেন ঘৃণা, ভয় এবং হিংস্রতা আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিকে কীভাবে পঙ্গু করেছে এবং এখনও পুরানো মিথ্যার পুনরাবৃত্তি অব্যাহত, খুনোখুনি ও হুমকির শেষ নেই । এই মনোভাবকে প্রকাশ করার জন্য দেবজ্যোতি বাহন করেছেন একটি দ্রুতগামী বেপরোয়া গদ্যের । তাঁর দ্বিতীয় বইটিতে, ‘নষ্ট আত্মার নোটবই’ আছে তেমনই ছোটো-ছোটো গদ্য, নাটক ও ফিকশান; এবং তাতেও তিনি একজন ক্রুদ্ধ লেখক, যাঁর গদ্যে গড়ে উঠেছে উষ্মার ভাপ । দেবজ্যোতির গদ্যকে, দ্বিতীয় বইটির প্রকাশক বলেছেন ‘ভাষা সন্ত্রাস’ এবং তা লেখকের সচেতন প্রয়াস। রাগ হল একটি নেতিবাচক আবেগ—এটাই আমাদের শেখানো হয়েছে এবং আমাদের সংস্কৃতি তা বিশ্বাস করে। রাগ কি "খারাপ"? যখন মনে করা হয় যে রাগ প্রায়শই মানসিক বা শারীরিক ব্যথার প্রতিক্রিয়া, এবং বিষণ্নতা, যন্ত্রণা, দুঃখ, ভয় এবং হতাশার মতো সম্ভাব্য গৌণ আবেগগুলোকেও তার আওতায় আনে, তখন রাগ একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া বলে মনে হয় । রাগ, হতাশার বিপরীতে, শক্তিতে পূর্ণ - আপনার নাড়ি দ্রুত হয়, আপনার শরীর উত্তপ্ত হয় এবং আপনি কিছু করতে চান, যেকোনো কিছু করতে। যখন সমস্ত শক্তি ইতিবাচকভাবে পরিচালিত হয়, তখন শুভত্ব জাগ্রত হয় । ক্রোধ একটি লাগামহীন, শৃঙ্খলাহীন শক্তিমত্তা । এই কারণেই আমরা মোকাবেলা করার, এবং রাগ পরিচালনা করার বিষয়ে কথা বলি। যদিও রাগের বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে, , মূলত দুটি ধরণের : দ্রুত, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, যা আপনাকে চিৎকার করতে বা নিঃশব্দে বদলা নিতে উৎসাহিত করে । কিন্তু যখন হতাশাজনক শক্তি আপনাকে কাবু করে তখন ফোড়ার মতন, ব্যথা থেকে জন্ম নেয় গভীর রাগ। উভয় ধরনের রাগ ধ্বংসাত্মক হতে পারে, আবার ইতিবাচক, গঠনমূলক হতে পারে। লেখা বা আঁকার মাধ্যমে, মানুষ রাগের কারণগুলোর প্রক্রিয়াকরণ করে। কেউ কেন রাগান্বিত তা একবার জানলে, সে তাকে নিয়ন্ত্রণে আনবে। সে তার প্রতিক্রিয়াগুলো পরীক্ষা করতে পারে এবং প্রকাশভঙ্গী বেছে নিতে পারে। সে রাগ থেকে শিখতে পারে এবং হতাশা বা ক্ষতি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারে। রাগ, এমন একটি আবেগ হয়ে ওঠে যা তাকে জাগিয়ে তোলে এবং নিজের প্রতি মনোযোগ দিতে বাধ্য করে। এই মনোযোগস্পৃহা থেকে লেখা হয়েছে ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’। লেখালিখি বা আঁকা কি রাগ প্রকাশ করার একটি উপায় হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে? কেনই বা হবে না ! লেখালিখি বা আঁকা এমন একটি পাত্র হতে পারে যেখানে একজন মানুষ তার কোনও বিশেষ কিংবা সমস্ত আবেগ ঢেলে দিতে পারেন। আবেগগত, আধ্যাত্মিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে একজন লেখক বা চিত্রশিল্পীর পক্ষে সে কে এবং সে কী তা সে নিজে ছাড়া অন্য কারো পক্ষে গড়ে তোলা আক্ষরিক অর্থে অসম্ভব। সর্বোপরি, তার অন্য কোনও আধার-আধেয় নেই। প্রকৃতপক্ষে, তার তরফ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে দমিয়ে দেবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, সে এই ধরনের একটি মানসিক বিনিয়োগ করতে চায় বা ঘটায়। কারণ, সম্পূর্ণ কাজটা একই সাথে প্রতিটি পাঠক বা দর্শকের জন্য একটি আয়না, যারা তা পড়েন বা দ্যাখেন, একথা দস্তয়েভস্কি অনেক আগেই বলেছেন। একজন রাগান্বিত পাঠক বা দর্শক পাঠবস্তুতে বা পেইনটিঙে রাগকে ঠিক তার নিজের মাত্রায় আবিষ্কার করে। একজন হতাশাগ্রস্ত পাঠক বা দর্শক তার বিচ্ছিন্নতা এবং দুঃখের সঙ্গে মিল খুঁজে পায়। তবে একথা স্বীকার করতে হবে যে সমস্ত লেখালিখি বা ছবিআঁকা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নয়। দেবজ্যোতির ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ বইটির স্বর বিশেষভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যার দরুন লেখকের মনোভাব ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি সরাসরি পাঠকের মর্মে চালান করা যায় । এই স্বর সরাসরি শ্রোতা এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কিত। দেবজ্যোতি এই বইতে রাগান্বিত স্বর যে ভাবে প্রয়োগ করেছেন যে টের পাওয়া যায় উনি এই স্বর অর্জনের জন্য প্রাসঙ্গিক শব্দভাণ্ডারও ব্যবহার করেছেন। দেবজ্যোতি রায় ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ আর ‘নষ্ট আত্মার নোটবই’ আমাকে পাঠিয়েছিলেন ২০২০ সালের অক্টোবরে । এক বছরের বেশি হয়ে গেল, বই দুটো সম্পর্কে আমার ভাবনা গোছাতে । প্রথম বইটাকে প্রকাশক কোয়ার্ক পাবলিশার্স বলেছেন ‘শর্ট নভেল’ । আগেই বলেছি বইটা তা কিন্তু নয় । একটি ধারণা, রূপক বা মডেলের সাহায্যে নতুন ধারণা, ছবিপ্রবাহ বা বিশ্বাস প্রকাশ করতে সক্ষম হওয়া দেবজ্যোতি রায়ের নিজের অধিকারে একটি কৃতিত্ব। পুরো বই জুড়ে, লেখকের উষ্মা । তিনি হয় সবে চাপা আবেগে ক্ষতবিক্ষত বা যাপিত জীবন থেকে টেনে এনেছেন এমন বহু অভিজ্ঞতা যা তাঁকে বাধ্য হয়ে সহ্য করতে হয়েছে। লেখক স্পষ্টভাষী, বলপ্রবণ এবং মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর । দেবজ্যোতি রায় তাঁর জীবন-জ্বর, লাগামহীন প্রতিবাদকে একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য কৌশলে পরিণত করেছেন, একটি কথ্য ভাষা, রাগ এবং উপহাসের ভাষার সাথে পরিশীলিত বাংলা গদ্যকে মুচড়িয়ে নিজেকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন এই বইতে। রাগ প্রবাহিত জলের মতো, যতক্ষণ কেউ তাকে প্রবাহিত হিসাবে নেয় ততক্ষণ কিছু ভুল ঘটার সম্ভাবনা কম । ঘৃণা স্থির জলের মতো, সেই রাগ যা কেউ নিজে অনুভব করার স্বাধীনতায় পেয়েছে, এবং পাঠক বা দর্শককে টেনে এনেছে তাতে । সেই জল যা লেখক বা ছবি-আঁকয়ে এক জায়গায় জড়ো করে ভুলে যাওয়ার জন্য রেখেছিলেন। স্থির জল হয়ে ওঠে নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত, রোগের ডিপো, বিষাক্ত, প্রাণঘাতী এবং এটাই লেখক বা ছবি-আঁকিয়ের ঘৃণা। দ্বিতীয় বইটির ভূমিকায় সাত্ত্বিক নন্দী লিখেছেন, “লেখক ( মূলত ) তাঁর নিজের জীবনটিকেই লেখেন এবং লেখার ভাষাটি তুলে আনেন সেই জীবন থেকেই।” কথাটা অনেকের বেলায় খাটে, দেবজ্যোতির বেলাতেও খাটে । কিন্তু নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকে লেখালিখি করেছেন জোতদারদের ভাষায় ; ভাষা সম্পর্কে তাঁরা চিন্তা করেননি । দেবজ্যোতি রায়ও দুটি বইতে একইরকম গদ্যবিন্যাস প্রয়োগ করেননি । দ্বিতীয় বইটিতে যেহেতু নিজের সম্পর্কে বলছেন না, তাই তাতে রোষাভাসের তাপ তেমন স্ফূলিঙ্গ ছড়ায়নি । একই রকম লেখনশৈলীও উচিত হতো না । কেননা প্রতিটি বিষয়ে একইরকম গদ্য লেখককে খেলো করে দিতে পারে -- লেখক নিশ্চয়ই দাবি করেন না যে “আমি সারাটা জীবন দিয়ে বিশেষ ভাষা আবিষ্কার করেছি”। প্রথম বইটিতে, আত্মবিনির্মাণের মাধ্যমে, নকশাল আন্দোলনে তাঁর যোগ, আন্দোলনের ও বামপন্হী ভাবধারার ভাঙনে দেবজ্যোতি রায় নিজের ভাঙনকে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাঁর সামাজিক জগতকে বিভিন্ন আত্মজৈবনিক সমতলে উদ্ভাসিত অথবা কলঙ্কিত হিসাবে উপস্থাপন করার প্রয়াস করেছেন, যেখানে বিভিন্ন ঘটনা উল্লম্বভাবে না হয়ে অনুভূমিকভাবে সংযুক্ত হয়ে এগিয়েছে । দেবজ্যোতির গদ্য-শৈলীটি পাঠবস্তু হিসাবে আকর্ষণীয় কারণ এটি সহজাত মূল্যবোধ এবং গুণাবলীকে ছাপিয়ে গেছে অথচ যা তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন তাকে ধরে রেখেছেন আদ্রেনালিনের রসায়নে এবং তা দ্রুত সরাসরি উপস্হাপন করার চেষ্টা করেছেন । জ্ঞানতত্বের ব্যাখ্যাকাররা একে বলবেন ‘প্যাশনেট’। হাইডেগার মনে করেন, ভাষাই সার্বভৌম, মানুষ নয়; সত্তা হিসেবে মানুষ ভাষার মধ্যেই প্রকাশিত হয়ে ওঠে। ভাষার ভেতরে মানুষের বিশুদ্ধ প্রকাশ তখনই সম্ভব, যখন মানুষ ভাষার সত্তার ওপর শ্রদ্ধাশীল থাকে এবং সে তখনই প্রকৃতপক্ষে শ্রদ্ধাশীল, যখন সে ভাষার ভেতরে সত্যিকার অর্থে কান পেতে তার অন্তর্গত কথনে আস্থাশীল হয়ে ওঠে। দেবজ্যোতি রায় তাঁর আত্মকথনে আস্হাশীল তো বটেই, সেই সঙ্গে প্রয়োগ করেছেন নিজের যাপিত জীবন থেকে তুলে আনা কান্নার, যন্ত্রণার, ষড়যন্ত্রের, পরাজয়ের, বিশ্বাসঘাতকতা ও ধ্বংসের ছবিগুলো । জার্মান কবি হোল্ডারলিন বলেছিলেন, “যদি তোমার মস্তিষ্ক এবং হৃদয় থাকে তাহলে কেবল একবারে একটি বা অন্যটি দেখাও, তুমি দুটিকেই একসঙ্গে দেখিও না ; একটার জন্য তুমি কৃতিত্ব পাবে ।” আবেগ ও বুদ্ধির মধ্যে এমন বিচ্ছেদ কার্যকর করতে পেরেছেন দেবজ্যোতি তাঁর ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ বইতে। দেবজ্যোতির ক্রোধ খাঁটি, তা নিছক সাহিত্যিকতা নয়, বিদ্বেষ নয়, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা নয় । পেছন ফিরে নিজের দৃষ্টিতে, তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে তিনি এমনই একজন মানুষ যাঁর নির্মাণ-স্বভাব সব কিছুর বিপরীতে । নসটালজিয়াকে ছাঁটাই করতে পেরেছেন তিনি । যদিও আধুনিক অবস্থা, ঔপনিবেশিকতা, দাঙ্গা, নকশাল গণহত্যা, বামপন্হীদের পচন, পরিবেশগত ধ্বংস এবং মানুষের শোষণ, এগুলো, আশ্চর্য মনে হলেও, মানুষের স্মৃতির কৃতিত্ব এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি দ্বারা গঠিত -- ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকদের (সবচেয়ে বিশিষ্ট থিওডর অ্যাডর্নো) পরিভাষা যৎসামান্য ধার করেই বলছি, হতাশা এবং নিন্দাবাদের, দেবজ্যোতি রায়ের ভাঙন-সন্দর্ভ ভিন্ন কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে - মানবজাতির মনভোলানো ফাঁদগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে। যদিও অ্যাডর্নো বুর্জোয়া মূল্যবোধ এবং নিয়ম-কানুন নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে অনুশোচনা করেছিলেন, দেবজ্যোতির গদ্যপ্রবাহে তেমন কোনও নস্টালজিয়ার উপাদান নজরে পড়েনি। দেবজ্যোতি রায় লুই ফার্দিনাঁ সেলিনের অ-আলোচনাযোগ্য, কঠিন এবং দুর্ভেদ্য নিহিলিজমকে এড়িয়ে এক টুকরো অনির্বচনীয় মেঘের সন্ধান করেছেন। প্রত্যাখ্যান করেও করছেন না । অবশ্য ওই অনির্বচনীয় মেঘ যে কোথায় তা আমি চাকুরিজীবনে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েও খুঁজে পাইনি । আলালের ঘুরের দুলাল থেকেই বাংলা সাহিত্যের একটি দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার কারণে লেখকরা সমাজকে নানা উপায়ে খোঁচা মেরেছেন, আক্রমণ করেছেন তাঁদের অপছন্দের ভ্রষ্ট সমাজ ও তার প্রকোপে দূষিত মানবতাকে । তা একটি মূল সাহিত্যিক কৌশল হিসাবে নানাভাবে প্রয়োগ ও ব্যবহার করা হয়, বাংলা গদ্যের উন্মেষকালের বক্র-ব্যঙ্গ থেকে শুরু করে সুভাষ ঘোষের ‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’, নবারুণ ভট্টাচার্যের ফ্যাতাড়ুর রোমান্টিক বিদ্রুপ আর সুবিমল মিশ্রের কাট-আপ পদ্ধতি ও হরফ-ব্যঙ্গের ধারার সাথে যা অব্যাহত রয়েছে, যদিও তাঁদের রচনায় পাওয়া যায় নির্মিত সাহিত্যিকতা---- তফাতটা এই যে দেবজ্যোতি রায়ের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া, আমাদের দেশের গুয়ে চোবানো অধঃপতন উপস্হাপনের প্রয়োজনে, পাঠবস্তুকে আধুনিকতা পরিত্যাগ প্রক্রিয়া হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ বইতে। প্রচলিত বুর্জোয়া পাল্প ফিকশান সাহিত্যের বিপরীতে, দেবজ্যোতি রায় তাঁর এই স্মৃতি-বিপর্যয়ে জীবনের উচ্চতর মূল্যবোধ, নৈতিকতা বা উদ্দেশ্যগুলিকে পাঠকদের কেবলমাত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চান না, সেই সঙ্গে জীবনকে চিত্রিত করতে চেয়েছেন যেমনটি তিনি উপলব্ধি করেছেন: সম্পূর্ণ অর্থহীন, প্রহসন হিসাবে, সমস্ত মান-লঙ্ঘন হিসাবে এবং বিপ্লবের হইচইকে একটি কেলেঙ্কারি হিসাবে---চারু মজুমদারের পথ থেকে নানা দিকে চলে যাওয়া ফ্যাঁকড়ার ভুলভুলাইয়াগুলোকে তেড়ে ঝাড় দিয়েছেন। দেবজ্যোতির এই বইটা পড়ার সময়, বঙ্গসমাজের একজন বিপর্যস্ত নিন্দুকের কল্পনা করা সহজ, একজন বিপ্লব-বিধ্বস্ত, যে কিনা সৃজনশীল লেখক, কবিতাও লিখেছে একসময়ে, হয়তো গভীর রাতে এই বইটি এবং অন্য বইয়ের পাঠবস্তুগুলোকে উন্মাদের ঘোরের মধ্যে লিখে গেছেন। আরও সুনির্দিষ্টভাবে, দেবজ্যোতি যে ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত তার মধ্যে একটি নতুন উপাদান আনতে চেয়েছেন, তা হলো বাক্যের সক্রিয় বল, অর্থাৎ গতিশক্তি। যখন নাকতলায় ছিলুম তখন উনি পাঠিয়েছিলেন কবিতার বই, ‘নষ্ট আত্মার নোটবই’তে কবিতার বই দুটির নাম দেয়া আছে : ‘নির্মম বর্শার গান’ আর ‘স্বর’। দেবজ্যোতি একাকী মানুষের ঘা-পূঁজ-আঘাত-চোট-জখম-ফোড়ার চারপাশে বিনয় মজুমদার-বর্ণিত হাত বুলিয়ে বুঝতে ও বোঝাতে চেয়েছেন । তিনি তাঁর সময়ের বঙ্গজীবনের ভয়াবহতা ও অর্থহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতে এগিয়েছেন--- অথচ, ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ বইতে তিনি জীবনানন্দের সেই লাইনগুলো ব্যবহার করেছেন যেগুলোর জন্য উৎপলকুমার বসু বলেছিলেন, ‘জীবনানন্দ কয়েকটি উপাদানকে অবলম্বন করেছিলেন, যেমন মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা’ । কিন্তু দেবজ্যোতি বইটার পর্বগুলো যেভাবে ভাগ করেছেন, তাতে স্পষ্ট হয় যে তাঁর ভাবনা ওই উদ্যমহীনতার বিরুদ্ধে, প্রচেষ্টা বানচাল করার বিরুদ্ধে । পর্বগুলো এরকম : ১) শুরুর কথা ; ২) বুকের মধ্যিটাই তো আকাশ ; ৩ ) আর আমরাও তখন আন্তোনিও জাসিনটোর ‘সেই মানুষ’; ৪) তখন যৌনাঙ্গ দিয়েও অনুভব করেছি আমি ‘বিপ্লব’; ৫ ) কী অসাধ্য সাধনাই না করেছে ; ৬ ) কিন্তু দেখ এ-কেমন তাই বলে ফল ভুগতে হচ্ছে ; ৭ ) অলৌকিক থানার শিং-ওলা বড়বাবু, মেজবাবু ইত্যাদি ; ৮ ) রঙে-রঙে আকাশকে রাঙিয়ে সেই আগুনের গোলকটাই নেমে যাচ্ছে দেখ নদীর ভিতর ; ৯ ) আতঙ্কের ঘন হাতছানি পড়াশুনো করতে হবে ; ১০ ) দু’জন পার্টি কমরেড মাটি কামড়ে পড়ে আছেন ; ১১ ) কানুদারা হাত ধুয়ে ফেললেন ; ১২ ) সবচাইতে বড় বিষয় সেসময় পার্টির পুনর্গঠন ; ১৩) দু’জন স্বপ্নদর্শী এল কলকাতায় ছ’জন স্বপ্নদর্শীর কাছে ; ১৪ ) গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা হল আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখতে স্বপ্নে পাওয়া অনুপম দৈবাস্ত্র ; ১৫ ) হাতিদের সঙ্গে জঙ্গলে সারারাত এবং ভোরে ‘ইউরেকা’ ; ১৬ ) ‘৭৩ থেকে ‘৭৬ এইসব বন্ধুরাই লালন করেছে আমাকে ; ১৭ ) মাইক্রোফোনের সামনে নিজেকে ; ১৮ ) সহজ লোকের মত ; ১৯ ) ভাষা নিয়ে আরো দু’চারটে কথা; ২০ ) সেই তীব্র বিপ্লবী দার্শনিক ; ২১ ) অমৃতের পুত্রদের এইসব ; ২২ ) অমৃতের পুত্রদের এইসব [ ২ ] এবং ২৩ ) মৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘ রমণ-ক্রিয়া আমার এবং এক নদীর কেচ্ছা । দেবজ্যোতি রায়ের অন্য বইটা, ‘নষ্ট আত্মার নোটবই’কে বলা হয়েছে ‘কাউন্টার প্রোজ’, যাতে রয়েছে দুটি ছোটো ফিকশান, একটি নাটক এবং দশটি গদ্য । গদ্যগুলোকে বলা যেতে পারে প্রথম বইটার সম্প্রসার । আমি একটু আগেই ছবি আঁকায় উদাহরণ দিয়েছিলুম পাবলো পিকাসোর গুয়ের্নিকার। পিকাসোও সারা জীবন একই শৈলীতে আটকে থাকেননি । যাই হোক, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে গুয়ের্নিকাতে বোমা হামলার প্রতিক্রিয়ায় পিকাসো এটি এঁকেছিলেন। গুয়ের্নিকা একটি শহর ছিল যার কোনও সামরিক মূল্য ছিল না এবং বোমা হামলা ছিল মূলত ফ্যাসিস্টদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ অনুশীলন, এমন একটি প্রশিক্ষণ অনুশীলন যার ফলে শহরের অর্ধেকেরও বেশি ধ্বংস হয়ে যায় এবং জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ আহত বা নিহত হয়। সেখানে একজন মহিলা তার মৃত সন্তানের জন্য শোক করছেন, একজন মৃত বা মৃত ব্যক্তি একটি ভাঙা তলোয়ারকে আঁকড়ে ধরে আছেন, একটি ঘোড়া ব্যথায় চিৎকার করছে এবং একটি জ্বলন্ত দালানের ভিতরে আটকা পড়েছেন একজন ব্যক্তি। ছবিটি অস্বাভাবিক এবং বিকৃত উপায়ে আঁকা হয়েছে, যা তাদের মধ্যে ব্যথা এবং আতঙ্কের অনুভূতি বাড়িয়ে তোলে। পিকাসোর একটি একরঙা প্যালেটের পছন্দও চিত্রকলার মধ্যে নাটকীয় তীব্রতা এবং বিষণ্ণ মেজাজ গড়ে তুলেছে। পিকাসো আপাতদৃষ্টিতে গুয়ের্নিকা বোমা হামলার দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তাঁর চিত্রকর্ম এই ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করে যে যুদ্ধ ব্যাপারটা বীরত্বপূর্ণ এবং মহৎ। দেবজ্যোতি রায়ের ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ এর গদ্যপ্রবাহ পিকাসোর পেইনটিঙটির মতনই, অভিজ্ঞতার প্রচুর টুকরো-টাকরায় জোড় দেয়া । দেবজ্যোতি রায় কার্যত সকলের প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব বজায় রেখেচেন। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও, তিনি যে-কোনও মানদণ্ডে একজন রহস্যময় মানুষ এবং সেইজন্য তিনি একজন অত্যন্ত আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বও বটে। যদি আমরা লোকেদের গালগল্পের পরিবর্তে তাদের কাজ এবং কৃতিত্বের ভিত্তিতে বিচার করি তবে এই জাতীয় বিশ্লেষণ দেবজ্যোতির ক্ষেত্রে কাজে দেবে, কেননা লিটল ম্যাগাজিনের জগতেও তিনি উপেক্ষিত-অবহেলিত । অবশ্য লেখকের চরিত্র নয়, তার সৃষ্ট কাজকেই আমরা বিচার করব। কোনও সন্দেহ নেই যে তাঁর ‘নরকের থেকে একটুকরো মেঘ’ বইটি বাংলাসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ । কলকাতার সাহিত্য পরিমণ্ডলের বাইরে থাকেন বলে সমাদৃত হবার সুযোগ পায়নি তাঁর লেখালিখি । নয়তো তাঁর বইটাকে চার্লস বুকোস্কির ‘দি পোস্ট অফিস’, টমাস পিনচনের ‘গ্র্যাভিটিজ রেনবো’র সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে নেয়া যেতে পারতো । দেবজ্যোতি রায় ‘নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ’ বইতে যা করেছেন তা লুই ফার্দিনাঁ সিলিনের প্যারোডি, বিল্ডুংস্রোমান এবং পিকারেস্ক প্রয়োগের সঙ্গে তুলনীয় । নিঃসন্দেহে তা একটি অত্যন্ত উদ্ভাবনী মিশ্রণ - এবং পাঠক প্রথম লাইন থেকে লক্ষ্য করেন যে বইটা তো উপন্যাস নয়, তা সম্পূর্ণ নতুন কিছু । বইটা যেন একটা বিবৃতি, স্বাধীনতার ঘোষণা, ভবিষ্যতের একটা জানালা। বইটার উদ্ভাবনী গদ্যবিন্যাস, সারগ্রাহী শব্দভাঁড়ার, এবং বিশেষ করে, এর উন্মত্ত গতি পাঠকদের ক্ষেপিয়ে তুলবে । কিন্তু বইটার অসংবৃত বিষয়বস্তুর জন্য তা সংগতিপূর্ণ । বইটা খুব খোলামেলা লেখার একটি নতুন আঙ্গিকের সাক্ষ্য দেয়, একটি কথ্যকে নিশ্চিত করার নিয়মগুলিকে ভেঙে দেয়। :

Monday, June 22, 2020

জজ ব্যাতাই-এর কবিতা -- অনুবাদ মলয় রায়চৌধুরী


জজ ব্যাতাই-এর কবিতা- Georges Bataille- (১৮৯৭ – ১৯৬২ ) । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

georges-bataille-121

অতিদেবদূতীয় কবিতা
আমার পাগলামি আর আমার ভয়
ওদের আছে বড়ো-বড়ো মরা চোক
আর জ্বরের অবিচলিত চাউনি

এই চোখগুলোয় যা দেখা যায়
তা ব্রহ্মাণ্ডের অসারতা
আমার চোখ দুটো অন্ধ আকাশ

আমার দুর্ভেদ্য রাতে
অসম্ভাব্যতা কেঁদে ওঠে
সবকিছু চুরমার হয়ে যায়

কালি-চোখের পঞ্জিকা
চুলবহুল কবির অমরত্ব
কবিতা মেদবহুলতার গোরস্হান
বিদায় ঢেমনি ধোপানি
বিদায় মিষ্টি-মরা নগ্ন তরুণীর মতন সাজগোজ
বিদায় মিথ্যা বলে মিথ্যা ঘুমোচ্ছে

পিঁপড়েদের অগণন চুলকানি
ধুলোয় কাগজের গোঁফ খোঁজার বাছাই
গাড়িভরা জ্বর

পাগল বৃষ্টির সারি
মলিন চাদরকে হাততালি দিচ্ছে
মানুষের হাড়ের শোকপূর্ণ বেহায়াপনা

ওখেনে ভিড় জড়ো করছে টিনক্যান কিসের হয়তো
এক পুলিশ ছাদের ওপরে শার্টের ভেতরে
রাক্ষস কাস্তে নাচায়

আমি তোমাকে হাওয়ায় হারিয়ে ফেলি
আমি তোমাকে মৃতদের একজন মনে করি
এক গুরুত্বপূর্ণ শিরা
হৃদয় আর বাতাসের মাঝে

এই জগতে আমার কিছুই করার নেই
পুড়তে থাকা ছাড়া
আমি তোমাকে মৃত্যু পর্যন্ত ভালোবাসি

তোমার অস্হিরতা
তোমার মগজে এক পাগল বাতাস সিটি বাজায়
তুমি হাসার দরুন অসুখে ভুগছ
তুমি আমার কাছ থেকে পালাও তেতো শূন্যতার জন্য
নিজের হৃদয়কে ছিঁড়ে আলাদা করো
আমাকে ছিঁড়ে আলাদা করো যদি চাও
আমার জ্বরগ্রস্ত চোখ
তোমাকে রাতে খুঁজে পায়
আমি কাঁপছি আমার হৃদয়ের শীতে
আমার যন্ত্রণার গভীরতা থেকে তোমাকে ডাক দিই
অমানুষের কান্নায়
যেন আমি সন্তান প্রসব করছি

তুমি আমার গলা টিপে ধরো মৃত্যুর মতন
আমি তা বড়ো দুঃখে জেনেছি
আমি তোমাকে কেবল মৃত্যুর মুখেই খুঁজে পাই
তুমি ততোই সুন্দরী যতোটা মৃত্যু

সব শব্দ আমার গলা টিপে ধরে

নক্ষত্ররা আকাশে ছ্যাঁদা করে
মৃত্যুর মতন আর্তনাদ করে
কন্ঠরোধ করে

আমি জীবন চাই না
কন্ঠরুদ্ধ হওয়া বেশ মিষ্টি
উদীয়মান নক্ষত্র
মৃত নারীর মতনই শীতল

আমার চোখ দুটো বেঁধে দাও
আমি রাতকে ভালোবাসি
আমার হৃদয় কালো

আমাকে রাতের ভেতরে ঠেলে দাও
সবকিছুই নকল
আমি যন্ত্রণায় ভুগি

জগত থেকে মৃত্যুর গন্ধ বেরোয়
পাখিরা অন্ধ হয়ে ওড়ে
তুমি তেমনই ময়লা যেমন কালো আকাশ

এক উৎসব আরম্ভ হবে
কাদায় আর ভয়ে

নক্ষত্ররা ঝরে পড়বে
যখন মৃত্যু কাছে এসে পড়ে

তুমি রাতের আতঙ্ক
তোমার জন্য আমার ভালোবাসা যেন মৃত্যুর কান্না
তুমি মৃত্যুর মতন দুর্বল

তোমার জন্য আমার ভালোবাসা বিভ্রমের মতন
তুমি জানো আমার মাথা মারা যায়
তুমিই বিশালতা তুমিই ভয়

তুমি খুন করার মতন সুন্দরী
আমার হৃদয় ফুলে ওঠে আমার গলা বন্ধ হয়ে আসে
তোমার তলপেট রাতের মতন উলঙ্গ

তুমি আমাকে সরাসরি শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাও
মৃত্যুর কামড় আরম্ভ হয়েছে
তোমাকে বলার আর কিছু নেই
আমি মৃতের কাছ থেকে তোমার সঙ্গে কথা বলছি
আর মৃতরা চিরকাল মৌন ।

জাঁ জেনের কবিতা : শবযাত্রার কুচকাওয়াজ


জাঁ জেনে’র কবিতা ( ১৯১০ – ১৯৮৬ ) ‘শবযাত্রার কুচকাওয়াজ’ । অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

index
এক কোনে আবদ্ধ, একটুখানি রাত রয়ে গেছে।
আমাদের ভিতু আকাশে নির্মম আঘাতে স্ফূলিঙ্গ উগরে
( নৈশব্দের গাছেরা কিছু দীর্ঘশ্বাস ঝুলিয়ে রেখেছে )
এই শূন্যতার শীর্ষে গরিমার এক গোলাপ জেগে।
ঘুম বড়োই বিশ্বাসঘাতক যেখানে জেলখানা আমায় নিয়ে এসেছে
যদিও আমার গোপন দালানে বেশ আস্পষ্টভাবে
ওই অহংকারী ছোঁড়া গভীরভাবে নিজের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে
নাবিকদের আলোয় ঝলমলিয়ে যারা শব-সুন্দরী  গড়ে তোলে ।

ও আমাকে নিজের ভেতরে শেকল পরিয়ে রাখে
জেলখানার এই কুড়ি বছর বয়সী পরিদর্শক
আর ও আমায় চিরকালের জন্য শেকল পরিয়ে রাখে !
একটিমাত্র ইঙ্গিত, ওর চোখ, দাঁতে চুল চিবোয় :
আমার হৃদয় খুলে যায়, আর পরিদর্শক, উৎসবময় উল্লাসে
আমাকে নিজের অন্তরে জেলবন্দী করে ।
এই অসূ্য়াভরা দরোজা আবার বন্ধ হবার সুযোগ পায় না
অনেক বেশি দয়ায়
আর তুমি তো ইতোমধ্যেই ফিরেছো । তোমার পরিপূর্ণতা আমাকে আতঙ্কিত করে
আর আমি আজকে শুনতে পাই আমাদের ভালোবাসা বর্ণিত হচ্ছে
তোমার মুখে যা গান গায় ।
এই ছোরামারা ট্যাঙ্গো যা জেলখুপরি শুনতে পায়
বিদায়বেলার এই ট্যাঙ্গোনাচ ।
তাহলে কি তুমি, হে প্রভূ, এই উজ্বল বাতাসে ?
তোমার আত্মা গোপন পথে এগিয়েছে
দেবতাদের থেকে পার পাবার জন্য ।

যখন তুমি ঘুমোও রাতের আস্তাবল ভেঙে ঘোড়ারা
তোমার চ্যাটালো বুকে নামে, আর জানোয়ারগুলোর টগবগ
অন্ধকারকে ছত্রভঙ্গ করে তোলা যেখানে ঘুম নিজের
ক্ষমতার যন্ত্র চালায়, আমার মগজ থেকে ছিঁড়ে
একটুও শব্দ না করেই ।
ঘুম অনেক শাখা তৈরি করে
তোমার পা থেকে ফুল
তাদের কান্নায় কন্ঠরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে আমি ভয় পাই ।
তোমার মোলায়ের পাছার বাঁকের ওপরে, মিলিয়ে যাবার আগে
তোমার শাদা ত্বকে তা নীলাভ।
কিন্তু একজন জেল পরিদর্শক কি তোমাকে জাগিয়ে তুলতে পারে, আমার কচি চোর
যখন তুমি তোমার হাত ধুয়ে নাও ( ওই পাখিগুলো তোমার দস্তানায়
ডানা ঝাপটায়, একশো দুঃখের ভারে )
তারপর তুমি নির্দয়ভাবে নক্ষত্রদের আলোকরশ্মিকে ছারখার করে দাও
তোমার কাঁদতে-থাকা মুখের ওপরে ।
তোমার শোকেভরা অবশিষ্টাংশে
মহিমাময় অঙ্গভঙ্গী ধরে রাখা হয়
তোমার হাত যেটা একে ছুঁড়ে দিয়েছিল, রশ্মি দিয়ে বীজ পুঁতেছিল।
তোমার গেঞ্জি, তোমার শার্ট, আর তোমার কালো বেল্ট
আমার জেলখুপরিকে অবাক করে আর আমাকে হতবুদ্ধি করে তোলে
তোমার সুন্দর হস্তিদন্তের সামনে ।

সারাদিনের সুন্দর রাতগুলো
পিলর-এর অন্ধকার
তোমার কালো পাকের ভেতরে
আমার ছুরি জাল করা হয় ।
ঈশ্বর, এখানে আমি উলঙ্গ
আমার ভয়ঙ্কর লুভরেতে ।
কেউ চিনতে পারে না
তোমার বন্ধ মুঠো আমায় খুলে দ্যায় ।
আমি ভালোবাসা ছাড়া কিছু নই
আমার সমস্ত শাখা জ্বলে
যদি আমি দিনটাকে অন্ধকার করে দিই
তারপর আমার ভেতরের ছায়া নিজেকে গুটিয়ে নেয় ।
বিশুদ্ধ হাওয়ায় এটা সম্ভব
আমার শুকনো দেহ গুঁড়িয়ে ধুলোয় মেশার জন্য
দেয়ালে পিঠ দিয়ে
আমি বিদ্যুতের চমকের দখল নিই ।
হৃদয় আমার সূর্য
মোরগের ডাকে চৌচির হয়ে যায়
ঘুম কখনও সাহস দেখায় না
এখানে তার স্বপ্নগুলোকে উথলে দিতে।
আমার আকাঙ্খায় শুকিয়ে যাওয়া
আমি স্তব্ধতাকে মেরামত করে দিই
পাখিদের আগুন দিয়ে
যা আমার গাছ থেকে জেগেছে ।

নিষ্ঠুর প্রকৃতির মনে হয় এমন মহিলাদের থেকে
তাদের খবরিয়ারা গয়না পরে থাকে ।
গলির এই ছিঁচকে চোরগুলো রাতের বেলায় জেগে ওঠে
আর তাদের ইশারা পেয়ে তুমি সাহসে বেরিয়ে পড়ো।
অমন এক কচিখোকা, নিজের মায়াময় পোশাকে কাঁপে
ও ছিল আমার কাছে পাঠানো দেবদূত, যার আলোময় দিশা
আমি অনুসরণ করি বিভ্রান্ত হয়ে, যাত্রায় পাগল হয়ে
এই জেলখুপরি পর্যন্ত যেখানে তার প্রত্যাখ্যান ছিল জ্যোতির্ময়।
যখন আমি অন্য সুরে গাইতে চাইলুম
আমার পালক আলোকরশ্মিতে জড়িয়ে পড়লো
এক ঝিমধরা শব্দে, মাথা নিচু করে
আমি বোকার মতন পড়ে গেলুম, এই ভুলের মাশুল হিসেবে
এই খাদের তলায় ।

আর কিছুই গোলমাল
বাধাবে না অনন্তকালীন ঋতুতে
যেখানে আমি নিজেকে আটক আবিষ্কার করছি ।
একাকীত্বের স্হির জলাশয়
আমাকে পাহারা দেয় আর জেলখানা ভরে রাখে ।
আমি চিরকালের জন্য কুড়ি বছর বয়সী
তোমাদের নিরীক্ষণ সত্বেও ।
তোমাদের মন রাখতে, ওহ বধির সৌন্দর্যের অনাথ
মারা না যাওয়া পর্যন্ত আমি পোশাক পরে থাকবো
আর তোমার আত্মা তোমার মুণ্ডকাটা ধড়কে ছেড়ে গিয়ে
আমার ভেতরে খুঁজে পাবে এক শাদা আশ্রয় ।
ওহ একথা জানতে পারা যে তুমি আমার মামুলি ছাদের তলায় শোও!
তুমি আমার মুখ দিয়ে কথা বলো
আমার চোখ দিয়ে দ্যাখো
এই ঘর তোমার আর আমার কবিতা তোমার।
যা ভালো লাগে তার জন্য আরেকবার বেঁচে নাও
আমি নজর রাখছি ।

হয়তো তুমিই ছিলে সেই দানব যে কেঁদেছিল
আমার উঁচু দেয়ালের পেছনে ?
রেশমি ফিতের চেয়েও মোলায়েম তুমি ফিরে এসেছো
আমার দৈব দুর্বৃত্ত
এক নতুন মৃত্যুর মাধ্যমে নিয়তি আবার তছনছ করে
আমাদের নিরানন্দ ভালোবাসাগুলো
কেননা তুমিই তো ছিলে আবার, পিলর, মিথ্যা বোলো না
এই চুরিকরা ছায়াগুলো !

যে খোকাটাকে আমি খুঁজছিলুম
বাচ্চাদের মধ্যে খেলছে
নিজের বিছানায় মরে পড়ে আছে, একা
এক রাজকুমারের মতন ।
নিজের আলতো পায়ে ইতস্তত করে
এক মহিমা ওর পায়ে জুতো পরায়
আর দেহ ঢেকে দ্যায়
রাজকীয় পতাকায় ।
হাতে গোলাপ ধরে-থাকা মিষ্টি ভঙ্গীতে
শবগুলো কে যে হাত লুটপাট করছিল তা চিনতে পারলুম।
একজন সেনা অমন কাজ করবে না
যা তুমি, একা, করেছিলে
আর তুমি তাদের মধ্যে নেমে গেলে
ভয়ও পেলে না
পশ্চাত্তাপও নয় ।
তোমার দেহের মতন
একটা কালো গেঞ্জি তোমার আত্মাকে দস্তানায় ঢুকিয়ে রাখলো
আর যখন তুমি নির্দিষ্ট সমাধিকে অপবিত্র করলে
তুমি ছুরির ডগা দিয়ে খোদাই করে দিলে
শব্দ আন্দাজ করার ধাঁধা
বিদ্যুৎ দিয়ে নকশাকাটা ।
আমরা তোমার উথ্থান দেখেছি, উন্মাদনায় বয়ে যাওয়া
নিজের চুলে ঝুলছ
লোহার মুকুটে
মুক্ত-বসানো ফিতেয় আর বাসি গোলাপে
জীবন্ত ধরবার জন্যে মোচড়ানো হাত ।
তোমার মৃদু হাসি আমাদের দেখাবার জন্য সবেই ফিরেছ
তুমি দ্রুত উধাও হয়ে গেলে আমার মনে হয়
আমাদের কিছু না জানিয়ে, তোমার ঘুমন্ত গরিমা
আরেক মুখের সন্ধানে অন্যান্য আকাশে ঘুরে বেড়িয়েছে।
পথচলতি এক বালককে লক্ষ করি
তোমার সুগঠিত দেহের ঝলক
আমি তার মাধ্যমে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি
কিন্তু তার এক সামান্য ইশারা
তার কাছ থেকে তোমাকে উধাও করে দিলো
আর তোমাকে আমার কবিতায় ছুঁড়ে ফেললো
যেখান থেকে তুমি পালাতে পারবে না ।
কোন দেবদূত তাহলে
তোমাকে পাশ দিয়ে যাবার অনুমতি দিলো
অকাতরে বস্তুর ভেতর দিয়ে যেতে
হাত দিয়ে বাতাসকে দুফাঁক করে
ক্ষেপণাস্ত্রের ডগার সূক্ষ্ম ঘূর্ণনের মতো
যা নিজের দামি পথ খুঁজে নিজেই তাকে নষ্ট করে ?
তোমার পালাবার সংকীর্ণতা আমাদের নিরানন্দ করেছিল ।
এক দ্যুতিময় পিছুটান তোমাকে আমাদের আলিঙ্গনে এনে দিয়েছিল।
তুমি আমাদের গলায় টোকা মেরে আমাদের মন ভরাতে চাইলে
আর তোমার হাত ছিল ক্ষমাময়
কামানো চুলের দরুণ ।
কিন্তু তুমি আর দেখা দাও না, ফর্সা খোকা যাকে আমি খুঁজি।
আমি কোনো শব্দে হুঁচোট খাই আর তোমাকে তার বিপরীতে দেখি।
তুমি আমার কাছ থেকে সরে যাও, কবিতা আমাকে রক্ষা করে।
কান্নার কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে আমি বিপথগামী হই ।
তোমাকে ধরার জন্য আকাশ নানা ফাঁদ পেতেছিল
করাল আর নতুন, মৃত্যুর সঙ্গে ষড় করে
এক অদৃশ্য সিংহাসন থেকে নজর রাখছিল
সুতোগুলো আর গিঁটগুলো
সোনার ববিনে পরানো ।
আকাশ এমনকি মৌমাছিদের যাত্রাপথ ব্যবহার করেছিল
কতোরকমের রশ্মি আর কতোরকমের সুতোর পাক খুলে
যে সেষ পর্যন্ত ওকে গোলাপের সৌন্দর্য ধরে ফেললো :
ছবিতে দেখানো এক শিশুর মুখ ।
এই খেলা যদি নিষ্ঠুর হয় তাহলে আমি নালিশ করব না
তোমার সুন্দর চোখ খুলে ফেলার জন্য
দুঃখের এক গান তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেল
অতো সন্ত্রাসকে আয়ত্ত করে
আর এই গান, হাজার বছরের জন্য
তোমার কফিনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ।
দেবতাদের ফাঁদে আটক, তাদের রেশমিসুতোয় কন্ঠরুদ্ধ
কেন আর কেমন করে না জেনেই তুমি মারা গেলে ।
তুমি আমাকে ছাপিয়ে জিতে গেছ
কিন্তু সাপসিঁড়ি লুডোখেলায় হেরে গেছ
যেখানে আমি তোমাকে ধর্ষণ করার সাহস দেখাই
ওগো আমার পলাতক প্রেমিকা ।
কালো সেনারা তাদের বন্দুক নত করলেও
তুমি ওই বিছানা ছেড়ে পালাতে পারো না যেখানে লোহার মুখোশ
তোমাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে — কিন্তু হঠাৎ তুমি উঠে দাঁড়াও
নড়াচড়া না করেই পেছনে পড়ে যাও
আর নরকে ফেরো ।

১০
আমার ভালোবাসার কালকুঠুরি
তোমার স্পন্দিত ছায়ায়
আমার চোখ, আচমকা, এক গোপনকথা আবিষ্কার করেছে ।
আমি কতো রকম শোয়া শুয়েছি তা জগত জানে না
যেখানে সন্ত্রাস নিজেই গিঁট পাকায় ।
তোমার অন্ধকার হৃদয়ের দর-দালানগুলো আঁকাবাঁকা পথ
আর তাদের জড়োকরা স্বপ্নগুলো স্তব্ধতাকে সঙ্গঠিত করে
কবিতার সঙ্গে মিল আছে এমন এক যান্ত্রিক প্রক্রিয়া
আর তার হুবহু তীব্রতা ।
আমার চোখ আর আমার কপাল থেকে
তোমার রাত কালির বন্যা বয়ে যেতে দ্যায়
এমন ঘন পালক যার ওপরে আমি এখানে শুই
নিয়ে আসবে কুসুমিত নক্ষত্রদের
যেমন কেউ গোলাগুলির বেড়াজালে দেখতে পায় ।
আমি তরল অন্ধকারের দিকে এগোই
যেখানে অবয়বহীন ষড়যন্ত্রেরা
ধীরে ধীরে আকার পাওয়া আরম্ভ করে ।
কেনই বা আমি সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করব ?
আমার সমস্ত অঙ্গবিক্ষেপ ভেঙে টুকরো হয়
আমার আমার কান্নাগুলো
খুবই সুন্দর ।
আমার চাপা দুর্দশা থেকে শুধু তুমিই জানতে পারবে
দিনের মেলে দেয়া অদ্ভুত সৌন্দর্যগুলো ।
ওদের হাজার রকমের ভেলকিবাজির পর
যে বজ্জাতদের কথা আমি শুনি
খোলা বাতাসে ভিড় জমায় ।
পৃথিবীতে তারা একজন কোমল প্রতিনিধি পাঠায়
এক শিশু যে কারোর পরোয়া করে না, আর নিজের যাত্রাপথ চিহ্ণিত করে
অনেকরকমের চামড়া ফাটিয়ে
আর ওর খোশমেজাজি বার্তা
এখানে পায় নিজের জাঁকজমক ।
কবিতাটা পযে তুমি লজ্জায় ফ্যাকাশে হয়ে যাও
অপরাধী অঙ্গভঙ্গী দিয়ে একজন বয়ঃসন্ধির লেখা
কিন্তু তুমি কখনও জানতে পারবে না
মৌলিক গিঁটগুলোর কোনও ব্যাপার
যা আমার মলিন ক্রোধের ফসল
কেননা ওর রাতে যে গন্ধগুলো গড়াচ্ছে তা খুবই তীব্র।
ও সই করবে পিলর আর ওর মহিমান্বয়ন হবে
গোলাপ-স্রোতের উজ্বল ফাঁসিমঞ্চ
মৃত্যুর সুন্দর কর্মফল ।

১১
সম্ভাবনা — সবচেয়ে মহার্ঘ সম্ভাবনা !
প্রায়ই আমার পালককে তৈরি করতে বাধ্য করেছে
আমার সমস্ত কবিতার হৃদয়কেন্দ্র
সেই গোলাপ যার ওপরে শাদা শব্দে লেখা মৃত্যু
বাহুর ফেট্টিতে নকশা করা
যে কালো যুদ্ধাদের আমি ভালোবাসি তাদের নাম।
আমার রাতের ভেতর দিয়ে কোন বাগানই বা ফুল ফোটাতে পারে
কোন যন্ত্রণাময় খেলা এখানে হয় যে
এই কেটে নেয়া গোলাপ থেকে পাপড়ি ছেঁড়া হয়
আর কে তাকে নিঃশব্দে ফাঁকা কাগজে নিয়ে যায়
যেখানে তোমার হাসি তাকে অভিবাদন করে ?
কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপারে বিশেষকিছু আমি জানি না
মেয়েটির বিষয়ে এতো কথা বলার পরও
আর গুরুতর উপায়ে
তাহলে মেয়েটি আমার ভেতরেই বাস করে
যাতে সহজে জেগে উঠতে পারে
আমার আমার আবোলতাবোল থেকে বইতে পারে
অন্তত আমার শব্দগুলো ।
মেয়েটির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না
বলা হয় যে ওর সৌন্দর্যের ইন্দ্রজাল
অনন্তকালকে খেয়ে ফ্যালে
কিন্তু এই বিশুদ্ধ বিচরণ পরাজয়ে বিদীর্ণ হয়
আর এক বিয়োগান্তক বিশৃঙ্খলার গোপনীয়তাকে ফাঁস করে ।
অশ্রুবিন্দুর আবহাওয়ায় ঘুরে বেড়িয়ে ফ্যাকাশে
মেয়েটি খালি পায়ে আসে ফুৎকারে আত্মপ্রকাশিত হয়ে
আমার উপরিতলে যেখানে ফুলের এই তোড়াগুলো
আমাকে শেখায়  মৃত্যুর
কন্ঠরোধী কোমলতা।
আমি নিজেকে তোমার আলিঙ্গনে ছেড়ে দেবো, হে বর্ণোজ্বল মৃত্যু
কেননা আমি জানি কেমন করে আবিষ্কার করতে হয়
আমার উন্মুক্ত শৈশবের চলমান চারণভূমি
যেখানে তুমি আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে যাবে
অপরিচিত লোকটার ফুলেফুলে সাজানো লিঙ্গের কাছে ।
আর এই শক্তিতে বলবান, হে রানি, আমি হবো
তোমার ছায়াদের নাটকের গোপন মন্ত্রী ।
মিষ্টি মৃত্যু, আমাকে নাও, আমি তৈরি
এই যে আমি এখানে, আমি যাচ্ছি
তোমার নিরানন্দ শহরে ।

১২
একটা শব্দে আমার কন্ঠস্বর হুঁচোট খায়
আর অভিঘাত থেকে তুমি উৎসারিত হও
এই অলৌকিকতার জন্য ততোটা উৎসাহী
যতোটা তুমি তোমার অপরাধগুলোর জন্য !
কেই বা তাহলে অবাক হবে
যখন আমি আমার নথিগুলো খুলে ধরব
যাতে পূঙ্খানুপূঙ্খভাবে অন্বেষণ করা যাব
শব্দের ঝোপঝাড়গুলো ?
আমার হাতে আরও দড়ি ধরিয়ে দেবার জন্য বন্ধুরা লক্ষ রাখে
জেলখানার ছড়ানো ঘাসে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো ।
তোমার জন্য, এমনকি তোমার বন্ধুত্বের জন্য
আমি পরোয়া করি না ।
আমি এই সৌভাগ্যকে আগলে রাখি
যা বিচারকরা আমাকে দেন ।
এটাকি তুমি, অন্য আমি, তোমার রুপোর চটি ছাড়াই
সালোম, যে আমাকে একটা গোলাপ কেটে এনে দ্যায় ?
এই রক্তাক্ত গোলাপ, শেষ পর্যন্ত তার ব্যাণ্ডেজ থেকে খোলা
তা কি মেয়েটির, নাকি এটা জাঁ জেনের মাথা ?
উত্তর দাও পিলর ! তোমার চোখের পাতাকে পিটপিট করতে দাও
আমার সঙ্গে তির্যক কথা বলো, তোমার গলায় গান গাও
তোমার চুলের কাছে কাটা আর গোলাপঝাড় থেকে পড়ে যাওয়া
হুবহু শব্দে, হে আমার গোলাপ
আমার প্রার্থনাকে মেনে নাও ।

১৩
হে আমার কারাগার যেখানে আমার বয়স না বাড়লেই আমি মারা পড়ি
আমি তোমাকে ভালোবাসি ।
জীবন, মৃত্যু দিয়ে সাজানো, আমাকে শুষে নেয় ।
তাদের ধীর কঠিন ওয়ালৎজ উল্টোদিকে নাচা হয়
প্রত্যেকে নিজের মহিমান্বিত কার্যকারণের পাক খোলে
অন্যের বিরোধীতায় ।
তবু, আমার অনেকটা জায়গা আছে, এটা আমার সমাধি নয়
আমার জেলখুপরি বেশ বড়ো আর আমার জানালা অতিবিশুদ্ধ ।
আবার জন্ম নেবার জন্য অপেক্ষা করছি জন্মের আগের রাতে
আমি নিজেকে তেমনভাবে বাঁচার অনুমতি দিয়েছি যাতে আমাকে
মৃত্যু চিনতে পারে
উচ্চতর ইশারার মাধ্যমে ।
আকাশ ছাড়া আর সকলের জন্য আমি আমার দরোজা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছি
আর আমি কেবল বন্ধুত্বপূর্ণ মুহূর্তের অনুমতি দিই
খোকা চোরগুলোকে যাদের ফিসফিসানিতে আমার কান গুপ্তচরগিরি করে
নিষ্ঠুর আশায়, আমার সাহায্যের ডাকের জন্য
তাদের সমাপ্ত গানের মাধ্যমে ।
যদি আমি ইতস্তত করি আমার গান নকল নয়
কেননা আমি আমার গভীর মাটির তলায় খোঁজ করি
আর আমি প্রতিবার একই ধ্বনন নিয়ে উঠে আসি
জীবন্ত কবর দেয়া ঐশ্বর্যের টুকরো-টাকরা
যা জগতের আরম্ভ থেকে ছিল ।
যদি তুমি দ্যাখো আমার টেবিলের ওপরে ঝুঁকে আছি
সাহিত্যে বরবাদ আমার মুখাবয়ব
তাহলে বুঝবে যে এটা আমাকেও পীড়িত করে
এই ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক কাজ
আবিষ্কার করার স্পর্ধা
সেই লুকোনো সোনার
এই প্রচুর
পচনের তলায় ।
এক আনন্দময় জ্যোতি আমার চোখে উদ্ভাসিত হয়
যেন উজ্বল ভোরবেলায় এক জাজিম
পাথরের ওপরে বেছানো
তোমার চলাফেরায় বাধা দেবার জন্য
গোলোকধাঁধা জুড়ে
কন্ঠরুদ্ধ দর-দালানগুলোতে
তোমার চৌকাঠ থেকে
ভোরের
সিংহদ্বার পর্যন্ত ।

( কবিতাটি মরিস পিলর [ Maurice Pilogre ] নামে একজন নামকরা অপরাধীকে উদ্দেশ্য করে। জেলে তার সঙ্গে জাঁ জেনের পরিচয় ।  ১৯৩৯ সালে গিলোটিনে তার মাথা কাটা হয়েছিল । মরিস পিলর হাসিমুখে গিলোটিনে মাথা দিয়েছিল ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমাভিক্ষা চায়নি । )

Monday, July 15, 2019

নাইজেরিয়ার সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবের পরাবাস্তব কবিতা ( ১৯৩০ - ২০১৩ ) অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী

নাইজেরিয়ার সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবের পরাবাস্তব কবিতা ( ১৯৩০ - ২০১৩ )
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী
শকুনেরা
ধূসরতায়
আর এক পশলা বৃষ্টিতে এক হতাশ
সকাল অগ্রদূতদের দ্বারা অনালোড়িত
সূর্যোদয়ে এক শকুন
অনেক উঁচু গাছের ভাঙা
হাড়ের ডালে বসে 
কাছে ঘেঁষে বসল
ওর সঙ্গীর মসৃণ
চোট-খাওয়া মাথায়, একটা নুড়ি
এক ডালে শেকড়-পোঁতা
কুৎসিত পালকের জঞ্জালে
আদর করে ঝুঁকলো
শকুনির দিকে । কালকে ওরা পেয়েছিল
জলভরা গর্তে একটা ফোলা লাশের
দুটো চোখ আর নাড়িভুঁড়িতে 
যা ছিল তা খেয়েছিল । পেট
ভরে খেয়ে ওরা বেছে নিলো
ওদের বিশ্রামের দাঁড়
বাকি ফাঁপা মাংসের দিকে
শীতল চাউনির সহজ
দূরবিন চোখের আওতায়…

অদ্ভুত
সত্যিই প্রেম কেমন অন্য
উপায়ে এতো সুনির্দিষ্ট
একটা কোনা তুলে নেবে
শব রাখার ওই বাসায়
সাজিয়ে-গুছিয়ের গুটিয়ে বসবে সেখানে, হয়তো
ঘুমিয়েও পড়বে -- শকুনির মুখ
দেয়ালের দিকে মুখ করে !

...এইভাবেই বেলসেন ক্যাম্পের 
কমাণ্ডান্ট দিনের শেষে বাড়ি 
গেলেন সঙ্গে পোড়া মানুষের
ধোঁয়া বিদ্রোহ করে নাকের
চুলে ঝুলে আছে যা থামবে
রাস্তার ধারে মিষ্টির দোকানে
একটা চকোলেট তুলে নেবে
তার কচি খোকার জন্য
বাড়িতে অপেক্ষা করছে
বাবা কখন ফিরবে…

বদান্য দূরদর্শিতার
গুণগান করো যদি চাও
যে এমনকি মানুষখেকো
রাক্ষসকেও একটা ছোটো
জোনাকি উপহার দ্যায়
কোষে মোড়া কোমলতা
নিষ্ঠুর হৃদয়ের তুষার গুহায়
নয়তো সেই বীজানুর জন্যেই
হাহুতাশ করো স্বজাতীয় প্রেমে
যাতে চিরকালের জন্য 
প্রতিষ্ঠিত করে হয়েছে
অমঙ্গল ।

জবাব
শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেললুম
সন্ত্রাসের ঝালর-বসানো মোহ
যা আমার প্রাচীন চাউনিকে বেঁধে রাখে
ওই ভিড়ের মুখগুলোর সঙ্গে
যা লুটতরাজের আর দখল করে আমার
অবশিষ্ট জীবন এক অলৌকিকতায়
শাদা-কলার হাতের নির্দেশের মাঝে
আর নাড়িয়ে দিলুম এক সস্তা 
ঘড়ির মতন আমার কানের কাছে
আর আমার পাশে মেঝেয় ছুঁড়ে
ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালুম । আমি
তাদের কাঁধ আর মাথাকে
ওপর-নিচ করালুম এক নতুন
সিঁড়ি দিয়ে আর ঝুঁকলুম
ওদের ঘেমো সারিতে
আর উঠে গেলুম মাঝের হাওয়া পর্যন্ত
আমার হাত কঠোরতার জন্য এতো নতুন
পাকড়াও করতে পারলুম এক 
ঝঞ্ঝাটে দিনের বন্ধুরতা
আর তেষ্টা মেটালুম উৎসের
যা তাদের পাগুলোকে উথালপাথাল 
খাওয়াচ্ছিল । আমি এক নাটকীয়
অবনমন আরম্ভ করলুম সেইদিন
পেছন দিক ফিরে গুঁড়িমারা ছায়ায়
ভাঙা মৌতাতের টুকরোয় । আমি
খুলে ফেললুম অনেকদিনের বন্ধ জানালা
আর দরোজা আর দেখলুম আমার চালাঘর
ইন্দ্রধনুর ঝাঁটায় নতুন সাফসুথরো করা
সূর্যের আলো আবার আমার বাড়ি হয়ে গেল
যার নিয়তিনির্দিষ্ট মেঝেতে অপেক্ষা করছিল
আমার গর্বিত চঞ্চল জীবন ।

উড়াল
( নিই ওসুনদারের জন্য ) 
দ্রাঘিমায় কিছু-একটা ক্ষমতার লালসাকে প্রশ্রয় দ্যায়
নিছক বাড়ির ছাদটুকু আমিরের জন্য যথেষ্ট
বৈভবশালী পাগড়ির দামি পাক থেকে বিলিয়ে দেন
ধুলোয় হামাগুড়ি দেয়া কৃষকদের
বিরল দুর্বোধ্য মাথা নাড়া যা প্যাঁচানো থাকে
রাজকুমারীয় বিষণ্ণতায় ।
আমিও জেনেছি
ওই ঝলসানো আদিম ক্ষুধাবোধ,
জীবন প্রকাশ করার দ্রুতি
এক দীর্ঘ পিছুহটা প্রবৃত্তি ।
যদিও দড়িবাঁধা আর হাতকড়া পরানো
সেই দিন আমি চূড়া থেকে হুকুম দিলুম ।
তিন তলা জগতের এক সেতু খাপ খেয়ে যায়
আমার উন্মাদ গর্বিত মূর্তির সঙ্গে যা আমি হয়েছি।
ভাসমান মেঘের এক ম্যাজিক লেপ
নিজের শাদা কোমলতাকে ওড়ালো আর ঘষল
আমার পায়ের তলায় পেশাদার পরীর আঙুলের মতন
আর ব্যাণ্ডেজের কাপড়ের ছাঁকনি দিয়েঢ
এক মহানগরের বিস্ময় প্রকাশ করল
সে ম্যাজিক পরীর দেশের আয়তনের ।
চাউনিকে বিভিন্নভাবে মাপজোক করে
আমি মেঘগুলোকে ভাসিয়ে দিলুম
এক স্হির চারণভূমির ওপরে, মিনারের ওপরে
আর মাস্তুল আর ধোঁয়া-পালক চিমনিতে ;
কিংবা পৃথিবীটাকেই উল্টে দিলুম, ছেড়ে দিলুম
তা থেকেই, এক ভবঘুরে ফেরারিকে
অবিচল আকাশের তলায় । তারপর এলো
জগতের ওপরে এক আচমকা ঔজ্বল্য,
তা ছিল বিরল শীতের হাসি, আর আমার
মেঘ-জাজিমের ওপরে একটা কালো ক্রশ আঁকা
যা ইন্দ্রধনুর অক্ষিগোলকে আটক । যাতে এলো
খ্রিষ্টজন্মের অসাধারণত্ব -- তাছাড়া কেই বা আসতো
ধূসর অখেলোয়াড়সুলভ তর্ক, অবিশ্বস্ত
বিদ্যাবাগিশের উৎসর্গ-করা টেকো অবাধ্য ঘোষণা ?
কিন্তু কি তুলনাহীন সৌন্দর্য ! কি গতি !
রাতের এক রথ নিয়েছে আতঙ্কের উড়াল
সেই দিনের আচার-বিচার সম্পর্কে আমাদের 
রাজকীয় ঘোষণা থেকে ! আর আমাদের কল্পনার
মিছিল ঘোড়ায় চেপে এগিয়েছে। আমরা এক প্রাচীন
লোভকে দমিয়েছি যা যুগ যুগ পড়ে থেকে কুঁকড়েছিল
যতক্ষণ না মহিমাময় শোভাযাত্রা দেখে ক্লান্ত চোখ
ফিরে এলো বিশ্রাম নেবার জন্যে ওই ক্ষুদ্র
কিংবদন্তিতে যা জীবনের পোশাককে টেনে নিয়ে গেল
সব জায়গা ছেড়ে আমার আসনের তলায় ।

এখন আমি ভাবি আমি জানি কেন দেবতারা
উচ্চতার ক্ষেত্রে পক্ষপাত করেন -- পাহাড়ের
শীর্ষকে আর গম্বুজকে, গর্বিত ইরোকো গাছগুলোকে
আর কাঁটার পাহারা-দেয়া বোমবাক্সকে,
কেন মামুলি গৃহদেবতারা
কঠিন কাঠের দাঁড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বসবেন
ঝুরঝুরে কড়িকাঠ  থেকে বিপজ্জনকভাবে ঝোলানো
চালাবাড়ির চালে যা আরামে বসে আছে
পৃথিবীর নিরাপদ মাটিতে ।

প্রতিশ্রুতি-ভীতি
হুররে ! তাদের জন্য যারা কিচ্ছু করে না
কিছুই দেখে না অনুভব করে না যাদের
হৃদয়ে বসানো আছে দূরদর্শিতা
পাতলা ঝিল্লির মতন গর্ভের উন্মুখ
দরোজায় যাতে বীর্যক্রোধের কলঙ্ক
না ঢুকতে পারে । আমি শুনেছি পেঁচারাও
জ্ঞানের গোলক পরে থাকে তাদের
চোখের চারিধারে প্রতিরোধ হিসেবে
প্রতিটি অসুরক্ষিত চোখ দ্রুত আড়াল পেতে চায়
আলোর ছোঁড়া কাঁকর থেকে । অনেকদিন আগে
মধ্য প্রাচ্যে পনটিয়াস পাইলেট
সবার সামনে তাঁর শাদা হাতের অবদান 
ধুয়েছিলেন যা বিখ্যাত হয়েছিল । ( তাঁর আগের
আর পরের রোমের কর্তাদের মধ্যে তাঁকে ছাড়া আর
কাকে নিয়ে আলোচনা হয়েছিল প্রতিটি
রবিবার পাঠানো প্রচারকদের ধর্মবিশ্বাস ? ) আর
প্রচারকদের কথা বলতে হলে সেই অন্য লোকটা
জুডাস অমন মূর্খ ছিল না মোটেই ; যদিও
বড়ো বেশি বদনাম হয়েছিল পরের প্রজন্মের
লোকেদের দ্বারা তবু তথ্য তো থেকেই যায় যে
তারই একা ওই  নানা-পোশাক জমঘটে
যথেষ্ট বোধবুদ্ধি ছিল এই কথা বলার
একটা মারাত্মক আন্দোলন যখন ও দেখল
আর তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল, একটা সুন্দর
ছোটো পুঁটলি ওর কোটের পকেট ফুলিয়ে রেখেছে
লেনদেনের ব্যাপারে -- ব্যাটা বেশ বিচক্ষণ ।

প্রেমচক্র
ভোরবেলায় আস্তে আস্তে
সূর্য নিজের কুয়াচ্ছন্ন দীর্ঘ 
বাহুর আলিঙ্গন ফিরিয়ে নেয় ।
খোশমেজাজ প্রেমিক-প্রেমিকারা
 প্রেমের ঘষাঘষি-কারবারের 
কোনোরকম স্বাদ বা ক্বাথ 
ফেলে যায় না ; পৃথিবী
শিশিরে সুগন্ধিত
সুবাসে জেগে ওঠে
নরম-চোখ আলোর
ফিসফিসানিতে…
পরে যুবক তার 
গুণাবলীর সমতা খুইয়ে ফেলবে
স্বর্গের বিশাল জমি চাষ করার
সময়ে আর তার ফল ফলাবে
যুবতীটির তপ্ত ক্রোধের
ফুলকির ওপরে । বহুকাল যাবত
অভ্যস্ত অমনধারা আবদারে
যুবতীটি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে
সন্ধ্যার জন্য যখন আরেক রাতের
চিন্তাভাবনা যুবকটির প্রফুল্লতা
পুনরুদ্ধার করবে 
আর যুবতীটির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা
যুবকটির ওপরে ।

প্রজাপতি
গতি হল উৎপীড়ন
ক্ষমতা হল উৎপীড়ন
ওজন হল উৎপীড়ন
প্রজাপতি সুরক্ষা খোঁজে মৃদুতায়
ভারহীনতায়, ঢেউখেলানো উড়ালে
কিন্তু এক চৌমাথায় যেখানে নানারঙা আলো
গাছেদের থেকে হঠকারী নতুন রাজপথে পড়ে
আমাদের অভিসারী এলাকার সংযোগ ঘটে
আমি দুজনের জন্য যথেষ্ট খাবার সঙ্গে করে আনি
আর অমায়িক প্রজাপতি নিজেকে উৎসর্গ করে
উজ্বল হলুদ আত্মবলিদানে
আমার কঠিন সিলিকন ঢালের ওপরে ।

উদ্বাস্তু মা আর ছেলে
কোনো ম্যাডোনা আর
শিশু ছুঁতে পারবে না
মায়ের কোমলতার ওই ছবিটিকে
একজন ছেলের খাতিরে ওনাকে দ্রুত ভুলে যেতে হবে।
বাতাস দুর্গন্ধে কটু হয়ে উঠেছিল
না-ছোঁচানো শিশুদের আমাশার
যাদের ক্ষয়ে যাওয়া পাঁজর আর শুকনো
পাছা ফুলে ফাঁপা তলপেট নিয়ে 
দাঁড়াতে চেষ্টা করছিল । অনেকেরই
মা বহুকাল যাবত পালন করা বন্ধ
করে দিয়েছে কিন্তু এর নয় । মা
দাঁতের পাটির মাঝখানে ভুতুড়ে 
হাসি ধরে রেখেছিল আর দুই চোখে
এক ভুতুড়ে মায়ের গর্ব যা আঁচড়ে দিচ্ছিল
করোটিতে টিকে থাকা মরচেরঙা চুল
আর তখনই --

দুই চোখে গান নিয়ে -- যত্নে আরম্ভ করল
সিঁথেকাটা...আরেক জীবনে এই কাজ
হতো প্রতিদিনের ঘটনা যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ
নয়, ওর সকালের খাবার আর স্কুলে যাবার 
আগে ; এখন মা

একটা ছোটো কবরে
ফুল রাখার মতন কাজটা করছিলেন ।